You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ৫ই ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার, ১৯শে অগ্রহায়ণ, ১৩৮১

বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া মৈত্রী

মালয়েশিয়ার রাজা ইয়াং দি পাতুয়ান এ্যাগং মহামান্য তুংকু আবদুল হালিম মুয়াজ্জম শাহ ইবনে আল মরহুম সুলতান বাদলী শাহ ও রানী রাজা পারমাইসুরী এ্যাগং মহামান্যা তুংকু বাহইয়া বিনতে আল মরহুম তুংকু আব্দুর রহমান চারদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে এসেছেন। বাংলাদেশের জনসাধারণ রাজদম্পতীকে জানিয়েছেন আন্তরিক ও সদস্যদের সংবর্ধনা। ’৭১ সালে রক্তাক্ত সংগ্রামের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হবার সঙ্গে সঙ্গেই মালয়েশিয়া সানন্দে এগিয়ে এসেছিল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানাতে। ’৭২ সালের ৩১শে ডিসেম্বর বাংলাদেশ আর মালয়েশিয়ার মধ্যে স্থাপিত হলো বন্ধুত্বের যোগসূত্র। পারস্পরিক সাহায্য, সহযোগিতাও মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হলো দুটো দেশ। বাংলাদেশ মালয়েশিয়ার মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক আজকের নয়। অনেক দিনের। সুপ্রাচীন কাল থেকেই দুটো দেশের জনগণের মধ্যে রয়েছে সুনিবিড় বন্ধুত্ব। গত মঙ্গলবার মালয়েশিয়ার মহামান্য রাজা রানীর সম্মানে আয়োজিত রাষ্ট্রীয় ভোজসভায় রাষ্ট্রপতি জনাব মোহাম্মদ উল্লাহ বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে নিবিড়তর বন্ধুত্বের সম্পর্কের উন্নয়নকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, আমাদের উভয় দেশ জোট-নিরপেক্ষ রাষ্ট্র সংহতি, ইসলামী সম্মেলন, কমনওয়েলথ ও জাতিসংঘের সদস্য হিসেবে পরস্পরের সঙ্গে জড়িত। তিনি আশা প্রকাশ করেন, মালয়েশিয়ার রাজার এ সফরে আমাদের দু’দেশের মধ্যে বিদ্যমান ভ্রাতৃত্বপূর্ণ আন্তরিক সম্পর্ক আরো জোরদার হবে।
মহামান্য রাজা ইয়ং দি পার্তুয়ান এ্যাগং তুংকু আব্দুল হালিম মোয়াজ্জম শাহ তার ভাষণে বলেছেন, আমাদের দু’দেশের দুই সরকারই সামাজিক ন্যায়বিচার, অর্থনৈতিক ও কারিগরি প্রগতি এবং সমৃদ্ধি আনার জন্য সংকল্পবদ্ধ। আমাদের দু’দেশের জনগণ যেন সম্পূর্ণরূপে শোষণমুক্ত, অভাব-অনটন মুক্ত হয়ে ক্রমোন্নত সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারে তার জন্য আমাদের দু’দেশের দুই সরকারই প্রচেষ্টা চালাতে সংকল্পবদ্ধ। তিনি আরো বলেন যে, আমাদের এই দুটি দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠতর সহযোগীতার বীজ ইতিমধ্যেই বপন করা হয়েছে। গত তিন বছরে আমাদের দুটি দেশের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার সম্পর্ক অনেক জোরদার হয়েছে।
দুটি দেশের মধ্যে পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতার প্রশ্নে মহামান্য রাজার বক্তব্য যে, আপ্যায়নকারীর মনঃতুষ্টির জন্য শুধুমাত্র কথার কথা নয় তার পরিচয় ইতিপূর্বেই বাংলাদেশের জনসাধারণ পেয়েছে। স্বাধীনতার জন্মলগ্নে মালয়েশিয়া বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানিয়েই বসে থাকেনি – বাংলাদেশ জাতিসংঘসহ বিশ্ব সংস্থার বিভিন্ন শাখা প্রতিষ্ঠানে সদস্যপদ লাভ করতে পারে সে জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছে। ইসলামী সম্মেলনে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভ, ইসলামিক সেক্রেটারিয়েট ও ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে মালয়েশিয়ার ভূমিকা গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের প্রতি মালয়েশিয়া জনগণের অকৃত্রিম ভালবাসা ও বন্ধুত্বের নিদর্শন পাওয়া যায় বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে মালয়েশিয়ার সাহায্য দানের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের জনগণও মালয়েশিয়ার জনগণকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে ভালোবাসে, তাদের অকৃত্রিম বন্ধুত্ব কামনা করে একথা উল্লেখ করার প্রয়োজন পড়ে না। ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাপান সফরান্তে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করার সময় কিছুক্ষণের জন্য কুয়ালালামপুরে অবস্থান করেন। স্বল্পকালীন অবস্থানকালে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রান ঢালা ভালোবাসা, বন্ধুত্ব ও শুভেচ্ছার বাণী পৌঁছে দিয়েছেন। সুদৃঢ় করেছেন দু’দেশের সম্পর্ককে।
মালয়েশিয়া উপনিবেশিক শাসনের সুশৃংখল মোচন করে নিজেদের স্বাধিকার ও সমৃদ্ধিকে অর্জন করেছে। মালয়েশিয়া যে পথে নিজেদের অগ্রগতি ও উন্নত ত্বরান্বিত করেছে সেখান থেকে বাংলাদেশেরও অনেক কিছু শিক্ষানীয় রয়েছে। একের অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখে অন্যে এগিয়ে যাবে এই তো নিয়ম। দুটো দেশের মধ্যে রয়েছে প্রচুর মিল মালয়েশিয়ার কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিকে কিভাবে স্বনির্ভর ও শিল্পমুখিন করা যায় সে শিক্ষা অভিজ্ঞতার কথা আমাদের জানা প্রয়োজন।
এটা অনস্বীকার্য যে, মালয়েশিয়ার মহামান্য রাজার বর্তমান সফর দুটো দেশের মধ্যে সাহায্য ও সহযোগিতার ক্ষেত্র আরো প্রশস্ত করবে। বন্ধুত্বের বন্ধন আরও সুদৃঢ় হবে। মহামান্য রাজ দম্পতির এ সফর সুন্দর হোক, আনন্দময় হোক, এই কামনাই আমরা করছি।

সাম্প্রতিক রেল দুর্ঘটনা

গত সোমবার রাতে লাকসামে এক মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটেছে। ঘটনাটি মুখোমুখি সংঘর্ষের ফলে হয়েছে। একদিক থেকে আসছিল সিলেট-চট্টগ্রাম যাত্রীবাহী ট্রেন, অন্যদিক থেকে আসছিল নোয়াখালী-লাকসাম যাত্রীবাহী ট্রেন। সংঘর্ষের ফলে একটি সংবাদপত্রের তথ্য অনুযায়ী পাঁচজন মারা গেছেন এবং ৪১ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে কয়েকজন রেলওয়ে কর্মচারী ও রয়েছেন। দুর্ঘটনা কারণে ১৫ ঘন্টার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। অবশ্য সরকার পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, দুর্ঘটনার ফলে চট্টগ্রাম ঢাকা রেল যোগাযোগের কোন ব্যাঘাত ঘটে নি। মুখোমুখি সংঘর্ষের কারণে একটি ইঞ্জিনিয়ার কিছুটা ক্ষতি সাধিত হয়েছে বলেও সরকার প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করেছেন। ইতিমধ্যে সরকার দুর্ঘটনার কারণ জানবার জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। ড্রাইভারসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে দেশের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনরুজ্জীবিত করার জন্য সরকার যথাযথ চেষ্টা চালিয়েছেন। বিধ্বস্ত রেল ব্যবস্থাকে পুনরুদ্ধারের জন্য কর্তৃপক্ষ আজও তার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু এতদ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও গত তিন বছরের বিভিন্ন সময় বহু রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। কর্তৃপক্ষ দুর্ঘটনা এড়াতে পারেননি। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ১৯ বার রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। বহু জীবন ও সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। আমরা বহুবার রেল দুর্ঘটনার অনিবার্য কারণ এবং পরিণতি সম্পর্কে কর্তৃপক্ষকে সজাগ করে দিয়েছিলাম। যে সকল ব্যবস্থা ও রেল বিভাগের রয়েছে তার প্রতিকারের জন্য আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু তাতে করে রেল বিভাগের নানা অব্যবস্থাপনা কাটেনি। আজো রেল দুর্ঘটনা অব্যাহত গতিতে ঘটে চলেছে। লাকসাম রেলওয়ে স্টেশনের কাছে যে সর্বশেষ দুর্ঘটনাটি ঘটেছে তার প্রকৃত কারণ তদন্ত কমিটিই নির্ণয় করবেন। তবে এতোটুকু জানা গেছে যে, এই লাইন দিয়ে দুটো ট্রেনের পরস্পর বিপরীতমুখী যাতায়াতের সংকেত দেওয়া হয়েছিল। ফলে সংঘর্ষটি মুখোমুখি হয়েছে।
এব্যাপারে কে দোষী বা নির্দোষি তা তদন্ত সাপেক্ষ। তবে ঘটনা দৃষ্টে মনে হয় পরিচালনা ও প্রশাসনের মধ্যে কোথায় যেন গলদ রয়েছে। কর্তৃপক্ষ যদি গোড়ায় গলদে হাত না দিয়ে কোন ঘটনার জন্য শুধু চার জনকে বরখাস্ত করেন তাহলেই সমস্যার সমাধান হবে না। বস্তুতঃ দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হলো রেলওয়ে বিভাগ। মানুষের যাতায়াত ছাড়াও মাল বহনের জন্য যোগাযোগ অতন্ত প্রয়োজনীয় বিভাগ। খাদ্যদ্রব্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের প্রয়োজনীয়তা ছাড়াও অন্যান্য প্রায় সবগুলো জিনিসপত্র রেল যোগাযোগের মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয়ে থাকে। কেননা আমাদের ট্রাক ও নৌপথের যোগাযোগব্যবস্থা তেমন উল্লেখযোগ্য পরিমাণ চাহিদা মেটাতে পারেনা। সে ক্ষেত্রে রেল ব্যবস্থাকে যদি উন্নত অথবা যা রয়েছে তাও যদি সচল বা দুর্ঘটনা মুক্ত করা যায় তাহলে মানুষের যাতায়াতের ক্ষেত্রে দুর্ভোগ যেমন কিছুটা কমবে তেমনি পরিবহনের ক্ষেত্রে অনেক বন্ধ্যাত্ব লাঘব হবে। জানা গেছে বহু ক্ষেত্রে ১৯৩৯ সালের পর বেঙ্গল ইস্টার্ন রেলওয়ে আমল থেকে রেললাইনের স্লিপার পরিবর্তন ও পাথরের নুড়ি ব্যালাস্টের আজ পর্যন্ত তেমন উল্লেখযোগ্য বা ব্যাপক সংস্কার হয়নি। রেল ব্যবস্থার সংস্কারের কথা আমরা শুনেছি বিভিন্ন সময় কর্তৃপক্ষের মুখে। বিদেশি সরকার বিশেষ করে জাপানের সঙ্গে আলোচনার কথা ও শুনেছিলাম রেলের উন্নতি এবং আধুনিকীকরণের প্রশ্নে। আমরা আশাবাদী, কর্তৃপক্ষ রেলের উন্নতির জন্য একটা কিছু করবেন বলে। দুর্ঘটনা বন্ধের ব্যাপারেও কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় এবং কার্যকর ব্যবস্থা অবলম্বন করবেন বলে আমরা আজো আশা করি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!