You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.11.30 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য অর্জনে কর্মী বাহিনীর আবশ্যকতা সর্বাগ্রে | মধ্যপ্রাচ্যে যেন আর আগুন না জ্বলে | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা : ৩০শে নভেম্বর, শুক্রবার, ১৯৭৩, ১৪ই অগ্রহায়ণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য অর্জনে কর্মী বাহিনীর আবশ্যকতা সর্বাগ্রে

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ঢাকা নগর শাখার বার্ষিক সম্মেলনে গত পরশুদিন শিল্পমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করেছিলেন। তিনি তাঁর ভাষণে সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচী বানচালের জন্যে দেশে যে সকল অশুভ শক্তি তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। এজন্যে তিনি দেশের প্রগতিশীল শক্তিসমূহকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন। বিশেষত এ ব্যাপারে দেশের যুবসমাজের অপরিসীম দায়িত্বের কথা তিনি জোর দিয়ে উল্লেখ করেছেন।
ঢাকা নগর ছাত্রলীগ সম্মেলনের দ্বিতীয় পর্যায়ে বিকেলে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেন। ‘রাজনৈতিক ক্যাডার ছাড়া সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে পৌঁছানো অসম্ভব’ বলে ডঃ কামাল তাঁর ভাষণে অভিমত পোষণ করেছেন। তিনি ছাত্রদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন,‘সৎ, নিষ্ঠাবান ও আত্মশুদ্ধ কর্মীবাহিনী ছাড়া নতুন সমাজ গড়ার সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। অতএব চারিত্রিক দুর্বলতা ও ব্যক্তিপ্রভাবমুক্ত হয়ে প্রতিটি কর্মীকে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। আর সে কারণেই রাজনৈতিক ক্যাডার তৈরীর আবশ্যকতা আজ সবচেয়ে বেশী।’ উল্লেখ করা যেতে পারে, কয়েকদিন পূর্বে দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ঘোষিত হয়েছে। পরিকল্পনার এক পর্যায়ে রাজনৈতিক ক্যাডার তৈরীর উপর সবিশেষ গুরুত্বও আরোপ করা হয়েছে।
ঢাকা নগর ছাত্রলীগের এই বার্ষিক সম্মেলনে নেতৃবৃন্দ সমাজতন্ত্রের বাস্তবায়ন সম্পর্কে যে জোরালো বক্তব্য রেখেছেন তার গুরুত্ব অপরিসীম বলে আমরা মনে করি। বিশেষ করে প্রচলিত ব্যবস্থার দ্বারা সমাজতন্ত্রের পথে অগ্রসর হওয়া যে নিদারুণ কষ্টকর—নেতৃবৃন্দ সে কথা উল্লেখ করেছেন এবং রাজনৈতিক ক্যাডার তৈরী করে সমাজতন্ত্র বাস্তবায়নের বিভিন্ন কর্মে তাদেরকে নিয়োজিত করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। সম্মেলনের প্রধান অতিথি ও বিকেলের আলোচনা সভার প্রধান অতিথি যথাক্রমে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও ডঃ কামাল হোসেন উভয়েই সমাজতন্ত্রের পথ দুর্গম এবং সে পথ অতিক্রম করতে হলে পরীক্ষিত ও আদর্শবান কর্মীর অনিবার্য প্রয়োজনীয়তার স্বপক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। বিদেশী পুঁজিবাদী শোষক শ্রেণীর মূলোৎপাটন সম্ভব হলেও স্বাধীনতার পর একশ্রেণীর নব্য মধ্যস্বত্বভোগী, টাউট ব্যবসায়ী, মুনাফাখোর, মুৎসুদ্দি শ্রেণী ও রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী নেতৃত্বসমূহ দেশের মেহনতি মানুষের উপর বিভিন্ন উপায়ে আজো শোষণ চালিয়ে যাচ্ছে। এদের শোষণের হাতিয়ারগুলোকে স্তব্ধ করতে হবে এবং একটি পরিকল্পিত উপায়ে এদের সমাজতন্ত্রবিরোধী কার্যকলাপকে রুখতে হবে। এর জন্যে অত্যাবশ্যক একটি আদর্শবান কর্মীবাহিনী। যাদেরকে সমাজতন্ত্র সম্পর্কিত প্রতিটি বিষয়ের উপর ট্রেনিং দান করে দেশের প্রতিটি সেক্টরে নিয়োজিত করতে হবে। এই বিশেষ কর্মীবাহিনীই হবে রাজনৈতিক ক্যাডার। ক্যাডার তৈরীর আবশ্যকতা সম্পর্কে আমরা বৎসরাধিককাল পূর্বেই আমাদের অভিমত ব্যক্ত করেছিলাম। তারপর বিভিন্ন সময় এর গুরুত্ব সম্পর্কে আমরা বিভিন্ন নিবন্ধে উল্লেখ করেছি। কেননা, আমরা বিশ্বাস করি, বিশ্বের অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশের গঠন ইতিহাস ও আমাদের জাতীয় পুনর্গঠনের কাজ দু’টি ভিন্ন উপায়ে চলতে পারে না। বিশ্বের কোনো দেশই দালাল, অসৎ ও প্রতিক্রিয়াশীল প্রশাসনযন্ত্র দিয়ে সমাজতন্ত্রের কাজ করেনি। দেশগঠন ও সমাজতন্ত্রে উত্তরণের জন্যে তারা সবাই মৌলিক রাষ্ট্রীয় আদর্শে উদ্বুদ্ধ কর্মীবাহিনী দিয়ে সমাজের প্রতিটি সেক্টরের কাজ শুরু করেছিলো। সংগঠনের দেয় ক্ষমতাই তাদের সরকার কার্যকরী করতো মাত্র। সংগঠনের এই প্রাধান্য সমাজতন্ত্রের জন্যে অপরিহার্য। যখন এই অপরিহার্যতা স্বীকৃত হবে ঠিক তখনই কেবল কর্মীবাহিনী বা ক্যাডার দ্বারা দেশ গঠনের অনিবার্য প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবে। আমরা আজো তাই মনে করি, সংগঠনের প্রাধান্য এবং ক্ষমতা সরকারের ক্ষমতার উৎস হতে হবে। এবং রাজনৈতিক ক্যাডার তৈরী করে তাদের মাধ্যমে দেশের গঠনপর্ব ও সমাজতন্ত্রের কর্মপ্রণালীর বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করতে হবে। যদি অসৎ আর প্রতিক্রিয়াশীল প্রশাসন দিয়ে সমাজতান্ত্রিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আশা কেউ করে থাকেন তাহলে তা শেষ পর্যন্ত প্রহসন হিসেবেই পরিগণিত হবে। আমরা আজো আশাবাদী বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ শুধু বক্তৃতা এবং মুখেই আদর্শের কথা সীমাবদ্ধ না রেখে সত্যিকার কাজে আত্মনিয়োগ করবেন। আর সেই আত্মনিয়োগেই আসবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাস্তবতা।

মধ্যপ্রাচ্যে যেন আর আগুন না জ্বলে

ইসরাইল যদি আরবদের অধিকৃত এলাকা ছেড়ে না দেয়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে আবার আগুন জ্বলে উঠবে। আরব বাদশাহ ও রাষ্ট্রপ্রধানদের তিনদিনব্যাপী শীর্ষ সম্মেলন সমাপ্ত হয়েছে। সম্মেলনের চূড়ান্ত ঘোষণা দু’টি শর্ত আরোপ করা হয়েছে। শর্ত দু’টিতে আরব রাষ্ট্রগুলো অটল সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে অধিকৃত সকল আরব এলাকা থেকে ইসরাইলী সৈন্য প্রত্যাহার করতে হবে, বিশেষ করে ইসরাইল যতদিন জেরুজালেম সহ সকল অধিকৃত আরব এলাকা প্রত্যর্পণ না করবে এবং ছিন্নমূল প্যালেস্টাইনীদের জাতীয় অধিকার ও মর্যাদার পুনঃপ্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আসবে না। আরব শীর্ষ সম্মেলনের সমাপ্তি অধিবেশনে ভাষণ দিতে গিয়ে মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদত তাই উচ্চকন্ঠে ঘোষণা করেছেন যে, ‘শান্তি আলোচনায় মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার সমাধান হবে এমন আশা করা যায়না, বরং যুদ্ধ ক্ষেত্রেই মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার মীমাংসা হবে।’ আরব শীর্ষ সম্মেলনের ঘোষণায় অবশ্য আগামী ১৮ই ডিসেম্বর জেনেভায় আয়োজিত মধ্যপ্রাচ্য শান্তি সম্মেলনে ইসরাইলের সাথে মিসর ও সিরিয়ার শান্তি আলোচনার প্রতি সমর্থন জানানো হয়েছে। আরব শীর্ষ সম্মেলনে ঘোষণা থেকে এ আভাসও পাওয়া গেছে যে, শান্তি আলোচনা ব্যর্থ হলে সেক্ষেত্রে সামরিক শক্তি বাড়ানোর জন্যে আরব জাহান পরিকল্পনা করছে। ঐদিকে জাপান এবং ফিলিপাইন আরব স্বার্থের অনুকূলে মতপ্রকাশ করেছে। জাপান হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেছে যে, ইসরাইল যদি অধিকৃত আরব এলাকা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার না করে, তাহলে জাপান তেলআবিবের সঙ্গে তার সম্পর্ক পরিবর্তন করতে বাধ্য হবে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী কাকুই তানাকা সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে ঘোষণা করেছেন যে, রাষ্ট্রীয় স্বার্থেই মধ্যপ্রাচ্য বিরোধের ব্যাপারে জাপান তার নীতি পাল্টাতে বাধ্য হচ্ছে। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট মার্কোসও ঐ একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন। ফলে, আরব লীগের সেক্রেটারী জেনারেল মোহাম্মদ রিয়াদ ঘোষণা করেছেন যে, তেল রপ্তানীর উপর নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে জাপান ও ফিলিপাইনকে এক মাসের জন্যে অব্যাহতি দেওয়া হবে।
আরব শীর্ষ সম্মেলনে ইসরাইলের প্রতি যে দু’টি শর্তারোপ করা হয়েছে, তা খুবই যৌক্তিক। আরবদের সত্য ও ন্যায়ের সংগ্রামের প্রতি আমরা আগাগোড়াই সর্বাত্মক সহযোগিতা ও সমর্থনের কথা ঘোষণা করে এসেছি। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে দেখা যাচ্ছে যে, ইসরাইল বারংবার যুদ্ধ বিরতি লংঘন করছে, জেনেভা চুক্তির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে বেআইনীভাবে অধিকৃত এলাকার প্রাকৃতিক সম্পদ লুন্ঠন করছে, অধিবাসীদের ঘরবাড়ী ধ্বংস করতেও দ্বিধা করছে না। এ পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ পরিষদের বিশেষ রাজনৈতিক কমিটি ইসরাইলের বিরুদ্ধে আনীত খসড়া নিন্দা প্রস্তাবটিও সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে অনুমোদন করেছে।
গোঁয়ার্তুমীর জন্যে ইসরাইল দিন দিন কোনঠাসা হয়ে পড়ছে এবং তাদের মুরুব্বী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গুলী হেলনীর জোরে মধ্যপ্রাচ্য সমস্যাকে জিইয়ে রাখছে। এতে আর যাই হোক, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির পথ প্রশস্ত হবে না। বরং আরো একটি যুদ্ধের স্ফুলিঙ্গেই জ্বলে উঠবে বলে আমাদের ধারণা। তাই আরব শীর্ষ সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তকে মেনে নেওয়াটাই ইসরাইলের জন্যে বুদ্ধিমানের কাজ হবে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ হেনরী কিসিঞ্জার আবার আর একদফা মধ্যপ্রাচ্য সফরের কথা নাকি বিবেচনা করছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এখন উচিত, তেল সংকট থেকে পরিত্রাণ লাভের জন্যে ইসরাইলকে বাগ মানানো। ইসরাইল যদি শীর্ষ সম্মেলনের শর্ত দু’টি মেনে নেয়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়া স্বাভাবিক। নইলে যুদ্ধের ময়দানে আবার জ্বলবে সর্বগ্রাসী আগুন। এ আগুন যাতে না জ্বলে, সেজন্যে ইসরাইলকে আরবদের ন্যায়সঙ্গত দাবী মেনে নেওয়াটাই শ্রেয়তর।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন