You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.11.27 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | রেল যাত্রীদের নিরাপত্তা চাই | উপমহাদেশের শান্তি ও মৈত্রীর পথ সুগম হবে | নাগরিক দায়িত্ববোধ | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা : ২৭শে নভেম্বর, মঙ্গলবার, ১৯৭৩, ১১ই অগ্রহায়ণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

রেল যাত্রীদের নিরাপত্তা চাই

গত রোববার রাজবাড়ীর নিকটস্থ পাটুরিয়া রেলস্টেশনে দু’টো যাত্রীবাহী ট্রেনের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে। একজন রেলওয়ে গার্ড সহ ৪ জন এই দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে। স্থানীয় একটি ইংরেজী দৈনিকে প্রকাশ, এই দুর্ঘটনার সঠিক কারণ এখনো জানা যায়নি। তবে রাজবাড়ী থেকে গোয়ালন্দগামী ট্রেনের চালক বলেছে, সে স্টেশনে প্রবেশের সবুজ সংকেত পেয়েছে কিন্তু স্টেশন মাস্টার জানিয়েছেন সংকেত অমান্য করা হয়েছে। এই ঘটনার আগের দিন অর্থাৎ শনিবার তেজগাঁও স্টেশনে চট্টগ্রামগামী ‘গ্রীন এ্যারো’ আরেকটি দুর্ঘটনায় পতিত হলে একটি বগি লাইনচ্যুত হয়।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, ১লা নভেম্বর থেকে ২৫শে নভেম্বর পর্যন্ত পঁচিশ দিনে সাতটি রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ গড়ে ৮৪ ঘন্টা পর পর একটি করে দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। পৃথিবীতে আর কোথাও রেল দুর্ঘটনার হার এত ব্যাপক কিনা আমাদের জানা নেই।
বর্তমান যুগে রেলপথ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ ব্যবস্থা। বিশেষ করে আমাদের দেশে এর গুরুত্ব যে কত ব্যাপক সে কথা বলাই বাহুল্য। বিমান, নৌ, সড়ক ও রেলপথের মধ্যে রেলপথই আমাদের দেশে অন্যতম প্রধান যোগাযোগ পথ। এবং অধিকাংশ লোকই তাই রেলপথেই দূর-দূরান্তের পথ পাড়ি দেয়। সড়ক পথে অহরহ দুর্ঘটনা, রাস্তার খারাপ অবস্থা ইত্যাদি কারণে এখনো মধ্যবিত্ত এবং নিম্নশ্রেণীর অধিকাংশ লোকই রেলপথে ভ্রমণ করে। আসলে রেলপথে এখনো অন্যান্য যানবাহনের তুলনায় ভাড়া কম এবং সড়ক পথের চাইতে নিরাপত্তাও তুলনামূলকভাবে অধিক। কিন্তু সেই রেলপথেও যদি প্রতি ৮৪ ঘন্টা পর পর দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে দূর-দূরান্তের যাত্রী সাধারণের পক্ষে স্বল্পব্যয়ে অধিক নিরাপত্তামূলক আর কোনো বিকল্প পথ থাকে কি? এবং তাই সাধারণ মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়েও রেলপথে ভ্রমণ না করে পারছে না। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা দরকার যে, গত পঁচিশ দিনে যে দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে তার অধিক ক্ষেত্রেই সামনাসামনি সংঘর্ষ ঘটেছে রেলপথের সংকেতের ক্রুটির দরুণ।
সংকেত ক্রুটি যান্ত্রিক ব্যাপার। কিন্তু সেই যন্ত্রটিকে ব্যবহার করতে হয় রেল কর্মচারীদেরকেই। সুতরাং এই যান্ত্রিক ক্রুটির অন্তরালে রেল কর্মচারীদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতার অভাব দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বললে বোধকরি অত্যুক্তি করা হবেনা।
রেলপথে দুর্ঘটনা যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে আমরা এবং জনসাধারণ উদ্বিগ্ন না হয়ে পারছিনা। ইতিপূর্বে রেলওয়ে প্রশাসনের জটিল কাঠামোর দরুণ অনেক জরুরী সমস্যা জরুরী ভিত্তিতে সমাধা করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু সম্প্রতি রেলওয়ের সার্বিক উন্নতির প্রেক্ষিতে পূর্বতন রেলওয়ে বোর্ডকে ভেঙে দিয়ে নতুন ছাঁচে একটি নতুন রেলওয়ে ডিভিশন করা হয়েছে। নবগঠিত রেলওয়ের ডিভিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণও নিযুক্ত হয়েছেন। সুতরাং এক্ষণে আমরা আশা করি, দেশের অন্যতম প্রধান যোগাযোগ ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়ন অতি দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করার কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কেবল দুর্ঘটনার জন্যে তদন্ত কমিটি গঠন বা কয়েকজন কর্মচারীকে বরখাস্ত করে সমস্যার সমাধান হবে না। দুর্ঘটনার মূল কারণ নির্ণয় করে এর যথাযথ সংশোধন করতে হবে এবং রেলওয়েকে একটি নিরাপত্তা ও আরামপ্রদ পরিবহন হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। আমরা আরও আশা করি, জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে সাধারণ মানুষকে আর রেলপথে ভ্রমণ করতে হবে না এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ রেলপথের ভ্রমণকে অধিক আরামপ্রদ ও নিরাপদ করে তোলার জন্যে ত্বড়িৎ কার্যকর ব্যবস্থা নেবেন।

উপমহাদেশের শান্তি ও মৈত্রীর পথ সুগম হবে

গতকাল সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারী জেনারেল কমরেড লিওনিদ ব্রেজনেভ নয়াদিল্লী এসে পৌঁছেছেন। ইতিপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছিলোম—কমরেড ব্রেজনেভের এই ভারত সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এশিয়ার এতদঞ্চলে তাঁর এই শুভেচ্ছা সফর শান্তি ও মৈত্রীর নির্দশন বলেও আমরা অভিমত পোষণ করেছিলাম। জানা গেছে, মিঃ ব্রেজনেভের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আঁদ্রে গ্রোমিকোও এসেছেন। কয়েকদিন আগে একটি সোভিয়েত প্রতিনিধিদল নয়াদিল্লী এসে পৌঁছেছিলেন। তাঁরা ভারতীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকের পর একটি খসড়া চুক্তিও চূড়ান্ত করেছেন। ভারতীয় বিভিন্ন শিল্পের উন্নয়নের ক্ষেত্রে সোভিয়েত সাহায্য ও সহযোগিতার আশ্বাস রয়েছে চুক্তিতে। বিমান বন্দরে মিঃ ব্রেজনেভকে স্বাগতম সম্বর্ধনা জানিয়েছেন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ও হাজার হাজার জনতা। বস্তুতঃপক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়নের এই মহান নেতার ভারত আগমনকে আমরা যেমন গুরুত্বপূর্ণ বলে অনুধাবন করছি তেমনি বিশ্বের শান্তিকামী প্রগতিশীল মানুষও এ সফরকে একটি বিশেষ দৃষ্টিতে পর্যালোচনা করছেন। বিশ্বের বহু সংঘাতময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে যে, সোভিয়েত রাজনৈতিক আদর্শ মুক্তিকামী প্রগতিশীল মানুষের স্বপক্ষে। যেখানেই সাম্রাজ্যবাদ উপনিবেশবাদ বা বর্ণবাদের শোষণ ও উৎপীড়ন অব্যাহত রয়েছে সেখানেই সোভিয়েত ইউনিয়নের নৈতিক এমনকি বৈষয়িক সাহায্য ও সহযোগিতার হাতও সম্প্রসারিত হয়েছে। মুক্তিকামী প্রগতিশীল মানুষের প্রতি সোভিয়েত আদর্শের এই সহযোগিতামূলক মনোভাব বিশ্বের উত্তেজনাকে অনেকখানি প্রশমিত করতে সাহায্য করেছে। উত্তেজনা জিইয়ে রাখা যেহেতু তার আদর্শ নয় সেহেতু বহু সমস্যাই সমাধানের দিকে মোড় নিতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের অন্যতম প্রধান বন্ধু সোভিয়েত ইউনিয়ন। আমাদের সংগ্রামের অন্যতম প্রধান সাথী সোভিয়েত ইউনিয়ন। তাদের সাহায্য সহযোগিতা ও সমর্থন আমাদের মুক্তি সংগ্রামকে ত্বরান্ব্তি করে বিজয়ের স্বর্ণদ্বারে পৌঁছে দিয়েছিলো। স্বাধীনতাত্তোরকালে আমাদের পুনর্গঠনের সংগ্রামেও সোভিয়েত হস্ত সবচেয়ে বেশী সম্প্রসারিত। দেশের সার্বিক গঠন কাজেও তাদের ভূমিকা আমাদের কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করার মতো। স্বাধীনতাযুদ্ধে আমাদেরকে প্রত্যক্ষ সাহায্য করেছিলো ভারত সরকার ও তার জনগণ। সেই বন্ধু ভারতে সফররত সোভিয়েত নেতা কমরেড ব্রেজনেভকে উপমহাদেশের শান্তিকামী জনগণের পক্ষ থেকে আমরাও স্বাগত জানাই। কেননা আমরা বিশ্বাস করি, ব্রেজনেভের এ সফর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বর্তমান পরিস্থিতির উপর একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তার করবে। চৈনিক সম্প্রসারণবাদী বিভ্রান্ত রাজনীতির নৈরাজ্য যা কি-না উপমহাদেশে নিষ্প্রভ প্রায় তার শেষ পরিণতির মুখে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক মহান আদর্শের নেতা ব্রেজনেভের এ সফর নিঃসন্দেহে একটি প্রভাব ও অবদান রেখে যাবে।
আমরা ব্রেজনেভের সফর শুভ হোক কামনা করি। সোভিয়েত-ভারত মৈত্রী আরো দৃঢ় হোক এটাও আমাদের কামনা।

নাগরিক দায়িত্ববোধ

বাঘের মাসি বিড়াল বোধ হয় সবচেয়ে নিরীহ প্রাণী। সহজে রাগ করে না। চুপ চুপ বসে থাকে। ইঁদুর বা পোকা মাকড় দেখলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এছাড়া আর কোনো দিকে সহজে নজর দেয় না। তবে বিড়াল রাতদিন চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে যে কাজটি করে তাহলো নিজেকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা। বিড়ালই বোধহয় সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন প্রাণী। সব সময়েই সে গা চাটছে। ময়লা থাকার কোনো উপায় নেই।
বিড়ালকে আমরা রাতদিন চব্বিশ ঘন্টাই দেখছি। অথচ বিড়াল যা করে আমরা তা করি না। অর্থাৎ নিজেকে বা বাড়ীঘর দোর, রাস্তাঘাট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার দিকে আদৌ নজর দিই না।
শহর বা বাড়ী-ঘর-দোর বা আশ-পাশ এলাকা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব আমার নয় দায়িত্বটা সরকারের এই মহাবাক্যটি তোতা পাখির মতো আউড়ে যাই। পত্র-পত্রিকায় লিখি রাজধানী ঢাকা শহরের অপর নাম জঞ্জালের শহর।
এক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে দায়িত্বটা কি সরকারের না একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসাবে জনসাধারণেরও। একটু চোখ মেলে দেখুন। দেখতে পাবেন বাড়ীর পাশে ডাস্টবিন থাকা সত্ত্বেও ময়লা ড্রেনে বা তার আশে-পাশে ফেলা হচ্ছে। ছোট ছোট বাচ্চা ছেলেমেয়েরা দিব্যি মনের সুখে ড্রেনের পাশে বসে মলমূত্র ত্যাগ করছে। বাদাম, কলা, বা বুট ভাজা কিনে ওগুলো খেয়ে কলার খোসা বা বাদামের ঠোঙ্গাটা রাস্তায় ফেলে দেওয়া হচ্ছে। এতে লজ্জিত হচ্ছি না। ভাবছি ঐ সামান্য কলার খোসাটা যে কোনো সময়ে যে কোনো মানুষের মৃত্যু ডেকে আনতে পারে।
এই যে অদ্ভুত ও আজগুবি মানসিকতা। এ মানসিকতার পরিবর্তন না হলে কোনো কিছু হবে বলে মনে হয় না। অবশ্য এ মানসিকতা বদলাবার জন্যে প্রয়োজন নাগরিক দায়িত্ববোধ। সেই দায়িত্ববোধ জাগ্রত না হলে শত চেষ্টা করলেও শহর পরিচ্ছন্ন অভিযান সফল হবে না। পরিচ্ছন্ন অভিযানকে সফল করার দায়িত্ব যেমন সরকারের তেমনি জনসাধারণেরও।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন