বাংলা হরফ ও বাংলা ভাষা
পাকিস্তান শিক্ষা উপদেষ্টা বাের্ডের ও বর্ণমালার বিবেচনার বিশেষজ্ঞ কমিটির নির্বাচন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের ছাত্র ছাত্রীদের স্মারক লিপি। নিশ্চিত সিদ্ধান্ত নিন : আমরা মনে করিতেছি যে, আরবি হরফ প্রণয়ন প্রচেষ্টার দ্বারা পৃথিবীর ৬ষ্ঠ স্থানাধিকারী বিপুল ঐশ্বর্যময়ী ও আমাদের জাতীয় জীবনের গৌরবের ঐতিহ্যবাহী বাংলা ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতির উপর হামলা করা হইতেছে। পাকিস্তানের জাতীয়তার ভিত্তিকে দৃঢ় করিতে জাতীয় সাংস্কৃতিকে অগ্রগামী করিতে এবং দুনিয়ার অন্যান্য জাতির সহিত আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রতিযােগিতায় ইহাকে আত্মনির্ভরশীল ও এবং বর্তমানে এই মৃতকল্প ভাষাগুলি উর্দু হরফেই লিখিতে হইতেছে। কাজেই হরফ পরিবর্তনের আঘাত পাকিস্তানের সর্ব প্রধান এবং অধিক সংখকে লােকের ভাষা বাংলার উপরই পড়িবে। অনভিজ্ঞ এবং মূর্খ লােকেই শুধু বলিতে পারে হরফ পরিবর্তনে ভাষার কোনাে ক্ষতি বৃদ্ধি নেই।
ঐক্যের অজুহাত
পাকিস্তানের প্রদেশগুলাের এবং মুসলিম দেশগুলাের সাংস্কৃতিক ঐক্যের অজুহাত হরফ পরিবর্তনের প্রধান যুক্তি। কিন্তু সাংস্কৃতিক ঐক্যের উপায় কি হরফ? ইহা যাহারা বলে, হয় তাহারা কিছু বুঝে না, না হয় লােককে ভুল বুঝাইবার চেষ্টা করে :
(১) আরবি হরফকে বাংলা ধ্বনিতত্ত্বের অনুযায়ী গড়িয়া তুলিতে তাহাতে অনেকগুলাে নতুন হরফের দরকার হইবে, তাহাতে বাংলা বুঝিবার জন্য আরবি হরফ জ্ঞানই যথেষ্ট হইবে না। উর্দুতে যেমন পেটে প্রভৃতি আরও সাতটি নতুন অক্ষর না শিখলে শুধু আরবি হরফ জ্ঞান দিয়ে ভাষা শেখা শুনিশ্চিত নয়।
০ বাংলা হরফ অধিকতর বৈজ্ঞানিক।
০ লিখা ও পড়ার বাংলা হরফ অধিকতর দ্রুতগামী
০ বাংলা হরফ বাংলা ধ্বনিতত্ত্বের অনুগামী।
০ হরফ পাল্টানাে মানেই বাংলা ভাষার উপর হামলা
০ হরফ ঐক্যের উপায় নহে।।
০ হরফ পরিবর্তন করা চলিবে না।
উর্দু পড়ার সহায়তা করে না, বাংলার এই অতিরিক্ত হরফের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাইবে। এই অতিরিক্ত হরফগুলাে শিখিতে যে অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের দরকার হইবে, তাহাতে বাংলা হরফই শিখিয়া লওয়া যায়।
(২) হরফ শিক্ষা কোনাে ভাষার ভাব সম্পদের সহিত পরিচিত করিতে পারে। কোনাে ইংরেজি জানা লােক কি রােমান হরফ জানার বদৌলতে ফরাসি, ইতালিয় বা স্পেনিয় প্রভৃতি রােমান হরফে লিখা ভাষা বুঝিতে পারে? গভীর আন্তরিকতা ও কঠোর অধ্যবসায়ের সহিত সতর্ক মনে উহা শিক্ষার সাধনা করিতে হয়। আরবি জানা থাকা সত্ত্বেও ও কয়জন সিন্ধী পশতু প্রভৃতির প্রতি আকৃষ্ট হন? কাজেই ঐক্যের অজুহাত একটি ধাপ্পা মাত্র।
ঐক্যের উপায় হরফ নহে
রাজনৈতিক ভূঁইফোঁড় বা সাংস্কৃতিক দল হরফকে ঐক্যের উপায় মনে করিতে পারে, কিন্তু সাংস্কৃতিক ঐক্যের উপায় পারস্পরিক সংস্কৃতির প্রতি দরদ। পাকিস্তানের সংস্কৃতির যদি সৰ্বাঙ্গীন বিকাশ এবং পরিপূর্ণ উৎকর্ষ লাভ করে তাহা হইলেই মাত্র অন্যান্য মুসলিম দেশগুলাের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিয়া সাংস্কৃতিক ঐক্যের পথ পরিষ্কার করিতে পারে। পাকিস্তানের প্রতিটি অঞ্চল, প্রতিটি শহর গ্রাম যদি পরিপূর্ণভাবে আত্মপ্রকাশ করিতে পারে তবেই পাকিস্তানের সুস্থ সবল সর্বাত্মকসংস্কৃতি গড়িয়া উঠিতে পারে। কিন্তু অবাঞ্ছনীয় জেদ এবং ক্ষুদ্র স্বার্থের বশবর্তী হইয়া যদি পাকবাংলার আত্ম সংস্কৃতির উৎকর্ষের পথ বন্ধ করা হয়। তাহা হইলে পাকিস্তানের সামগ্রিক সংস্কৃতিকেই আঘাত করা হইবে, মুসলিম জাহানের ঐক্যের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা ধরা হইবে।
হরফ কি আরবি থাকিবে
শিক্ষা উপদেষ্টা বাের্ড বাংলার জন্য আরবি হরফের সুপারেশ করিয়া ধর্মপ্রাণ লােককে ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করিতেছেন। বাংলা ধ্বনিতত্ত্বের অনুযায়ী করিয়া গড়িয়া তুলিলে আরবি হরফ এক নূতন বর্ণমালায় পরিণত হইবে, আরবি বর্ণমালা বলিয়া যতই লােকের সরল বিশ্বাসের সুযােগ গ্রহণ করিতে চান না কেন উহা খাটি বর্ণমালা থাকিবে না। এবং শিক্ষা উপদেষ্টা বাের্ডের মনে যদি এমন দূরভিসন্ধি থাকিয়াও থাকে যে এই সুযােগ বাংলা ভাষাকে একেবারে বানচাল করিয়া দেওয়া হইবে তাহা হইলেও খাটি হরফের জন্য কোনাে সুস্থ বুদ্ধির লােক ভাষাকে বিকলাঙ্গ করিতে রাজি হইবে না।
বাংলা হরফ বাংলা ধ্বনিস্তরের অনুগামী
আমরা প্রাত্যহিক ব্যবহারে যে ধ্বনির সহিত পরিচিত একমাত্র বাংলা হরফেই তা প্রকাশিত করিতে পারে, অন্য কোনাে হরফ নহে। তবুও যদি রাজনৈতিক কুবুদ্ধিচালিত হইয়া বাংলা আরবি হরফে লিখিতে হয় তাহা হইলে বহু সংখ্যক নতুন হরফে তৈয়ার করিতে হইবে। বাংলা খ, খ, থ, ধ প্রভৃতি মহাপ্রাণ ধ্বনি ট, ঠ, ড, ঢ প্রভৃতি মূর্ধণ্য ধ্বনি, ফ, ফ, ভ ওষ্ঠ্য ধ্বনি, ঙ, ঞ, প্রভৃতি নাসিক্য ধ্বনি চ, ছ, ঝ সৃষ্ট ব্যঞ্জন ড়, ঢ় কম্পিত ধ্বনি এবং ও, ঐ, ও, ঔ স্বরবর্ণ আরবী বর্ণমালায় নাই। এই হরফগুলাের জন্য নতুন প্রতীক গৃহীত হইলে লাভের মধ্যে লাভ এই হবে যে। শুধু মাত্র আরবী হরফ জানা বাংলা পড়ায় জন্যে লাগাবে না কিন্তু পাকবাংলার শিক্ষিত লােকের শক্তির অপচয় ঘটিবে।
বাংলা হরফ ও বাংলা ভাষা
বাংলার জন্য নতুন প্রতীক গৃহীত হইলে লাভের মধ্যে লাভ এই হইবে যে শুধু মাত্র আরবি হরফ-জ্ঞান বাংলা পড়ায় কাজে লাগিবে না। কিন্তু পাকবাংলার শিক্ষিত লােকের শক্তির অপচয় ঘটিবে।
আরবি হরফের প্রকৃতি
বাংলা হরফ ধ্বনিপ্রধান আরবি হরফ ব্যাকরণানুগত, ব্যাকরণানুগ হরফ মাত্রেই প্রকৃতিগত অবৈজ্ঞানিকতা সুস্পষ্ট। ভাষার ব্যাকরণ জানা না থাকিলে আরবি হরফে লেখা পড়িতে পারা যায় না, ইয়াব (স্বরচিহ্ন) দিলে প্রাথমিক অসুবিধা দূর হয় বটে, কিন্তু বর্তমান জগতের দ্রুত গতির সহিত তাহাতে তাল রাখা অসম্ভব। এই অসুবিধা বাংলা হরফে নাই। ভাষা জানা থাকা আর না থাক হরফ মনে থাকিলেই পড়িতে বেগ পাইতে হয় না। আরবি (আলেফ, মীম, ইয়া) শব্দের অসি, আসি উসি, ইসি প্রভৃতি যে কোনাে উচ্চারণ হইতে পারে। বাংলা উচ্চারণে এই অনিশ্চয়তা নাই। (সৈনিক ৯ বৈশাখ শুক্রবার)
আরবি হরফ দ্রুত পঠন ও লিখনের কি উপযােগী
যুগপােযােগী দ্রুততার সহিত তাল রাখিতে দ্রুত পঠন ও লিখন উপযােগী হরফের প্রয়ােজন, আরবি হরফে কি দ্রুত লিখা ও পাঠ করা যায় কিনা বিবেচনা করিয়া দেখা দরকার। আরবি হরফে লিখা পড়িতে বাংলা হরফের প্রায় দ্বিগুণ সময় লাগে। লেখার ব্যাপারে আরবির চেয়ে বাংলা সুবিধা বেশি। বাংলা হরফের প্রায় দেড়গুণ সময়ে আরবি হরফে লিখা হয়। আধুনিক কোনাে শ্ৰেষ্ঠতা কামী উন্নতিশীল রাষ্ট্র সময়ের এই অপব্যবহার স্বীকার করিতে পারে না। আরবি হরফ বর্জনের ব্যাপারে তুরস্ক ও ইন্দোনেশিয়া প্রকৃত দৃষ্টান্ত।
বৈজ্ঞানিক আবিক্রিয়ায় অসুবিধা
উন্নতকামী রাষ্ট্র মাত্রকেই আধুনিক বৈজ্ঞানিক আবিস্ক্রিয়ার সুযােগ গ্রহণ করিতে হইবে। নূতন হরফ প্রবর্তনের পূর্বে প্রচলিত হরফ হইতে উহা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সহিত অধিক উপযােগী কিনা পূর্বাহ্নে তাহা সতর্কতার সহিত বিবেচনা করিয়া দেখা দরকার। আরবি হরফ বিভিন্ন অবস্থানের বিভিন্ন হরফ ধারণ করে।
* The language problem of To-day’ – by, Md. Fordouse Khan M. SC B,T, M. A in Education (London)। তাই আরবি হরফের বিভিন্নতার সংখ্যা যত বাড়িয়া যায়, বাংলা যুক্তব্যঞ্জনকে কোনােভাবে সরল না করিয়া শুধুমাত্র সাদৃশীভূত করিয়া লইলেই বাংলা হরফ সংখ্যা তাহা হইতে কম হয়। এইভাবে বাংলা প্রতীকের সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৫টি, উর্দু হরফের সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৭টি, সামান্য মাত্র সংস্কারেই বাংলা হরফ টাইপ, লিনােটাইপ, টেলিগ্রাম প্রভৃতি আধুনিক আবিষ্কারের উপযােগী হইয়া উঠিতে পারে, কিন্তু আরবী হরফে এই সম্ভাবনা নাই। বাংলা স্বরচিহ্নের বিভিন্নতার দরুণ বাংলা হরফ টাইপ রাইটার প্রভৃতির উপযােগী নহে যাঁহারা বলেন তাঁহারা অজ্ঞতারই পরিচয় দেন। বাংলা যতিচিহ্নগুলাে খুব জটিল নহে এবং তাহাতে বাংলা হরফের সংখ্যা অতি অল্পই বাড়ে। এবং টাইপ রাইটার প্রভৃতিতে ব্যবহারের জন্য অতি অল্প সংস্কারই প্রয়ােজন। কিন্তু আরবি ইরাবি (স্বরচিহ্ন) সম্বন্ধে তাহা বলা যায় না। ইরাবি না দিলে পড়া অসম্ভব। আবার ইরাবি দিলে দ্রুত লিখা বা ছাপা অসম্ভব। বাংলার ব্যাপারে আরবী হরফের মােহ একেবারেই ত্যাগ না করিলে এই অসুবিধার হাত হইতে রেহাই পাওয়ার উপায় নাই।
নতুন শিক্ষার্থীর সুবিধা অসুবিধা
আদিতে, মধ্যে, অন্তে অবস্থিতির জন্য আরবি হরফ নানা রূপ গ্রহণ করে। প্রথম শিক্ষার্থীর কাছে এই রূপভেদ বাংলা হরফ হইতে অনেক বেশি জটিল। তদুপরি বাংলা ধ্বনিতত্ত্বের অনুগামী করিয়া তুলিলে যে বহু সখকে একান্ত অপরিচিত চিহ্ন আসিবে। তাহাতে আরবি হরফ শিক্ষার বর্তমান যে সুবিধা আছে তাহাও দৃর হইবে, জটিলতা বহু গুণ বৃদ্ধি পাইবে, ইহার উপর পড়িবার জন্য ব্যাকরণের সাহায্য লইতে হয় বলিয়া আরবি হরফকে আয়ত্তে আনা এক প্রশান্ত ব্যাপার। অপ্রয়ােজনীয় বৰ্ণত্যাগ, যুক্ত স্বর-ব্যঞ্জনের সাদৃশ্যকরণ এবং যুক্তব্যঞ্জনের যৎসামান্য সংস্কার করিয়া লইলে বাংলা হরফ বহু সরল ও শিক্ষার্থীর পক্ষে সহজ হইয়া পড়িবে।
নতুন হরফ শিক্ষা ও জ্ঞান বিস্তারের অন্তরায়
পাক বাংলার শতকরা ১৫ জন অশিক্ষিত লােকের মধ্যে দ্রুত শিক্ষা বিস্তারের প্রয়ােজন। বহু সংখ্যক শিক্ষিত লােককে এই কার্যের জন্য অগ্রসর হইতে হইবে। কিন্তু বাংলা হরফ পরিবর্তনের মধ্য দিয়া পাক বাংলার শিক্ষিত সমাজকে অশিক্ষিতের শ্রেণীতে পরিণত করার চক্রান্ত সফল হইলে কে তাহাদিগকে শিক্ষা দান করিবে? এ পর্যন্ত যে লক্ষ লক্ষ পুস্তক বাংলা ভাষায় ছাপা হইয়াছে, কে কবে সে গুলিকে আরবি হরফে রূপান্তরিত করিবে? হরফ পরিবর্তনের পশ্চাতে আছে শিক্ষা বিস্তারকে ব্যাহত করিবার ঘৃণা চক্রান্ত।
সংস্কৃতির সংকট
হরফ পরিবর্তনের মধ্য দিয়া পাকবাংলার শিক্ষিত সমাজের উপর ও ঘৃণিত আঘাত নামিয়া আসিতেছে। হরফ পরিবর্তনের বিশৃঙ্খলার মধ্যে দিশাহারা শিক্ষিত সমাজ সৃষ্টির অনুপ্রেরণাকে স্থায়ীরূপ দান করিতে পারিবে না। আজাদির মধ্য দিয়ে লব্ধ পাক বাংলার নতুন জীবন চেতনাকে যদি হরফ পরিবর্তনের অছিলায় ব্যর্থ সাংস্কৃতিক জীবনের অপূরণীয় ক্ষতি হইবে। আঞ্চলিক প্রভুত্ব লাভের দুরাকাঙ্ক্ষা এমনিভাবে পাকিস্তানের শত্রুতা করিতে যাইতেছে। পাকবাংলার মনে নূতন পরাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে কায়েম করিয়া তুলিতেছে।
মােট কথা
সংস্কারমুক্ত মন লইয়া মুক্তির আলােকে বিচার করিয়া দেখা যায়:
১. বাংলাকে আরবি হরফে লিখিতে হইলে নতুন যে প্রতীকগুলাে গ্রহণ করিতে
হইবে তাহাকে শিখিবার জন্য একজন আরবি জানা লােকের যে পরিমাণ শ্রমও অধ্যবসায়ের প্রয়ােজন। তাহা অপেক্ষা অনেক কম শ্রম বাংলা হরফ শিক্ষা করা সম্ভব।
২. কাজেই কোরান তেলাওয়াতের জন্য আরবি হরফ শিখিতে হয় বলিয়া আরবি | হরফে বাংলা লিখিত হইলে লােকের শ্রম লাঘব হইবে তাহা বলা চলে না।
৩. লিখন পঠনের আরবি হরফ বাংলা হরফ হইতে অধিক সময় লয়।
৪. বাংলা হরফের অমি সহজে টাইপ লিনােটাইপ প্রভৃতির উপযােগী করিয়া
লওয়া যাইতে পারে। আরবি হরফে তাহা অসম্ভব।
৫. নতুন শিক্ষার্থীর পক্ষে আরবি হরফ (বাংলা ধ্বনিতত্ত্বের অনুযায়ী)। শিক্ষা | অপেক্ষা বাংলা হরফ শিক্ষা সহজ।
৬. হরফ পরিবর্তনের ভিতর শিক্ষার দ্রুত প্রসার ব্যবহত হইবে।
৭. পাক বাংলার শিক্ষিত লােকের উপর যে আঘাত আসিবে, তাহাতে সারা পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক সৃষ্টি পুষ্টি অবাঞ্ছনীয় ভাবে ব্যাহত হইবে।
৮. বাংলা ভাষার সর্বাঙ্গীন পরিপুষ্ট ও উন্নত বানানভঙ্গীর সহিত হরফ পরিবর্তনের মধ্য দিয়া বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িলে পাক বাংলার ভাষা সাহিত্য বিজ্ঞান প্রভৃতির গভীর ভাব প্রকাশের অনুপােযােগী হইয়া পড়িবে।
৯. বাংলাকে আরবি হরফে লিখিলেই উহার সহিত আরবি হরফ জানা লােকের
পরিচয় স্থাপিত হইবে না।
আমাদের দাবি
এ সকল বিবেচনা করিয়া, পাকিস্তানকে সম্পর্কে ও সংস্কৃতিতে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র হিসেবে দেখিতে চাই বলিয়া।
উর্দু হরফ গ্রহণের বিরুদ্ধে মজলিশের প্রতিবাদ সভা ভাষা কমিটির পুনর্গঠনের দাবি: সাহিত্যিক সমাজ ও সংবাদপত্রের প্রতি আন্দোলনের আহবান।
ঢাকা ১০ই ডিসেম্বর। গতকল্য বিকালে পাকিস্তানের তমদুন মজলিশের ভাষাকে উর্দু হরফে লিখিয়া, হিন্দুভাষা বাংলাকে বিতাড়িত করিয়া ও আমাদিগকে উর্দু শিখাইয়া, সমগ্রভাবে পূর্ববংগের মুসলমানকে নূতন করিয়া মুসলমান করিবার জন্য এবার তিনি কোমর বাঁধিয়া লাগিয়াছেন; একটা জাতিকে মুসলমান করার ‘আজিমুশশান নেকি ‘এবার তিনি হাসিল না করিয়া ছাড়িবেন না বলিয়া মনে হইতেছে। একদিকে কর্জে হাসানা সন্ধন্ধে নীরবতা, অন্য দিকে পূর্ববংগের বিভিন্ন শহরে উর্দু স্কুল প্রতিষ্ঠার তােড়জোড় উর্দু হরফে বাংলার এক্সপেরিমেন্টের জন্য হাজার হাজার টাকার মঞ্জুরী পূর্ববংগের জনসাধারণের মনে নানাবিধ সন্দেহকে ঘনীভূত করিয়া তুলিতেছে। অনেকের ধারণা, জনাব এফ, এ, করিম ও অন্যান্য বাঙালি বিদ্বেষী আমলাদের সহযােগিতার মিজান সাহেব এই কর্জে হাসানার টাকা হয়তাে উর্দু হরফে বাঙলার এক্সপেরিমেণ্টের ও উর্দু স্কুল প্রতিষ্ঠার খাতে চালাইয়া দিয়াছেন।
এই ধারণার মূলে কোনাে সত্য থাকুক আর না থাকুক, কর্জে হাসানার লক্ষ লক্ষ টাকা কোথায় আত্মগােপন করিয়াছে, কোন্ অন্ধকারে চাপা পড়িয়াছে, কোন্ কোনাে পাপী ইহার জন্য দায়ী তাহা আজ আমরা স্পষ্ট করে জানিতে চাই। এই টাকা আমরাই একদিন দিয়াছিলাম— আজ ইহার কী পরিণতি ঘটিয়াছে তাহা জানিবার অধিকারও আমাদের রহিয়াছে। এদেশেরই আশা ভরসার স্থলে হাজার হাজার দরিদ্র শিক্ষার্থীর দুর্ভাগ্যকে লইয়া মিজান কোং যে পরিহাস রস করিয়াছেন তার কি কোনই প্রতিকার নাই? পূর্ব বংগের শিক্ষামন্ত্রী কি তার সমস্ত দায়িত্ব ও কর্তব্যে হাত ধুইয়া বসিয়া আছেন? এম, এল, এদেরও কি এ ব্যাপারে কোনাে কর্তব্য নাই? তমুদুন মজলিশের আহবানে ঢাকার তরুণ শিল্পী সাহিত্যিক ও কর্মীবৃন্দ সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’ অফিসে (১৯ আজিমপুর) এক সাহিত্য সভার মিলিত হন। সভায় সভাপতিত্ব করেন ‘সৈনিক সম্পাদক মণ্ডলীর সভাপতি জনাব শাহেদ আলী।
সমাগত সুধীবৃন্দকে অভ্যর্থনা জানাইতে গিয়া মজলিশের সাহিত্য বিভাগের পরিচালক জনাব সানাউল্লাহ নূবী বলেন মজলিশ তার অসমাপ্ত মিশন লইয়া আবার শিল্পী সাহিত্যিকদের দ্বারে উপস্থিত। বিভিন্ন জিলায় মজলিশের বাণী ছড়াইয়া দেওয়ার জন্য ব্যস্ত থাকায় ও নানা ঝড় ঝাপটার দরুণ সাহিত্য বিভাগ কিছুদিন যাবৎ এই শহরে কাজ গুটাইয়া রাখিতে বাধ্য হইয়াছিল। আজ আবার নতুন করিয়া তার জয়যাত্রা শুরু হইল। তখন হইতে নিয়মিতভাবে শুক্রবারে মজলিশের পাক্ষিক সাহিত্য সভা বসিবে। সভায়, প্রতিশ্রুতিশীল, নাট্যকার আকার ইবনে শাইখ, উদীয়মান কবি আব্দুল মুতালিব ও তরুণ লেখক আলতাফ হােসেন যথাক্রমে ‘দিবাস্বপ্ন’ ‘ফরিয়াদ’ ও ‘স্বাধীনতার স্বরূপ’ নামক একটি গল্প একটি কবিতা ও প্রবন্ধ পাঠ করেন।
অতঃপর সভায় পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষায় উর্দু হরফ গ্রহণের জন্য যে গােপন চক্রান্ত চলিতেছে সে সম্বন্ধে আলােচনা করা হয়। আলােচনায় অংশগ্রহণ করেন অধ্যাপক আবুল কাসেম, মজলিশ কর্মী মােহাম্মদ তাহা ও প্রবীণ সাহিত্যিক মােহাম্মদ আব্দুল ওদুদ প্রভৃতি এবং সভাপতি জনাব শাহেদ আলী। সভায় নিম্নোক্ত প্রস্তাবগুলাে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়:
১. ঢাকার শিল্পী, সাহিত্যিক, ছাত্র ও কর্মীদের এই সভার দৃঢ় অভিমত এই
যে, বাংলা ভাষার জন্য উর্দু হরফ গ্রহণ পূর্ব পাকিস্তানের তামদুনিক জীবনের পক্ষে নিতান্ত মারাত্মক হইবে। কতিপয় সরকারি আমলা ও ‘গণ প্রতিনিধিত্বের দাবিদার’ নেতা বাংলা ভাষায় উর্দু হরফ প্রবর্তনের যে ষড়যন্ত্র করিতেছেন এই সভা তাহার তীব্র নিন্দা করিতেছে। এবং সরকারের নিকট দাবি জানাইতেছে যে, অবিলম্বে বাংলা হরফ বিরােধী
অপরিণামদর্শী প্রচেষ্টাকে অবিলম্বে বন্ধ করিয়া দেওয়া হউক।
২. এই সভা আরাে দাবি জানাইতেছে হা হুজুরদের মেজরিটি রাখিয়া শিক্ষা | বিভাগের সেক্রেটারি কর্তৃক গঠিত তথাকথিত বাংলাভাষা কমিটি অবিলম্বে ভাঙ্গিয়া দিয়া সুবিজ্ঞ ভাষাবিদদের লইয়া এই কমিটি পুনঃ গঠিত করা হউক।
৩. এই সভা পূর্ব পাকিস্তানের যুব শক্তি ও শিল্পী সমাজের প্রতি এই জঘন্য
ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করিতে আন্দোলন চালাইয়া যাইতে আহ্বান জানাইতেছে।
৪. এই সভা পূর্ব পাকিস্তানের সমুদয় বাংলা ও ইংরেজি সংবাদদাতাকে বাংলা হরফের বিরুদ্ধে এই জঘন্য আক্রমণ রােধ করিবার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের জনমত সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করিতে অনুরােধ জানাইতেছে। (সৈনিক – ১৯৪৯, ১৩ জানুয়ারি, পৃষ্ঠা-৪-৫)
সৈনিক
হরফের সমস্যা জনগণই মীমাংসা করিবে : পূর্ববঙ্গ সরকারের প্রেসূনােট ঢাকা, ১৩ই ডিসেম্বর : পূর্ব পাক সরকারের অদ্যাকার প্রকাশিত এক প্রেস নােটে বলা হয় বাংলা ভাষা প্রচলিত বাংলা হরফে লিখা হইবে অথবা আরবি হরফে লিখা হইবে, ইহা এই প্রদেশের জনগণের স্বাধীন মতামতের উপরই সম্পূর্ণ নির্ভর করে। প্রেস নােটটিতে আরও প্রকাশ : পাকিস্তান শিক্ষা উপদেষ্টা বাের্ডের অধিবেশনে বাংলা ভাষায় আরবী হরফ চাপাইয়া দেওয়ার ব্যবস্থা করা হইতেছে বলিয়া বাহিরে যে খবর রটিয়াছে, তাহা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন গুজব ছাড়া আর কিছুই নয়।
সূত্র: ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও দলিল – সাহিদা বেগম