বাংলার বাণী
৭ই আগস্ট, মঙ্গলবার, ১৯৭৩, ২২শে শ্রাবণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
কবিগুরু আমাদের আত্মার আত্মীয়
আজ বাইশে শ্রাবণ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বত্রিশতম মৃত্যু বার্ষিকী। বাংলা আর বাঙালীর অভিন্ন সত্তা রবীন্দ্রনাথ। বাঙালী জাতির হৃদয়ের মানস পুত্র কবি গুরু। আজ তাঁর মৃত্যু দিবসে আমরা আমাদের হৃদয়ের শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করি।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই মহাপ্রয়াণের দিবসে তার মহাকীর্তির কথা স্মরণ করতে এসে আমাদের মনে নানা চিন্তার উদ্রেক হয়। কবিগুরু বাংলার মান আর ভাষার মহত্ত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। শুধু দেশেই নয়, সারা বিশ্বের দুয়ারে কবিগুরুর মাধ্যমেই প্রথম ভাষার গৌরব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলা ভাষা যে কোন অংশে দীন বা দরিদ্র নয় তা কবিগুরুর নবেল পুরস্কার লাভের মধ্য দিয়েই সপ্রমাণিত হয়েছে। সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বাংলার মান তিনিই বিশ্বব্যাপী সমুন্নত করে তুলেছিলেন। আজকের বাংলা ভাষা যে মর্যাদায় সমাসীন তা কবিগুরুর পদপ্রাপ্ত হতেই পাওয়া।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে কবিগুরুর নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল আজো রয়েছে। অতীতের সকল আন্দোলনেই কবিগুরু ছিলেন আমাদের প্রেরণাদাতা। তাঁর কবিতা, গান আমাদের আন্দোলনের উজ্জীবন শক্তি। জাতির অকৃত্রিম হৃদয়ের কোমলতন্ত্রীতে লেখা কবিগুরুর নাম। আমাদের মজ্জায় মজ্জায় তার দ্যোতনা। স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরু হয়েছে কবিগুরুর ‘আমার সোনার বাংলা-আমি তোমায় ভালোবাসি’র মধ্য দিয়ে, শেষ হয়েছে ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’-এর বন্দনার মাধ্যমে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একদিন কবিগুরু ছিলেন বিতর্কিত প্রতিভা। সেদিনও বাঙালীরা তাদের প্রিয় কবির প্রতি ছিল শ্রদ্ধাবনত। সেজন্যে কবিগুরুর বিরুদ্ধে চক্রান্তকে রুখে দাঁড়িয়েছিলো এদেশের মানুষ। ষড়যন্ত্রের বেড়াল বেরিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। আজ কবিগুরুর আসন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সুশোভিত। বাঙালীর হৃদয়ে তাঁর পবিত্র আসন সমুজ্জ্বল।
বরাবর লক্ষ্য করেছি, কবিগুরুর প্রসঙ্গে আমরা একটু বেশী ভাবপ্রবণ। এর মাহাত্ম আছে নিঃসন্দেহে কিন্তু বাস্তবতার নিরীখে তা দুর্বল। কবিগুরুর সম্পর্কে আজ আমাদের বাস্তব কর্মসূচী নিতে হবে। বাংলাদেশে তিনি যে পদচারণা করেছেন এবং এদেশের পদ্মা যমুনার পাড়ে যে গান তিনি গেয়েছিলেন। তার গবেষণা সুসম্পন্ন হওয়া দরকার। তাঁর স্মৃতি চিহ্নগুলোকে চিরকালের করে রাখা দরকার। আমাদের কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কিছু করবেন বলে আমরা শুনেছিলাম। আমরা আশ্বাস বাণীর জন্যে আজো আশাবাদী।
কবিগুরুর এই মহাপ্রয়াণের দিনে আমরা কবির বিদেহী আত্মার প্রতি পরম শ্রদ্ধা জানাই।
শিক্ষার লক্ষ্য—চারিত্রিক ঐশ্বর্য
গত রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে অবস্থিত এশিয়াটিক সোসাইটির বার্ষিক সাধারণ সভায় ভাষণদানকালে আমাদের রাষ্ট্রপতি বিচারপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী দেশে সুষ্ঠু শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্যে শিক্ষাবিদ ও শিক্ষক সমাজের প্রতি এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধান অতিথির ভাষণদানকালে রাষ্ট্রপতি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে মহা সংকটাপন্ন বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, আমাদের শিক্ষা কেবলমাত্র স্বাক্ষরতায়ই পর্যবসিত হয়েছে। তিনি দেশের শিক্ষার পাঠ্যপদ্ধতি বা ব্যবহারিক পরিচালনায় মৌলিকত্ব, সৃজনশীলতা ও বৈজ্ঞানিক চিন্তার বিকাশের অভাব বলেও উল্লেখ করে মনের বিকাশ ও চারিত্রিক ঐশ্বর্য বর্ধন সম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থা কামনা করেছেন।
বস্তুতঃ আমাদের জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা যখন নৈরাজ্যের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে—ঔপনিবেশিক আমলের শ্রেণী সৃষ্টির যে উপনিবেশবাদী শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের জাতীয় জীবন ও জাতীয় চরিত্রকে পঙ্গু করার ষড়যন্ত্রে তৈরী হয়েও এখনো স্বাধীন দেশের বুকে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে রয়েছে—যে শিক্ষা ব্যবস্থায় বাস্তব জ্ঞান আহরণের দ্বার ঔন্মোচিত হবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে উপনিবেশিক আমলে সেই শিক্ষা ব্যবস্থাই আমাদের উপর চেপে দেওয়া হয়েছিলো এবং আমরা সেই অহেতুক গুরুভার এখনো টেনে চলেছি। রাষ্ট্রপতি সেই আবর্জনা থেকে মুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থায় আমাদের ভাবী বংশধরদের প্রকৃত জ্ঞান আহরণের পথ খুলে দেয়ার এই সময়োচিত আহ্বান জানিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি বলেছেন : জ্ঞান-শিক্ষায় প্রশিক্ষিত জনশক্তি গড়ে তুলতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা বিফল হয়েছে। মৌলিক শিক্ষাস্তরের বেসরকারী বিদ্যালয়গুলোর পরিচালনা পরিবেশ, শিক্ষকতার মানের অবনতি, ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা অসংখ্য বেসরকারী কলেজ, যেনতেন প্রকারে ডিগ্রী হাসিল করার প্রচেষ্টা আর কেরানী পদের জন্য নিম্নতম যোগ্যতাহীন প্রার্থীদের মর্মান্তিক ভীড় জাতীয় অস্তিত্বের পক্ষে এক মারাত্মক বিপদ হয়ে দেখা দিয়েছে। তিনি ব্যাধিগ্রস্ত এই শিক্ষা ব্যবস্থার রোগ নির্ণয় ও প্রতিকারের জন্য এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতির এই বক্তব্য দেশের আপামর জনমতেরই প্রতিধ্বনি। শিক্ষা আর কুসংস্কার, দরিদ্র এবং দারিদ্র্যতা হেতু শিক্ষার পথে অনগ্রসর—মানুষ গড়ার শিক্ষা থেকে বঞ্চিত জাতির সামনে এক আলোকবর্তিতার মতোই কাজ করবে তাঁর এই বাণী তাছাড়া আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে নতুন করে ঢেলে সাজাবার প্রয়াসী হয়ে যখন জাতীয় শিক্ষা কমিশন একটা সুপারিশ প্রণয়ন করছেন ঠিক সেই মুহূর্তে রাষ্ট্রপতির এই উক্তি তাঁদের সহযোগিতাই করবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। তাঁর এই আহ্বান অবশ্যই দেশের বিবেকবান মানুষদের অন্তরে অনুরণন তুলবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
রাষ্ট্রপতি অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক সমস্যার বস্তুনিষ্ঠ ও বিজ্ঞানসম্মত সমাধান খুঁজে বের করার জন্য দেশের চিন্তাবিদ সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এই ব্যাপক সমস্যার সমাধানে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে। সাথে সাথে বিদেশ থেকে ধার করা সমাধান ও তত্ত্ব প্রয়োগের চোরাগর্তও পরিহার করতে হবে।
রাষ্ট্রপতি যা বলেছেন তার সাথে আমরা একমত। আমরা মনে করি আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের সমাজ, আমাদের রাজনীতি আজ যেসব সংকটের আবর্তে আবর্তিত আমাদের দেশজ প্রক্রিয়ায়—আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবী আর চিন্তাশীল মানুষের সহজাত ও স্বাভাবিক চিন্তা দ্বারাই তার সমাধান অবশ্যই করতে পারবো। তবে আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে আজ সংকটের যে দোলা, তার রোধ করার জন্য দেশের চিন্তাশীল বুদ্ধিজীবী মানুষের এগিয়ে আসা যেমন প্রয়োজন তেমনি সমস্যাকে সমস্যা হিসেবে ধরে নিয়ে তার প্রতিরোধে সরকারকেও আরো মনোযোগী হওয়া শ্রেয়ঃ বলেও আমরা মনে করি।
নির্বাচিত সংসদ সদস্যদ্বয়কে স্বাগতম
গত পরশু সিলেট-১০ কুলাউড়া ও ফরিদপুর-১৭ নড়িয়াতে উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। উপ-নির্বাচনে দু’টি আসনেই আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী বেসরকারীভাবে নির্বাচিত বলে ঘোষিত হয়েছেন।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, ফরিদপুর-১৭ আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য জনাব নূরুল হক আততায়ীর গুলিতে নিহত হওয়ার ফলে এবং সিলেট-১০ কুলাউড়া আসনের সদস্য জনাব মোস্তাকিম চৌধুরী জাপানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হওয়ায় ঐ দু’টি আসন শূন্য হয়। গত রোববার সেই শূন্য আসন দু’টিতেই উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সর্বশেষ প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী নিঃসন্দেহে বলা যায়, শূন্য আসন দু’টিতে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এবং এতে প্রতিদ্বন্দ্বী জাসদের প্রার্থীদের চেয়ে বিপুল ভোটের ব্যবধানে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। প্রার্থী দু’জনের বিজয়ে এ কথাই পুনর্বার প্রমাণিত হলো এদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দলকে কত গভীরভাবে ভালোবাসেন এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি দৃঢ় আস্থা পোষণ করেন। নির্বাচনের খবর শুনে বঙ্গবন্ধুও সুদূর বিদেশ থেকে নির্বাচনী এলাকার জনগণের প্রতি অভিনন্দন জানিয়েছেন।
সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন দেশে আজ অভাব-অনটন আর অভিযোগের অন্ত নেই একথা সত্য। এবং একথা বঙ্গবন্ধুর সরকার ধামাচাপা না দিয়ে অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে স্বীকারও করেন। এবং তাই তাঁর সরকার অনেক অভাব-অভিযোগের স্বীকারোক্তির মাধ্যমে সেগুলো সমাধানেরও প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে এবং পরবর্তী সময়ে কিছু সংখ্যক স্বার্থান্বেষী সুযোগ সন্ধানীদের তৎপরতার ফলে দেশে একটা অস্থিতিশীল অবস্থার উদ্ভব হলেও তা ক্রমান্বয়ে ধীরে ধীরে অবসার হ’তে চলেছে। আমরা আশা করি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বর্তমানে বিরাজিত প্রতিকূল অবস্থার নিশ্চয়ই অবসান ঘটবে। এবং সেজন্য প্রয়োজন বঙ্গবন্ধুর হাতকে আরো শক্তিশালী ও সুদৃঢ় করা। উপ-নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আস্থাবান নব-নির্বাচিত সংসদ সদস্যদ্বয় অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর গতিশীল নেতৃত্বের সহায়ক হবেন এতে আমরা নিঃসন্দেহ। এবং সেই জন্য উপ-নির্বাচনে নব-নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্যদ্বয়কে আমরাও স্বাগত জানাচ্ছি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক