You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.11.11 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | ধান-চালের সংগ্রহ মূল্য ঘোষণা | উন্নতমানের সোনালী আঁশ | অচল টেলিফোন সচল করার নির্দেশ | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা : ১১ই নভেম্বর, রোববার, ১৯৭৩, ২৫শে কার্তিক, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

ধান-চালের সংগ্রহ মূল্য ঘোষণা

গত শুক্রবার এক সাংবাদিক সম্মেলনে খাদ্যমন্ত্রী শ্রী ফণীভূষণ মজুমদার ধান-চালের সংগ্রহ মূল্য ঘোষণা করেছেন। ঘোষণা অনুযায়ী সরকার কৃষকদের কাছ থেকে ধান ৪৫ টাকা মণ দরে, মোটা চাল ৭১ টাকা ৬৯ পয়সা এবং মাঝারী ধরনের চাল ৭২ টাকা ৬৩ পয়সা মণ দরে কিনবেন।
খাদ্যমন্ত্রী এই মূল্যকে কৃষকদের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্যে উৎসাহপ্রদ বলে আখ্যায়িত করেন। চলতি বাজার দরের চাইতে এই দর যুক্তিসঙ্গত।
আগামী ১৫ই নভেম্বর থেকে সরকার সারাদেশে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান আরম্ভ করবেন। এই ধান-চাল সংগ্রহের জন্যে প্রয়োজনীয় অর্থ, গুদাম ও পরিবহনের সবরকম বন্দোবস্ত ইতিমধ্যেই সম্পন্ন করা হয়েছে। ধান গুদামজাত করার জন্যে বর্তমান সরকারের হাতে ১২টি সিএসডি ও ৩২০টি আইএসডি গুদাম রয়েছে। বিভিন্ন স্থানে প্রয়োজন হলে যাতে আরো গুদাম ভাড়া করা যায় তার বন্দোবস্তও করা হচ্ছে।
সারাদেশে ধান-চালের দর সুষম ও স্থিতিশীল রাখার জন্যে ও খাদ্য সংকট মোকাবেলা করার উদ্দেশ্যেই সরকার এ আইনগত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। এ ব্যবস্থায় ২০ দিনের ঊর্ধ্বে খাদ্যশস্য মওজুত নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এ উদ্যোগকে সফল করে তোলার দায়িত্ব একদিকে যেমন সকল দেশপ্রেমিক নাগরিকের উপর অর্পিত তেমনি প্রশাসন যন্ত্রে যাঁরা নিয়োজিত তাঁদেরও। সকলের মিলিত প্রচেষ্টাতেই এ অভিযান সাফল্যমন্ডিত হবে।
প্রসঙ্গতঃ বলা প্রয়োজন যে, বিরোধীদল নামধারী কিছু সংখ্যক সাদা পোশাকধারী শহরবাসী খাদ্যের মতো একটি কঠিন সমস্যা নিয়ে অতীতে ঘোলা জলে মাছ শিকার করতে চেষ্টা করছেন এবং এখনও করছেন। তাদের বক্তব্যের মূল লক্ষ্য হলো সরকার খাদ্যশস্য সংগ্রহ ও সরবরাহের বিষয়ে ব্যর্থতা অর্জন করেছেন। তাঁরা এ সাদামাটা কথাটিকে বেমালুম ভুলে গেছেন যে, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে যেখানে দুর্ভিক্ষ অনিবার্য ছিলো সেখানে বাংলাদেশে না খেয়ে একজন মানুষও মরেনি। জাতিসংঘের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জ্যাক এন্ডারসন অনেকবারই একথা স্বীকার করেছেন। খাদ্য সংগ্রহের জন্যে সরকারকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হচ্ছে। বন্ধুদেশগুলোর কাছে খাদ্য সরবরাহ করার জন্যে জানাতে হচ্ছে আকুল আবেদন। সরকার বর্তমানে ধান-চালের যে সংগ্রহ মূল্য ঘোষণা করেছেন তা চলতি মওসুমের বাজার দর থেকে তুলনামূলকভাবে বেশী। সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে আমদানীকৃত খাদ্যশস্য সরকারকে দেশের অভ্যন্তরে সরবরাহ করতে হচ্ছে অনেক কম মূল্যে। এ কম মূল্য অর্থাৎ সাবসিডি রেশনিং প্রথার মাধ্যমে ভোগ করছেন সাদা পোশাকধারী শহরবাসী মুষ্টিমেয় মানুষ। সারাদেশের তুলনায় তাদের সংখ্যা সমুদ্রে গোষ্পদ তুল্য। অথচ তারাই খাদ্যশস্য সংকট নিয়ে তর্জন গর্জন করে থাকেন সবচেয়ে বেশী।
সাংবাদিক সম্মেলনে এক প্রশ্নের উত্তরে খাদ্যমন্ত্রী বলেছেন, সবকিছু ঠিক থাকলে সরকার এ বছর শহর ও গ্রাম উভয় অঞ্চলেই জনসাধারণের জন্যে রেশনিং ব্যবস্থায় পর্যাপ্ত খাদ্যশস্যের ব্যবস্থা করতে পারেন।
এ প্রশংসনীয় উদ্যোগ সফল হোক এ আশাই আমরা করছি। আমরা আরো আশা করি গ্রাম বাংলার নিরীহ জনসাধারণও রেশনিং ব্যবস্থার পরিপূর্ণ সুযোগ আগামীতে পাবে।

উন্নতমানের সোনালী আঁশ

সোনালী আঁশের জন্যে খ্যাত এই বাংলাদেশ। এদেশের নরম পলিমাটিতে পর্যাপ্ত সোনালী আঁশ তথা পাট জন্মে এবং এ কথায় সন্দেহের অবকাশ নেই যে, পাটই বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল এবং পাটের উপর বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। কারণ দেশে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার শতকরা পঁচাশি ভাগই আসে পাট ও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানী করে। সুতরাং পাটকে টিকিয়ে রাখতে না পারলে এদেশের অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনার প্রয়াস পাওয়া তো দূরের কথা—একে রক্ষা করাই সম্ভবপর হবে না।
এরই প্রেক্ষিতে কৃষিমন্ত্রী পর্যাপ্ত পরিমাণে উন্নতমানের পাট উৎপাদনের জন্যে পাট চাষী ও সংশ্লিষ্ট মহলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তেজগাঁও পাট গবেষণা কেন্দ্রে কৃষি বিভাগের সহকারী পরিচালক এবং পাট সম্প্রসারণ বিভাগের অফিসারদের চারদিন ব্যাপী প্রশিক্ষণ সেমিনারে কৃষিমন্ত্রী উক্ত আবেদন রাখেন।
প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, পাটশিল্পের যথার্থ উন্নয়নের দ্বারা দেশে যে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনীতি গড়ে তোলা যায় সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মহল সচেতন। সেজন্যে তাঁরা উন্নতমানের পাট উৎপাদনের প্রতি জোর দিয়েছেন। কারণ এ কথা সত্য যে, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে পাট ও পাটজাত দ্রব্যের মানকে উন্নত করতেই হবে।
পাট শিল্প ও পাট চাষ সম্বন্ধে ন্যায্য দাম না পাওয়া, পাট চাষীদের দুর্ভোগ, পরিবহনের অব্যবস্থা ইত্যাদি অভিযোগ আজ তীব্র আকার ধারণ করেছে। সেই প্রসঙ্গে কৃষিমন্ত্রী পাট চাষীদের অর্থনৈতিক দুরবস্থা এবং পাটের উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করার জন্যে পাট বিভাগের সকল কর্মচারীর প্রতি আহ্বান জানান।
এছাড়া বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতার জন্যে উন্নতমানের পাট উৎপাদনের সহায়ক শর্ত হিসেবে কয়েকটি প্রস্তাবও এই সেমিনারে পেশ করা হয়। প্রথমতঃ পাট চাষীদের মধ্যে পাট উৎপাদন সম্পর্কে আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে। এর জন্যে কৃষকরা যেন ন্যায্য দাম পায় তার দিকে কড়া লক্ষ্য রাখতে হবে। কৃষকদের উপর জবরদস্তি নয়—কতটা জমিতে তারা পাট চাষ করবে সে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকারও তাদেরই দিতে হবে। থানা, মহকুমা ও জেলা পর্যায়ে কৃষকদের সংঘবদ্ধ করে তুলতে হবে এবং সর্বোপরি পাট বিষয়ে সরকারী নীতি ও কার্যক্রম এমনভাবে গ্রহণ করতে হবে যেন কৃষকরা পাট চাষে অনুপ্রাণিত হয়।
দ্বিতীয়তঃ পাট চাষের ব্যাপারে যে সকল উচ্চ পর্যায়ের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিলো তা কার্যকরী করতে হবে। কিছুকাল পূর্বে চার লাখ একর জমিতে পাট চাষের জন্যে যে ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিলো, জনশক্তি ও অন্যান্য অসুবিধার জন্যে যা আজও বাস্তবায়িত হচ্ছে না, সেই কাজে হাত দেওয়ার আশু তাগিদ সৃষ্টি করতে হবে।
তৃতীয়তঃ পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলোতে কৃত্রিম পাট উৎপাদন হতো, সম্প্রতি তেলের মূল্য বৃদ্ধির ফলে সেই উৎপাদনের ক্ষেত্রে যে বিরাট অসুবিধার সৃষ্টি হয়েছে সেই সুযোগে শুধু পাট উৎপাদন বৃদ্ধি নয়, উন্নতমানের পাট উৎপাদন করে স্থায়ীভাবে পাটের আন্তর্জাতিক বাজার দখল করার চেষ্টা করা ‍উচিত।
উল্লেখিত প্রস্তাবের সবগুলোই সম্ভাবনায় পূর্ণ। প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়িত হলে দেশের সার্বিক মঙ্গল সুনিশ্চিত। পাট গবেষণা কেন্দ্রের উদ্যোগে আয়োজিত এই সেমিনার তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এরই প্রেক্ষিতে গবেষণা সহ সকল প্রকার পরিকল্পনা ও কাজে সংশ্লিষ্ট মহল, পাট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত অফিসার ও কর্মচারীবৃন্দ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিবেদিতপ্রাণে কাজ করে যাবেন বলেই আমাদের বিশ্বাস।

অচল টেলিফোন সচল করার নির্দেশ

ডাক, তারবার্তা ও টেলিফোন দপ্তর থেকে এক নির্দেশ জারী করা হয়েছে। নির্দেশে বলা হয়েছে বঙ্গভবন, প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, জাতীয় সংসদ সদস্য, সরকারী অফিস, স্বায়ত্তশাসিত অফিস, বিদেশী দূতাবাস, দৈনিক পত্রিকাসমূহ, সংবাদ সরবরাহ প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির টেলিফোন খারাপ হলে অভিযোগ পাওয়ার ২৪ ঘন্টার মধ্যে সারিয়ে দিতে হবে। ব্যক্তিগত টেলিফোনগুলো সর্বাধিক ৪৮ ঘন্টার মধ্যে সারিয়ে দিতে হবে বলে সরকারী হ্যান্ড আউটে প্রকাশ।
বর্তমান যুগে টেলিফোনের আবশ্যকতার কথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। অত্যাবশ্যকীয় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মধ্যে শিক্ষিত ও আধুনিক সমাজে টেলিফোন একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বস্তু। টেলিফোন দূরের পৃথিবীকে মানুষের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। এবং সে কারণেই বর্তমান যুগে টেলিফোনের ব্যবহার শুধু বেড়েই চলেনি, এর গুরুত্বও বেড়ে চলেছে বিপুল পরিমাণে।
অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশে পর্যাপ্ত টেলিফোন নেই। উপরন্তু সেগুলোর অধিকাংশ প্রায়ই বিকল হয়ে থাকে। আর একবার বিকল হলে তা সারাতে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস অতিবাহিত হলেও তা আর সুস্থ হয়ে ওঠে না। বিশেষ করে বিগত কয়েকমাস ধরে টেলিফোন বিকলের যেন মড়ক লেগে গেছে। প্রায়ই বিভিন্ন ত্রুটিতে টেলিফোন ব্যবহারে শুধু অসুবিধাই হচ্ছে না, বরং এই অত্যাবশ্যকীয় যন্ত্রটি নিয়ে নানা সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। আর টেলিফোনের ক্রুটির দরুণ উদ্ভূত সমস্যা গোটা দেশ ও জাতির জন্যে কেবল অকল্যাণ বয়ে আনছে। সুতরাং অভিযোগ পাওয়ার ২৪ ঘন্টার মধ্যে তা সারিয়ে দেবার সরকারী নির্দেশ নিঃসন্দেহে একটি শুভ কাজ। কিন্তু কথা হচ্ছে কেবলমাত্র নির্দেশ জারী হয়ে থাকলেই এতদসংক্রান্ত সমস্যার সমাধান হবে না। দেয় নির্দেশ যথাযথ কার্যকরী হচ্ছে কিনা সেটাই বড় প্রশ্ন।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, যানবাহনের ভাড়া নির্ধারণের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ বেশ ক’বার বিভিন্ন নির্দেশ জারী করেছেন এবং ঘোষণা করেছেন। কিন্তু কার্যতঃ তার ফল কিছুই হয়নি। এ নির্দেশের পরিণতিও সে রকম হবে না বলেই আমরা আশা করি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন