You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ২০শে অক্টোবর, শনিবার, ৩রা কার্তিক, ১৩৮০

বঙ্গবন্ধুর জাপান সফর সফল হোক

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গত পরশুদিন এক সপ্তাহের রাষ্ট্রীয় সফরে জাপান গিয়েছেন। জাপান যাওয়ার প্রাক্কালে ঢাকা বিমানবন্দরে তিনি বলেছিলেন বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা নিয়ে আমি জাপান চলেছি। আমি আশা করি আমাদের উভয় দেশের সম্পর্ক আরো দৃঢ় ও সহযোগীতা মূলক হবে। জাপান পৌঁছানোর পর তোকে বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে বিপুল সংবর্ধনা দেওয়া হয়। রাতে জাপান বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতির পক্ষ থেকে তাকে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ভোর সভায় ভাষণে বঙ্গবন্ধু সকল প্রকার ক্ষুধা, দারিদ্র্য, ও ব্যাধির বিরুদ্ধে পরিকল্পিত সংগ্রাম জানানোর জন্য বিশ্বের ধনী দরিদ্র সব শ্রেণীর দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। ধ্বনি ও দরিদ্র এই উভয় শ্রেণীর রাষ্ট্রের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া ব্যাধি, রোগ, দারিদ্র্য ও ক্ষুধা থেকে বিশ্বমানবতাকে নিষ্কৃতি দেওয়া সম্ভব নয়। তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পারস্পারিক উন্নয়ন সাধন ও বিশ্বশান্তিতে নিশ্চিতকরণের জন্য কাজ করে যাওয়ার পক্ষে অভিমত পোষণ করেন। তিনি এশিয়ার শান্তি নিরাপত্তা ও প্রগতির স্বাস্থ্যের জাপান বাংলাদেশের ভূমিকার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন-এশিয়া মহাদেশের শান্তি ও প্রগতির জন্য জাপান-বাংলাদেশ একই প্রকার চিন্তা করে। বাংলাদেশের উন্নয়নের কাজে জাপান অর্থনৈতিক ও কারিগরি সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসবে বলে আমাদের প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেছেন।
আমরা ইতিপূর্বেও বলেছি বঙ্গবন্ধুর জাপান সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক কারণে না হলেও আমাদের দেশের কারিগরি উন্নয়নে জাপানের সহযোগিতা অবশ্যকতা অনীস্বকার্য। অন্যদিকে এশিয়ার শান্তি ও নিরাপত্তার প্রশ্নে উভয় দেশের সম্পর্ক দৃঢ় ও মজবুত হওয়া আবশ্যক। এশিয়ার মধ্যে শুধু নয় বিশ্বের মধ্যে একটি উন্নয়নশীল দেশ জাপান। তার কারিগরি ও কৃষি উন্নতির চরম শীর্ষে উন্নীত হয়েছে। আমাদের দেশ যেহেতু কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির দেশ সেহেতু এর সার্বিক উন্নয়নের জন্য জাপানের সহযোগিতা প্রয়োজন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী জাপান সফরের মাধ্যমে সহযোগিতার আশ্বাস নিয়ে আসবেন বলে আমরা মনে করি।

সোজা আঙ্গুলে ঘি ওঠে না

দীর্ঘদিনের তিক্ত অভিজ্ঞতার কষাঘাতে জর্জরিত ঐক্যবদ্ধ আরব জগৎ আজ একথা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে যে, বাঁদরের পিঠে ভাগকারী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী ও তার দলের প্রকৃত শায়েস্তা করতে হলে শুধুমাত্র কূটনৈতিক ও সামরিক শক্তি প্রয়োগ করলে চলবে না। এজন্য অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টির যথেষ্ট প্রয়োজন আছে।
তাই বিগত ১৬ই অক্টোবর পারস্য উপসাগরীয় তেল উৎপাদনকারী দেশ (সৌদি আরব, ইরাক, ইরান, কুয়েত, আবুধাবি, ও বাহারাইন) কুয়েতে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে মিলিত হয়ে সম্মিলিত ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে এখন থেকে আরবের তেলের মূল্য শতকরা ১৭ ভাগ বৃদ্ধি করা হল। আরবের স্বচ্ছ অশোধিত তেলই অন্যান্য সমস্ত অশোধিত তেলের মান নির্ধারক। সুতরাং অন্যান্য ধরনের তেলের মূল্য বেড়ে যাওয়ার ফলে আরবের তেলের মূল্য শতকরা ৫০ থেকে ৬৫ ভাগ বৃদ্ধি পাবে।
অবশ্য, ঠিক এই মুহূর্তে আরব দেশগুলো সর্বতোভাবে তেল সরবরাহ বন্ধ করবে না ঠিকই, তবে ইসরাইল সমর্থক দেশগুলোর চালান সম্পূর্ণ বন্ধ করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই হবে মূল লক্ষ্য। মধ্যপ্রাচ্যের আরব-ইসরাইল সংঘর্ষে তেলকে যাতে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যায় একমাত্র এজন্যই আরব রাষ্ট্রগুলোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সৌদি আরব ইতিমধ্যেই শতকরা দশভাগ তেল সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে এবং ইসরাইলকে আমেরিকা অস্ত্র সরবরাহ করা বন্ধ না করলে তেলের চালান সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়া হবে বলে হুমকি দিয়েছে। আবুধাবিও যুক্তরাষ্ট্রকে তেল সরবরাহ করা বন্ধ করে দিয়েছে। আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলো যে পরিমাণ তেল আমদানি করে তার শতকরা ১৫ থেকে ২৫ ভাগ আবুধাবি সরবরাহ করে থাকে।
এদিকে তেল সম্পর্কে আরব রাষ্ট্র সমূহের এ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের একবারে “ত্রাহি মধুসূদন” অবস্থা। গত ১৮ তারিখ থেকে যুক্তরাষ্ট্র আভ্যন্তরীণ তেল খরচ হ্রাস করেছেই, তার ওপর রেশন ব্যবস্থাও। চালু করেছে তেল সরবরাহকারী আরব রাষ্ট্রসমূহ জানিয়েছে যে, সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা ও ইসরাইল সমর্থকদের বিরুদ্ধে তাদের এটা একটি প্রাথমিক প্রয়াস মাত্র।
এ সিদ্ধান্তের জাপানেও বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। একটি জাপানি সংবাদ সংস্থা খবরে জানা গেছে যে, এ সিদ্ধান্তে জাপান অত্যন্ত উদ্বিগ্ন।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের চিরাচরিত মুখোশ আবার নতুন করে বিশ্বের দরবারে নগ্নভাবে বিধৃত হয়েছে। আমেরিকার চেয়েছিল মধ্যপ্রাচ্যের তেল সরবরাহকারী দেশগুলোর উপর ইসরাইলকে চাপিয়ে দিয়ে বরাবরের জন্য একটা রাজনৈতিক কৌশল সৃষ্টি করে রাখবে এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল সরবরাহ নিশ্চিত করে রাখবে। তাই হাতিয়ার হিসেবে তারা আরবের আভ্যন্তরীণ বিরোধ কে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু বীর আরবরা সাম্রাজ্যবাদীদের বিষদাঁত ভেঙ্গে চুরমার করে দিচ্ছে। সব দিক থেকেই সমস্ত ঘটনা নাটকীয় ভাবে সংগ্রামী আরবদের স্বপক্ষে চলে যাচ্ছে। তাই মার্কিন মামুর জোরে বলিয়ান ইসরাইল আজ দারুণভাবে বিপন্ন।
কয়েকটি ঘটনার বিচার করলেই সমগ্র যুদ্ধ পরিস্থিতির বর্তমান আসল রূপ জানা যাবে। যেমন বিভিন্ন সেক্টরের আরবদের বিপুল সাফল্য, আরবদের স্বপক্ষে নিয়ত বর্ধমান প্রচন্ড বিশ্বজনমত, তেল সরবরাহ বন্ধের সিদ্ধান্ত, আমেরিকায় তেল রেশন প্রথা চালু, যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বিমান ঘাঁটি ব্যবহারে যুক্তরাজ্যের অস্বীকৃতি-সব মিলে এক এলাহি কান্ড। যুক্তরাষ্ট্রের “ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি” অবস্থা আর পরধনলোভী ইসরাইলের “আল্লাহ বাঁচালে বাঁচি” অবস্থা পৃথিবীর কাছে সত্যিই হাস্যাস্পদ। ইরান অবশ্য তেল কে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবেনা ভেবেছে।
চারদিকে প্রচণ্ড চাপে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী গোল্ডামায়ার ৬৭ সালের দখলকৃত আরব ভূমি শর্তসাপেক্ষে ছেড়ে দিতে রাজি হয়েছেন। নিক্সন ওয়াশিংটনে শান্তির বৈঠক করছেন। সমস্ত পৃথিবীর চাপ দিচ্ছে ইসরাইল ও আমেরিকার ওপর। আমরাও চাই ৬৭ সালের বিধান কার্যকর করা হোক। তাহলে লক্ষ-লক্ষ যেসব ফেলিস্তিনি আরবকে নিজ ভূমি থেকে উৎখাত করা হয়েছে এবং যারা বিগত ২৫ বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধ করে যাচ্ছে তারা অচিরেই আপন আপন ঘরে ফিরে যেতে পারবে-শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।
আমরাও চাই সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার শুভবুদ্ধির উদয় হোক-ইসরাইল তার অন্যান্য গোঁ পরিহার করুক, পৃথিবীতে শান্তির পথ সুগম হোক, সভ্যতা বেঁচে উঠুক।
তা না হলে, বীর আরব জাতি একবার যখন বুঝতে পেরেছে যে সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠবে না তখন অবস্থা বিশেষ সুবিধের হবেনা এটা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে।

একটু খানি বাসা

গ্রামবাংলায় গৃহনির্মাণের সরঞ্জামাদি তীব্র অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে ঢেউটিন আর কাঠের অভাবটাই বেশি। বাঁশ, বেত আর শণ আজকাল ব্যবহারই হয় না-যেহেতু এগুলা এখন আর জন্মেওনা। গৃহনির্মাণ আজকাল এ দেশের বড় বড় সমস্যা গুলোর মধ্যে অন্যতম। বন্যা-বাত্যা আর নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার এই দেশ এবং এই দেশের মানুষ। প্রায় প্রতিবছরই বানের জলে তাদের ঘর ভাসে-ঘূর্ণি বাত্যা আর সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে তাদের আবার বিধ্বস্ত হয় ধ্বংস হয়ে মাটির সাথে মিশে যায় ঘরবাড়ি সব কিছু। তদুপরি মাত্র বছর দুয়েক আগে একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বর সেনারা এ দেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামে হামলা চালিয়েছে ওদের দুষ্কর্মের দোসর রাজাকার, আলবদর, আল-শামস আর শান্তি কমিটির দালালদের সহযোগিতায় মানুষের ঘর ভেঙেছে বাড়ি পুড়িয়েছে ছত্রখান করে দিয়েছে সবকিছু। সমস্যা-সংকুল দেশে গৃহ নির্মাণের সমস্যা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ‘ধন নয় মান নয়, এতোটুকু আশা’ নিয়ে ‘ধরণীর এক কোনে একটু খানি বাসার’ স্বপ্নও যেন উঠে গেছে।
আগের শণ, বাঁশ আর বেত ছিল গ্রাম-দেশে গৃহ নির্মাণের প্রধান সরঞ্জাম। অবস্থাপন্ন তো বটেই যেকোনো বাড়ির পাশেই একটি শণের ভিটি, একটি বাঁশ ঝাড় এবং একটি বেত ঝাড় অবশ্যই দেখা যেত। প্রতিটি বাড়ির পাশে নারকেল-সুপারি-আম-জাম সহ আরো নাম না জানা কত গাছ গাছরার ছোট ছোট বনানী বা বাগিচা তো একটা স্বাভাবিক নিয়মেই ছিল। এসব বাগিচা একদিকে যেমন ছায়া দিয়ে বাড়ি তো বটেই গ্রামকেও ছায়াঘেরা করে রাখতো তার সাথে সাথে করে সনালুর গাছ ব্যবহৃত হতো ঘরের কাজ হিসেবে। নারকেল সুপারি তো গায়ের মানুষের নিত্যদিনের সাথী। কিন্তু এখন আর তা নেই। ‘সেদিন গিয়েছে-শিয়রের কাছে কহিছে কালের ঘড়ি।’ আজ গ্রামকে গ্রাম খুঁজলেও শণের ভিটি, বেতের ঝাড় চোখে পড়ে না। বাঁশের ঝাড় যাও দু-একটা পাওয়া যায় তাও মুমূর্ষ অবস্থায়। পারিবারিক বাগিচায় হয়ত বা দুই-একটা সুপারি গাছ চোখে পড়ে। আগের মতো ঘন গাছ-গাছালি আর নেই। অনেক গাছই জ্বালানি হয়ে সর্বভূকের পেটে গেছে। নতুন করে লাগানোর উদ্যোগ নেই।
তাই আজ যান্ত্রিক নির্ভরতা গায়ের গৃহনির্মাণের এসে গেছে সর্বতোভাবে। টিনের চাহিদা ও প্রচলন আজ সর্বত্র। কিন্তু সে টিনও এখন কেবল দুমূল্যই নয়-দুষ্প্রাপ্য বটে৷ টি.সি.বি’র হাতে ২০ হাজার টন ঢেউ টিন রয়েছে। প্রয়োজন আরো ২৫ হাজার টনের। অন্যদিকে স্বাধীনতার পর যত টিন আমদানি হয়েছে টি.সি.বি’র অকর্মণ্যতায়, ডিলারদের অসাধুতায় তা সঠিকভাবে বন্টন হয়নি। বাংলাদেশ জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে টিন আনে। এবার সেই উদ্যোগও নেই। তাছাড়া গৃহনির্মাণের অন্য উপকরণ লোহার রড, সিমেন্ট, ইট তো এখন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। মোটকথা, সবকিছু মিলিয়ে সমস্যা এখন এক ভয়াবহ রূপ নিতে যাচ্ছে। কতৃপক্ষ যদি সমস্যা সেই ভয়াবহতা উপলব্ধি করে শীগগিরই কোন সমাধান খুঁজে বের করেন, তবে হয়তো কিছুটা রেহাই পাওয়া যেতে পারে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!