You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ২৩শে অক্টোবর, বুধবার, ১৯৭৪, ৫ই কার্ত্তিক, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ

রাজধানীর সড়ক বৃত্তান্ত

রাজধানী নগরীর অধিকাংশ প্রধান রাস্তাই এখন প্রায় সব রকম যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ক্ষত-বিক্ষত ও গহ্বরযুক্ত পথে ঘাটে চলতে গিয়ে মানুষজন ও পরিবহন যান বিপদগ্রস্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ‘বাংলার বাণী’র প্রতিবেদন সূত্র জানাচ্ছে যে, ঢাকা পৌরসভাধীন মোট ৪৪০ মাইল রাস্তার মধ্যে ২০০ মাইলেরও বেশী রাস্তা এখন বিধ্বস্ত। সাম্প্রতিক বন্যার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তার পরিমাণও প্রায় শতাধিক মাইল। দুঃখের বিষয়, এই বিধ্বস্ত রাস্তা মেরামতির কোনো উদ্যোগ পৌরসভার পক্ষ থেকে দেখা যাচ্ছে না।
প্রতিবেদন সূত্র আরো জানাচ্ছে যে, এ ব্যাপারে ঢাকা পৌরসভার জনৈক কর্মকর্তার সূত্র থেকে অর্থ ঘাটতির কথা জানা যায়। ঢাকা পৌরসভাধীন বিধ্বস্ত রাস্তাঘাট পুনঃনির্মাণ ও মেরামতের জন্য নাকি কমপক্ষে ৩ কোটি টাকার প্রয়োজন। এজন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকার একটি স্কীম পেশ করা হয়েছে। কিন্তু ও পক্ষ চুপচাপ। ফলে মেরামতির বিলম্বে রাস্তাঘাটের অবস্থা ক্রমশঃ দ্রুত খারাপের দিকেই যাচ্ছে। পৌরসভা কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন যে, রাস্তাঘাট নির্মাণখাতে তাদের নিজস্ব কোনো তহবিল নেই। তবু পৌরসভার নিজস্ব আয় থেকে সামান্য কিছু বাঁচিয়ে শুধুমাত্র রাস্তার বড় ক্ষতগুলোতে মেরামতির প্রলেপ দেবার চেষ্টা তাঁরা করছেন। বলাবাহুল্য, অতিশয় দূরবস্থা সম্পন্ন পথ-ঘাটগুলোর তাতে বিশেষ একটা কিছু রদবদল হচ্ছে না। পৌরসভার জনৈক ঊর্ধ্বতন কর্তা এ প্রসঙ্গেই জানান যে, সম্প্রতি ওয়ার্কস প্রোগ্রামের আওতায় পৌরসভাকে যে ২৫ লাখ টাকার একটি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে—তার দ্বারা মাত্র ৫/৬ মাইল রাস্তা মেরামত করা সম্ভব হতে পারে। প্রশ্ন আসে বাকীগুলোর জন্য—সেগুলোর তবে কি উপায় হবে? এছাড়াও আবার ঢাকা নগরীর রাস্তাঘাটের উপর ওয়াসা, তিতাস গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিভাগের অস্ত্রাঘাত প্রায়শঃই চলে। কারণ যাই থাক কিংবা প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব যতই হোক—এতে এক পক্ষে আকস্মিকভাবে রাস্তা বন্ধ করে রাখার ফলে যানবাহন ও জনচলাচলের দারুণ অসুবিধা হয়, অপরপক্ষে নিখুঁত রাস্তায় দুঃখজনক ক্ষতের সৃষ্টি হয়। ফলে সাময়িকভাবে ঐ বিশেষ সড়কটি অকেজো থাকে এবং তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ীও হয়। তবে রাস্তা খননের জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো প্রতি বর্গফুটের জন্য যথাক্রমে ৯ টাকা (ব্রিক রোড), ১৫ টাকা (পিচের আস্তরণ) ও ২১ টাকা (কংক্রিটের কাজ) হারে পৌরসভার কাছে ক্ষতিপূরণও দেন। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে দ্রব্যমূল্য ও মজুরী বৃদ্ধি এবং মেরামতি দ্রব্যাদির দুষ্প্রাপ্যতাজনিত কারণে রাস্তার ক্ষতগুলো যথাসময়ে মেরামত করা সম্ভব হয়ে উঠে না। ফলে রাস্তার ঐ ক্ষত বা ফাটল বেড়ে যায়। দেখে মনে হয়, সড়ক তো নয় মাঠের আইল। একে তো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের রাস্তাঘাট পুনঃনির্মাণ ও মেরামত করার গুরুদায়িত্ব আমাদের কাঁধে আছে। তার উপর অর্থ সহ নানাবিধ ঘাটতিজনিত সমস্যা আছে, আছে প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং রাস্তা নির্মাণে ফাঁকিবাজি ও কনট্রাক্টরদের বেপরোয়া চুরি। তার উপর আবার যখন তখন, যেখানে সেখানে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির লাইন ঠিক করা বা লাইন সম্প্রসারিত করার খামখেয়ালে রাস্তাগুলোর উপর নির্মমভাবে গাঁইতি কোদাল চালানো কেন? আমরা জানি, ঢাকা পৌরসভা কর্পোরেশন হতে চলেছে। সেক্ষেত্রে তাঁদের দায়িত্বও বাড়বে। এবং এও সত্য যে, নগর রক্ষার প্রধান কাজ হলো তার সড়ক ব্যবস্থাকে সুষ্ঠু রাখা। কারণ নগরীর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে মসৃণ সড়ক। সভ্যতা ও রুচিরও প্রকাশ থাকে সড়ক পরিকল্পনা ও রক্ষণাবেক্ষণে। অতএব এখানে কৈফিয়ৎ বা গাফিলতি না দেখিয়ে সততার সঙ্গে কাজ করাই উচিত।

মধ্যপ্রাচ্যে আবার উত্তেজনা

গত শনিবার রাবাতে আরব রাষ্ট্রসমূহের অষ্টম গ্রীষ্মকালীন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সম্মেলনে আরব অধিকৃত এলাকার মুক্তির প্রশ্নে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা করা হয়েছে। আরব রাষ্ট্রসমূহের নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থা ও প্যালেস্টাইন সংক্রান্ত বিষয়ের উপর বিভিন্ন রাজা, প্রিন্স ও প্রেসিডেন্টগণ তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। প্যালেস্টাইন মুক্তি সংস্থার চেয়ারম্যান ইয়াসির আরাফাতও ঐ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেছেন। সম্মেলনে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি স্থাপন সম্পর্কে জেনেভায় অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সভায় যে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে সে ব্যাপারে আরব রাষ্ট্রের নেতৃবৃন্দ মতামত ব্যক্ত করেছেন। জেনেভা সম্মেলনে আফ্রিকার দু’টি দেশ সোমালিয়া ও সুদান মধ্যপ্রাচ্যের প্রশ্নে যে প্রস্তাব উত্থাপন করেছিল সে সম্পর্কে আরব নেতাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে এবং আরব-আফ্রিকার মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ক আরো জোরদার করার স্বপক্ষে তারা মতামত ব্যক্ত করেছেন। এছাড়া আরবদের নিজেদের সম্পর্কে ও ইউরোপের নয়টি দেশ বিশিষ্ট অর্থনৈতিক কমিটির সঙ্গে তাদের কথাবার্তা শুরু করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কেও সম্মেলনে রাষ্ট্রনায়কদের মতবিনিময় হয়েছে।
নিঃসন্দেহে এ কথা বলা চলে যে, আরব রাষ্ট্রসমূহের এই সম্মেলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং অর্থবহ। মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রশ্নটিকে নিয়ে আজ যে টালবাহানা শুরু হয়েছে তার নিষ্পত্তি হওয়ার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত হয়ে পড়েছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের মহা সম্মেলনে মধ্যপ্রাচ্য প্রসঙ্গ বিশেষ করে প্যালেস্টাইন মুক্তি সংস্থার পক্ষ থেকে সম্মেলনে প্রতিনিধিত্ব করার যে সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে তাতে সমস্যার সমাধান হবেই এমন আশা করা বৃথা। প্যালেস্টাইন মুক্তি সংস্থার চেয়ারম্যান জনাব ইয়াসির আরাফাত সম্প্রতি এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ইসরাইল তার নীতি পরিবর্তন না করলে মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধ বাঁধবে। মার্কিন সমর্থনপুষ্ট ইসরাইলী সামরিক মহল তাদের বর্তমান ভাবনা-চিন্তা বজায় রাখলে পঞ্চমবারের মতো যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। জনাব আরাফাত আরো জোর দিয়ে বলেছেন—প্যালেস্টাইন মুক্তিযোদ্ধারা বৈধ উপায়ে সৎ সামরিক পন্থায় তাদের অধিকার অর্জন করবে। এদিকে লেবানন সীমান্তে প্রচুর গোলাগুলি বিনিময়ের এক সংবাদ প্রকাশ পেয়েছে। গত রোববার লেবানন ও ইসরাইলী সৈন্যদের মধ্যে গোলা বিনিময় হয়েছে এবং গোলান মালভূমি এলাকায় সিরিয়া সীমান্তে ইসরাইলী বাহিনীর অগ্রবর্তী ঘাঁটিগুলোর শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। বস্তুতঃ মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি স্থাপনের উদ্যোগের পর্বে এবং প্যালেস্টাইনীদের পক্ষ থেকে বক্তব্য শোনার জন্য জাতিসংঘের সুযোগ দানের শুরুতেই এ ধরনের যুদ্ধংদেহী তৎপরতা নিঃসন্দেহে শুভ লক্ষণ নয়। আমরা মধ্যপ্রাচ্যের যথার্থ শান্তি কামনা করি। এ কারণে প্যালেস্টাইনীদের মুক্তি সংগ্রাম এবং তাদের ন্যায়সঙ্গত দাবীর ব্যাপারটি যাতে মীমাংসা হয়ে পরিস্থিতি বিশ্বশান্তির পক্ষে অগ্রসর হয় তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ সাধারণ পরিষদের সদস্য দেশগুলোকে অবিলম্বেই গ্রহণ করা উচিত বলে আমরা মনে করি।

বন্ধুত্বের মার্কিন ঐতিহ্য

একে যদি অপরকে সাহায্য করে, তাহলে পরস্পরের মধ্যে বন্ধুত্বের বন্ধন দৃঢ় হয় এবং এক বন্ধু যদি অপর বন্ধুকে সাহায্য করে তবে তা মার্কিন ঐতিহ্যে পরিণত হয়। নেলসন রকফেলার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট সম্প্রতি ‘টাইমস’ পত্রিকার প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাতকার দিতে গিয়ে ‘বন্ধুত্ব মার্কিন স্টাইল’ সম্পর্কে এক অভিনব বক্তব্য উপস্থিত করেছেন। মিঃ নেলসন রকফেলার বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ হেনরী কিসিঞ্জার একদা প্রেসিডেন্ট নিক্সনের অধীনে চাকুরী গ্রহণ করবেন কি করবেন না, এই নিয়ে দারুণ দ্বিধা-দ্বন্দ্বের দোলায় দোল খাচ্ছিলেন। কারণ, ডঃ কিসিঞ্জার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা এবং অন্যত্র উপদেশকের কাজ করে রীতিমতো মোটা অংকের টাকাই উপার্জন করতেন। অর্থনৈতিক দিক থেকে তাঁর অবশ্য স্বাচ্ছন্দ্যই ছিল বলা যেতে পারে। সে জন্য ডঃ কিসিঞ্জার প্রেসিডেন্ট নিক্সনের অধীনে চাকুরী করার ব্যাপারে তেমন আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু কথায় বলে ‘বন্ধুত্বের আহ্বান নাকি দূরে ঠেলে ফেলে দেয়া যায়না।’ মিঃ নেলসন কিসিঞ্জারকে নিক্সনের অধীনে চাকুরী নেয়ার জন্য আহ্বান জানান। কিসিঞ্জার বন্ধুর ডাক সরাসরি উপেক্ষা করতে পারেন না এবং তাই তিনি শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নাকি কিসিঞ্জারকে পঞ্চাশ হাজার ডলার দানও করেছিলেন। সে জন্যেই কিসিঞ্জার নাকি নিক্সনের উপদেষ্টা হতে উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন। হবেও বা, বন্ধুত্বের এমন লোভনীয় হাতছানি কি কেউ কখনো পায়ে মাড়াতে পারে? কিসিঞ্জারও হয়তো তা পারেননি। বরং তিনি বন্ধুত্বের মর্যাদা অক্ষুন্ন রেখেছেন। মিঃ নেলসনও বন্ধু হিসেবে অপর বন্ধুকে সাহায্য করতে পেরে মার্কিন ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছেন এবং সম্প্রতি তাই গর্বের সঙ্গেই বলে বেড়াচ্ছেন যে, এক বন্ধু অপর বন্ধুকে সাহায্য করবে, এটি আমেরিকান ঐতিহ্য, এই ঐতিহ্যের প্রতি মিঃ নেলসনের বিশ্বাস সুগভীর। সত্যি বন্ধুত্ব জিনিসটি বড়োই উপাদেয়। যদি সে বন্ধুত্বের মধ্যে মার্কিনী ঐতিহ্য আবিষ্কৃত হয়, তাহলে তো কোনো কথাই নেই। দেয়া-নেয়ার মধ্যে গড়ে ওঠা বন্ধুত্বের রজ্জুকে শিথিল করে কার এমন সাধ্য!

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!