You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ২১শে জুন, শনিবার, ৭ই আষাঢ়, ১৩৮১

মুদ্রণ শিল্পের সংকট

দেশের প্রকাশনা বা মুদ্রণ শিল্প এক ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে এসে পড়েছে। যেকোনো মুহূর্তে দেশের ছাপা কারখানাসমূহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। মুদ্রণ শিল্পের যন্ত্রাংশ ও কাঁচামালের অভাব ও মূল্য বৃদ্ধির ধরুন এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। জানা গেছে, ইতিমধ্যে অনেক ছাপাখানার চাকা বন্ধ হয়ে গেছে, বহু শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। ছাপাখানার এর সংকটের নানা ধরনের প্রকাশনাসহ গন্থাবলীর প্রকাশনী মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। একটা সংবাদে প্রকাশ, সুলভে ও সুষ্ঠুভাবে ছাপার উপাদান সামগ্রী সরবরাহ করার ব্যবস্থা অতি সত্বর গৃহীত না হলে দেশের শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশ ব্যাহত হবে। প্রকাশ, শিল্পের কাঁচামাল অর্থাৎ কাগজ, কালী, টাইপ, কেস, গেলি, ব্রাশ, ব্লক ইত্যাদির মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যয় দরুণ ছোট এবং মাঝারি ধরনের ছাপাখানা গুলোর সবচাইতে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। কাগজের মূল্য বৃদ্ধিই এর মধ্যে সবচাইতে উদ্বেগের কারণ। সরকার ন্যায্যমূল্যে কাগজ বিক্রির জন্য ডিলার নিযুক্ত করা সত্ত্বেও ন্যায্যমূল্যে কোথাও কাগজ পাওয়া যাচ্ছেনা। ন্যায্যমূল্যের সাদা কাগজ ও নিউজপ্রিন্ট খোলা বাজারে রিম প্রতি ৫০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। ফলে কাগজের অভাবে কোন ছাপাখানা কাজে হাত দিতে পারছেনা। উল্লেখিত ওই সংবাদে একটি প্রয়োজনীয় তথ্য পরিবেশন করে আরও বলা হয়েছে যে, এমনি শঙ্কট যদি অপ্রতিহত গতিতে চলতে থাকে তাহলে অনিবার্যভাবে লাখ লাখ ছাপাখানা শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বে। দেশে প্রায় পাঁচ হাজার ছোট-বড় ছাপাখানা রয়েছে। ঢাকা নগরীতে রয়েছে প্রায় পনের শত ছাপাখানা। কম্পোজ, ব্লক, ছাপা, বাঁধাই সবকিছু মিলিয়ে প্রায় দশ লক্ষ শ্রমিক ছাপাখানার সঙ্গে জড়িত। শ্রমিকরাই শুধু আসন্ন বিপদ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েনি। মালিকরাও আজ নিদারুণভাবে আশঙ্কিত। জানা গেছে-স্বাধীনতার পরেও যে কালির মূল্য প্রতি পাউন্ড আট টাকা ছিল তার দাম বর্তমানে পঞ্চাশ টাকা। অন্যদিকে ব্রাশ-রুল যে টাকায় দুই ডজন পাওয়া যেত সেই টাকায় বর্তমানে একটি রুল পাওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেসের দাম বারো টাকা থেকে পঞ্চাশ টাকা হয়েছে। তিন টাকার গ্যালীর দাম হয়েছে বিশ টাকা। ব্লক উৎপাদন সামগ্রীর দাম বেড়েছে পাঁচ গুন। স্বাধীনতার পরও যে টাইপের মূল্য ছিল প্রতি ফন্ড দুইশত পঞ্চাশ টাকা তা বেড়ে বর্তমানে হয়েছে সাতশত টাকা। উল্লেখযোগ্য, উল্লিখিত তথ্যের কোন একটি স্থিতিশীল মূল্য নয়, প্রতিদিন কিছু না কিছু বেড়েই চলেছে। অনেক সময় এর দাম দিয়েও জিনিস পাওয়া যায় না। প্রকাশনা শিল্পের এই নিদারুণ অবস্থার শেষ কোথায় তা সুস্পষ্ট করে বলা মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এটা সর্বজনবিদিত যে দেশের সার্বিক জ্ঞানোন্নয়নের সঙ্গে ছাপাখানার যোগসুত্র অত্যন্ত নিবিড়। ছাপাখানার এহেন দুর্গতি গোটা শিক্ষা ব্যবস্থায় দুর্গতি ডেকে আনতে বাধ্য। বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে সকল প্রয়োজনীয় প্রকাশনা কর্ম বিশেষ করে স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আবশ্যকীয় বইপত্র প্রকাশ একান্ত আবশ্যক তা যদি ছাপাখানায় উদ্ভুত হয়ে যায় তাহলে তা গোটা শিক্ষার মূল্যায়নের উপর গিয়ে আঘাত হানবে। আমরা এর একটি সুষ্ঠু নিরসন কামনা করি। প্রকাশনা শিল্পের প্রয়োজন জ্ঞানার্জনে যে বিশেষভাবে রয়েছে তা সবারই উপলব্ধি সাপেক্ষ ব্যাপার। ছাপাখানার সঙ্গে লাখ লাখ গরিব মানুষের যে বাঁচা-মরার সম্পর্ক রয়েছে তার দিকে আন্তরিক দৃষ্টিপাত করেই কর্তৃপক্ষ বিষয়টির একটি বাস্তব সুরাহা করবেন বলে আমরা মনে করি।

প্যালেস্টাইনী উদ্বাস্তু শিবিরে হামলা

ইসরাইলি আগ্রাসী মনোভাব ও মানসিকতার ফলে আবার মধ্যপ্রাচ্যের স্থায়ী শান্তির পথ রুদ্ধ হলো বলা যেতে পারে। গত ২০শে জুন দক্ষিণ লেবাননের প্যালেস্টাইনী উদ্বাস্তু শিবিরে ফাঁকে-ফাঁকে ইসরাইলি জঙ্গিবিমান, রকেট ও নাপাম বোমা বর্ষণ করেছে। ফলে শতাধিক লোক আহত হয়েছে বলে এ.এফ.পি জানিয়েছেন। এদের মধ্যে কয়েকজন ডাক্তার ও নার্সও রয়েছেন। খবরে প্রকাশ, আল রাশিদি এবং আইন আল হেলু সহ পাঁচটি উদ্বাস্তু শিবিরে ইসরাইলী বিমানবহর ২০ মিনিট ধরে আক্রমণ চালায়।
লেবাননের প্রতিরক্ষা দপ্তরের ইশতেহারে প্রকাশ, ইসরাইল আল রাশিদি উদ্বাস্তু শিবিরে দশ মিনিটব্যাপী বিমান আক্রমণ চালায়। অপরদিকে আল হেলুর উদ্বাস্তু শিবিরে দুইবার ব্যাপক আক্রমণ চালায়। লেবাননের বিমান বিধ্বংসী কামান গুলো ইসরাইলি বিমান হামলায় মুখে গর্জে উঠল গুলো পালিয়ে যায়। ওয়াফা ইসরাইলি বিমান মিইয়েহ-মিইয়েহ এবং বুর্জ আল সামালীতেও নাপাম বোমা ও রকেট নিক্ষেপ করেছে বলে জানিয়েছেন।
ভূমধ্যসাগরের তীরে ঐতিহাসিক সাইদা ও বন্দরের কাছে অবস্থিত উদ্বাস্তু শিবির দুটিতে ইসরাইলি নাপাম বোমা শিকার হয়েছে বৃদ্ধ এবং শিশুরা।
ভয়েস অব আমেরিকার জানিয়েছেন, ইসরাইলী বোমারু বিমান বহরে পরপর তিনদিন দক্ষিণ লেবাননের উদ্বাস্তু শিবির সমূহে বোমাবর্ষণ করলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক নিহত এবং আহত হয়েছে। ইসরাইলের আক্রমনকে হিংসাত্মক বলে বর্ণনা করে ভয়েস অব অ্যামেরিকা আরো জানিয়েছেন যে, এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আনায়নের পথ বিঘ্নিত হবে।
উদ্বাস্তু শিবিরে নতুন করে হামলার ফলে শান্তির ললিত বাণী যে পরিহাসের মতো শোনাবে এতে কোন সন্দেহ নেই।
মধ্যপ্রাচ্যের স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগ্রহী। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবারে আগ্রহের মাত্রাটা অধিক পরিমাণে প্রকাশ করেছেন।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিঃ হেনরি কিসিঙ্গার শাটল ককের মত তেল আবিব আর দামেস্কে ৩৩ দিনব্যাপী দৌড়োদৌড়ি করেছেন। তারই ফলশ্রুতি হিসেবে গোলান রণক্ষেত্রে শান্তির ছায়া নেমে এসেছে গত ৩১শে মে। এদিনেই লিবিয়া ও ইসরাইল সৈন্য পৃথকীকরণ সম্পর্কিত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। দীর্ঘ ৮১ দিনের তীব্র সংঘর্ষে অবসান হয়েছে এ চুক্তির মাধ্যমেই। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, চুক্তি স্বাক্ষর কালে জাতিসংঘ জরুরী বাহিনীর অধিনায়ক জেনারেল এনসিও সিলাসভোর বলেছিলেন, এই চুক্তি কোন শান্তিচুক্তির নয় তবে একথা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না যে, মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তা একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে।
নতুন অধ্যায়ের সূচনা যে হয়নি তা নয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট মিঃ রিচার্ড নিক্সনের সাম্প্রতিক মধ্যপ্রাচ্য সফরই তার প্রমাণ। প্রেসিডেন্ট নিক্সন বিবদমান দেশগুলোর মধ্যে সমঝোতা বৃদ্ধির জন্য এগিয়ে এসেছেন। প্রেসিডেন্ট নিক্সন মিসর, সিরিয়া, সৌদি আরব ও তেল আবিব সফর করেছেন। ইতিমধ্যে মিশর-মার্কিন যুক্ত ইশতেহারও প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু একটা জিনিস বিশেষভাবে লক্ষ্য করা গেছে যে, প্যালেস্টাইনীদের মুক্তিসংগ্রাম বা তাদের দাবি-দাওয়া সম্পর্কে কোন বক্তব্য রাখেননি প্রেসিডেন্ট নিক্সন। মিশর-মার্কিন যুক্ত ইশতেহার প্রকাশিত হবার পর হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র মিঃ জিগলার বলেছেন যে, যুক্ত ইশতেহারে প্যালেস্টাইনি প্রশ্নের মত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নকে বাদ দেয়া হয়েছে। অথচ সিরিয়া ইসরাইল চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পর মিশরীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব ফাহমি বলেছেন, ইসরাইলকে পশ্চিম এশিয়ায় অস্তিত্ব রাখতে হলে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব স্বীকার করতেই হবে।
স্পষ্টঃই বোঝা যাচ্ছে যে, মধ্যপ্রাচ্যের স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্যালেস্টাইনি সমস্যাকে বাদ দিয়ে হবেনা। হতে পারে না। তাছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি ‘সাপও না মরে লাঠিও না ভাঙ্গে’ নীতির আশ্রয় নিয়ে থাকেন তাহলে তা হবে আত্মপ্রবঞ্চনার নামান্তর মাত্র। বাস্তবতাকে অস্বীকার করে কোন সমস্যার সমাধানই হয় না। শুধু তাই নয়, মধ্যপ্রাচ্যের স্থায়ী শান্তির পক্ষে বিষফোঁড়া ইসরাইলকে বাগ মানাবার দায়িত্ব আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। খুঁটার জোরে পাঠা যেন কুঁদতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। অন্যথায় শান্তির ললিত বাণী প্রচারের জন্য জান দিয়ে দিলেও শান্তি আসবেনা। তার পরিবর্তে দেখা যাবে নতুন করে হামলা ও হুমকি শুরু হয়েছে। যেমনটি আবার হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। ইসরাইল এ ধৃষ্টতার জবাব যে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তিপ্রিয় জনসাধারণ ও প্যালেস্টাইনি মুক্তিকামী সূর্য সেনানীদের পক্ষ থেকে পাবে এতে কোন সন্দেহ নেই।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!