You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.06.14 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | শিশু খাদ্য নিয়ে কেলেঙ্কারি | বিদ্যুৎ বিভ্রাট | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: ১৪ই জুন, বৃহস্পতিবার, ৩০শে জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮১

শিশু খাদ্য নিয়ে কেলেঙ্কারি

শিশুখাদ্য নিয়ে সংসদে কথা উঠেছে। জোর বাকবিতণ্ডা হয়েছে সরকারি সদস্যদের মধ্যেই। বাণিজ্য দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী শিশুখাদ্যের আমদানিকারকদের তালিকা পেশ করেছেন। সে তালিকায় বিড়ি ফ্যাক্টরি থেকে শুরু করে ইলেকট্রিক কোম্পানির নাম পর্যন্ত ঠাঁই পেয়েছে। রয়েছে ‘পাকিস্তান হোটেল ও রেষ্টুরেন্ট’, ‘পাক ট্রেডিং’ এন্ড জেনারেল মার্চেন্ট, ‘পাক ষ্টোর’ ‘পাক এম্পোরিয়াম’ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের নাম। এই নামগুলো নিয়ে যেমন বিপত্তি বেঁধেছে তেমনি বা কথা উঠেছে তাদের ‘কাম’ নিয়েও। শিশুখাদ্যের আমদানিকারকদের সম্বন্ধে প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, তাদের বিবেকের উপরই শিশু খাদ্য সরবরাহের ‘ব্যাপারটা আমরা ছেড়ে দিয়েছিলাম তা সত্বেও কালোবাজারী হচ্ছে।’ তিনি এ ব্যাপারে সরকারি কার্যক্রম ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, ‘সরবরাহ বৃদ্ধি ও কালোবাজারি রোধের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
বাংলাদেশ পাকিস্তান হোটেল ও রেষ্টুরেন্টের অবস্থান কি করে সম্ভব সে নিয়ে অনেক কথাই তোলা যেতে পারে। প্রশ্ন রাখা যেতে পারে এমন একটা প্রতিষ্ঠান কাদের হাত দিয়ে আমদানি লাইসেন্স পেল। অথবা কারা সেই আমদানি লাইসেন্স পাওয়ার ব্যাপারে সহযোগিতা করেছিল অথবা এম্পোরিয়াম না হয় পাকের স্থলে পাক উচ্চারণ করে অথবা পাক-পবিত্রতার আতর লাগিয়ে গ্রহণ করার পরামর্শ দেয়া যেতে পারে, কিন্তু পাকিস্তান হোটেল ও রেষ্টুরেন্টকে কোন অলংকার দিয়ে বাঙালি সাজে সজ্জিত করবে?
এবারেই নামধারী আমদানিকারকদের ‘কামের দিকটা’ খতিয়ে দেখা যাক। গত ২৬ শে মে ‘বাংলার বাণী’তে এই কীর্তিমানদের কার্যকলাপ সম্বন্ধে একটা রিপোর্ট বেরিয়েছিল। নির্ভরযোগ্য সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে সেই রিপোর্টে বলা হয়েছিল, চলতি বছরে দু’হাজার পাঁচশ সত্তর মেট্রিক টন দুধ টিসিবি আমদানি করেছে এবং বাকি তেরো হাজার সাতশ চুয়াল্লিশ মেট্রিকটন দুধ আমদানির লাইসেন্স দেয়া হয়েছে বেসরকারি আমদানিকারকদের। বলা বাহুল্য, সংসদে পেশকৃত তালিকায় সিপয় বিড়ি ফ্যাক্টরি, রংপুর টোবাকো কোম্পানি প্রভৃতিই উল্লেখিত বেসরকারি আমদানিকারক। তারা দুধ আমদানি করেছে এবং বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী কথা থেকে আমরা জানতে পেরেছি, এই আমদানিকারকরা শিশুখাদ্য নিয়ে কালোবাজারি করেছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ব্যাপারটি আগে থেকেই জানতেন। বাংলার বাণীর সেই ২৬শে মে’র রিপোর্টেই লেখা হয়েছিল শিশুখাদ্যের সংকট প্রসঙ্গে আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা এই সংকটকে কৃত্রিম বলে অভিহিত করেন। তারা বলেন সংকটের জন্য বেসরকারি আমদানিকারকরাই দায়ী। কিন্তু সংশ্লিষ্ট দফতর আমদানিকারকদের এই কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির ব্যাপারটি জেনেও কিছু বলছেন না। বেসরকারি আমদানিকারকদের তালিকা চাওয়া হলে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রধান নিয়ন্ত্রক সেদিন তালিকা দিতে অসম্মতি প্রকাশ করেন। আমাদের প্রশ্ন সবকিছু জেনেও কেন এতদিন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চুপ ছিলেন। শিশু খাদ্যে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি কারীদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
এটা বাংলাদেশের গত উনত্রিশ মাসের ঘটনাবলী থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। এর আগে এমনই নানা কেলেঙ্কারি কথা সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাই জনগণকে প্রকাশ করেছেন। মন্ত্রীমহোদয়রাই বিভিন্ন সময়ে ভুয়া তাত, সমবায় এবং শিল্প ইউনিট এর বিবরণ দিয়েছেন। ‘কঠোর ব্যবস্থা’ গ্রহণের হুমকি তখনও দেয়া হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। অন্যান্য ক্ষেত্রেও দেশে যত পারমিট লাইসেন্স বিতরণ করা হয়েছে সেগুলো সম্বন্ধে বিভিন্ন প্রকার অভিযোগ পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি বাস্তবেই খড়গ হয়ে কোন দোষী ব্যক্তির ঘাড়ে পড়েছে বলে আমাদের জানা নেই। শিশুখাদ্যের ব্যাপারে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আবার সেই কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন। আবারও সে আশ্বাস হাওয়ায় ভেসে বেড়াবে কিনা সেই নিয়ে মানুষের মনে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।
কথায় নয় কাজেই মানুষের পরিচয়-যেমন বৃক্ষের পরিচয় ফল-এ। হুমকি আর সতর্কবাণী গত উনত্রিশ মাসে বহুবার দেয়া হয়েছে। তাতে করে দুর্নীতি কারচুপি কালোবাজারি মজুতদারী এতটুকু কমেছে বলে সরকারও দাবি করতে পারবে না। বরং ইতিমধ্যে এই সকল গণবিরোধী অমানবিক কার্যকলাপ স্মরণকালের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। সরকার যদি এরপরও হাওয়ায় গদা খুড়িয়ে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে চান তবে আমরা শুধু তাদের অবশ্যম্ভী পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে দিতে পারি। যে পরিণতি কেউ এড়াতে পারেনি।

বিদ্যুৎ বিভ্রাট

অন্যান্য দুর্ঘটনা ও দুঃসংবাদের মত বিদ্যুৎ বিভ্রাটের খবরও প্রায় প্রতিদিনই দৈনিক পত্রিকাগুলোতে ছাপা হচ্ছে। যেন আটপৌরে ব্যাপার। আজ রাজধানী ৬ ঘন্টা অন্ধকার ছিল, কাল অমুক অঞ্চলে তিন ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না, পরশু সিলেটের অমুক শহরে তিন দিন ধরে অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। এইসব খবর যেন শুধু খবরই। অন্যদিকে বিদ্যুৎ বন্ধ থাকার জন্য শিল্পকারখানাগুলোও বন্ধ হয়ে যায় এবং ব্যাপক ক্ষতির দেখা দেয় উৎপাদনে। জাতীয় সংসদে নির্বিকারে তার হিসেবও দাখিল করা হয়। বিদ্যুৎ বিভ্রাটের জন্য দেশের কোটি কোটি টাকা লোকসান গেছে- তার একটা লিখিত প্রতিবেদন পেশ করা হয়।
গত ১৬ই জুন পত্রিকাস্তরের বিশেষ প্রতিবেদনে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের একটা ব্যাখ্যা প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়েছে যে, কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ প্রকল্পের দুটি টারবাইন এর মধ্যে একটি গত ১০ দিন যাবত অচল হয়ে রয়েছে। ফলে ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহর দেশের বিভিন্ন শহরে ও শিল্প কারখানায় হরদম বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটছে। দেশের রাজধানী ঢাকা এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রামেই দেশের অধিকাংশ শিল্প কারখানা স্থাপিত। এ দুটি জেলায় বিদ্যুৎ বিভ্রাটের অর্থই উৎপাদনে ব্যাপক ক্ষতি ঘন্টা। এবং তা ঘটছেও।
প্রসঙ্গক্রমেই বলতে হয়- কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ প্রকল্পের দুটি টারবাইন চালু রয়েছে। প্রতিটি টারবাইনের উৎপাদন ক্ষমতা ৪০ মেগাওয়াট। কাপ্তাই প্রকল্পে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দেশের দক্ষিণাঞ্চলেই ব্যবহৃত হয়। দক্ষিণাঞ্চলের সিদ্ধিরগঞ্জ, ঘোড়াশাল ও শাহী মাজার এই তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের আন্তঃসংযোগ আছে কাপ্তাই কেন্দ্রের সাথেই। ফলে মূল বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র কাপ্তাই বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হলে স্বাভাবিকভাবেই তার ভোগান্তি এসে পড়ে এই তিনটি কেন্দ্রের উপর।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে যে, কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ প্রকল্পের একমাত্র চালু টারবাইনটি এখন বহুবার চালনা করা হচ্ছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের শহর ও শিল্প কারখানায় বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য এই টারবাইনটিকে ক্ষমতার অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হচ্ছে। ফলে ওই মেশিনটির ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ছে এবং বিদ্যুত উৎপাদনে বিঘ্ন দেখা দিচ্ছে। হয়তো এমনও হতে পারে অপর অচল টারবাইন মেরামত করার আগেই অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের চাপে চালুর টারবাইন বিকল হয়ে গেল। এর সম্ভাবনা যে একেবারে নেই তা নয়। তখনকার অবস্থা কল্পনা করার জন্য কি খুব বেশী দূরদৃষ্টির প্রয়োজন আছে?
আমরা যতদুর জানি কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ প্রকল্পের তিনটি টারবাইনই চালু করার কথা ছিল। দুটো টারবাইন সর্বদা চালু থাকবে এবং তৃতীয়টি থাকবে নিদানকালের জন্য। কোন সময় বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ প্রকল্পের তৃতীয় টারবাইন চালু করা হয়নি। ফলে চালু টারবাইন দু’টিকে অনবরত বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হয়েছে। এবং তাদেরকে প্রায়ই খোড়া হতে হয়েছে। ঘটনা দৃষ্টে মনে হয় কাপ্তাই প্রথম চালু হবার পর এসব ব্যাপারে মাথা ঘামানোর সময় আগে কারও হয়নি, এখনো নয়। অথচ তিনটি টারবাইন চালু রেখে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারলে তা দেশে সরবরাহ করেও উদ্ধৃত্ত থাকার কথা। সে কথা না ভেবে আজ বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রশ্ন উঠছে। তাছাড়া একটা টারবাইন অচল রয়েছে বলে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ব্যাখ্যাকে সত্য ও যুক্তিযুক্ত মেনে নিলেও অনিয়মিত বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যাপারটা মেনে নেয়া যায় না। কারণ জানা কথা যে, একটা টারবাইনে ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় এবং তা কোথায় কতটা সরবরাহ করা যাবে তাও অঙ্কের ব্যাপার। সুতরাং এখানে আঞ্চলিক ভিত্তিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার একটা পরিকল্পনা নেয়া খুবই সহজ। চাহিদার অনুপাতে কম বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে বলে একটা ছক কেটে নিয়ে এক এক অঞ্চলে ঘোষণা করে বিদ্যুৎ বন্ধ রাখার ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। সুপরিকল্পিতভাবে আঞ্চলিক বিদ্যুৎ সরবরাহের বিরতি দিলে হয়তো এক দিনের বিদ্যুৎ উৎপাদন কম লাগতে পারে। এর ফলে একমাত্র চালু টারবাইন একটু বিশ্রাম পেতে পারে। অপরদিকে অনিয়মিত বিদ্যুৎবিভ্রাট আকস্মিকভাবে জীবনযাত্রা ব্যাহত হবে না। ঘোষণা থাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহে বিরত থাকার সময়ে শহরাঞ্চল ও শিল্প এলাকার বাসিন্দারা সজাগ ও সতর্ক থাকবার সুযোগ পাবে। অথচ এর কোনটাই করা হচ্ছে না।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সার্বিক পূণর্গঠনের কাজে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহের একটা ব্যাপক ভূমিকা সৃষ্টি হয়েছে। গত বছরে কয়েক হাজার গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহের কথা পত্রিকার মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। আমরা জানি যে, সভ্যতার বিস্তার তথা একটি দেশের উন্নতি অগ্রগতি অন্যতম প্রধান সহায়ক শর্ত হলো দেশের প্রতিটি অঞ্চলে বিদ্যুতায়নের পদক্ষেপ নেয়া। আধুনিক জগতে বিদ্যুতই আলো, বিদ্যুতই শক্তি। শিল্প-কারখানার সম্প্রসারণ ও ব্যাপকভাবে বিদ্যুতায়ন পরিকল্পনার ওপর নির্ভর করে। আমাদের দেশ পানি বিদ্যুৎ সম্পদে সমৃদ্ধও বটে। বিশেষজ্ঞ মহলের ধারণা, তিনটি টারবাইন চালু করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা নিলে এবং সেই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করতে পারলে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের প্রশ্ন আসতে পারে না। এবং বিদ্যুৎ বিভ্রাটের জন্য কোটি কোটি টাকার উৎপাদন ঘাটতি হবে না। বরং উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ আমরা বেচতেও পারব। অতএব সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করা হোক। তাহলে বিদ্যুতের মূল্য বেশি না করেও সুলভে বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হবে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন