বাংলার বাণী
ঢাকা: ২২শে অক্টোবর, সোমবার, ৫ই কার্তিক, ১৩৮০
হিসাব আগেও মেলেনি এখনো মিলবে না
খবরটা ছোট্ট হলেও তাৎপর্যপূর্ণ বৈকি। খবরে প্রকাশ চীন নেপালের জুমলা এলাকায় বিরাট তৃণভূমির উপর অধিকার দাবি করেছে। গত বৃহস্পতিবার নেপালের ব্যবসায়ীরা টাকলা কোটমন্ডী থেকে বাণিজ্য করে ফিরে আসার পর এ তথ্য পরিবেশন করে। চীন নেপালকে উক্ত তৃণভূমি ব্যবহার করতে নিষেধ করে দিয়েছে। এই দাবি নেপাল কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য একটি প্রতিনিধিদল বিভাগীয় সদর দফতর মহেন্দ্র নগরের পথে রয়েছে। জুমলা এলাকা তিব্বতের একটি উৎকৃষ্ট চারণভূমি।
প্রকাশিত খবর অনুসারে স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন উত্থাপিত হবে যে, দীর্ঘদিন পর হঠাৎ চীন জুমলা এলাকার চারণভূমি নিয়ে মাথা চাড়া দিয়ে উঠল কেন? জুমলা এলাকা যদি চীনেরই হয়ে থাকে তাহলে এতদিন এ সম্পর্কে কোনো উচ্চবাচ্য করেনি?
আপাতঃদৃষ্টিতে চীনের এহেন কার্যকলাপকে খামখেয়ালি সূচক মনে হলেও চীন কিন্তু ঝোপ বুঝে কোপ মারতে চেষ্টা করেছে। জুমলা চারণ ভূমির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে এমন একটি সময়ে যখন নেপালের রাজা ও রানী ভারত সফর করে দেশে ফিরে এসেছেন। নেপালের বর্তমান রাজা প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে মৈত্রীর বন্ধন সুদৃঢ় করতে আগ্রহী। ভারত সফরকালে নেপালের রাজা পারস্পারিক প্রীতি, শুভেচ্ছা ও বন্ধুত্বের কথাই বলেছেন। নেপালের রাজার সাম্প্রতিক সফরকে কিন্তু চীন খুব একটা সুনজরে দেখতে পারেনি। নেপালের সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্বের সেতু বন্ধন সুদৃঢ় হোক এটা কোন অবস্থাতেই চীনের কাম্য নয়। সুতরাং ‘আককল মন্দ কোলিয়ে ইশারাই কাফি’ অর্থাৎ বুদ্ধিমানের জন্য ইশারাই যথেষ্ট এ উপমার যথার্থতা প্রমাণ করার জন্য ইশারাই যথেষ্ট এ উপমার যথার্থতা প্রমাণ করার জন্যই চীন অকস্মাৎ উদ্ভট ও আজগুবি দাবি উত্থাপন করেছে। উদ্দেশ্য হল নেপাল যেন এ জুমলা চারণভূমির সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে আলোচনার জন্য এগিয়ে যায়। আর আলোচনায় বসলে আকারে-ইঙ্গিতে নেপালকে বুঝিয়ে দেয়া যে জুমলা চারণভূমি-টুমি ওসব কিছু নয়। আসল কথা হলো ভারতের সঙ্গে বেশি মাখামাখি করা চলবে না। যদি চলে তাহলে কিন্তু চীনের এই সম্প্রসারণবাদী হিসেবটা যে আদৌ নতুন নয় তা আর বিস্তারিত বিশ্লেষণ এর অপেক্ষা রাখে না। অতিপরিচিত সম্প্রসারণবাদী কৌশল ইতিপূর্বে ভারতের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছিল। আর তারই ফলশ্রুতিতে বাষট্টি সালে ভারতের ওপর হয়েছিল অতর্কিত চীনা হামলা। একাত্তর সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন ভারত-বাংলাদেশের ন্যায় সঙ্গত সংগ্রামকে সাহায্য ও সহযোগিতা করাতে একই কৌশল প্রয়োগ করে চীনা এলাকায় ভারতীয় মেষ প্রবেশ করেছে বলেও হুমকি দিয়েছিল। অবশ্য চীনা হুমকিতে ভারত আদৌ কর্ণপাত করেনি।
ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে যে বাষট্টি সালে চীনা হামলার ফলে ভারতের লাভই হয়েছে। ভারত তারপর থেকেই অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। ভারতকে এখন আর ইচ্ছে করলেই হুমকি দিয়ে বা হামলা করে কাবু করা যাবে না। স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে ভারতের ক্ষেত্রে চিনা অংকের হিসাব মেলেনি। জুমলা চারণ ভূমি নিয়ে নেপালের সঙ্গে চীন যে নতুন হিসাব-নিকাশের খাতা খুলতে চাচ্ছে তাও মিলবে না। মিলতে পারেনা। অন্ততঃ ইতিহাস সে কথা বলে না।
বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা কাউন্সিল
সরকার বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা কাউন্সিল গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং শিগগিরই এই কাউন্সিল গঠিত হচ্ছে। গত শুক্রবারের বাংলার বাণীতেই এ খবর বেরিয়েছে। (ক) বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা মূলক কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সমস্যার সমাধান বিজ্ঞান ও গবেষণা মূলক কাজে উৎসাহ, উন্নয়ন, দিক নির্দেশ, তত্ত্বাবধান ও পরিচালনার প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখা, (খ) গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য জাতীয় প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন অথবা প্রতিষ্ঠা এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক সম্পদের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা, (গ) কাউন্সিলের গবেষণা কাজ থেকে সৃষ্ট ও আবিষ্কৃত সম্পদে পূর্ণ সদ্ব্যবহার ও উন্নয়নে প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখা এবং (ঘ) বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বৈজ্ঞানিক ও গবেষণা মূলক সংস্থাগুলোর সঙ্গে কার্যকরী যোগাযোগ স্থাপন করা ইত্যাদি হবে এই কাউন্সিল গঠনের মূল উদ্দেশ্য।
প্রাগ্রসর বর্তমান বিশ্ব বৈজ্ঞানিক সভ্যতা এবং শিল্প উন্নয়নের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাই তো কি সমাজতান্ত্রিক অথবা উভয় প্রকার দেশগুলোতে ব্যাপক উন্নয়ন এবং প্রসার ঘটেছে বিজ্ঞান এবং শিল্পের। বর্তমান বিশ্বের উন্নত দেশ রাশিয়া, জাপান, জার্মানি, আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স ইত্যাদি যে কোনটির দিকেই লক্ষ্য করলে দেখা যাবে বিজ্ঞান এবং শিল্পায়নের ফলে কেবল তারা স্বয়ংসম্পূর্ণই হয়নি, উপরন্তু তাদের উন্নয়নের সুফল উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিস্তার লাভ করতে শুরু করেছে।
আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি সোনার বাংলা নামে পরিচিত। এই পরিচয় কেবল কাব্যিক বা কাল্পনিক নয়, এখানে অনেক ঐশ্বর্য লুকায়িত আছে বলেই এর এই নাম। আমাদের দেশে বিজ্ঞান এবং শিল্পোন্নয়নের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। এ দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে প্রচুর সম্ভার যা মৌলিক গবেষণার মাধ্যমে আবিষ্কৃত বিষয়ে কাজে আসতে পারে।
বিধ্বস্ত দেশকে বাইরে থেকে শুধু ঋণ আর সাহায্য নিয়ে এসে বাঁচানো যাবে না। আমাদের সমস্যা আমাদের সংকট এবং আমাদের সার্বিক প্রয়োজন মেটাতে হবে আমাদের দেশের কারিগরি সম্পদ এবং শ্রম দিয়েই। সুতরাং এর জন্য আশু প্রয়োজন বর্তমান বিশ্বের বৈজ্ঞানিক ও শিল্পোন্নয়নের সাথে সম্পর্ক রেখে মৌলিক গবেষণার মাধ্যমে নতুন জিনিস আবিষ্কার করা। বর্তমান প্রয়োজন মেটানোর প্রচেষ্টা হিসেবে কেবল জিনিসপত্র আমদানি এবং বৈদেশিক কারিগরি, বিশেষজ্ঞের সহযোগিতা গ্রহণ করে ক্ষান্ত হলেই চলবে না। বরং স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলার প্রেক্ষিতে এবং সর্বোপরি সার্বিক প্রয়োজন মেটানোর তাগিদেই আমাদেরকে বিভিন্ন বিষয়ে মৌলিকত্বের অধিকারী হতে হবে এবং সে দিক থেকে বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা কাউন্সিল এর প্রয়োজন এবং গুরুত্বের কথা নতুন করে উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। আমরা মনে করি যথা সম্ভব সত্বর বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা কাউন্সিল গঠিত হবে এবং আমাদের তরুণ বিজ্ঞানী ও গবেষকরা মৌলিক গবেষণার মাধ্যমে নব নব আবিষ্কার এর পূর্ণ সুযোগ পাবেন। এবং তাতে করে নব আবিষ্কার এর ফলশ্রুতিতে শুধু নিজেদের প্রয়োজন মেটানোই সম্ভব হবে না, বরং বিজ্ঞান ও শিল্প উন্নয়নে বাংলাদেশকে উল্লেখযোগ্য আসনে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক