বাংলার বাণী
ঢাকা : ৫ই মার্চ, মঙ্গলবার, ১৯৭৪, ২১শে ফাল্গুন, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
দুর্নীতিবাজ যেই হোক—
আবার সেই ভুয়া, দুর্নীতি আর কালোবাজারীর কারচুপি। গতকালকের পত্রিকাগুলোতে এ সব সম্পর্কিত বেশ ক’টি খবর ছাপা হয়েছে। একটি খবরে বলা হয়েছে যে, দেশের ২৮৫টি রেজিষ্ট্রিকৃত সামুদ্রিক মৎস্য শিকার ইউনিটের মধ্যে ৯৯টি ইউনিট সত্যিকারভাবে মাছ শিকারে নিয়োজিত রয়েছে। বাকী ১৮৬টিই কেবলমাত্র কাগজ-কলম এবং সাইনবোর্ড সর্বস্ব। ফিনিশিং ইউনিটের নামে বিদেশ থেকে আমদানী করা বিপুল পরিমাণ নাইলন সূতা, ম্যানিলারোপ, মেরিন ডিজেল ইঞ্জিন, মূল্যবান কাঠ, কোলতার, জিপি শীট, বল্টু, নাট, স্ক্রু ইত্যাদি পণ্যের অবৈধ ব্যবসাই এখন এসব ভুয়া ইউনিটের একমাত্র মূলধন। এই ভুয়া ইউনিটগুলো সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট বিভাগ কর্তৃক সম্প্রতি পরিচালিত এ জরিপে জানা গেছে যে, এদের অনেকেরই সুদীর্ঘকাল যাবত কোনো আমদানী লাইসেন্স পর্যন্ত নেই। অথচ তারা এ যাবতকাল কোটি কোটি টাকা উপার্জন করতে সক্ষম হয়েছে। আবার এই ভুয়া ইউনিটের অধিকাংশগুলোই স্বাধীনতার পরে সৃষ্ট। অন্যদিকে যে ৯৯টি ইউনিট কাজ করছে তার মধ্যে ৮৫টির কোনো যন্ত্রচালিত নৌকাই নেই। কাজেই এদের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হওয়া স্বাভাবিক। এদিকে ভুয়া ইউনিটগুলো আবার বন্যা, বাত্যা ও সামুদ্রিক, জলোচ্ছ্বাসের সময় তাদের বিরাট বিরাট ক্ষয়ক্ষতির হিসাব দেখিয়ে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বিরাট অংকের ক্ষতিপূরণও আদায় করে নিচ্ছে প্রায়ই।
অপর একটি খবরে বলা হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান চট্টগ্রাম জেলার ৭৮টি ভুয়া তাঁত শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং এগুলোর সাথে জড়িত সরকারী কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু এ সকল ভুয়া প্রতিষ্ঠানের মালিক কারা এবং কাদের সুপারিশক্রমে সূতার পারমিট ইস্যু করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় প্রদত্ত তালিকায় সে সম্পর্কে কিছু উল্লেখ নেই। অনেকেই মনে করেন যে, কেবলমাত্র বিসিকের অভিযুক্ত চারজন জুনিয়র সহকারীর রিপোর্টের উপর ভিত্তি করেই লাখ লাখ টাকার লাইসেন্স বা পারমিট ইস্যু করা যেতে পারেনা। বিসিকের ঐ কর্মচারীরা অবশ্যই এর সাথে জড়িত থাকতে পারেন, তবে এর পেছনে রাজনৈতিক প্রভাবশালী ও দুর্নীতিপরায়ণদের যে হাত নেই এ কথাও স্পষ্টভাবে বলা চলে না। ব্ল্যাকলিস্টেড উক্ত ৭৮টি তাঁতশিল্প প্রতিষ্ঠানের ফাইলপত্র তদন্ত করে অবশ্যই এসব অভিযোগ সম্পর্কে অনুসন্ধান চালানো উচিত।
বস্তুতঃ আজ যে ভুয়া ও দুর্নীতি আমাদের গোটা জাতীয় চরিত্রকে গ্রাস করতে উদ্যত গোটা সামাজিক জীবনকে বিপর্যস্ত করতে ক্রুর ভূজঙ্গের মতো থাবা বিস্তার করেছে। একশ্রেণীর আমলা যে এর সাথে সংশ্লিষ্ট সে কথা নিঃসন্দেহে বলা গেলেও আরো একটি কথা বলতে হয় যে, রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহলের অর্বাচীনতা, আভ্যন্তরীণ কোন্দলের পঙ্কে নিমজ্জিতপ্রায় নেতৃত্ব টিকিয়ে রাখার প্রশ্নে স্বজনপ্রীতি এবং সর্বোপরি ‘এমন চান্স আর নাও আসতে পারে’ মনোভাব ও মানসিকতাও কম দায়ী নয়। সেক্ষেত্রে কেবলমাত্র দোষী আমলাদের চাকুরী থেকে বরখাস্ত করেই যেমন সাজা দেয়া ঠিক নয় এবং প্রয়োজন বোধে বিচারের মাধ্যমে দন্ড দেয়াও উচিত, তেমনি এই অর্বাচীন ও র্দুনীতিবাজ প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহলকেও ঘায়েল করার প্রয়োজন রয়েছে বলেও আমরা বিশ্বাস করি।
রোগ-বিশীর্ণ মুমূর্ষুকে বাঁচান বাঁচাতে হবে
গতকাল একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশ যে, প্যাথেড্রিন ও এ্যাবসোলুট এলকোহলের মারাত্মক সংকটের দরুণ নাকি দেশের বৃহত্তম চিকিৎসা কেন্দ্র ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অস্ত্রোপচার ও প্যাথোলজিক্যাল বিভাগ প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে।
অস্ত্রোপচারের জন্যে প্রয়োজনীয় ঔষধ প্যাথেড্রিন শেষ হয়েছে গত শুক্রবার, আর রক্ত পরীক্ষার জন্যে প্রয়োজনীয় একান্ড অপরিহার্য এ্যাবসোলুট এ্যালকোহল তো গত কয়েক মাস ধরেই নেই।
শুধু তাই নয়, কেন্দ্রীয় মেডিকেল স্টোরে দীর্ঘ কয়েক মাস ধরেই নাকি এ্যান্টিভেনোন, গ্লুকোজ সলুশন, টেরামাইসিন এস-এফ ইত্যাদি বিভিন্ন জীবন রক্ষাকারী ঔষধ এবং স্পিরিট, মাল্টি ভিটামিন ট্যাবলেট, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, এ্যান্টাসিডস ইত্যাদি একান্ত প্রয়োজনীয় ঔষধও নেই। এতে কর্তব্যরত চিকিৎসক, নার্স, কম্পাউন্ডার সহ শত শত মরণোন্মুখ রোগীরা প্রতিদিনই ভীষণ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। সংবাদে প্রকাশ যে, কেন্দ্রীয় মেডিকেল স্টোর বা সিএমএস থেকে হাসপাতালে যে সব ঔষধপত্র সরবরাহ করা হয়, তা ন্যূনতম প্রয়োজনের জন্যেও অত্যন্ত অপ্রতুল।
অথচ, এসব একান্ত প্রয়োজনীয় ঔষধের এই মুহূর্তেই যোগান সম্ভব না হলে দেশের বৃহত্তম হাসপাতালের সার্জিক্যাল ও প্যাথোলজিক্যাল বিভাগ অচিরেই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গত শুক্রবার প্যাথেড্রিন নিঃশেষিত হবার পর থেকে ডাক্তারেরা নাকি বাধ্য হয়ে এর বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে মরফিন এ্যাম্পল ব্যবহার করে আসছেন। অথচ, দুনিয়ার এমন কোনো আধুনিক হাসপাতাল নেই, যেখানে মরফিনকে এমন এনালজেসিক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মাসিক প্যাথেড্রিনের প্রয়োজন নাকি ৩০০০ (তিন হাজার) এ্যাম্পল।
বর্তমান বছরে বিভিন্ন ঔষধ সংগ্রহ ও সরবরাহের ব্যাপারে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বাবদ প্রায় ৩২ লাখ টাকা গ্র্যান্ট দেয়া হয়েছিল এবং কথা ছিল সিএমএস হাসপাতালকে তার প্রয়োজনীয় সম্পূর্ণ ওষুধ ইত্যাদি সরবরাহ করবে। কিন্তু, গত ৮ মাসে সিএমএস হাসপাতালকে মাত্র ১৫ (পনেরো) লাখ টাকার ঔষধ সরবরাহ করেছে। এর মধ্যে আবার ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকার ছিল যন্ত্রপাতি সরবরাহ।
অনেকের মতে, ঔষধের এ সংকট বা স্বল্পতা সাধারণতঃ বিপুল সংখ্যক রোগীর উপস্থিতির কারণে হয়ে থাকে। কারণ, দিন দিনই শুধু রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ফলে সিএমএস একটা মোটামুটি আন্দাজ করেও যদি ঔষধ সরবরাহ করে, তবুও ক’দিন যেতে না যেতেই আবার ঔষধের সংকট দেখা দেয়। ফলে, নিত্যনতুন রোগী বৃদ্ধির জন্যে ঔষধ সংকট নাকি কোনোক্রমেই আয়ত্তে আনা সম্ভব হয় না।
হয়তো এ যুক্তির পেছনে সামান্য সত্যতার ভিত্তি থাকতে পারে, তবে একে কোনোক্রমেই একটি যথেষ্ট অজুহাত বলে ধরা চলেনা।
অনেকেরই অভিযোগ, ঔষধও সরবরাহ করে না। ফলে, সবাইকে দারুণ দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রোগী ভর্তি করার যোগ্যতা মাত্র ৯০০ জন, অথচ, হাসপাতালকে বর্তমানে প্রায় ১৮০০ রোগী নিতে হচ্ছে। অর্থাৎ প্রায় দ্বিগুণ রোগীর চাপ বহন করতে হচ্ছে। এরপর আছে বহির্দরোয়াজার রোগী যাদেরও দৈনিক সংখ্যা প্রায় ৫০০০ (পাঁচ হাজার)। দেশের অন্যান্য হাসপাতালেরও তথৈবচ অবস্থা।
ঔষধের প্রয়োজন মেটাতে সরকার স্থানীয়ভাবে ঔষধ কেনাকাটির জন্যে সময়ান্তরে অর্থ বরাদ্দ করেন বটে তবে লাল ফিতার দীর্ঘ পেঁচালো পথ ঘুরে আসতে আসতে এ বরাদ্দ সংশ্লিষ্টের মূলতঃ কোনোই উপকারে আসেনা। যেমন, স্বাস্থ্য দপ্তর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে স্থানীয়ভাবে জীবন রক্ষাকারী ঔষধপত্র কেনাকাটির জন্যে ৫০,০০০ (পঞ্চাশ হাজার) টাকা বরাদ্দ দেয়। কিন্তু দিলে কি হবে, যেকোনো মূল্যবান বা জীবন রক্ষাকারী ঔষধ কিনতে হলে প্রথমেই সিএমএস থেকে ‘পাওয়া যাচ্ছেনা তাই এ ঔষধ কেনা’ এমন একটি সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে হয়। অথচ এ সার্টিফিকেট ঠিক কতদিনে হাতে এসে পৌঁছুবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই ফলে অর্থ মওজুত থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজন মুহূর্তে তাৎক্ষণিকভাবে ঔষধ কিনে রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয়না।
এরপর, হাসপাতালের অসাধু কর্মচারীদের দুর্নীতি তো আছেই। একে হাসপাতালে প্রয়োজনীয় ঔষধ সরবরাহ আসেনা তার উপর যাও আসে, তাও সংঘবদ্ধভাবে অসাধু কর্মচারীরা হয় বেনামে ইস্যু করে খোলা কালোবাজারে পাঠিয়ে দেয়, কিম্বা খুব বেশী দয়া করলে বিপুল অর্থের বিনিময়ে সেগুলো মুমূর্ষু ও সহায় সম্বলহীন রোগীদের কাছে বিক্রি করে দেয়। অথচ, এগুলো হয়তো তাদের বিনামূল্যেই পাবার কথা এবং হয়তো তাদের নামেই ফ্রি ইস্যু বলে দেখানোও হয়েছে। তা’ তারা জানে না।
ক’দিন আগে খবরের কাগজেও বেরিয়েছে যে, জনসাধারণের মধ্যে ন্যায্যমূল্যে বিতরণের জন্যে সরকার যেসব একান্ত প্রয়োজনীয় জীবন রক্ষাকারী ঔষধ সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা ন্যায্যমূল্যের দোকানে বরাদ্দ করেছেন তা’ নাকি এখন কালোবাজারে চলে গেছে। এ সম্পর্কে কর্তৃপক্ষ কতটুকু সজাগ বা এর বিহিত করতে কর্তৃপক্ষ কি ব্যবস্থাই বা নিতে পেরেছেন, তা আমরা এখনো কিছুই জানিনা।
হাসপাতাল ও জীবন রক্ষাকারী ঔষধের ক্ষেত্রে এই দুর্নীতি, টালবাহানা ও গ্যাঁড়া-খাপচার ফলে সাধারণ মানুষের জীবন এখন চরমভাবে নাভিশ্বাস হয়ে উঠেছে।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এদিকে আশু দৃষ্টি দিয়ে ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে এই মুহূর্তেই দেশের রোগ বিশীর্ণ ও মুমূর্ষু মানুষকে জীবনের নিশ্চয়তা দিতে এগিয়ে আসবেন, এটাই আজ সর্বতোভাবে আশা করা যাচ্ছে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক
পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন