You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.07.21 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | সীমান্তে চোরাচালানীরা আবার তৎপর | ৭৩-৭৪ সালের চা নীতি | সত্তুর হাজার নয়া টেলিফোন লাইন | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
২১শে জুলাই, শনিবার, ১৯৭৩, ৫ই শ্রাবণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

সীমান্তে চোরাচালানীরা আবার তৎপর

সীমান্তে চোরাচালানীরা তাদের তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে বলে বিভিন্ন সূত্রে আমরা খবর পেয়েছি। গতকালের বাংলার বাণীর একটি বিশেষ রিপোর্টে প্রকাশ, সীমান্তে চোরাচালানীদের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকার চোরাচালানী রোধ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ইতিপূর্বে সীমান্তে চোরাচালান রোধকরণ সম্পর্কে আমরা আমাদের অভিমত ব্যক্ত করেছি। সরকার চোরাচালান রোধের জন্যে কিছু কিছু ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছিলেন। সর্বশেষে সীমান্তে সৈন্য পাঠিয়ে বেশ নিয়ন্ত্রণে এসেছিলো পরিস্থিতি। কিন্তু বর্তমানে আবার চোরাকারবারীদের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে রিপোর্টে প্রকাশ। সরকার যে সকল ব্যবস্থা নিয়েছিলেন চোরাকারবার রোধের জন্যে তা আজ আর ফলগ্রস্ত হচ্ছে না। দেশ স্বাধীন হবার পর সীমান্তে চেকপোস্ট ছিলো মোট তিনশত দশটি। সরকার তার বাড়িয়ে বর্তমানে করেছেন চারশত দশটি। এছাড়া থানা পুলিশকেও সক্রিয় করে তোলা হয়েছে বলে জানা গেছে। মাঝে মাঝে কার্ফু জারি করে সীমান্ত চোরাচালানকারীদেরকে ধরা হয়ে থাকে। তবু অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়নি। আবার মানুষ মনে করে পুরোনো পদ্ধতিতে যদি সীমান্তের চোরাচালান বন্ধ করার প্রয়াস নেয়া হয় তাহলে কোন মতেই চোরাকারবার বন্ধ হবে না। অন্যদিকে পুরোনো পুলিশের নিয়ন্ত্রণে সীমান্ত বন্ধ করার প্রচেষ্টাও মূলতঃ কার্যকরী হবে না। এ কারণে মানুষ চায় পুরোনো আইনের পরিবর্তন এবং সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ বাহিনীকে ঢেলে সাজানোর। আমাদের দেশে আজো সংক্ষিপ্ত বিচারে দীর্ঘদিনের শাস্তিদানের কোন আইন নেই সীমান্ত চোরাচালানীদের সম্পর্কে।
দেখা গেছে, চোরাচালানীদের ব্যাপারও প্রচলিত ক্রিমিন্যাল প্রসিডিওর কোডের অধীনে ফৌজদারী আদালতে দায়ের হয়ে থাকে। ফলে অপরাধী বলে অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষে জামিন পেয়ে বেরিয়ে এসে আবার পূর্ব অন্যায় কার্য অব্যাহত রাখা মোটেই কষ্টকর হয় না। তাই স্বাভাবিকভাবেই পুরোনো পদ্ধতির বিচার কার্য পরিচালনার প্রশ্নটি আজ একবার ভেবে দেখার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। বস্ততঃপক্ষে সীমান্তের চোরাচালান বন্ধ করা আশু প্রয়োজন। আপাততঃ রক্ষী বা সৈন্য পাঠিয়ে বন্ধ করার চাইতে স্থায়ীভাবে যতদূর সম্ভব পরিস্থিতির নিয়্ন্ত্রণ একান্ত দরকার। ইতিপূর্বে সীমান্তে যখন সৈন্য পাঠানো হয়েছিলো তখন চোরাচালানীদের তৎপরতা বেশ আয়ত্তে এসেছিলো। কিন্তু সৈন্য প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গে তা আবার বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই তাই প্রশ্ন উঠেছে শুধু কঠোর পদক্ষেপ নিয়েই পরিস্থিতি আয়ত্তে আনা সম্ভব? না, আইনের পরিবর্তন করে—পুলিশ বাহিনীর পুনর্গঠন করে একটি সুদূর পরিকল্পনা নিয়ে এটা রোধ করা সম্ভব? আমাদের বিশ্বাস, সরকার যদি পুরোনো পদ্ধতি ও অসৎ সীমান্ত পুলিশ দিয়ে এই চোরাচালান বন্ধ করার প্রয়াস নেন তাহলে তা ব্যর্থ হতে বাধ্য। দেশের যে বিপুল পরিমাণ সম্পদ পাচার হয়ে যায় এবং পাচার হয়ে যে সকল দ্রব্য ভারত থেকে এদেশে আসে তা রোধের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। বিশেষ করে উভয় দেশের যৌথ ও আন্তরিক প্রচেষ্টার দ্বারাই তা সম্ভব। আমরা আশা করবো, সরকার অবিলম্বে সীমান্তের চোরাচালান বন্ধ করতে একটি বাস্তব পদ্ধতির প্রয়োগ করবেন। মানুষের দুঃখ-কষ্টের একটি অন্যতম কারণ এই চোরাচালান বলে আমরা মনে করি।

৭৩-৭৪ সালের চা নীতি

চলতি আর্থিক বছরে ছয় কোটি চল্লিশ লক্ষাধিক পাউন্ড চা বিদেশে রপ্তানী করা সম্ভব হবে। গত পরশুদিন সচিবালয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বাণিজ্যমন্ত্রী এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামান ১৯৭৩-৭৪ সালের চা নীতি ঘোষণাকালে উপরোক্ত তথ্য প্রকাশ করেছেন। মন্ত্রী মহোদয় সাংবাদিকদের জানিয়েছেন যে, এ বছর চা রপ্তানীর পরিমাণ বাড়বে। বিদেশে যাতে বাংলাদেশের চায়ের বাজার সম্প্রসারিত করা যায়, সরকারীভাবে সে চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও তিনি জানান। বিদেশে বাংলাদেশের চায়ের সমাদর রয়েছে। ১৯৬২-৬৩ সাল পর্যন্ত বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের চায়ের বিরাট বাজার ছিলো। কিন্তু সাবেক পাকিস্তান সরকার হঠাৎ করে বিদেশে চা রপ্তানী বন্ধ করে দেয়ায় আমরা চায়ের আন্তর্জাতিক বাজার হারিয়েছি। স্বাধীনতার পর থেকেই বিদেশে চায়ের হারানো বাজার ফিরে পাওয়ার জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। বাণিজ্যমন্ত্রী মহোদয় সাংবাদিকদের জানিয়েছেন যে, ক্রমশঃ বিদেশে আমাদের চায়ের বাজার বাড়ছে। বিদেশে বাংলাদেশের চায়ের বাজার বাড়ুক, এটা সুখের সংবাদ। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা দরকার যে, গত বছর বিদেশে পাঁচ কোটি কুড়ি লক্ষ পাউন্ড চা রপ্তানী করা হয়েছে এবং এতে আট কোটি পঞ্চান্ন লক্ষ টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়েছৈ। চলতি বছরে চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে ছয় কোটি পাউন্ড। গত বছরের উদ্বৃত্ত রয়েছে দুই কোটি ছয় লক্ষ ত্রিশ হাজার পাউন্ড। ফলে বর্তমান বছরে সর্বমোট আট কোটি ছয় লক্ষ ত্রিশ হাজার পাউন্ড চা পাওয়া যাবে। জানা গেছে, এর মধ্যে এক কোটি ষাট লক্ষ পাউন্ড চা আভ্যন্তরীণ চাহিদার জন্যে প্রয়োজন এবং বাকী ছয় কোটি পঞ্চান্ন লক্ষ পাউন্ড বিদেশ রপ্তানী করা হবে। এই হিসেবে যদি কোন শুভঙ্করের ফাঁকি না থাকে, তা হলে গত বছরের তুলনায় আমরা এক কোটি পাউন্ড চা বেশী উৎপাদন করতে পারবো এবং এই উৎপাদিত চা বিদেশে রপ্তানী করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে সক্ষম হবো।
নতুন চা নীতি প্রণয়নকালে মন্ত্রী মহোদয় রপ্তানী, বিভিন্ন শ্রেণীর চা বাগানের উৎপাদন খরচ এবং বিশ্ব বাজারে চায়ের দাম ইত্যাদি পর্যালোচনা করেছেন। উৎপাদন ও বাজারজাত করণের ক্ষেত্রে বর্তমানে চা শিল্প যে সব সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে, নতুন চা নীতিতেও সে সব সুযোগ সুবিধা বহাল রাখা হয়েছে। এছাড়া বিশ্বের বাজারে আমাদের চা যাতে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে টিকে থাকতে পারে এবং আমরা যাতে আমাদের হারানো বাজার পুনরুদ্ধার করতে পারি, নতুন চা নীতিতে সে ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। বাণিজ্যমন্ত্রী মহোদয় জানিয়েছেন যে, চা রপ্তানীতে উৎসাহ দানের জন্য চা বাগানগুলোতে হ্রাসকৃত মূল্যে সার, স্বল্প সুদে ঋণ, বাগানগুলোকে ভর্তুকি দান সরকার অব্যাহত রাখবেন। মন্ত্রী মহোদয় আরো জানিয়েছেন, বাংলাদেশের চায়ের বাজার অনুসন্ধানের জন্য মরক্কো, মিসর, মৌরিতানিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিনিধিদল প্রেরিত হবে এবং লন্ডনের নিলামকারকদের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হবে। এছাড়া বিনিময় বাণিজ্য এলাকার দেশগুলোতে চা বিক্রির জন্যে আফগানিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যে প্রয়োজনীয় ‘গ্রীন টি’ সরবরাহ এবং সিঙ্গাপুর ও হংকং-এর মাধ্যমে চা বিক্রির ব্যবস্থা করা হবে।
মোদ্দা কথা, বিদেশের হারানো বাজার দখল করার জন্যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টাই নেয়া হবে—নতুন চা নীতিতে এই কথাটি আমাদের কাছে স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে। চা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানী পণ্য। এবং এই চা উৎপাদন ও রপ্তানীর মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের চাবিকাঠি রয়েছে। কাজেই চা শিল্পকে আমরা অনাদরে অবহেলায় কোনক্রমেই এড়িয়ে যেতে পারি না। ছোট-বড়ো মিলিয়ে সমগ্র দেশে সর্বমোট ১৫২টি চা বাগান রয়েছে।
প্রতিটি চা বাগানেই যাতে অধিক চা উৎপাদন করা সম্ভব হয়, সে জন্যে নতুন চা নীতিতে সরকারীভাবে ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে এবং সবচেয়ে আশার কথা হলো এই যে, বিদেশে বাংলাদেশের চা রপ্তানীর জন্যে নতুন চা নীতিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ঘোষিত চা নীতির পরিপ্রেক্ষিতে আমরা শুধু এই কথাই উচ্চারণ করতে পারি যে, ঘোষণা দিয়ে নয়, সত্যিকার কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে যেন আমরা বিদেশে বাংলাদেশের চায়ের বাজার সম্প্রসারিত করতে পারি, সে জন্যে সর্বপ্রথমে উৎপাদনের হার বাড়াতে হবে, নইলে চা দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা দিবাস্বপ্নেরই নামান্তর হবে।

সত্তুর হাজার নয়া টেলিফোন লাইন

টেলিফোন আসছে আরো সত্তুর হাজার। এর ত্রিশ হাজার বসবে শুধু ঢাকা এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহে। বাকী চল্লিশ হাজার দেশের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকা সহ বিভিন্ন অঞ্চলে। প্রথস পাঁচসালা পরিকল্পনার মধ্যেই এই সত্তর হাজার নয়া টেলিফোন লাইন সংস্থাপন করা সম্ভব হবে বলে একটি বার্তা সংস্থা খবর দিয়েছে। সূত্রের কথা উল্লেখ না করে এই বার্তা সংস্থা আরো জানিয়েছে যে, এই বর্ধিত টেলিফোন লাইনের জন্যে মগবাজার, চকবাজার এবং গুলশান মডেল টাউন এলাকায় তিনটি টেলিফোন এক্সচেঞ্জ স্থাপন করা হবে। প্রস্তাবিত টেলিফোন এক্সচেঞ্জের ক্ষমতা হবে দশ হাজার করে। শুধু গুলশান এক্সচেঞ্জের ক্ষমতা হবে পাঁচ হাজার। এজন্য বিদেশ থেকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আমদানীর ব্যবস্থাও করা হয়েছে। মগবাজার এক্সচেঞ্জের ভবনটি বর্তমানে নির্মাণাধীন রয়েছে, চকবাজারের জন্যে স্থান নির্বাচন এখনো চূড়ান্ত হয়নি। ১৯৭৪ সালের শেষ নাগাদ নাকি গুলশান এক্সচেঞ্জে যন্ত্রপাতি সংস্থাপনের কাজ শেষ হবে।
স্বাধীনতাত্তোর কালে ঢাকার রূপ বদলেছে, গুরুত্ব বেড়েছে অনেক বেশী। বন্দর নগরী এবং বাণিজ্যিক এলাকা সমূহেও কর্মব্যস্ত আগের চাইতে বেড়েছে অনেক গুণ। সীমিত ক্ষমতার মধ্যেই এর ভিতর বহু নতুন টেলিফোন লাইন বসানো হয়েছে। এতে করে চাপ বেড়েছে বর্তমান এক্সচেঞ্জ সমূহে। তাই বিভ্রাটও বাড়তি পথে। টেলিফোনে কল পেতে অযথা বিলম্ব, সময়ে অসময়ে তা বিকল হয়ে পড়া এবং অবাঞ্ছিত লাইনের সংযোগ ইত্যাদি আজকের এ নগর সভ্যতার যুগে রীতিমতো সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। দেশে বর্তমানে যে পঞ্চাশ হাজার টেলিফোন লাইন রয়েছে তার মধ্যে আটাশ হাজার ঢাকায় সংস্থাপিত। পূর্বের চাইতে কল বেড়েছে। এক হিসেব অনুযায়ী ১৯৭০ সালে যখন প্রতি টেলিফোনে গড়পড়তা প্রতিদিন দু’টি কল বুক করা হতো এখন সেখানে বুক করা হয় প্রায় ত্রিশটি।
নতুন টেলিফোন লাইন আসছে আশার কথা। মোটামুটি ভবিষ্যতকে নিয়ে এমন অনেক আশা পোষণ করেই আমরা বর্তমানের সবাই কাল যাপন করছি। কিন্তু সব পরিকল্পনাই যে বাস্তবায়িত হয়না এই তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের অতীতের। তিনটি নতুন এক্সচেঞ্জের ক্ষমতা সম্বন্ধে যে তথ্য সংবাদে দেয়া হয়েছে তাতে করে ঢাকার প্রস্তাবিত ত্রিশ হাজার লাইনের মধ্যে পঁচিশ হাজার এই তিনটি এক্সচেঞ্জের আওতায় পড়বে। বাকী পাঁচ হাজার সম্বন্ধে কোন কিছু বলা হয়নি। তাছাড়া টেলিফোন বিভ্রাট সম্পর্কে যে কৈফিয়তগুলো দেয়া হয়েছে সেগুলোর যৌক্তিকতা মেনে নিয়েও বলা চলে টেলিফোন লাইন সংস্থাপন এবং অন্যান্য ব্যাপারে টেলিফোন বিভাগ অধিকাংশ সময়ই কোন সুষ্ঠু পরিকল্পনার আশ্রয় গ্রহণ করেননি। লাইন প্রদানে নিয়ম নীতি মেনে না চলারও বিভিন্ন অভিযোগ জনমনে রয়েছে। প্রস্তাবিত এই পরিকল্পনায় অতীতের সকল ক্রুটি-বিচ্যূতি সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করা হবে বলে আমরা মনে করি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন