You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.06.04 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | পেটের দাবী বড় নির্মম | গরিব ঘরের শিশু গরীবিরই উত্তরাধিকারী | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: ৪ঠা জুন, সোমবার, ২০শে জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮১

পেটের দাবী বড় নির্মম

ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্যের গলা ধরে এবার রেশনের চাল গমের দামও একটা উচ্চ লাফ দিয়েছে। মণপ্রতি চাল ও গমের দাম বেড়েছে ২০ টাকা, তেলের দাম সের প্রতি দু’টাকা। পূর্ববর্তী দাম ছিল- চাল ৪০ টাকা, গম প্রতি মণ ৫০ টাকা, ভোজ্য তেল ৬ টাকা সের। এবারকার ধার্যকৃত দাম হল-চাল প্রতি মণ ৬০ টাকা, প্রতি মণ গম ৫০ টাকা আর তেল প্রতি সের ৮ টাকা। আকস্মিকভাবেই মূল্যবৃদ্ধির পক্ষে সরকারের তরফ থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে চাল ও গমের দাম অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আরও বলা হয় আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার ফলে সরকারের ভর্তুকির পরিমাণ বেড়ে যায়। ফলে রেশনের চাল ও গমের দাম বাড়াতে হয়।
প্রশ্ন হচ্ছে সরকারি যুক্তি হয়তো তাদের জন্য ঠিকই আছে। কিন্তু দেশে সীমিত আয়ের ব্যক্তিদের হয়েছে মরণ। রেশনের চাল গম ও তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে তাদের অতিকষ্টে ছকে ফেলা পারিবারিক বাজেটটাও অকেজো হয়ে গেছে। বাজেটে শুধুমাত্র রেশনের খরচই শতকরা ৫০ থেকে ৬০ ভাগ বেড়ে গেছে। এই বাড়তি অর্থ তারা কোথায় পাবেন সে কথা ভেবে দিশেহারা জনগণ এখন উদভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন।
স্বাধীনতার পর থেকেই নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদি সহ সবরকম খাদ্যশস্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকে। কোন কোন জিনিসের দাম শতকরা তিন থেকে ছয়শ গুণ বেড়েছে। এর ওপর আছে দ্রব্যাদির দুষ্প্রাপ্যতা এবং ভেজালের অসহ্য উৎপাত। সবটাই মিলে জীবনযন্ত্রণার ক্রমবর্ধিষ্ণু ক্লেসে সাধারণ মানুষ হতাশার সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়েই চলেছে।
নাগরিক জীবনে এবং শহরের জীবনের রেশনের চাল, গম, তেল তবু একটু স্বস্তি দেয়। পুরো সপ্তাহ না গেলেও কটা দিন নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। কিন্তু সরকারি ভাবে যখনই কোন জিনিসের দাম বাড়ানো হয় তখন খোলাবাজারেও শুরু হয় মূল্যবৃদ্ধির লীলা। ফলে বাকি দিনের জন্য যে সীমিত আয়ের লোকেরা খোলাবাজার থেকে চাল তেল কিনে সাপ্তাহিক ঘাটতি পূরণ করবেন তার সাধ্যও তাদের নেই।
এই মাত্র কয়েক মাস আগেই একদফায় চালের মণ ৩০ টাকা থেকে ৪০ টাকা করা হয়েছিল। আবার কয় মাস পরে ৪০ টাকা থেকে ৬০ টাকা করতে হলো। সরকারি যুক্তি ও অসুবিধা ভরতুকির বর্ধিত পরিমাণ সবই মেনে নিলেও বলা যায় এই হারে সরকারিভাবে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বাড়লে তা কি দেশি অর্থনৈতিক অস্থিতাবস্থাকে বাড়িয়ে তুলবে না?
এহেন অবস্থায় আয় ও ব্যয় সামঞ্জস্য বজায় রাখা সাধারণের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না। অথচ বাঁচতে হবে কাজ, করতে হবে এবং জীবনযাত্রা নির্বাহ করতে হবে। যদিও শহরে জীবনে বা নাগরিক জীবনে রেশনের আশীর্বাদ কিছুটা আছে তবে সেই সঙ্গে বাড়িভাড়ার ভয়ঙ্কর একটা ব্যাপার আছে। একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, বর্তমান সীমিত আয়ের লোকদের পক্ষে চরম বাড়ি ভাড়া দিয়ে বর্ধিত মূল্যের রেশন খাওয়ার সঙ্গিতও নিঃশেষ। চারিদিক প্রায় অন্ধকার।
কিছু করা বা না করাটা হয়ত সরকারি পর্যায়ের সংগতি ও ব্যবস্থাপনার প্রশ্ন। কিন্তু এই হলো জনগণের অবস্থা। আর চাল গমের দামের সঙ্গে সঙ্গে অন্য দ্রব্যাদির আপেক্ষিকতা বজায় রেখে বাড়ে। তাই বর্তমান ধার্যকৃত রেশনের বর্ধিত মূল্য অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রভাব বিস্তার করতে পারে বলে বিশেষ মহলের আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমানে দেশে যৌথ অভিযান চলছে। সেই দিক চেয়েই আমরা আবেদন জানাচ্ছি-দ্রব্যমূল্যের ড্রাগণকে যেন অন্য সকল দিক থেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়।
আমরা জানি শূন্যের আধার এ দেশ। এদেশের মাটির স্তরে স্তরে ফসলের সম্ভাবনা ঘুমিয়ে আছে। তারই জন্যে সবুজ বিপ্লব অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। কিন্তু পেট তো আর কোনো কথা বা পরিকল্পনার ছক দেখে ভরবে না। দেশের সাধারণ লোকের জন্য চাই পেটের আহাদের নিশ্চয়তা। অতএব সেইদিকে খেয়াল রেখে অতি দ্রুত সক্রিয় চিন্তার বিন্যাস দেখাতে হবে। সাধারণ লোক স্বাধীনতার স্বাদ পেতে চায়-মরতে চায় না। আশাবাদী হিসেবেই এ তাদের মৌলিক দাবি। সুতরাং এই দাবিকে স্মরণ রেখে তাদের বাঁচার বিকল্প পথ এর পরিকল্পনাও আজ সরকারকে একযোগে নিতে হবে বৈকি। কারণ পেটের দাবি বড় নির্মম।

গরিব ঘরের শিশু গরীবিরই উত্তরাধিকারী

দরিদ্রের সুতীব্র কষাগাতে জর্জরিত পরিবারের যে শিশু দুঃসহ বোঝা বয়ে আনে সে শিশুর খবর কে রাখে? কে নেয় সে শিশুর পরিচর্যা ভার, তার ভবিষ্যত গড়ে তোলার দায়িত্ব। গরীবের ঘরে শিশু গরিবীর উত্তরাধিকারীই হয়ে আসে, ভবিষ্যৎ তার অনেকটা নির্ধারিত। আজীবন সংগ্রাম করে ধুঁকে ধুঁকে মরা অথবা আঁতুড়ঘরেই একদিন প্রান স্পন্দনহীন অবস্থায় পরে থাকা। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় এই তার লিপি আবর্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে কজন?
সারা দুনিয়ার এমনই লক্ষ কোটি শিশুর অনাদর আর অবহেলার মুখে প্রতি বছর পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব শিশু দিবস। এবারের দিবস পালিত হয়েছে গত পরশু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে এই দিবস পালন উপলক্ষে আয়োজিত এক সেমিনারে ভাষণ দিতে গিয়ে শিক্ষামন্ত্রী জনাব ইউসুফ আলী বলেছেন “সমাজতান্ত্রিক দেশে শুধু উপরতলার মানুষের ছেলেদের মানুষ করলেই প্রকৃত উন্নতি আসবে না। গ্রামের কুটির বস্তি ও রাস্তার ফুটপাতে যেসব শিশু ভাগ্রহতের মতো দিন কাটাচ্ছে তাদের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তাদের অধিকার দান করা সমাজের কর্তব্য।”
মন্ত্রীমহোদয় সমাজতান্ত্রিক দেশের কথা বলেছেন। সে সকল দেশে শিশুদের গড়ে তোলা হয় ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব উপযোগী করে। এর জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা পরিবেশ এবং পরিস্থিতির সৃষ্টি করার দায়িত্ব বহন করে সরকার। এ থেকে বিচ্যুত হবার অবকাশ নেই। আমাদের দেশ সমাজতান্ত্রিক বলা ঠিক হবে না তবে আমরা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারবদ্ধ। সংবিধানেও তেমনি লেখা রয়েছে এবং গত আটাশ মাসে নীতিগতভাবে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। বিত্তশালী ভাগ্যবানদের অবস্থান সম্বন্ধে সচেতন থেকেই শিক্ষামন্ত্রী শিশুদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য আহবান জানিয়েছেন সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগের প্রতি। এই যৌথ উদ্যোগে শিশুদের সম্ভাবনাময় জীবনের বিকাশ সাধন সম্ভব বলে বিশ্ব শিশু দিবস পালনের মতো এমনই নানা আহ্বান জানানো আজকাল রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। অন্ততঃ এই একটি দিন শিশুদের নিয়ে নানা চিন্তা চেতনার উদ্রেক হয় বক্তারা বক্তৃতা দিয়ে বাহবা কুরান, কিন্তু অনাদরে-অবহেলায় লালিত হওয়ার শিশুদের যে অবস্থা সেই। এক বছরে তারা আরো কৃশকায় হয়ে পড়ে, আবারো ‘দিবস’ আসে, আবারো সেই আলোচনা অনুষ্ঠান। বাংলাদেশ অবশ্য এটি একটি রেওয়াজ হয়ে দাঁড়াবে-এমনটি আমরা আশা করি না। শিক্ষামন্ত্রী আহবানে সাড়া দিয়ে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে, শিশুদের নিরাপত্তা, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দিয়ে বাস্তব কর্মপন্থা গৃহীত হবে-এটাই জনগণের আশা।
কিন্তু তা কি সম্ভব দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন না এনে! শিশুদের সমস্যা কি আট-দশটি অর্থনৈতিক সমস্যা থেকে বিচ্ছিন্ন? শিশুর পারিবারিক অসচ্ছলতায় কি তাকে অন্ধকারময় ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিতে মূল ভূমিকা পালন করে না? শিক্ষামন্ত্রীকে উপরতলার শিশুদের কথা বলেছেন, তাদের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব উপযোগী করে গড়ে তোলার পথে যে অন্তরায়সমূহ রয়েছে তা হয়তো প্রগতিশীল শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নের মাধ্যমে অনেকটা সফল করে তোলা যায়, কিন্তু সেই শিশু যে পথে বস্তিতে ঘুরে বেড়ায়, মুখ থেকে দুর্গন্ধ না যেতেই যাকে জীবিকার অন্বেষণে ছুটে বেড়াতে হয় তাদের ব্যাপারে কি ব্যবস্থা নেয়া হবে? শিশুদের সমস্যা কি তাই অন্যান্য সমস্যার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পৃক্ত নয়? বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আজ তাই প্রথমে সমাজের সার্বিক মুক্তির কর্মপন্থা গ্রহণ করতে হবে। ক’জন ভাগ্যবান বিত্তশালীর ওপর অথবা সরকারি কোন প্রতিষ্ঠান লালিত হওয়া ক’টা শিশুর পরিচর্যা ওপর লক্ষকোটি ভাগ্যাহত শিশুর ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবেনা।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: <b>Alert:</b> Due to Copyright Issues the Content is protected !!