You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ২০শে সেপ্টেম্বর, শুক্রবার, ৩রা আশ্বিন, ১৩৮১

উত্তরাঞ্চলে পরিবহন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত

দেশের সামাজিক যানবাহন চলাচল পরিস্থিতি স্বাধীনতা পরবর্তীসময়ে কোনদিন ভাল ছিল, সরকার সে দাবি করবেন না। কারণ প্রথম বছরদেড়েক ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট ও বিপর্যস্ত সেতুগুলো মেরামত ও পুনঃনির্মাণে সময় লেগেছে এবং এই যুক্তিটা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে যেমন যুৎসই ছিল তেমনি জনসাধারণও তা মেনে নিয়েছে সত্যের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের খাতিরে। পরবর্তী সময় গুলোতে বন্যা এবং অতিবৃষ্টিতে মাঝেমধ্যে রাস্তাঘাট খারাপ হয়েছে এবং জনসাধারণকে তার জন্য বিস্তর অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। সুতরাং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে যুক্তিনির্ভর প্রদর্শনের ব্যাপারে জনসাধারণের খুব বেশি একটা কিছু বলার থাকে না। কারণ বিধি যেখানে বাম যুক্তি-তর্কের বেড়াজাল সেখানে অবান্তর।
কিন্তু যদি শুনতে হয় কয়লা, জ্বালানি তেল অথবা যন্ত্রপাতির অভাবে যানবাহন চলাচল শুধুমাত্র নয় একবারে বন্ধ হয়ে গেছে। সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জবাব দেবেন? গতকাল ‘বাংলার বাণী’তে উত্তরাঞ্চলে বারোটি ট্রেন, ২ হাজার ট্রাক এবং ৬শ’ বাস অচল হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। তাতে খুচরা যন্ত্রাংশ এবং জ্বালানি তেলের অভাবের কথা বলা হয়েছিল। কয়লার অভাবে দুটি মালবাহী সহ মোট ১টি ট্রেন বন্ধ করে দেয়া হয়। বাংলাদেশ রেলওয়ে এক মুখপাত্রের বিবৃতি দিয়ে রিপোর্টার লিখেছিলেন, কয়লার অভাব যেভাবে প্রকট তাতে করে অদূর ভবিষ্যতে আরও ট্রেন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। রিপোর্টে বলা হয়েছিল, যে পরিমান কয়লা মজুদ আছে তাতে পশ্চিম জোনে বিশ দিন এবং পূর্ব জোনে দশ দিন চলবে। রিপোর্টারকে মুখপাত্রটি আশ্বস্ত করতে চেয়েছিলেন যে, ভারত থেকে সরাসরি কয়লা আমদানির চেষ্টা চলছে।
হ্যাঁ, এই একটিমাত্র আশ্বাসবাণী আমাদের কর্তাব্যক্তিরা শুনাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। কয়লা ফুরিয়ে যাচ্ছে এ কথা তারা আগে টের পাননি কেন? সংকটের মধ্যে পড়া মাত্রই কর্তারা ছুটে চলেন তা নিরসনের জন্য অন্য দেশে চুক্তি করতে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা গেল, ভারত থেকে ১৫ হাজার টন শোধিত তেল কেনা হচ্ছে বগুড়া-রংপুর এবং দিনাজপুরের জন্য। ভারতের সাথে চুক্তি করতে একটি প্রতিনিধি দল আজ সেজন্য বোম্বে যাচ্ছেন। কিন্তু সংকট শুরু হওয়ার আগে যেতে তাদের আপত্তি ছিল কোথায়? চুক্তি হবে এবং সে তেল পরে দেশে আসবার সময়ের ব্যবধানে সংকট তীব্র আকার ধারণ করবে কর্তাব্যক্তিরা কোনদিন ভেবে দেখেছেন? গত বছরও ঠিক এমনই ঘটনা ঘটেছিল। পাওয়ার পাম্প এর অভাবের কথা প্রচুর লেখালেখি পর পাওয়ার পাম্প যখন খেতে যাবার জন্য রেডি হল, কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল ওই সময় থেকে তীর জ্বালানি তেলের সঙ্কট শুরু হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী জানালেন সংকট শুরু হবার পরেই তাকে তা জানান হয়েছে।
এই হলো বাংলাদেশের প্রাত্যহিক ঘটনা। সংকট শুরুর আগে সব চুপচাপ। খবরের কাগজে হইচই শুরু হল অমনি কর্তারা গা ঝাড়া দিয়ে দৌড় দিলেন বিদেশে। কিন্তু এভাবে চলতে পারে না। এই দায়িত্ব ও কর্তব্য হীনতা সুবাদে চলতে সরকার দিতে পারেননা। কয়লা, জ্বালানি তেল ও খুচরা যন্ত্রাংশের অভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন আর বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। কিন্তু তেল কয়লা আসতে আসতে যোগাযোগের অভাবে ওই এলাকার জনগণের অস্পর্শনীয় ক্ষতি হবে সে ক্ষতিপূরণ কিভাবে সম্ভব?

সুপেয় পানির সংকট

ইংরেজ কবি কোল্ডব্রিজ লিখেছিলেন “ওয়াটার, ওয়াটার এভরি হোয়ার নট এ ড্রপ টু রিচ” অর্থাৎ পানি সর্বত্রই আছে কিন্তু পান করার জন্য পানি নেই। ঢাকা শহরের অবস্থাটাও তাই পানি আছে ঠিকই নালার পানি নদীতে পানি সর্বত্রই পানি, বন্যার পানিতে ঢাকা শহর ভেসে গিয়েছিল। পানির সমস্যা সমাধান করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করছেন অনেকদিন থেকেই। কিন্তু ফল হয়নি। হয়েছে উল্টোটা। গতকাল বাংলার বাণীতে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে কোটি টাকা গচ্চা নেবার পর ডেমরা ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টটি নাকি বন্ধ হয়ে গেছে।
প্রকাশ ডেমরা ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট বাস্তব জল না নেওয়াতে প্রায় এক কোটি টাকা গচ্চা দেয়ার পর মূলত অর্থের অভাবে এই প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে রাজধানী ঢাকা শহরে সুপেয় পানির সংকট আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে বলে পর্যবেক্ষকমহল আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। পানি সরবরাহ কতৃপক্ষের জৈনিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন নবাব সলিমুল্লাহ’র আমলে তৈরি ওয়াটার ওয়ার্কস বোর্ডে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট ও ৬০ থেকে ৬২টি উচ্চ ও নিম্ন ক্ষমতাসম্পন্ন গভীর নলকূপের মাধ্যমে বর্তমানে ঢাকা শহরে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। পুরাতন গভীর নলকূপের অনেকগুলো অকেজো হয়ে পড়ে আছে। নতুন ২০ টি গভীর নলকূপ স্থাপনের কাজ শুরু হলেও শেষ হতে দু-তিন মাস সময় নেবে। ফলে ঢাকা শহরে সুপেয় পানির সংকট থাকা স্বাভাবিক।
পানি সরবরাহ কতৃপক্ষের জৈনিক কর্মকর্তা সুপেয় পানির সংকট স্বাভাবিক বলে মন্তব্য করেছেন। সেই সঙ্গে আমরা সুর মিলিয়ে বলেছিলাম স্বাভাবিকই বটে। কেননা সংকটটা একদিনের নয়। বহু দিনের। সংকটটা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালিপনা ও অদূরদর্শিতার ফলে সৃষ্টি হয়েছে। যতদূর মনে পড়ে ১৯৩৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ. আই. ডি এক চুক্তি অনুসারে ঢাকার জন্য ব্যাপক পানি সরবরাহ ও ময়লা নিষ্কাশনের একটি প্রকল্প প্রণয়নের দায়িত্ব রালফ এম পারসপ কোম্পানিকে প্রদান করে। এই কোম্পানি যে পরিকল্পনা পেশ করে তা ১৯৬১ সালে তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার অনুমোদন করে। কোম্পানি ঢাকার অসংখ্য জরিপ করে সুপারিশ করে যে, ভূগর্ভজাত কূপের সাহায্যে পানি উঠিয়ে তা সরবরাহ করা ঠিক হবে না। কারণ শহরের মধ্যে বিস্তৃতভাবে কূপ তৈরি করলে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানি পাওয়া যাবে না। বুড়িগঙ্গার পানি পরিশোধন করে ব্যবহারের পরিবর্তে সরসঙ্গ কোম্পানি শীতলক্ষ্যার পানি শোধন করে সরবরাহের পক্ষে মত দেয়। এজন্য ডেমরায় শোচনাগার স্থাপনের সুপারিশ করে। এরপর ঢাকা পানি সরবরাহ ও ময়লা নিষ্কাশন প্রকল্পের জন্য আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহ্বান করা হয় টেন্ডার এর সর্বনিম্ন কোটেশনে সে বার উল্লেখ করা হয় তা প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত বেড়েছে শতকরা ৯০ ভাগ বেশি ছিল। যাই হোক শেষ পর্যন্ত ৩৩ কোটি টাকা ব্যয় করার পর অবশেষে আবার সংশোধিত প্রকল্পে ভূগর্ভস্থ হতে পানি উত্তোলন ব্যবস্থার সুপারিশ করা হয়। এ অবস্থায় ১৯৩৯ সালে মিঃ মোশে নামক একজন বিশ্বে নামক একজন বিশেষজ্ঞকে আনা হয়। প্রি মোশে ঢাকায় ৬টি খনন করেন করতে সুপারিশ করেন। কিন্তু কার্যত সেখানে ১১টি কূপ খনন করা হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে গুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি বন্ধ হয়ে যায়।
এদিকে এ অবস্থা অন্যদিকে গ্রাম বাংলার প্রবাদ দের ভাষায় আই না কিনলেই দুনিয়া ব্যবস্থা করে ফেললেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ পানি না থাকা সত্ত্বেও স্থানীয় আবারের ব্যবস্থা করলেন। ৬০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে তিনটি ওভারহেড স্টিলের ট্যাংক নির্মাণ কাজ শেষ করা হলো। অস্ট্রীয়ার একটি সংস্থার সাহায্যে এগুলো তৈরি করা হয়। মহাখালী, ফকিরাপুল ও লালমাটিয়ায় নির্মিত তিনটি ওভারহেড ট্যাংক এর প্রতিটি ১০ লক্ষ গ্যালন পানি ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন। ট্যাংক নির্মিত হলো বটে কিন্তু চালু করার সময় দেখা গেল ঢাকার মধ্যে এগুলো আদৌ কার্যকর নয় প্রথম কারণ হলো ট্যাংক ভরবার মত পানির অভাব, দ্বিতীয়তঃ পানি ভর্তি করে ওভারহেড ট্যাংক চালু করলে পানির যে চাপ সৃষ্টি হবে সে চাপ সহ্য করার ক্ষমতা বিতরনকারী পাইপগুলোর নেই। ফলে পাইপ ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। সুতরাং ওগুলো বর্তমানে আর কোন কাজেই লাগছে না।
আগেই আমরা বলেছি, সমস্যা ও সংকট একদিনের নয়-অনেক দিনের। পুরনো হতে হতে ক্রনিকে রূপান্তরিত হয়েছে। সামগ্রিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা আর পুনরাবৃত্তি অপেক্ষা রাখেনা যে রাজধানীর লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য সুপেয় পানির অভাব পূরণ করতে হলে বাস্তবমুখী ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা প্রণয়ন আবশ্যক। আর তা না হলে সুপেয় পানির অভাব কোনদিনই পূরণ হবে না।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!