ভাষা আন্দোলনে মানিকগঞ্জ
প্রগতিশীল গ্রামাঞ্চলের অগ্রচারীর ভূমিকা
পাকিস্তান পর্বের পূর্ববঙ্গে মানিকগঞ্জ ঢাকা জেলার একটি স্বনামখ্যাত মহকুমা। যেমন নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ। শেষােক্ত দুই মহকুমার মতাে ভাষা আন্দোলন জোয়ারি চরিত্রের না হলেও এ ক্ষেত্রে মানিকগঞ্জ তার ভূমিকা পালনে পিছিয়ে থাকেনি। মানিকগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত ঘিওর থানার তেরশ্রী গ্রাম নিবাসী আমার সহপাঠী আবদুস সালামের সূত্রে জানা যায় তেরশ্রী হাইস্কুলকেন্দ্রিক প্রগতিবাদী রাজনীতি এবং ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণের কথা।
ওই গ্রামকেন্দ্রিক এলাকা ছিল কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম ঘাঁটি। কৃষক আন্দোলন থেকে সাংস্কৃতিক আন্দোলনে ছিল তাদের বিশেষ ভূমিকা। এসব রাজনৈতিক ঘটনার নেপথ্যে ছিলেন ওই স্কুলের শিক্ষক প্রমথনাথ নন্দী। সালাম তার ছাত্রজীবন এবং স্কুলজীবনেই ওই শিক্ষক মহােদয়ের প্রভাবে বাম রাজনীতিতে দীক্ষিত এবং ১৯৫২ সালে ঢাকায় ভাষা আন্দোলনে আমার সহকর্মী সহপাঠীও বটে। মানিকগঞ্জের ভাষা আন্দোলনের বেশ কিছু তথ্য তার সূত্রে জানা।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চের ভাষা আন্দোলনের আহ্বান যথারীতি মানিকগঞ্জে এসে পৌছেছিল। বাদ যায়নি তেরশ্রী ও আশপাশের গ্রাম। তেরশ্রী স্কুলের ছাত্ররা এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ছাত্রদের উদ্যোগে তেরশ্রীতে একটি প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য যে এ সভায় সভাপতিত্ব করেন ওই স্কুলের ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী ছাত্র ভূপেন্দ্রনাথ দাস।
সভা শেষে যথারীতি প্রতিবাদী মিছিল ও স্লোগান ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ইত্যাদি। এ মিছিলের আয়তন বাড়ে স্থানীয় জনসাধারণের অংশগ্রহণে। এর তৎপরতা তেরশ্রী গ্রামেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, ছড়িয়ে যায় ঘিওর থানার আশপাশের কয়েকটি গ্রামে। এই প্রতিবাদী তৎপরতা সংঘটনে নেতৃত্বদানে ছিলেন উল্লেখযােগ্য আরও কয়েকজন ছাত্র। যেমন রেহাজউদ্দিন, ওয়াজি উদ্দিন, নিরঞ্জন বিহারী প্রমুখ।
তখন পাকিস্তানি মৌতাতের সূত্রে মুসলিম লীগ শাসন-প্রশাসনের প্রভাব। ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে প্রসারিত। তেরশ্রী ইউনিয়ন বাের্ডের সভাপিত ও সেক্রেটারির ষড়যন্ত্রে উল্লিখিত চার ছাত্রকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে মানিকগঞ্জ কারাগারে পাঠায়, সেখান থেকে পরে তাদের গতি হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। ভাষা আন্দোলনে যােগ দেওয়ার জন্য তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযােগ আনা হয়। মানিকগঞ্জ আদালতে তাদের জামিন নামঞ্জুর হয়। পরে কংগ্রেস নেতা, আইনজীবী ভবেশচন্দ্র নন্দী তাঁদের জামিনের ব্যবস্থা করেন।
পরবর্তী পর্যায়ে ঢাকায় পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর উর্দু রাষ্ট্রভাষার পক্ষে বক্তৃতার প্রতিবাদে মার্চ মাসের শেষ দিকে মানিকগঞ্জ শহরে ছাত্র-বুদ্ধিজীবীদের উদ্যোগে স্থানীয় কালীবাড়ি প্রাঙ্গণে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভার বক্তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য আবু তাহের, জাহানারা বেগম, ভীমদেব, নিজামউদ্দিন প্রমুখ। একপর্যায়ে পুলিশ সভাঙ্গন ঘিরে ফেলে। তাদের হামলা ও লাঠিচার্জের কারণে সভা ভেঙে যায়।
পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন ও মুসলিম লীগ নেতাদের প্রবল বিরােধিতার মুখে আন্দোলনের নেতাদের আত্মগােপন করতে হয়। এটা ছিল মুসলিম লীগ সরকারের আন্দোলন বন্ধ করার চিরাচরিত কৌশল। সেই সঙ্গে এ ক্ষেত্রে ছিল ছাত্রদের অভিভাবকদের ভয় দেখানাে, গ্রেপ্তারের হুমকি ইত্যাদি। স্বভাবত আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। (অরূপ রায়, ভোরের কাগজ)।
অন্য এক নির্ভরযােগ্য সূত্রে (প্রদীপ কুমার রায়) জানা যায়, একই বছর মানিকগঞ্জ শহরে ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৪ আগস্ট রাতে প্রতিবাদী তৎপরতার প্রতীক হিসেবে কালাে পতাকা তােলা হয় লােহারপুলের ওপর। পরদিন রাতে ইশতেহার বিলি করা হয়। এ দুই ক্ষেত্রেই দায়িত্ব পালন করেন পূর্বোক্ত শিক্ষক প্রমথনাথ নন্দী। শেষ পর্যন্ত পুলিশের তাড়ায় তাকে গ্রামে চলে যেতে হয়। গ্রাম থেকে গ্রামে গােপনে তিনি ছাত্রদের ভাষাসংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেন।
মানিকগঞ্জের ভাষা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে স্থানীয় স্কুল ও কলেজের (দেবেন্দ্র কলেজ) ছাত্ররা। নেতৃত্বেও তাদের অন্যতম প্রধান ভূমিকা। ১৯৫২-এর ফেব্রুয়ারি তথা একুশের ভাষা আন্দোলন মানিকগঞ্জে তুলনামূলক বিচারে জোরদার হয়ে ওঠে ঢাকায় পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতিক্রিয়ায়। মানিকগঞ্জে দেবেন্দ্র কলেজের সাবেক ছাত্র রফিকউদ্দিন আহমদ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হােস্টেল প্রাঙ্গণে পুলিশের গুলিতে প্রথম শহীদ। এ খবরও মানিকগঞ্জবাসীকে উত্তেজিত করে তােলে। মানিকগঞ্জের রাজনীতিসংশ্লিষ্ট ছাত্র পূর্বোক্ত আবদুস সালাম ও খন্দকার দেলােয়ার হােসেন তখন ঢাকায় একুশের মিছিলে। হত্যাকাণ্ডের খবর তাঁদের মাধ্যমে মানিকগঞ্জে পৌঁছায়।
২২ ফেব্রুয়ারি বিকেলে মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজের মাঠে ছাত্রদের বিশাল সমাবেশ ও সভা। সভা শেষে ছাত্র-জনতার মিছিলে স্লোগান, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘পুলিশি জুলুম চলবে না’, ‘নুরুল আমিনের বিচার চাই’ ইত্যাদি। মিছিল শহরের প্রধান সড়কগুলােকে প্রতিবাদী পদচারণে স্পন্দিত করে তােলে। হরতালের ডাকে দোকানপাট, যানবাহন, অফিস বন্ধ থাকে।
দৈনিক আজাদ-এর প্রতিবেদনে জানা যায়, ‘২১শে ফেব্রুয়ারি (মানিকগঞ্জে) বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও দোকানপাট বন্ধ থাকে। শহর ও মহকুমার বিভিন্ন স্থানে শােভাযাত্রা ও সভাসমিতি অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন সভায় বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণ, ঢাকায় ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলীবর্ষণের তীব্র নিন্দা এবং নুরুল আমীন মন্ত্রীসভার পদত্যাগ দাবী করিয়া প্রস্তাব গৃহীত হয়। শহীদ রফিকউদ্দিনসহ অন্য শহীদ ছাত্রদের মাগফেরাত কামনা করা হয়।’ (আজাদ, ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২)।
একুশের ভাষা আন্দোলন মানিকগঞ্জে দেশের অন্যান্য শহর-গ্রামের মতােই একই রকম ঐতিহ্য সৃষ্টি করে। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে গ্রামেগঞ্জে।
ছােট ছােট থানা শহর থেকে ইউনিয়নগুলাের শিক্ষায়তনে ছড়িয়ে পড়ে। বাদ যায় না তেরশ্রী ইউনিয়নের আশপাশের গ্রামগুলাে কিংবা মালী ইউনিয়নও (২৫ ফেব্রুয়ারি)। আন্দোলন চলে ঢাকায় ঘােষিত ৫ মার্চের হরতাল পালনের মাধ্যমে। ঢাকায় যেমনই হােক দৈনিক আজাদ পত্রিকার প্রতিবেদনমতে, ৫ মার্চ মানিকগঞ্জে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। স্কুল-কলেজ, দোকানপাট বন্ধ থাকে।
একই সংবাদ প্রতিবেদনে প্রকাশ, ‘জনাব মশিহুদ্দিন আহমদ এমএলএর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার এবং সাম্প্রতিক আন্দোলনে আটক বন্দীদের মুক্তি দাবি করা হয়।’ (আজাদ, ৮ মার্চ)। সাপ্তাহিক সৈনিক-এর এক প্রতিবেদনে প্রকাশ, (৯ মার্চ ১৯৫২) পূর্বোক্ত মালী ইউনিয়নের প্রায় চারশ ছাত্র শুধু ধর্মঘট করেই ক্ষান্ত থাকে না, তারা “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”, “পুলিশি জুলুম চলবে না”, “আমাদের দাবী মানতে হবে” ইত্যাদি স্লোগানসহ শােভাযাত্রা করিয়া সমস্ত ইউনিয়ন প্রদক্ষিণ করে। হাটবাজার বন্ধ থাকে।
‘শােভাযাত্রার পর কলতা মধ্য ইংরেজি স্কুল প্রাঙ্গণে জনসাধারণের এক বিরাট সভা হয়। সভায় সম্মিলিতভাবে পাকিস্তান গভর্নমেন্টের নিকট গণভােটের দ্বারা রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণের দাবী… জানানাে হয়।’
এ দুটো সংবাদ প্রতিবেদনে লক্ষ করার বিষয় যে একুশের আন্দোলন ব্যাপকভাবে শহর থেকে গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছিল স্কুলগুলাের মাধ্যমে, তেমনি জনসাধারণের মধ্যে। দ্বিতীয়ত, রাজধানী ঢাকার বাইরে ছােট-বড় একাধিক শহরে এবং থানাস্তরে বা গঞ্জে মুসলিম লীগ দলের কিছুসংখ্যক নেতা এ আন্দোলনে অংশ নেন, কোথাও কোথাও জনসভায় সভাপতিত্ব করেন। অর্থাৎ দলের তৃণমূল স্তরে ভাষার টানে ভাঙনের সূচনা।
একুশের ভাষা আন্দোলন এভাবে শহর থেকে গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগবিরােধী যুক্তফ্রন্টের অভাবিত একচেটিয়া বিজয় নিশ্চিত করেছিল। মানিকগঞ্জের শহর ও গ্রামাঞ্চলও অন্যান্য মহকুমার মতােই একই ধরনের উদাহরণ সৃষ্টি করেছিল।
সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক