বাংলার বাণী
ঢাকা : ১৮ই মার্চ, সোমবার, ১৯৭৪, ৪ঠা চৈত্র, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
রাজনৈতিক হত্যার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন চাই
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নেতা ও সংসদ সদস্য গাজী ফজলুর রহমান গত পরশুদিন প্রকাশ্য দিবালোকে দুষ্কৃতিকারীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন। একই দিনে পাংশা থানার আওয়ামী লীগের সভাপতি জনাব গফুর আলী মন্ডল গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এ যাত্রা তিনি বেঁচে যেতে পারেন বলে সংবাদে প্রকাশ। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত কয়েক হাজার আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মী দুষ্কৃতিকারীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন। সঠিক হিসাব আমরা জানিনা—বোধ করি আওয়ামী লীগও জানে না। অনেক প্রখ্যাত নেতা ও জাতীয় সংসদ সদস্য দুষ্কৃতিকারীদের গুলিতে প্রাণ দিয়েছেন। তাদের মধ্যে আজো আমাদের স্মরণে রয়েছে সগীর, গফুর ও মোতাহার মাস্টারের মতো জনগণের প্রিয় নেতা। পরশুদিন গাজী ফজলুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। দুষ্কৃতিকারীরা যখন তাঁকে গুলি করে তখন তিনি একটি স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। জানা গেছে, গাজী সাহেব একজন সৎ, নির্ভীক ও একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। গাজী ফজলুর রহমানের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি এক বিবৃতি প্রদান করে হত্যাকারীদের স্বরূপ ব্যাখ্যা করেছেন এবং এই সকল হত্যাকান্ডকে রাজনৈতিক বলে অভিহিত করেছেন। এদের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্যেও তিনি আহ্বান জানিয়েছেন। শোক প্রকাশ করে আমাদের অর্থমন্ত্রীও একটি বিবৃতি দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত সভাপতি কিছুদিন পূর্বে মাদারীপুরের যুবলীগ এবং আওয়ামী লীগের নেতা সরদার শাহজাহানের নিহত হবার সংবাদ পেয়ে ছুটে গিয়েছিলেন। বস্তুতঃপক্ষে দুষ্কৃতিকারীদের গুলিতে আজ পর্যন্ত যত আওয়ামী লীগ, ছাত্র লীগ ও যুবলীগ ও শ্রমিক লীগের কর্মী ও নেতা মারা গেছেন তাদের সবার ব্যাপারেই কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ শোকাপ্লুত হয়েছেন। পূর্বাপরই একজন কর্মীর নিহত হবার সংবাদ শুনে তারা মর্মাহত হয়েছেন। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, দু’বছর আগেও এ সকল হত্যাকান্ডকে যে দৃষ্টিকোণে বিচার করা হয়েছিল আজও সেটাই হচ্ছে। দু’বছর পূর্বেই এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়েছিল, আজও সেটাই হচ্ছে। অথচ এ পর্যন্ত সত্যিকার আন্দোলন গড়ে তোলার জন্যে কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করা হয়নি। আওয়ামী লীগের কর্মী ও নেতারা বিভিন্ন সময় প্রাণ হারিয়েছেন আর কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেই ক্ষান্ত হয়েছেন। এ ধরনের রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের পেছনে যে একটি বিরাট ষড়যন্ত্র কাজ করছে এ কথা আওয়ামী লীগ নেতারা জানেন এবং দু’বছর আগে থেকেই তা জানেন। তবু কেন সাংগঠনিকভাবে ব্যাপক কর্মসূচী এই হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে গ্রহণ না করে সরকারের ঘূণে ধরা প্রশাসন যন্ত্রের দিকে তাকিয়ে থাকা হলো সেটাই আজ দেশবাসীর মনে প্রশ্ন। সংগঠন যদি প্রথম থেকেই একটি ব্যাপক ও বাস্তব কর্মসূচী গ্রহণ করতো তাহলে নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক হত্যাকান্ড অনেকাংশে প্রশমিত হতো। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতারা সে কাজটি না করে সরকারের বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আর নেতা ও কর্মীদের হত্যার খবরে মর্মাহত হয়ে শোক প্রকাশ করে চললেন। এদিকে বোধ করি কয়েক হাজার বার বীর দর্পে ঘোষণা করা হয়েছে—‘আমরা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করবোই’ কাউকে স্বহস্তে আইন তুলে নিতে দেবোনা। স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন জনের মুখে ঐ শব্দগুলো আমরা শুনেছি—এবং দেশের বাস্তব-অবস্থা চিন্তা করে প্রমাদ গুনেছি। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা আমরাও কামনা করি। কিন্তু যখন আমরা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করি যে, কর্তৃপক্ষ আইন প্রয়োগে অত্যন্ত দুর্বল এবং অপরিকল্পিত; তখন আমরা হতাশ হয়ে পড়ি। বোধ করি আইন প্রয়োগের ব্যাপারে সঠিক পরিকল্পনার অভাব ও নানা দুর্বলতাতেই দেশের মানুষের মনে গভীর হতাশা নেমে এসেছে। আমরা বহুবার বলেছি—শুধু শুধু হুমকি-ধমকি না দিয়ে একটি বাস্তব পরিকল্পনা নিয়ে সমাজের শত্রুদেরকে কঠোর হস্তে দমন করা হোক। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমরা সেই কঠোর পদক্ষেপটি লক্ষ্য করিনি, অথচ বারবারই শুনেছি—আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবোই। আমাদের প্রশাসন যন্ত্রের এক অংশ সম্পূর্ণ অর্থে অসৎ ও অকর্মণ্য। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার এক অংশও অনুরূপ। সর্বোপরি দেশে এমন কিছু ঔপনিবেশিক আইন রয়েছে যার দ্বারা ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। কর্তৃপক্ষ যতদিন এগুলোর পুনর্বিন্যাস না করবেন ততদিন কোনোক্রমেই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না। শক্ত বাঁধুন ফসকা গেরোর মতোই অবস্থা হবে। রাজনৈতিক খুনী থাবা সিঁধেল চোর সবাই আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসার সুযোগ পাবে। তাই পরিকল্পনাহীন অবস্থায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে কর্তৃপক্ষের নাকের উপর দিয়ে গাজী ফজলুর রহমানের মতো দেশপ্রেমিকরা অকাতরে জীবনই দিয়ে যাবে। আমরা জানি, এ পর্যন্ত যতগুলো আওয়ামী নেতা ও কর্মী নিহত হয়েছেন তার এক অংশ স্বদলীয় কোন্দলেরই ফলাফল। এই স্বদলীয় কোন্দল রোধ করার জন্যেও আওয়ামী নেতারা আজ পর্যন্ত কোনো বাস্তব কর্মসূচী প্রণয়ন করতে পারেননি। অথচ স্বাধীনতার পর থেকেই আমরা শুনে আসছি—গণপ্রতিরোধ,—গণআন্দোলন, আর তুমুল সংগ্রামের হুমকি। আমরা কর্তৃপক্ষকে বলবো—আইনের শাসন আপনারা প্রতিষ্ঠা করুন—তবে তার পূর্বে দেশপ্রেমিক কর্মীদের প্রাণহানি বন্ধের নিশ্চয়তা প্রদান করুন। আওয়ামী লীগের নেতারাও শুধু হুমকি আর শোক বিবৃতি দিয়ে নয় বাস্তব কর্মসূচী নিয়ে এগিয়ে আসবেন বলে আমরা আজো বিশ্বাস করি। পাকিস্তান আমলে একজন কর্মী মার খেলে যেখানে আন্দোলন আর প্রতিবাদের ঝড় উঠতো সেখানে আজ হাজার হাজার কর্মীর নিহত হবার ঘটনা দেখেও আমাদের তেমন কোনো প্রতিক্রিয় হয়না। এটাই আজ সাংগঠনিক তৎপরতার সর্বশেষ অবস্থা।
আমরা দেশপ্রেমিক শক্তিসমূহকে রাজনৈতিক হত্যার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ বাস্তব কর্মসূচী প্রণয়নের আহ্বান জানাই। গাজী ফজলুর রহমানের বিদেহী আত্মার প্রতি আমরা আমাদের সশ্রদ্ধ সালাম জানাই।
বিধি বহির্ভূত পণ্য আমদানী
আমদানী বা রপ্তানী ব্যবসায়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের নানা রকম ফন্দি-ফিকির বা টিরিকবাজী কোনো নতুন জিনিস নয়।
ব্যাপকভাবে বলতে গেলে, সেই নিক্ষিপ্ত পচা অতীতে যেদিন থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে বিদেশীদের বা বিদেশীদের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক যোগসূত্র রচিত হয়েছে, সেদিন থেকেই আমদানীকারক বা রপ্তানীকারকদের মধ্যে এ টিরিকবাজীর বিষ বীজাণু সংক্রমিত হয়েছে।
সত্যি কথা বলতে কি, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকে পণ্য আমদানী বা রপ্তানীর ক্ষেত্রে বিশেষ করে আমদানীর ক্ষেত্রে, যে হারে ফন্দি-ফিকির, টিরিকবাজী ও চুরি চোট্টামি ইত্যাদি বৃদ্ধি পেয়েছে তাতে সবারই যথেষ্ট উদ্বিগ্ন হবার কথা। আর এসব অসাধু ও সমাজবিরোধী ব্যবসায়ীদের চক্রান্তেই বাংলাদেশে বিভিন্ন পণ্যের দাম আজ আকাশ ছোঁয়া বা সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন। কারণ, বিভিন্ন মধ্যস্বত্ব ও টাউট ফড়িয়া বা অসাধু কর্মচারীদের নানা রকম হাতবদলের দরুণ যে কমিশনের উপর কমিশনের পাহাড় গড়ে উঠে, তা শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষকেই চরম অগ্নিমূল্যে বহন করতে হয়।
প্রত্যেক দেশেই বিভিন্ন অর্থনৈতিক কারণ ও প্রয়োজনে আমদানী বা রপ্তানী ব্যবসায়কে সরকার নির্দিষ্ট নিয়মের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন এবং এজন্য এক এক মৌসুমে সরকারের এক এক নির্দিষ্ট নীতি সময়ের আগে থেকেই প্রণীত ও ঘোষিত থাকে। এই নির্দিষ্ট নীতি বা নিয়মানুসারেই ব্যবসায়ীকে আমদানী বা রপ্তানী ব্যবসায় চালাতে হয়। এ নীতি অনুসারে কিছু কিছু পণ্য আমদানী বা রপ্তানীর অনুমোদন থাকে আর কিছু কিছু পণ্যের আমদানী রপ্তানী নিষিদ্ধ বা নিয়ন্ত্রিত থাকে। যে ব্যক্তি এ নিয়মের বরখেলাপ করে অন্য কিছু করে তাকেই আইনের চোখে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং শাস্তি দেয়া হয় এ নিয়ম সব দেশেই আছে।
তবে বাংলাদেশের দিকে তাকালে এর এক বিষাদ চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। দেশ স্বাধীন হবার সাথে সাথে এ রাজ্যের সমস্ত নিয়ম-কানুন ও একেবারে ফ্রিস্টাইল হয়ে গেছে। অন্ততঃ সরকার নির্ধারিত আমদানী রপ্তানী নীতিকে অবজ্ঞা ও ধর্ষণ করে যে ব্যাপক হারে বাংলাদেশের ইচ্ছে মাফিক সামান্য ঘুষের পরিবর্তে বিভিন্ন আমদানী-রপ্তানী চলছে তাতে এ কথা মনে না করে উপায় নেই।
গতকাল একটি স্থানীয় দৈনিক সংবাদ দিয়েছে যে, আমদানীকারকদের লাইসেন্স বহির্ভূত জিনিস পত্র আমদানী দেদার চলছে। গত ১লা জানুয়ারী থেকে এ পর্যন্ত সমুদ্র শুল্ক বিভাগ চট্টগ্রাম বন্দরে তল্লাশি চালিয়ে ৫২ জন আমদানীকারকের কাছ থেকে প্রায় ১০ লাখ টাকার পণ্যসামগ্রী আটক করেছে। হঠাৎ শুনলে মনে হবে শুল্ক বিভাগ কত না জানি বেআইনী মাল আটক করে ফেলেছেন। অনেক অভিজ্ঞের মতে, যেখানে চট্টগ্রাম ও দেশের অন্যান্য বন্দরে দৈনিক লক্ষ লক্ষ টাকার বেআইনী মাল এসে পৌঁছুচ্ছে সেখানে তিন মাসে মাত্র দশ লাখ টাকার মাল আটক খুব একটা কৃতিত্বের কিছু নয়। বরং পরোক্ষভাবে শুল্ক বিভাগ তাদের যথোপযুক্ত কর্তব্য পালন করতে পারেনি বলেই অনেকের ধারণা।
এই ৫২ জন আমদানীকারক সবাই সরকারী লাইসেন্স প্রাপ্ত। অথচ, তারা সবাই এক জিনিস আমদানীর নাম করে অন্য বিধি বহির্ভূত মাল এনেছেন বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশ। অনেক অদৃশ্য মহলের প্রভাবে অনেক বিধি বহির্ভূত মালও নাকি খালাস পেয়ে গেছে বলে অভিযোগ এসেছে। এসব মহল কারা বা কারা এসব বেআইনী কাজে ইন্ধন যোগাচ্ছে তাদের এই মুহূর্তে চিহ্নিত করে শাস্তি দিতে হবে। এজন্যে বিভাগীয় তদন্তের উপর ভরসা না করে গোপন তদন্তের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আমদানী আইনকে যাতে কঠোরভাবে প্রয়োগে করা হয় সেদিকে যথেষ্ট দৃষ্টি রাখতে হবে। বন্দর বিভাগ, শুল্ক বিভাগ, পুলিশ বিভাগ ও এল.এম-ডি বিভাগে যে সমস্ত অসাধু ও দক্ষিণাপরায়ণ কর্মচারী বা শ্রমিক নেতারা আছেন তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
তা’ না হলে, অযথা ঢাক ঢোল পিটিয়ে এক এক মৌসুমী নীতি প্রণয়ন করে তাকে চরম অবজ্ঞার শিকার বানিয়ে নিজেদের করুণ রোদন ভরা দৈন্য প্রকাশে কোনোই কৃতিত্ব নেই। একে প্রতিরোধ করতেই হবে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক