You dont have javascript enabled! Please enable it! 1975.01.11 | বাংলাদেশ মিলিটারী একাডেমীর ক্যাডেটদের প্রথম শিক্ষা সমাপনী কুচকাওয়াজে জাতির পিতা - সংগ্রামের নোটবুক

আপনারা আমার জনগনের বাহিনী

গত ১১ ই জানুয়ারী ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিন বাংলাদেশ মিলিটারী একাডেমীর প্রথম জ্যান্টেলম্যান ক্যাডেটদের শিক্ষা সমাপনী কুচকাওয়াজ জাতির পিতা প্রধান মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সালাম গ্রহণ করেন এবং সেরা ক্যাডেটদের পুরস্কৃত করেন। ময়নামতি সেনা নিবাসের মনোরম উপত্যকায় ক্যাডেটদের এই পাণবন্ত আনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বিদায়ী ক্যাডেটদের উদ্দেশ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ প্রদান করেন। তিনি সেনা বাহিনীকে মজুতদার, চোরাচালানকারী, সমাজ বিরোধী ও দুস্কৃতিকারী নির্মুল করার অভিযাবে নিষ্ঠার সঙ্গে আপন দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে জনগণের আশা আকাক্ষার সঙ্গে পূর্ণ একান্ত হওয়ার আহবান জানান।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, জনগণের প্রতি গভীর ভালোবাসা নিয়ে, শ্রদ্ধা নিয়ে সমগ্র জাতির সেবায় আপনাদের আত্ননিয়োগ করতে হবে। পূর্ণ শৃঙ্খলার সাথে পালন করে যেতে হবে জাতীয় দায়িত্ব। আপনারা জনগণের বাহিনী, পাকিস্থানী বাহিনীর পেশাদার সৈনিক আপনারা নন।

বঙ্গবন্ধু বলেন, জনজীবনে অপরিসীম দুর্ভোগ ও বিপর্যয় সৃষ্টির অপচেষ্টায় লিপ্ত মুনাফাখোর, মজুতদার, চোরাচালানী, দুর্নীতি পরায়ণ ব্যাক্তি ও সমাজ বিরোধীদের উপর চরক্ম আঘাত হানতে তার সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ।

বঙ্গবন্ধু দ্ব্যার্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন, আমাদের সেনা বাহিনী শিক্ষা ও সরঞ্জাম পেলে বিশ্বের যে কোন সুসজ্জিত বাহিনীর মোকাবেলা করতে সক্ষম।…………… বাংলাদেশের মালিক আজ জনসাধারণ, তাই বাংলার মাটিতে মিলিটারী একাডেমী স্থাপন করা সম্ভব হয়েছে। ইনশাল্লাহ এমন একদিন আসবে যেদিন শুধু দক্ষিল পূর্ব এশিয়া নয়, সারা বিশ্বের লোক এই একাডেমী দেখতে আসবে।

বিদায়ী ক্যাডেটদের তিনি বলেন, তোমাদের এক পর্যায়ের শেষ হয়েছে, এখন আরেক পর্যায়ের শুরু। সেই পর্যায়ের দায়িত্ব অনেক বেশি। তোমাদের দায়িত্ব জ্ঞান থাকা দরকার। এটা না হলে মানুস হওয়া যায় না।

তিনি আরো বলেন, আমি প্রধানমন্ত্রী হসাবে বলছি না, জাতির পিতা হিসাবে বলছি। প্রধানমন্ত্রী অনেক আসবে, কিন্তু জাতির পিতা একজনই হয়। তোমরা আমার প্রথম ক্যাডেট। আমার মুখ কালো করিও না। তুমি যদি হুকুম না মানো, ত্যোমার আদেশ কেও মানবে না।

বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলার সম্পদ আর কেও লুট করতে পারবে না। বাংলার সম্পদ বাংলাই থাকবে। বিডি আর এর সহযোগিতায় সেনাবাহিনী সীমান্তের চোরাচালান ৯৫ ভাগ বন্ধ করে দিয়েছে। বহু কষ্ট সহ্য করে বিদেশ থেকে সাহায্য আনা হয় কিন্তু দেশ ও সমাজের শত্রুতা তা বিদেশে পাচার করে দেয়। সহ্যের সীমা অতিক্রান্ত হয়েছে। এখন কঠোর আঘাত হানতে হবে।

দুষ্ককৃতিকারীদের সমালোচনা করে বঙ্গবন্ধু বলেন, কেমন করে লোক নিজের দেশের মাতৃভূমিকে পয়সার লোভে বিক্রি করতে পারে ভাবে আমি শিউরে উঠি। অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে হবে, চরম আঘাত হানতে হবে।

ক্যাডেটদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলেন, আমার আদেশ মনে রেখ। আমি তোমাদের জন্য দোয়া করব। দেশবাসী তোমাদের জন্য দোয়া করবে।

ইতিপূর্বে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা সংগ্রামে যে সকল বীর সেনানী আত্নাহুতি দিয়েছেন, তাদের প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।

অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব মনসুর আলী, বাণিজ্য ও বৈদেশিক বাণিজ্য মন্ত্রী খন্দকার মোস্তাক আহমেদ, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব জিল্লুর রহমান, তথ্য ও বেতার প্রতিমন্ত্রী জনাব তাহের উদ্দিন ঠাকুর, বন ও পশু পালন প্রতিমন্ত্রী জনাব রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জনাব নুরুল ইসলাম মঞ্জুর। সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীর চীফ অফ স্টাফ,উচ্চ পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক অফিসার সহ কয়েকজন কূটনৈতিক যোগদান করেন।

চির উন্নত মম শীর

৩ টা বেজে ৫৭ মিনিট শহীদ লেঃ কর্ণেল এম আর চৌধুরী স্টেডিয়ামে চলছে প্রস্তুতির শেষ পালা। ব্যন্ড বেজে উঠল। ব্যান্ডে বাজছে চির উন্নত শীর, শীর নেহারি আমার। ধীরে ধীরে পাহাড়ের ঢালু থেকে সমতলে উঠে এলেন ক্যাডেটরা। বাংলাদেশ সামরীক একাডেমীর প্রথম ক্যাডেট দল। রিহার্সেল চলছে সমাপনী কুচকাওয়াজের। বিকালের পড়ন্ত রোদে তখন উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে ৭৯ জন ক্যাডেটের দীপ্ত মুখোচ্ছবি।

এ হচ্ছে ১ বছর পরের ঘটনা। এই ১ বছরে অনেক কিছু ঘটেছে। অনেক পরিবর্তন এসেছে একাডেমীর জীবনে। প্রথম যখন গিয়েছিলাম, তখন ছিলো গুড়ের চা। গুড়ের চা দিয়ে অতিথি আপ্যায়নে তাদের কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিলো না, কিন্তু ছিলো আন্তরিকতা। সেই আন্তরিকতা, সেই নিয়ম শৃঙ্খলা ঠিক তেমনি আছে। এক বছরের ব্যবধানে একাডেমী সয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে। সামরীক একাডেমীর প্রতিটি ব্যক্তি আজ গর্বিত। তাদের ১ বছরের সাধনা বাস্তবে রূপায়তীত হয়েছে। এই একাডেমীর প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ক্যাডেটরা যোগ দিচ্ছেন সেনা বাহিনীতে অফিসার হিসাবে। অনেকেই হয়ত আর এই একাডেমীতে ফিরে আসবে না। কেও কেও আসবেন শিক্ষক হিসাবে। কিন্তু পিছনে থাকবে স্মৃতিময় জীবন।

জাতীয় জীবনে সামরিক একাডেমী এক বিশেষ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। জাতীয় গঊরব, সার্বভৌমত্বের প্রতিক যে কোন ভাবেই অভিহিত করা যায় সামরিক একাডেমীকে। সামরিক একাডেমীর প্রশিক্ষকরা মনে করেন, সামরিক একাডেমী হচ্ছে আমাদের জাতীয় গৌরব। সামরিক একাডেমী ভিন্ন কোন দেশের সার্বভৌমত্ব সম্পূর্ণ হয় না। সামরিক একাডেমীর অভাবে সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী গড়ে তোলা যায় না।

যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে সেনা বাহিনী গড়ে উঠেছে যুদ্ধতর পরিস্থিতিতে সে সেনাবাহিনীর জন্য সমস্যা ছিল সাংগঠনিক। সাংগঠনিক সমস্যা কাটিয়ে উঠে, সামরিক একাডেমী প্রতিষ্ঠা এবং সে একাডেমীর প্রথম ক্যাডেট দলের সমাপণী কুচকাওয়াজ নিঃসন্দেহে অগ্রগতির পদক্ষেপ।

শুরুতে ছিল বিস্তর সমস্যা। বাসস্থান থেকে শুরু করে প্রতিটি সমস্যাকে দৃঢতার সঙ্গে মোকাবেলা করেছেন একাডেমীর অফসাররা। ধরতে গেলে বিরাট শূন্যতার মধ্য দিয়ে তাদের যাত্রা শুরু হয়েছে। ছিল আত্নপ্রত্যয়।

সামরিক একাডেমীর যতজন প্রশিক্ষকের সঙ্গে কথা হয়েছে সবাই বলেছে আমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব আমরা পালন করব। সেনাবাহীনীর প্রতি জনগণের যে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রয়েছে তাদের কর্ম জীবনে তাই হচ্ছে প্রেরণা।

একাডেমী জীবন, শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে লেখার কিছুই নেই। প্রতিটি সামরীক একাডেমীর জীবন যাত্রা শিক্ষাব্যবস্থা প্রায় অভিন্ন। গুনগত দিক দিয়ে আমাদের সামরিক একাডেমী হয়ত অন্য একাডেমীর সমমানের হবেনা, কিন্তু সে দূর্বলতা জনশক্তিগত দূর্বলতা, সম্পদগত দূর্বলতা। একাডেমী পরিচালনার ব্যাপারে দক্ষ জনশক্তি সম্পর্কে আমাদের প্রশ্ন ছিলঃ আপনারা কি বিদেশ থেকে প্রশিক্ষক আনবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন? এ প্রশ্নের জবাবে, একটু হেসে কর্ণেল মান্নাফ বলেছিলেন, সে প্রয়োজন নেই। এখানে এমন কয়েকজন প্রশিক্ষক রয়েছেন যাদের নাম করা বিদেশী সামরিক একাডেমীর অভিজ্ঞতা রয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখিত কর্ণেল মান্নাফ সেই সব প্রশিক্ষকদের অন্যতম।

সামরিক একাডেমির প্রথম এডজুটেন্ট হিসাবে যোগ দিয়েছে মেজর আনোয়ার। প্রথম যখন দেখা হয়েছিল, তখন ছিল বলিষ্ঠ সুপুরুষ। সমাপনী কুচকাওয়াজে রেহার্সেলের সময় যখন দেখা হলো তখন সেই বলিষ্ঠতা তেমনি আছে। কিন্তু গায়ের রঙ পালটে গেছে। রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে। এক বছরের কষ্ট তিনিও গ্রহণ করেছে ক্যাডেটদের সাথে।

সেনাবাহিনীর জন্য যে একাডেমী অফিসার তৈরি করেছে সে একাডেমীর প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে জানতে অনেকের ইচ্ছ করতে পারে। সামরিক বাহিনীর প্রতিটি অফিসার, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সবাই অনুভব করেছিলেন সামরিক একাডেমী প্রয়োজনের কথা।

সেই প্রয়োজনের ভিত্তিতেই ১৯৭৩ সালের নভেম্বর মাসে কুমিল্লা ক্যান্টন্মেন্টকে বির্বাচিত করা হয় সামরিক একাডেমী প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। ভবিষ্যতে একাডেমী সরিয়ে নেয়া হবে স্থায়ী এলাকায়। ৩রা ডিসেম্বর একাডেমীর অফসাররা কাজে যোগ দেন। তখন পর্যন্ত পদাধিকার বলে একাডেমীর কমান্ডার ছিলেন কুমিল্লা স্টেশনের তৎকালীন কমান্ডার কর্ণেল নাজমুল হুদা। একাডেমীর প্রশিক্ষকদের যৌথ প্রচেষ্টায় দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে।

১৯৭৫ সালের ১১ ই জানুয়ারী সেই কারণেই সমগ্র সেনাবাহিনীর জীবনে একটি আনন্দের দিন। এ দিন বাংলাদেশে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত প্রথম ক্যাডেট দলকে নিযুক্ত করা হচ্ছে সেনাবাহিনীর অফিসার কোর্সে।

এই একটি বছর চেষ্টা করা হয়েছে একজন সম্পূর্ণ মানুষ হিসাবে একজন ক্যাডেটকে গড়ে তুলতে। তাদের শেখানো হয়েছে পেশাগত জ্ঞান এমনিতেই কখনও আসেনা । কঠোর পরিশ্রম প্রগাঢ় প্রার্থনা এবং উদ্দেশ্যের ঐকান্তিকতা দিয়েই তা অর্জন করতে হয়। একাডেমীর প্রশিক্ষকগণ সবাই এ দৃষ্টিকোণ থেকেই ক্যাডেটদের শিক্ষা দিয়েছে, তারা ক্যাডেটদের কতখানি উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছেন তা প্রমাণ হবে সেনাবাহিনীর দায়িত্বপূর্ণ অফিসার হিসাবে তাদের কার্যকলাপ হিসাবে।

একাডেমীর জীবনে গৌরবময় দিন হচ্ছে সমাপনী কুচকাওয়াজের দিন। সেনাবাহিনীর চিফ অফ স্টাফ মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ এবং চীফ অফ জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডার খালেদ মোশারফের সঙ্গে আমরা যখন একাডেমীতে পৌছি তখন সমাপনী কুচকাওয়াজের প্রস্তুতি চলছে। দ্বিতীয় দিন সকালে সানাবাহিনীর প্রধানের উপস্থিতিতেই অনুষ্ঠিত হল রিহার্সেল কুচকাওয়াজ।

ব্যন্ডে যখন চীর উন্নত মম শীর বাজছে, পাহাড়ের ঢালু থেকে মার্চ করে এগিয়ে এলেন ক্যাডেটরা। তাদের পেছনেই এলেন কালারবাহী ক্যাডেটরা। ব্যান্ডে তখন বাজানো হলো জয় বাংলা। এর পরেই প্রেসিডেন্ট স্যালুট। জাতীয় সংগীতের সুরে স্যালুট করলেন ক্যাডেটরা। তারপর ইন্সপেকশন প্যারেডের সময় আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী বাজানো হলো, ট্রুথ দ্যা কালার। এর পরেই মার্চ পাসটের পালা। ধন্নে ধান্নে পুষ্পে ভরা যখন ব্যান্ডে বাজছে, তখন স্যালুটির ডায়াসের সামনে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন ক্যাডেটরা। এই পরিবেশ, একজন ক্যাডেটদের জীবনে সবচেয়ে বর্ণাঢ্য পরিবেশ। সমাপনী কুচকাওয়াজ শেষে ক্যাডেটদের চলে যাওয়ার জন্য যে পথ তৈরি করা হয়েছে পাহাড় কেটে, সেই পথ দিয়েই যখন ক্যাডেটরা চলে যান , তখন এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। ব্যান্ডে তখন বাজে স্কটল্যান্ডের একটা লোকগীতের সুর। সে সুর মনে করিয়ে দেয় রবীন্দ্রনাথের পুরানো সেই গানের কথা। মূল গানটির ভাবার্থ একই। হয়ত পুরান দিন গুলোর কথা ক্যাডেটদের মনে করিয়ে দেবার জন্যই এ ব্যবস্থা।

ধীরে ধীরে একাডেমী ব্যপ্তি লাভ করবে। একাডেমী শিক্ষা বর্ষ আরোও বিস্তৃত হবে। একটি পূর্ণাঙ্গ একাডেমী হিসাবে গড়ে উঠবে এই সামরিক একাডেমী। সামরিক একাডেমীর কর্তৃপ্পক্ষ যথার্থই চয়ন করেছেন তাদের মনোগ্রামের ভাষা। একাডেমীর স্লোগান হচ্ছে, চীর উন্নত মম শীর। যে সেনাবাহিনী দিপ্ত সাহসে উন্নত শীরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে না, সে সেনাবাহিনী গোউরব অর্জন করতে পারে না।

স্বার্বভৌমত্বকে যে দেশ শ্রদ্ধা ও মূল্য দেয়, তার কেবল সেনাবাহিনি থাকলেই চলবে না, নিজ বাস ভূমে তার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও থাকতে হবে। একাডেমীর উদ্বোধন ভাষণেও তাই প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু বলেছেন, “আমি কারো ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে চাই না এবং নিজেদের ব্যাপারেও অন্য কারোও হস্ত ক্ষেপ সহ্য করব না”। দেশের বুকে একটি সামরিক একাডেমী প্রতিষ্ঠা সেই যৌক্তিকতাই প্রমাণ করে।

সামরিক একাডেমি জীবন

আমি ………, পরম করুণাময় ………নামে সশ্রদ্ধচিত্তে দৃঢভাবে ঘোষণা করিতেছি যে, আমি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান এবং সরকারের প্রতি অকৃত্তিম বিশ্বস্ততা ও আনুগত্য ঘোষণা করিব। আমি আমার অপরিহার্য কর্তব্য মনে করিয়া সততা ও বিশ্বস্ততার সহিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চাকিরিতে আমার কর্তব্য পালন করিব। এবং আমার প্রাত জ্বল, স্থল অথবা আকাশ পথে যেখানেই যাইবার আদেশ করা হোক সেখানেই যাইব এবং আমি আমার জীবন বিপন্ন করিয়াও আমার উপর নিয়োজিত কর্তব্যরত যে কোন অফিসেরে সকল আদেশ পালন ও মান্য করিব। এই শপথ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে ১১ ই জানুয়ারী শহীদ লেঃ কর্ণেল এম আর চৌধুরী স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হলো বাংলাদেশ মিলিটারী একাডেমীর প্রথ ক্যাডেট দলের সমাপনী কুচকাওয়াজ। ৭০ জন তরুণ সেনাবাহীনির অফসার হিসাবে অভিষিক্ত হলেন।যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৪ ই জানুয়ারী, ১৯৭৪ – শেষ হলো ১১ ই জানুয়ারী ১৯৭৫।

যারা এসেছিলেন, সবাই শেষ পর্যন্ত অভিষিক্ত হতে পারেন নাই। কেও কেও বাদ পড়েছেন। সর্বত্ত সামরিক একাডেমীগুলোর এই হচ্ছে নিয়ম। যারা যোগ্যতার সঙ্গে প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করেছেন আজ তারা বিজয়ী। এবার যোগদান করবেন বিভিন্ন ইউনিটের অফিসার হিসাবে। আগামী দিনে এরাই সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিবেন।

এই একটি বছর, প্রতিটি ক্যাডেটের জীবন কেটেছে কর্মব্যস্ততার মধ্য দিয়ে। সকাল থেকে সন্ধ্যা রুটিন মাফিক জীবন যাত্রা। নিয়ম শৃংখলার বেড়াজালে আবদ্ধ জীবন। সেনা বাহিনীর জীবনটাই সুশৃংখল নিয়ম দ্বারা পরিচালিত। শিক্ষা জগতের পুরো সময়টাতে ক্যাডেটদের শেখানো হয়েছে চীর উন্নত মম শীর। এই আদর্শ শুধু বাংলাদেশ মিলিটারী একাডেমীর আদর্শই নয়, এই আদর্শ প্রতিটি ক্যাডেটেরই আদর্শ। এই আদর্শকে জিইয়ে রাখার জন্য উৎসর্গীকৃত তার সঙ্গে জীবন।

এই আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েই, প্রয়োজন হলে জীবনের বিনিময়ে হলেও মোকাবেলা করতে হবে শত্রুকে। এ একাডেমী থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে যে সব ক্যাডেটরা বেড়িয়ে যাচ্ছেন, তাদের নেতৃত্ব পোষাকনির্ভর নয় বরং অভিজ্ঞতা, শিক্ষা, জ্ঞান, দক্ষতা এবং পেশাগত গর্বের উপর নির্ভরশীল।

সামরিক একাডেমীর জীবনে শিখতে হয় অনেক কিছু। মানসিকভাবে এবং দৈহিকভাবে তৈরি হতে হয় সকল প্রতিকূল অবস্থাকে মোকাবেলা করার জন্য।

পূর্বের আকাশ লাল হয়ে ওঠার সাথে সাথে শুরু হয় একজন ক্যাডেটের জীবন। এই নিয়ম সৈনিকের জীবনের চিরাচরিত নিয়ম। গৃষ্মকালের সকাল ৫ টা থেকে রাত সাড়ে দশটা , শীতকালে সকাল সাড়ে পাচটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত কর্মব্যবস্ত দিন কাটে একজন ক্যাডেটের। সারা বছরে সব মিলিয়ে ছুটি মিলেছে চার সপ্তাহ।

সকালে বিউগল বাজার সাথে সাথে উঠে যেতে হয় বিছানা থেকে। তার পর শুরু হয় রুটিন বাঁধা জীবনঃ সজ্জা ত্যাগ ৫ টায় (গ্রীষ্মকাল), সজ্জা ত্যাগ ৫.৩০ মিনিট (শীতকাল), প্রস্তুতি গ্রহণ ১ ঘণ্টা, প্রাতঃকালীন ফলোইন ৬ টা (গ্রীষ্মকালে)
এবং পোষাক পরিদর্শন ৬.৩০ মিনিট (শীতকাল)
৬.৩০ মিঃ – ৭.৩০ মিঃ
ড্রিল/শরীরচর্চা ৭টা – ৭.৩০মিঃ
৭.৩০ মিঃ – ৮.৩০মিঃ
প্রাতঃরাশ ৮.৩৫মি – ৯.৩৫ মিঃ
ক্লাশ ৯.৩৫মিঃ – ১.৩০ মিঃ (গ্ররীষ্মকাল)
৯.৩৫মিঃ – ২তা (শীতকাল)
মধ্যাহ্ন ভোজ। অবসর গ্রহণ বিরতি – ২ ঘণ্টা
উদ্যান চর্চা – ৩০মিঃ
খেলাধুলা – ৪০ মিঃ
বিরতি –
ক্লাসে বসে পরাশুনা – ১ ঘণ্টা
নৈশ্যকালীন ড্রস
পএয়াশুনা –
বাধ্যতামূলক সজ্জা গ্রহণ রাত ১০টা শীতকাল রাত ১০.৩০মি গ্রীষ্মকাল।

এই হচ্ছে সামরিক একাডেমীতে একজন ক্যডেতের প্রতিদিনের জীবন। সপ্তাহে ৪ দিন নৈশভোজে একজন আফিসার উপস্থিত থাকেন। এই নৈশ্যভোজ গুলো অন্যদিনের মতই কিন্তু আনুষ্ঠানিক নৈশ্যভোজ হিসাবে অভিহিত।

এই রুটিন মাফিক জীবন ছাড়াও সামরিক একাডেমীর একজন প্রশিক্ষণ গ্রহণ রত ক্যাডেটের জীবনে আরেক টি দিক রয়েছে সে জীবন অনেক বেশি কষ্ট সাধ্য। সে জন্য প্রয়োজন ধৈর্য, মনোবল এবং দৈহিক শক্তি।

সামরিক একাডেমী জীবন শুধুমাত্র শরীল চর্চা ও ক্লাসে যোগদানের মধ্য দিয়ে সীমাবদ্ধ থাকে না। এর বাইরেও যে দিকটি রয়েছে, তা হলো কলমে যুদ্ধ বিদ্যা শিখা। সামরিক একাদেমীর একজন ক্যাডেটিওকে ৮৫ মেইল দৌড়াতে হয়। অন্যান্য মানসিক এবং দৈহিক পরিশ্রম। তাই সমাপনী কুচইকাওয়াজে যারা এক বছর পর সমাবীত হয়েছিলেন, তাদের চেহারাও ১ বছর আগের কোন ছাপ ছিল না। রোদে পুরে অনেকেই কালো হয়ে গিয়েছেন, সেই সঙ্গে প্রশিক্ষকরাও।

সামরিক একাডেমি থেকে প্রথম যে ক্যাডেট দল বেরোলেন, তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ ছিল ইনফ্যান্টটির প্রশিক্ষণ ঘেষা। এই প্রশিক্ষণের অন্তর্ভুক্ত ছিল অস্ত্রের ব্যবহার, যুদ্ধ বিদ্যার কৌশল, শত্রু প্রতিহত করা, গোয়েন্দা বৃত্তি, নিকট বর্তি যুদ্ধ এবং সঠিক ভাবে আক্রমনের লক্ষ্যে উপর আঘাত হানা। যারা পাশ করে বের হচ্ছেন অধিকাংশই সৈনিক অফিসার হিসাবে যোগ দিবেন পদাতিক বাহিনীতে।

একাডেমীর জীবনে পাঠ্য বিহশয়ক শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে যাতে একজন ক্যাডেট অফিসার হিসাবে নিজেকে সঠিক ভাবে তুলে ধরতে পারে। ইংরেজী এবং বাংলা ভাষা বিষয়ক জ্ঞান শুধু লেখার মধ্যেই সীমাবন্দধ নই, সেই সঙ্গে রয়েছে উভয় ভাষাতেই কথা বলা, তর্ক করার পারদর্শিতাই অর্জন।

ক্যাডেটদের দৈনন্দিন জীবনে বৈচিত্রিতা আনবার জন্য রয়েছে বিভিন্ন বিতর্ক প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং ক্রিয়া প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা। রবিবার দিন অন্য সকলের মত ক্যাডেটরাও সাপ্তাহিক ছুটি ভোগ করেন।

একাডেমীতে যোগ দানের কিছু দিন পর নিজেদের কল্যাণ ও যৌথ মানসিকতা সৃষ্টি করার জন্য ক্যাডেটদের ৩ টি প্লাটুনে ভাগ করা হয়। প্রতিটি প্লাটুনে ক্যাডেট সংখ্যা সমসংখ্যক। শিক্ষাত্রী ত্রের মধ্যে থেকেই আকজন নির্বাচিত হন প্লাটুনের কমান্ডার হিসাবে। সামগ্রিক ভাবে ৩ টি প্লাটুনের নেতৃত্ব দেন ৩ জন অফিসার ইন্সট্রাক্টর।

প্রথম যে দলটি সামরিক একাডেমীতে প্রশিক্ষণ শেষে অফিসার হিসাবে বেরিয়ে এলেন, তাদের প্রশিক্ষণের সময় ছিল মাত্র ১ বছর। এই ১ বছর সময়ের মধ্যে তাদের যথা সম্ভব প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। তাদের জন্য যে পাঠক্রম তইরি হয়েছে তা অন্যান্য সামরিক একাডেমী গুলোর পাঠক্রমের তফাৎ শুধু এক জায়গায়, এই পাঠক্রম জাতীইয় আশা আকাঙ্ক্ষা ও আদর্শের আলোকে রচিত। প্রতিটি সামরিক একাডেমীর পাঠক্রম এ দৃষ্টিকোণ থেকেই তৈরি হয়ে থাকে।

এদের চাকুরিজীবনও শুরু একাডেমীর প্রথম দিন তেকেই। সামরিক বাহিনীর একজন আফিসারের জীবনের সাথে অত্যন্ত ভাবে জড়িত থাকে একাডেমীর জীবন। একাডেমী জীবন থেকে শুরু হয় সামরিক বাহিনীর জীবন। এই সময় হচ্ছে হাতে কলমে শেখার সময়। তাই একাডেমীর জীবন কোন অফিসারই সহজে ভুলে যেতে পারেন না। একজন সামরিক বাহিনির অফিসারের চেতনা অবচেতনে মনের অনেক ক্ষানিক ধরে থাকে একাডেমী জীবনের স্মৃতি।

একাডেমীর প্রশিক্ষণের সময় সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটার উপর গুরুত্ব আরোপ করে তা হলো চরিত্র গঠন। একজন অফিসারের জন্য প্রতিনিয়ত প্রয়োজন দায়িত্বজ্ঞ্যান এবং স্বার্থ ত্যাগের মানসিকতা। চারিত্রিক দৃঢ়তা না থাকলে এ পেশায় টিকে থাকা সম্ভব নয়। একটি বছর ক্যাডেটদের যা শেখানী হয়েছে দক্ষতা এবং জ্ঞানের চেয়েও এটি গুরুত্বপূর্ণ।

এক জানুয়ারী থেকে আরেক জানুয়ারী সামরিক একাডেমী জীবনের প্রথম বছর প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত প্রথম ক্যাডেট দলের জীবনে স্মরণীয়। যারা প্রশিক্ষণ শেষে সেনাবাহিনীতে যোগ দিলেন, অনেক প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে তারা কাজ করেছেন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন, এই প্রথম দলে রয়েছেন মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ক্যাডেট। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এই একটি বছর তারা কাটিয়েছে এক কাতারে সৈনিক হিসাবে।

নাম ধরে বলতে গেলে দীর্ঘ তালিকা তৈরি করতে হবে। সংযোজীত হবে সব মিলিয়ে ৭০ টয়ি নাম। এদের সবাই সমান যোগ্যতা দেখাতে পারেন নি। তার চেয়েও বড় কথা হলো ’৭৪ এর ১৪ই জনাউয়ারী যারা অসামরিক পোষাকে এসেছিলেন সামরিক একাডেমীতে ’৭৫ এর ১১ই জানুয়ারী তারাই দীপ্ত পদভারে বেরিয়ে এলেন নতুন মানুষ হিসাবে দীপ্ত সৈনিক অফিসার হিসাবে।

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/02/1975.01.17-bichitra.pdf” title=”1975.01.17 bichitra”]