You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.12 | ‘বাঙলাদেশ’-এ স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম- সাম্প্রদায়িকতা প্রদেশিকতাকে সমাধিস্থ করেছে | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

‘বাঙলাদেশ’-এ স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম- সাম্প্রদায়িকতা প্রদেশিকতাকে সমাধিস্থ করেছে। শহীদ মিনার পাদদেশে বিরাট জনসভায় ভবানী সেন
(স্টাফ রিপাের্টার)

কলকাতা, ১১ এপ্রিল- “পাকিস্তানের সামরিক চক্রের অধিনায়ক ইয়াহিয়া খা ‘বাঙলাদেশ’-এ যে নির্মম গণহত্যায় লিপ্ত, বর্বরতার ইতিহাসে তা এক নতুন অধ্যায় রচনা করেছে। আর এর পাশাপাশি বাঙলাদেশএর অধিবাসীরা যে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরােধ গড়ে তুলেছেন তা সত্যিই অভূতপূর্ব। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও স্বাধিকার অর্জনের জন্য এই বিপুল জনজাগরণ সায়িকতা ও প্রাদেশিকতাকে বাঙলাদেশ’-এর মাটিতে চিরতরে সমাধিস্থ করেছে। এই অবস্থায় বেলুচিস্তান, পাখতুনিস্থান, পাঞ্জাবের দরিদ্র কৃষক ও শ্রমিকের কাছে আমাদের আবেদন-আপনারা ও আপনাদের স্বাধিকারের সংগ্রাম শুরু করেন। বাঙলাদেশ’- এ তাহলে কম মৃত্যুতে স্বাধীনতা আসবে এবং ইয়াহিয়ার পরাজয় ত্বরান্বিত হবে। আর, ভারত সরকারের কাছে আমাদের আহ্বান— উত্তর। ভিয়েতনাম যেমন দেশের দক্ষিণ প্রান্তকে অকাতরে সাহায্য দিয়ে চলেছে, ঠিক তেমনি বাঙলাদেশ’-কে সাহায্য দিন। লােককবির কণ্ঠে “তােমার নাম আমার নাম: ভিয়েতনাম”-এর মত নতুন সুরে আজ ঝঙ্কত হােক “তােমার দেশ আমার দেশ : তারই নাম বাঙলাদেশ।”
আজ শহীদ মিনার পাদদেশে বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম সহায়ক সমিতি”-এ উদ্যোগে আয়ােজিত বিরাট জনসমাবেশে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডীর সদস্য শ্রীভবানী সেন উপরােক্ত বক্তব্য রাখেন। সভায় একাধিক বক্তা বাংলাদেশ-এর সমর্থনে সােভিয়েত ভূমিকার প্রশংসা করেন।
এই সভায় সভাপতিত্ব করেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, সহায়ক সমিতির সভাপতি শ্রী অজয় মুখাজি।

‘বাঙলাদেশ’-এর প্রজাতান্ত্রিক সরকারের স্বীকৃতি দাবি
সভায় সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত এক প্রস্তাবে বাঙলাদেশ’-এর জন্য জনসাধারণকে তাদের ন্যায্য ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের জন্য অভিনন্দন জানিয়ে এই প্রত্যয় পােষণ করা হয় যে, মুক্তি সংগ্রামীদের জয় হবেই। প্রস্তাবে জানানাে হয় পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক চক্রের পৈশাচিক তাণ্ডব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন নাৎসী অত্যাচারকেও ম্লান করে দেয়। প্রস্তাবে বাঙলাদেশের অস্থায়ী সার্বভৌম প্রজাতান্ত্রিক সরকারকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দান এবং রাষ্ট্র সঙ্রে হস্তক্ষেপের জন্য উদ্যোগ গ্রহণের উদ্দেশ্যে ভারত সরকারের কাছে দাবি জানানাে হয়।

অর্থবল, ধনবল থাকলেও ইয়াহিয়ার জনবল, মনােবল নেই
অতীতে হুন আক্রমণে বিধ্বস্ত রােম নগরীর ইতিহাস বর্ণনা করে শ্রীভবানী সেন তার সঙ্গে ইয়াহিয়ার পাশবিকতা তুলনা করেন। তিনি বলেন, “সগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী হবে, হয়ত গেরিলা যুদ্ধের রণ-কৌশল আয়ত্ত করে মুক্তিফৌজকে লড়াই চালাতে হতে পারে। ইয়াহিয়া ভাবছে শহরে অধিকতর সৈন্য মােতায়েন করে নৃশংস তাণ্ডবের মাধ্যমে জনমনে ত্রাস সৃষ্টি করে যুদ্ধ জেতা যাবে। কিন্তু অর্থবল, ধনবল থাকলেও ইয়াহিয়ার জনবল, মনােবল নেই। যত বেশি সৈন্য আনবে ততবেশি রসদ যােগাতে হবে তাদের জন্য, আর সে-রসদ বাঙলাদেশএর শহর-গ্রাম থেকে পাওয়া যাবে না। তাই একদা যেমন নেপােলিয়ন রাশিয়ার রণাঙ্গন ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, তেমনি ইয়াহিয়ার সৈন্যরাও বাঙলাদেশ থেকে হয় পলায়ন করবে নয় সেখানেই কবরস্থ হবে।”
ভারতের অ-বাঙালীরা বাঙলাদেশে প্রাদেশিক দাঙ্গা বাধার যে আশঙ্কা করছেন তাকে অমূলক বলে শ্রীসেন মুজিবের এক ভাষণের বক্তব্য তুলে ধরেন। তিনি জানান, সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকল স্তরের জনগণ লড়াই করছে। ওপারের একতার ঢেউ যে এখানেও এসে লেগেছে তাকে
অভিনন্দন জানিয়ে তিনি জানান, দলমত নির্বিশেষে সবাই আজ বাঙলাদেশ’-কে সাহায্য ও স্বীকৃতিদানের দাবিতে সােচ্চার।
শ্রী অজয় মুখােপাধ্যায় বলেন, ওপারের সঙ্গে আমাদের রক্তের সম্পর্ক এবং সাধারণ মনুষ্যত্ববােধের ভিত্তিতে আমরা বাঙলাদেশ’-এর জন্য ভারত সরকারকে সামরিক সাহায্য এবং জনগণকে বেসামরিক সহায়তা দানের কথা বলছি।
বিহারের মুখ্যমন্ত্ৰী শ্ৰীকপূরী ঠাকুর জানান, বিহার সরকার বাঙলাদেশ’-এর জন্য ২০ লক্ষ টাকার অর্থ ১০,০০০ টাকার ঔষধাদি দান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সভায় ডাঃ রউফ আনসারী, সর্বশ্রী পাবর্তী মুখখাপাধ্যায়, সমর গুহ ; হরিদাস মিত্র, নিমাই দাস, অরুণ মিত্র, সুব্রত মুখােপাধ্যায়ও ভাষণ দেন।

সূত্র: কালান্তর, ১২.৪.১৯৭১