You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.04.28 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | মৈত্রীর জন্য প্রয়োজন পরস্পরকে জানা | সাবান কারখানাগুলোকে চালু করা হোক | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: ২৮শে এপ্রিল, সোমবার, ১৫ই বৈশাখ, ১৩৮১

মৈত্রীর জন্য প্রয়োজন পরস্পরকে জানা

তথ্য দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী ভারত ঘুরে এলেন। ছিলেন দশ দিন। এই দশদিনে দিল্লি, কলকাতায় ভারতীয় নেতা, মন্ত্রী, সাংবাদিকদের সঙ্গে তার আলোচনা হয়েছে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে নিশ্চয়ই কথা বলেছেন। কলকাতায় প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের সাথে তিনি বসেছিলেন। আলাপ আলোচনায় তিনি বুঝেছেন বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে বিরাজমান ‘তথ্যের শূন্যতার’ কথা। একে অন্যকে যে সঠিকভাবে বুঝতে পারছে না, জানতে পারছে না পরস্পরকে এর মূল কারনই হল সেই ‘তথ্যের শূন্যতা’।
দশদিনের এই ভারত সফর শেষে তাই তিনি ঢাকা বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের কাছে এই ‘তথ্যের শূন্যতা’ দূর করার জন্য দুই দেশের মধ্যে অধিকতর তথ্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেছেন, এই উদ্দেশ্যে শীঘ্রই দু’দেশের মধ্যে একটি তথ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে।
প্রতিমন্ত্রীর কথার সুর ধরেই আমরা বলি তিনি যাকে ‘তথ্যের শূন্যতা’ বলেছেন তারই ফলে ইতিমধ্যে এই দুটি (অস্পষ্ট) দেশের মধ্যে নানা ধরনের ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। যে (অস্পষ্ট) বন্ধনে এ দুটি দেশ আবদ্ধ ছিল একে অন্যকে না জানার ফলে, সাধারণ মানুষের মধ্যে পারস্পারিক ভাববিনিময়ের অভাবে ইতিমধ্যেই তাতে কিঞ্চিৎ হলেও ভাটা পড়েছে। এই ‘তথ্যের শূন্যতার’ সুযোগে একশ্রেণীর মতলববাজ লোক ঢালাওভাবে গুজব এবং অপপ্রচার চালিয়েছে। সন্দেহ-সংশয় দানা বেঁধেছে।
অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। পাকিস্তানি আমলে বাংলাদেশের মানুষের মনে ভারতীয়দের জন্য যে আবেগ অনুভূতি সঞ্চিত ছিল, স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তা আরো শত গুণ বৃদ্ধি পায়। শুধু ভারতের সরকারই নয় বরং সাধারণ মানুষ এই সংগ্রামে যে আন্তরিকতা নিয়ে এ দেশের মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল তার দু’দেশের মানুষের বন্ধনকে দৃঢ় করে। অথচ সময় যাবার সঙ্গে সঙ্গে সে সবই যেন যেমন ম্লান হতে বসেছে।
স্বাধীনতাত্তোরকালে বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে উপলব্ধি করা হয়। এই উদ্দেশ্যে দু’দেশের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল কথা ছিল। এই চুক্তির অধীনে উভয় দেশ বই-পুস্তক চলচ্চিত্র বিনিময় করবে। ভারত থেকে আসবেন লেখক, সাংবাদিক, শিল্পী। বাংলাদেশ থেকেও তারা যাবেন। দুই দেশের মানুষের মধ্যে স্থায়ী সেতুবন্ধন রচিত হবে।
কিন্তু হয়নি। চুক্তি অনুযায়ী কাজ হয়নি। ও দেশ থেকে আসেনি বই-পুস্তক চলচ্চিত্র। এদেশ থেকেও যায়নি। প্রতিনিধিদল এদেশ-ওদেশ যারা ঘুরেছেন তারাও তেমন কার্যকরী কোন চাপ রাখতে পারেনি। অনেকটা শুভেচ্ছা সফরে এসেছেন গেছেন। ও দেশের লোকেরা এ দেশে এসেছেন। মৈত্রী-ভালোবাসার কথা বলেছেন, ইলিশ মাছের স্বাদ নিয়ে আলোচনা করেছেন। এদেশের যারা গেছেন তাজমহলের সৌন্দর্য উপভোগ করেছেন, আজমীর শরীফের মাজার জিয়ারত করেছেন। ব্যাস ঐটুকুই।
প্রতিমন্ত্রী তথ্যবিনিময় গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেছেন। অথচ ভারতের কোন শহরে এদেশীয় পত্রিকার কোন প্রতিনিধি নিয়োগ অথবা অফিস স্থাপন যে কতটুকু দুঃসহ ব্যাপার তা শুধু ভুক্তভোগী মাত্রই উপলব্ধি করতে পারেন। যদি সত্যি তথ্য বিনিময় ব্যাপারে মন্ত্রী মহোদয় আগ্রহী হয়ে থাকেন তবে তিনি এদিকটা একটু ভেবে দেখবেন বলে আমাদের বিশ্বাস।
আর একটি কথা আমরা না বলে পারছিনা। প্রতিবেশীর দুটি দেশের মধ্যে মৈত্রী অক্ষুন্ন রাখা এবং তা বৃদ্ধি করার ব্যাপারে বৃহত্তর প্রতিবেশীর যে একটি বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে সেটা নিশ্চয়ই কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। অনিবার্য কারণে ক্ষুদ্রতর দেশের জনসাধারণ একটু বেশি স্পর্শ কাতর হয়ে থাকে তাদের সেই অনুভূতির দিকে দৃষ্টি রেখে বৃহৎ প্রতিবেশী দায়িত্বশীল লোকেরা তাদের বক্তব্য রাখলে অনেক ভুল বুঝাবুঝি এড়ানো সম্ভব। আর এ ব্যাপারে সংবাদপত্রের ভূমিকা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ।
তথ্য বিনিময় চুক্তি সম্পাদন এবং তার বাস্তবায়ন নবযাত্রা সূচনা করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। আমরা মনে করি দুই দেশের সাধারণ মানুষ একে অন্যের সঙ্গে এক নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ। পারস্পারিক ভাব বিনিময় সে বন্ধনকে দৃঢ়তরই করবে।

সাবান কারখানাগুলোকে চালু করা হোক

সম্প্রতি পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক সংবাদে জানানো হয় তাল্ল, নারিকেল তেল, কষ্টিক সোডা ইত্যাদি কাঁচামালের অভাবে দেশের প্রায় তিন’শ মেকানাইজড কারখানা গত তিন মাস ধরে বন্ধ রয়েছে। এই তিন’শ কারখানাই দেশের চাহিদার শতকরা ৬০ ভাগ সাবান উৎপাদন করত। কাঁচামালের অভাবে নন মেকানাইজড কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাবার ফলে দেশে এই ব্যাপক সাবান সংকট দেখা দিয়েছে।
এই সংবাদ সূত্র আরো জানায় যে, গত বছরের প্রথম বাণিজ্য মৌসুমে সাবানের প্রধান কাঁচামাল উৎপাদনকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাল্ল রপ্তানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করার ফলে বাংলাদেশের সাবান উপাদান ব্যাহত হয়। গত বছরের জানুয়ারি-জুন মাসে বাংলাদেশে তাল্ল আমদানি হয়নি। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে কোন অনুদান মঞ্জুর করেনি। অথচ বাংলাদেশে প্রধানতঃ অনুদানের ভিত্তিতেই তাল্ল আমদানি করা হয়। তাছাড়া ওই বাণিজ্য মৌসুমের তাল্ল আনার জন্য সরকারেরও কোনো নগদ বরাদ্দ ছিল না।
সাবান উৎপাদনের অন্য কাঁচামাল কস্টিক সোডা ও নারিকেল তেলের মধ্যে শক্ত কাঁচামালের আমদানি অত্যন্ত নৈরাশ্যজনক। গত জুলাই-ডিসেম্বর বাণিজ্য মৌসুমে ৮৭২ মেট্রিক টন অপরিশোধিত নারিকেল তেল আমদানির চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাত্র ২২০ মেট্রিক টন নারিকেল তেল বাংলাদেশে এসে পৌঁছে। এবং এ পর্যন্ত মাত্র ২৯৭ মেট্রিক টন নারিকেল তেল বিতরণ করা হয়েছে বলে সংবাদ সূত্র জানাচ্ছে।
গত জুলাই-ডিসেম্বরে ৩ হাজার ১৫ মেট্রিক টন কস্টিক সোডা আমদানির চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তার মধ্যে কি পরিমান কস্টিক সোডা আমদানি হয়েছে তা জানা যায়নি। তবে গত দু’টি বাণিজ্য মৌসুমে চুক্তি করার মধ্যে গত জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৩২৮ মেট্রিক টন দেশে এসে পৌঁছেছে এবং বিতরণ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
ওই বাণিজ্য মৌসুমে টিসিবিও ১০ হাজার মেট্রিকটন চাল আমদানি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এবারের চলতি বাণিজ্য মৌসুম অর্থাৎ জানুয়ারি-জুনে ৪ হাজার মেট্রিক টন চাল আমদানির আর এক চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। প্রথমোক্ত চুক্তির মধ্যে ৭ হাজার মেট্রিক টন চাল বাংলাদেশে এসেছে এবং গত জুলাই থেকে এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ছয় হাজার মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। এরমধ্যে আবার বেশিরভাগ পেয়েছে মেকানাইজড সাবান কারখানাগুলো। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, দেশে মেকানাইজড কারখানার সংখ্যা মাত্র ১২টি।
এছাড়াও সরকার গত বাণিজ্য মৌসুমের প্রাইভেট সেক্টরের মেকানাইজড ও নন মেকানাইজড সাবান কারখানা গুলোকে যথাক্রমে তাদের ষান্মাসিক বরাদ্দের শতকরা ৫০ ভাগ ও ২৫ ভাগ আমদানির অনুমতি দিয়েছিলেন। এবং সেক্টর কর্পোরেশনের অধীনে বিভিন্ন সাবান কারখানাকে চাহিদার বিপুল পরিমাণ নারকেল তেল আমদানির অনুমতিও দেয়া হয়। সেখানেও ঘাপলা। প্রকৃতপক্ষে আমদানির ক্ষেত্রে এই ঔদাসীন্য ও লক্ষ্য পৌঁছার প্রতি লঘু মনোভাবই সাবান সংকটের মূলে ক্রিয়া করছে বলে আমাদের ধারণা।
আবার অন্যপক্ষে কাঁচামালের অভাবে উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে তাই নয় সাবানের দাম সেই জন্য দু’গুণ বা তিন গুণ বেড়েছে। যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি ও বাংলাদেশের সাবান শিল্পের প্রভাব বিস্তার করেছে, তবু বলা যায় সাবানের দাম কাঁচামালের তুলনায় অধিক বেড়েছে।
প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, রাজস্ব বোর্ড মেকানাইজড কারখানার সাড়ে ৫ আউন্স সাবানের দাম বেঁধে দিয়েছিলেন ৭০ পয়সা। এই দামে বিক্রি করলে তাদেরকে সরকারের ডিউটি দিতে হয় না। ৭০ পয়সা সাবান এক টাকায় বিক্রি করলে শতকরা ১৫ ভাগ ডিউটি ধরা হয়। এই নিয়ম অনুযায়ী ৭২ সালের কাঁচামালের ভিত্তিতে একটি সাবানের শতকরা ২০ ভাগ ডিউটি দিয়েও কারখানাগুলোর প্রচুর লাভ থাকতো। বর্তমানে কাঁচামালের অভাবে তারা ৭০ পয়সা সাবানের দাম দুই টাকায় নিয়ে গেছে। তবুও নাকি তাদের লাভ থাকছে না। আর স্বভাবতই নন মেকানাইজড কারখানায় উৎপাদন খরচ বেশি লাভের সম্ভবনা তাদের আরো কম।
একদিকে কাঁচামালের তীব্র অভাব, অন্যদিকে লাভ বঞ্চিত ব্যবসায়ের ভার-এই দুই চাপে সাবান শিল্প আজ ধবংসের পথে। আমরা জানি স্বাধীনতা লাভের পর থেকে প্রতিটি ক্ষেত্রে সমস্যা যেন চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে। দুঃখের কথা এই সমস্যার মূল অনুসন্ধান করলে সংশ্লিষ্ট মহলের প্রকটিত হয়।
সাবান যদিও খাদ্য নয় তবুও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মধ্যে অন্যতম অপরিহার্য দ্রব্য। অন্যান্য দ্রব্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এর দাম যদি এভাবে বাড়তে থাকে এবং সাবান কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যায় তাহলে জনজীবনের সার্বিক ভোগান্তি যে আরও অবনতির খাদে গড়াতে থাকবে, তা বলা বাহুল্য। অতএব বলা যায়, দেশের এই গঠনমূলক পর্যায়ে দেশীয় ছোটখাটো কারখানাগুলো চালু থাকে, উৎপাদন অব্যাহত থাকে এবং খুচরা জিনিসের অভাব এ যেন জনজীবন অধিকতর বিপদগ্রস্থ না হয় সেদিকে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের আশু দৃষ্টি প্রয়োজন। মনে রাখা উচিত, দেশ গঠনে পদক্ষেপ গ্রহণে কোনো সোপানই উপেক্ষণীয় নয়। সেক্ষেত্রে আভ্যন্তরীণ উৎপাদন যন্ত্র গুলোর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব রাখা বাঞ্ছনীয়। কারণ অধিকাংশ জনজীবনের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের চাহিদা দেশীয় উপকরণেই মেটাতে হবে। তাই অবিলম্বে সাবান শিল্পের উন্নতির বিধানকল্পে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে অবিলম্বে সাবানের দাম নন মেকানাইজড কারখানাগুলোকে চালু করার ব্যবস্থা নেয়া হোক।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন