বাংলার বাণী
ঢাকা : ২৪শে নভেম্বর, রোববার, ১৯৭৪, ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ
প্রেসিডেন্ট ফোর্ডে’র সফর
জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া হয়ে সবশেষে সোভিয়েত ইউনিয়ন। এশিয়ায় প্রেসিডেন্ট ফোর্ডের এই প্রথম সফর। জাপান এবং কোরিয়ায় প্রেসিডেন্ট ফোর্ডের সফরের উদ্দেশ্য পারস্পরিক সহযোগিতা এবং সম্প্রীতি বৃদ্ধি। ব্লাডিভোস্টক বৈঠক মূলতঃ বিশ্ব শান্তি এবং স্বার্থ কেন্দ্রিক। পূর্বসুরী রিচার্ড নিক্সনের অনুসৃত দাঁতাত চাঙ্গা করে তোলা। অন্ততঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে তেমনি আভাস পাওয়া যায়।
সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রহ কিন্তু দু’দেশের এমনি একটা শীর্ষ বৈঠকের ব্যাপারে সতর্কতার আবরণে ঘেরা। দাঁতাত প্রশ্নে প্রেসিডেন্ট ফোর্ডের মনোভাব সম্পর্কে তারা এখনো নিশ্চিত বলে মনে হয়না। চীন-সোভিয়েত সম্পর্ক নিয়ে সম্প্রতি যে জল্পনা-কল্পনা চলছে তাও ব্লাডিভোস্টক বৈঠককে প্রভাবিত করতে পারে বলে অনেকের ধারণা। এমতাবস্থায় প্রেসিডেন্ট ফোর্ডের সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর বিশ্বশান্তি অথবা দাঁতাতের কতটুকু অগ্রগতি সাধন করবে তা বলা না গেলেও তিনি যে অনর্থক এমন একটা লম্বা সফরের পরিকল্পনা নিয়েছেন তা ভাবা ঠিক হবে না।
গণতান্ত্রিক দেশ জাপানে প্রচন্ড বিক্ষোভের সম্মুখীন হতে হলেও স্বৈরাচারী পার্ক চুং হি’র দক্ষিণ কোরিয়া ফোর্ডকে জানিয়েছে সাদর অভ্যর্থনা। ব্লাডিভোস্টকের কূটনৈতিক উষ্ণতা তার এই সফরের গুরুত্বকে নিশ্চয়ই বাড়িয়ে দেখানোর ব্যাপারে সহায়তা করবে না। এদিক থেকে বিচার করলে মিঃ ফোর্ড যদি পরবর্তী নির্বাচনে বিজয় লাভের স্বপক্ষে স্বীয় ভাবমূর্তি গড়ার ব্যাপারে এই সফরকে ব্যবহার করতে চেয়ে থাকেন তবে তাতেও যে তিনি তেমন সাফল্য অর্জন করতে পেরেছেন এমনটি বলা যায় না। বরং একজন মার্কিন প্রেসিডেন্টের এশীয় রাষ্ট্র সফর যেন নীরবেই সম্পন্ন হতে চলেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই এক রীতি। নির্বাচনের পূর্বে সম্ভাব্য প্রার্থীরা সক্রিয় হয়ে উঠেন আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রশ্নে নিজেদের একটা ভাবমূর্তি গড়ে তুলে অধিকসংখ্যক আমেরিকান ভোটারকে আকর্ষণ করতে। কিউবা সংকটকে কেন্দ্র করে যে নিক্সন একজন উগ্র গোঁয়ার বলে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন দাঁতাত তাকেই আবার শান্তিকামী মানুষের কাছে জনপ্রিয় করে তোলে। এমনকি ওয়াটারগেটের মতো আভ্যন্তরীণ রাজনীতির এমন একটা কেলেংকারীকেও দাঁতাত এর ভাবমূতি বহুদিন চাপা রাখতে সক্ষম হয়। পুনর্বার প্রতিদ্বন্দ্বিতার আশায় ভিয়েতনাম প্রশ্নে অনঢ় নিষ্ঠুরতার প্রতীক লিন্ডন বি জনসনকেও ভিয়েতনামে বোমাবর্ষণ বন্ধের নির্দেশ দিতে বিশ্ববাসী দেখেছে। আর ষাটের সেই ‘উদার গণতন্ত্রী’ কেনেডিকে নিহত হতে হয়েছে স্বদেশীয় গুপ্তঘাতকদের হাতে।
এটাই চলে আসছে। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত না হয়েও আজ যিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্ণদার সেই জেরাল্ড ফোর্ড যদি তার পূর্বসুরীদের অনুকরণে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবার সিদ্ধান্ত নেবার পর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নিজস্ব একটা ভাবমূর্তি গড়ে তোলায় সচেষ্ট হয়ে উঠেন তবে তাকেই বা কি দোষ দেয়া যাবে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত ফোর্ড কি তার ভাবমূর্তি গড়ে তোলার ব্যাপারে কোনো চাঞ্চল্যকর ঘোষণার আশ্রয় নেবেন? তাও অসম্ভব নয়। হাতের কাছে রয়েছে বিস্ফোরণোন্মুখ পশ্চিমা এশিয়া, রয়েছে দাঁতাতহীন ও.এ.এস। কিউবার সাথে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেই জল্পনা-কল্পনা চলছে। প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসেবে খবর ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে নিক্সনের মতো ফোর্ড কিউবা প্রশ্নে অতো ‘স্পর্শকাতর’ নন। এখনো ফোর্ডের হাতে বেশ কিছুটা সময়। তড়িঘড়ি নেই। তাই হয়তো অনেকটা চাঞ্চল্য এবং উত্তেজনাহীন অবস্থায়ই সারছেন তার প্রথম ‘দূরপ্রাচ্য সফর।’
ডাল, মরিচ ও পেঁয়াজ
বাংলাদেশ সরকারের কৃষিমন্ত্রী গত পরশুদিন জাতীয় সংসদের অধিবেশনে ডাল, মরিচ ও পেঁয়াজ উৎপাদানে মোটামুটি দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে জানিয়েছেন। এক প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী আরো জানান যে, ১৯৭৩-৭৪ সালে বিভিন্ন জেলায় দুই লাখ আট হাজার চার শ’ তেইশ টন ডাল, তেতাল্লিশ হাজার চার শ’ পঞ্চাশ টন মরিচ ও এক লাখ ছয়চল্লিশ হাজার পাঁচ শ’ চৌষট্টি টন পেঁয়াজ উৎপন্ন হয়েছে। এ সকল বাজার নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা কৃষি মন্ত্রণালয়ের নেই বলেও তিনি জানান। ডাল, মরিচ ও পেঁয়াজে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও বাজারে এর মূল্য বিশ থেকে পঁচিশ গুণ বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে অন্য এক সম্পূরক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে মন্ত্রী বলেন, বন্যার পরিপ্রেক্ষিতে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সে জন্যই মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। জাতীয় সংসদে কৃষিমন্ত্রীর উল্লেখিত এ তথ্য নিঃসন্দেহে দেশের কৌতুহলী মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকবে। কৃষিজাত কিছু কিছু দ্রব্যের উৎপাদনে আমাদের দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে। দেশে বর্তমানে নিদারুণ দ্রব্যমূল্যজনিত সংকট চলছে। প্রায় দু’বছর হতে চললো প্রতিটি জিনিসের দাম ক্রমাগত বাড়ছেই। এর মাঝে দেশে বন্যা এবং বন্যার অব্যবহিত পরে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। বর্তমানেও দেশে দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছে। প্রতিদিন আজো মানুষ অনাহারে মৃত্যুবরণ করছে। বিভিন্ন প্রকার রোগ মহামারী আকার ধারণ করছে। সরকার তার সাধ্যমতো চেষ্টা চালাচ্ছেন—এ সকল প্রতিকূল অবস্থার মোকাবেলার জন্য। তবু সমস্যা এতোই বিরাট এবং ব্যাপক যে, কর্তৃপক্ষও আজ অনেকটা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। আমাদের দেশের কৃষিজাত দ্রব্যের মধ্যে এমন কতকগুলো বিষয় ছিল যা কিনা চাহিদা পূরণে সক্ষম। কৃষি ব্যবস্থায় যদি আধুনিক পদ্ধতি আরোপ করা যায় এবং একটি সুদূর পরিকল্পনা নিয়ে গোটা কৃষিজাতকে কারিগরি ও বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে পুনর্গঠিত করা হয় তাহলে খাদ্য সহ কৃষিজাত অনেক দ্রব্যের বেলায়ই আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারি। কিন্তু কৃষি ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাসের জন্য কর্তৃপক্ষ ব্যাপক কোনো বাস্তব কর্মসূচী নিয়েছেন বলে আজো জানা যায়নি। কিছু গভীর নলকূপ স্থাপন করে এলাকা বিশেষে নতুন ধান উৎপাদনের কর্মসূচী ছাড়া আজ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ তেমন উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। কৃষিমন্ত্রী সাহেব জাতীয় সংসদে ডাল, মরিচ ও পেঁয়াজ উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণত বলে যে অভিমত ব্যক্ত করেছেন তা সত্য বটে, তবে বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে উক্তিটি অত্যন্ত বেমানান। দেশের সব অঞ্চলেই ঐ তিনটি দ্রব্য উৎপন্ন হয়। যে সকল জেলায় এবার বন্যা হয়েছে এবং তার দরুণ পেঁয়াজ, মরিচ ও ডাল উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে সে সকল জেলা ছাড়া দেশের বৃহত্তর অংশেও ঐ দ্রব্য তিনটির বর্তমান বাজার মূল্য কোনো অংশে কম নয়। তাছাড়া এক জেলা থেকে অন্য জেলায় এই সকল দ্রব্য বিরাট পরিমাণে পাচার হচ্ছে বলেও জানা যায়নি। দেশের সাধারণ মানুষের কাছে যেটা চরম সত্য বলে আজ প্রতিষ্ঠিত তাহলো কাঁচামরিচ আটচল্লিশ টাকা সের, শুকনা প্রায় এক শত টাকা, পেঁয়াজ বারো টাকা, ডাল ছয় টাকা থেকে আট টাকা। অথচ এদেশের মানুষ এতোকাল বারো আনা থেকে এক টাকা সের কাঁচা মরিচ কিনেছে, এক টাকা থেকে দু’টাকা সের ডাল কিনেছে এবং চার আনা থেকে আট আনা সের পেঁয়াজ কিনেছে। আজ তাই স্বয়ংসম্পূর্ণতার দাবী করার সময় দেশের সাধারণ মানুষগুলোর হৃদয়ে বড় অনুশোচনা জাগে। তবু কর্তৃপক্ষের তথ্যের উপর নির্ভর করেই দেশ পরিচালিত হয়, বিদেশীরাও সেই দৃষ্টিকোণে আমাদেরকে বিচার করে থাকে। আমরা বিশ্বাস করি, কর্তৃপক্ষ যদি ব্যাপক পরিকল্পনা নিয়ে দেশের কৃষি ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করেন এবং কারিগরি বা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি কৃষি ব্যবস্থায় আরোপ করেন শুধু ডাল-পেঁয়াজ এবং মরিচই নয় আরো অনেক কৃষিজাত দ্রব্যতেই আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারবো।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক