বাংলার বাণী
ঢাকা: ১৫ই অক্টোবর, সোমবার, ২৮শে আশ্বিন, ১৩৮০
যুদ্ধের ভয়াবহতা বিশ্বশান্তির বিরুদ্ধে হুমকি হতে পারে
মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ ক্রমান্বয়ে সম্প্রসারিত হচ্ছে। এ কারণে বিশ্বের বিবেক সম্পন্ন মানুষ মাত্র উদ্বেগাকুল হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের হয়ে অতিমাত্রায় নাক গলানোর কারণে মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। যুদ্ধ শুরুর দ্বিতীয় দিনেই মার্কিন তার ষষ্ঠ নৌ-বহর প্রেরণ করেছে মধ্যপ্রাচ্যের অভিমুখে। গত কয়েক দিনের সংবাদ, মার্কিন ফ্যান্টম বোমারু বিমান সিরিয়ার ওপর বোমা বর্ষণ করেছে। গত দু’দিনের সংবাদ অনুযায়ী আশঙ্কা করা হচ্ছে যে, ইসরাইল শেষ পর্যন্ত প্রভু কর্তৃক আণবিক বোমা নিক্ষেপ করতে পারে। আরব রাষ্ট্রগুলোর ঐক্য দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। শেষ অবধি জর্ডান ও সৌদি আরব ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যোগদানের কথা ঘোষণা করেছে। এদিকে জাতিসংঘের বার কয়েক মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির উপর জরুরি বৈঠক আহ্বান করে সিদ্ধান্ত ছাড়াই মুলতবি রাখতে হয়েছে। মূলত পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে এসে গেছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আর যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে এসে জাতিসংঘের মাধ্যমে সমঝোতার ডাক দেয়া সম্ভব নয়। যুদ্ধের এই ধরনের ক্রমপ্রসারতায় আমরা আতঙ্কিত। কেননা আমরা মর্মে মর্মে চালিয়ে যুদ্ধে একটি জাতির কি পরিমান ক্ষতি সাধিত হয়। কি পরিমাণ প্রাণ ও সম্পদের বিনষ্টি ঘটে। জীবন নিয়ে হোলি খেলার নিরসন আমরা চাই। কিন্তু একটি ন্যায় সঙ্গত বা সম্মানজনক সমাধানের কথা আমরা না বলতে পারি না। প্যালেস্টাইনদের মুক্তির জন্য আরব রাষ্ট্রগুলোর এ লড়াই। অন্যদিকে ১৯৬৭ সালে ইসরাইল অন্যায় ভাবে জোর করে আরব এলাকার দখল করে রেখেছে। জাতিসংঘ এ ব্যাপারে সকল প্রকার নৈতিক চাপ সৃষ্টি করেও ইসরাইলের গোয়ার্তুমির কাছে ব্যর্থ হয়েছে। এবারের যুদ্ধে আরব জাহানের একটিমাত্র পণ দখলকৃত এলাকার এক ইঞ্চি জমিও শত্রু কারায়ক্ত থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে। আর প্যালেস্টাইন মুক্তি নিশ্চিত করতে হবে। এতে করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আঁতে ঘা লেগেছে। সে প্রত্যক্ষভাবে ইসরাইলের হয়ে মুক্তিকামী আরো অন্যান্য আরব সমর্থক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। এবং আমেরিকার এই মানবতাবিরোধী যুদ্ধের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে মোড় নিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আরব রাষ্ট্রগুলোর ন্যায় সঙ্গত দাবীর সমর্থনে সোভিয়েত সামরিক সাহায্য আসছে বলে জানা গেছে। এটা অত্যন্ত সঙ্গত কারণ যে, আমেরিকা যদি শান্তি বা সমঝোতার ন্যূনতম নীতি অবলম্বন করে অস্বীকৃতি জানায় এবং প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধ হয় তাহলে শান্তির স্বার্থে অথবা ন্যায় সঙ্গত দাবীর সমর্থনে বিশ্বের যেকোন শান্তিবাদী শক্তিকে এগিয়ে আসতেই হয়। সোভিয়েত রণতরী ছদি আরব বাহিনীর পাশে ঘিরে থাকে তাহলে তার জন্য দায়ী আমেরিকার যুদ্ধ বা আগ্রাসনে তৎপরতাই। আমরা যারা বিশ্বের ছোট ছোট শক্তির যারা বিশ্ব শান্তি ও সমঝোতার পক্ষপাতী, যারা যুদ্ধের ক্ষতি ও সম্পদ বিনষ্ট পরিণতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল তারা মধ্যপ্রাচ্যে বড় আকারের একটা যুদ্ধ দিন দিন সম্প্রসারিত হয়ে বিশ্ব যুদ্ধের আকার ধারণ করুক তা চাই না। আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের নীতি কে ঘৃণা করি। অবিলম্বে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ফিরে আসুক এটাই আমাদের কামনা। কিন্তু আমরা আরবদের ন্যায়সঙ্গত দাবি মার্কিন ফ্যান্টম আর নৌবহরের ভ্রুকুটিতে নস্যাৎ হয়ে যাক তা মেনে নিতে পারি না। কেননা আমরা জানি কোন জাতির ন্যায় দাবি স্থায়ী ভাবে কেউ কোনদিন দাবিয়ে রাখতে পারে না। শক্তি উন্নত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পারেনি-পারছে না-পারবেও না।
সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে, একে প্রতিরোধ করতে হবে
আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ঘটনা দুর্ঘটনা অন্ত নেই। প্রতিদিন অসংখ্য ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। দুর্ঘটনাও কম ঘটছে না। গতকাল বাংলার বাণীতে রাজধানী ঢাকা শহরের সড়ক দুর্ঘটনার একটি জরিপ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত রিপোর্টের তথ্যনুযায়ী জানা গেছে যে, গত বছরের তুলনায় বর্তমান বছরের ন’মাসের হিসাবে ঢাকা শহরের সর্বমোট পাঁচশ উনিশটি সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এসব সড়ক দুর্ঘটনায় চব্বিশ জন প্রাণ হারিয়েছে, সাতাশ জন গুরুতর ভাবে আহত হয়েছে এবং চারশ আটষট্টি জন সামান্য আহত হয়েছে। ন’মাসের হিসেবেই রাজধানী ঢাকা শহরের সড়ক দুর্ঘটনার যে চিত্র পাওয়া গেছে তা আমাদের আতঙ্কিত না করে পারে না। বছর শেষে ঢাকা শহরের সড়ক দুর্ঘটনার যে হিসেব পাওয়া যাবে তা নিঃসন্দেহে অন্যান্য বছরের চেয়ে বেশি হবে বলেই আমরা আচঁ করছি। জানা গেছে একাত্তর সালের সড়ক দুর্ঘটনা বাহাত্তর সালের সমান সমান। এ বছরের সংঘটিত যে সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য পাওয়া গেছে তা সবই পুলিশ রিপোর্টের ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে। এইসব দুর্ঘটনা ছাড়াও শহরের বিভিন্ন অলিতে-গলিতে প্রতিনিয়ত অজস্র ছোটখাটো সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, ঘটছে এবং ঘটবে। কিন্তু সব দুর্ঘটনার খবরই ট্রাফিক পুলিশ বিভাগ জানতে পারে না, ফলে সেগুলো পুলিশ রিপোর্ট এর অন্তর্ভুক্ত হয় না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, হর-হামেশা শহরে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার কারণ কি?
সংশ্লিষ্ট বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন অসতর্কভাবে গাড়ি চালানো ফুটপাতের ভিড় এবং ঢাকা শহরে প্রয়োজনুপাতে ট্রাফিক পুলিশ না থাকার জন্যই এত দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। শহরের সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে অনেক অমূল্য প্রাণ অকালে ঝরে যাচ্ছে, অনেক মায়ের কোল হচ্ছে শূন্য আবার অনেক সংসারের নেমে আসছে অমানিশার গভীর অন্ধকার। অসতর্কভাবে যানবাহন চলাচল তাই রোধ করা দরকার। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে? রাজধানী শহরের যদি ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা অপ্রতুল থাকে, তাহলে বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর প্রবণতা রোধ করা কিছুতেই সম্ভব হবে না। গাড়ী চালকদের বেপরোয়াত্ব যদি রোধ করা না যায়, তাহলে শহরের সড়ক দুর্ঘটনাকেও রোধ করা যাবে না। গাড়িচালকদের ট্রাফিক আইন মেনে চলতে বাধ্য করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
রাজধানী ঢাকার সড়ক পথ গুলোতে রিক্সারই রাজত্ব চলছে বলে মনে হয়। এমন অনেক রিকশাচালক রয়েছে যারা রিক্সা চালানোর লাইসেন্স অর্জন করেনি, কিংবা ভালো করে রিকশা চালাতে শেখেনি। ফলে এরা অনেক সময় সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হয়। যানবাহন বিধি যাতে প্রতিটি যানবাহন চালক মেনে চলে সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তীক্ষ্ণ নজর দিতে হবে। তাই সর্বপ্রথমে যানবাহন সুষ্ঠু প্রয়োগ আমরা দেখতে চাই । নইলে রাজধানী ঢাকা শহরের সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা যাবে না।
ভাড়াটিয়া বনাম বাড়ীওয়ালা
ভাড়াটিয়া আর বাড়িওয়ালার মল্লযুদ্ধ শুরু হয়েছে স্বাধীনতার পর থেকেই। বাড়িওয়ালারা মনের সুখে ভাড়া বাড়িয়ে চলেছেন আর ভাড়াটিয়ারা ত্রাহি মধুসূদন চিৎকার করছেন। দু’য়ের টাগ অব ওয়ারের কূলকিনারা করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে একটা প্রেস নোটও জারি করা হলো। কিন্তু তাতে বাড়িওয়ালারা দমলেন না। হুমকি ছেড়ে অনেকে বললেন বাড়ি আমার। আমার বাড়ি ভাড়া কত হবে না হবে সেটা আমি বিবেচনা করব। না পোষালে পথ দেখুন।
যারা বাড়িওয়ালাদের হুমকি-ধামকিতে না ঘাটিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকেন তাদের বিরুদ্ধে শুরু হয় বাড়িওয়ালার আক্রমণ। পানি ও বিজলী বন্ধ। তাতেও যদি কাজ না হয় তাহলে ভাড়াটিয়া গুন্ডা আমদানির মাধ্যমে হামলা। এই হলো রাজধানীর ভাড়াটিয়া বনাম বাড়িওয়ালার নিত্যদিনকার কাহিনী।
গত শনিবার বিকেলে বায়তুল মোকারম প্রাঙ্গণে ভাড়াটিয়া ইউনিয়নের উদ্যোগে একটি গণজমায়েত অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ১৯৬৩ সালে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ অর্ডিন্যান্সের পুনরাবৃত্তি সমালোচনা করে অবিলম্বে সংশোধিত অর্ডিন্যান্স আবেদন জানানো হয়।
গণসমাবেশে বাসস্থান সমস্যাকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে ঘোষণা করে ভাড়াটিয়া বাড়ির এক বৎসরের ভাড়া বাড়ির বাজার মূল্যের শতকরা ৫ ভাগ ধার্য, বাড়ি ভাড়া বাবদ কোন রকম অগ্রিম সেলামি গ্রহণ নিষিদ্ধকরণ, ভাড়াটিয়া উচ্ছেদ নির্যাতন ও ভাড়া বৃদ্ধি থেকে বাড়ির মালিককে নিবৃত্তকরণ, উপ ভাড়াটিয়া প্রথা বিলোপ, ভাড়া গ্রহণ বাবদ পাকা রসিদ প্রদান প্রভৃতি দাবিসহ মোট ১৬ দফা দাবির প্রস্তাব করা হয়।
ভাড়াটিয়া ইউনিয়নের পক্ষ থেকে যে বক্তব্য দাবি উত্থাপন করা হয়েছে তা আদর অনায্য নয়। ভাড়াটিয়াদের জীবনের দুঃসহ যন্ত্রণা লাঘব করার জন্য সরকারের একটা কিছু করা উচিত। পুরনো বাড়ি ভাড়া অর্ডিন্যান্স কে নতুন ভাবে চালু করার মাধ্যমে সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে না। এক্ষেত্রে দু’ তরফা উদ্যোগ সরকারকে গ্রহণ করতে হবে। বাড়িওয়ালাদের সীমাহীন অত্যাচারে যাতে ভাড়াটিয়াদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে সে দিকে যেমন সরকারকে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে তেমনি অন্যদিকে স্বল্প আয়ের মানুষদের বসবাসের উপযোগী বাড়ি নির্মাণের পরিকল্পনা নিতে হবে। অবশ্য সরকার ইতিমধ্যে ফ্ল্যাট বাড়ি নির্মাণের কথা ঘোষণা করেছেন। যাইই হোক, এ কাজ যাতে দ্রুত গতিতে ও জরুরি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সুসম্পন্ন হয় সেদিকে সরকারকে লক্ষ্য রাখতে হবে। তাছাড়া স্বল্প ব্যয়ে বাড়ি নির্মাণের একটা সুষ্ঠু পরিকল্পনা যদি সরকারের পক্ষ থেকে উপস্থাপিত হয় তাহলে স্বল্প আয়ের মানুষেরা সে সুযোগ গ্রহণ করতে পারে। মোদ্দা কথা হলো ভাড়াটিয়া বনাম বাড়িওয়ালার টাগ অব ওয়ারের অবসানকল্পে সরকার উদ্যোগী হবেন এ আশাই আমরা করছি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক