You dont have javascript enabled! Please enable it!

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ১

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এতে তার নিজের ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের কথা যেমন আছে, তেমনি আছে সমকালীন অন্য নেতাদের এতে অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বদানের বিবরণ। এতদিন যারা ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদান প্রসঙ্গে নেতিবাচক ধারণা পােষণ করেছেন, পাকিস্তানি গােয়েন্দা সংস্থার গােপন প্রতিবেদনসমূহ এবং বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী প্রকাশের ফলে তাদের সেসব বক্তব্য বস্তুনিষ্ঠতা হারিয়েছে। অসমাপ্ত আত্মজীবনীর বিবরণের সঙ্গে ভাষাসংগ্রামীদের স্মৃতিচারণ, গােয়েন্দা প্রতিবেদন ও পত্র-পত্রিকার বিবরণ মিলিয়ে দেখলে ইতিহাসের প্রকৃত তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়।।
১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক না থাকলেও, অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন ‘৫২-র ভাষা আন্দোলনে তার অবদান প্রসঙ্গে। কারণ ওই সময় তিনি কারাগারে বন্দি ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে এ বিষয়ে যেসব তথ্য পাওয়া যায়, তাতে ইতিহাসের সেই সময়ের বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ উন্মােচিত হয়েছে। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন, একুশে ফেব্রুয়ারি পালন, ১৪৪ ধারা ভাঙাসহ আন্দোলনের নানা বিষয়ে
——————–
১ শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, চতুর্থ মুদ্রণ, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা ফেব্রুয়ারি ২০১৮ থেকে লেখাটি সংকলিত।
———————
তিনি যে দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন সেসব বিষয় এ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পাদিত পাকিস্তানি গােয়েন্দা সংস্থার গােপন প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৯৫১ সালের মাঝামাঝি থেকে ১৯৫২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নিরাপত্তা-বন্দি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ও রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ নিয়মিত সাক্ষাৎ করেছেন। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক খালেক নেওয়াজ খান ওই সময় একাধিকবার তার সঙ্গে গােপনে সাক্ষাৎ করেছেন বলে গােয়েন্দা প্রতিবেদনে নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, যা অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও হুবহু উঠে এসেছে। এককথায় বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। আমরা প্রাসঙ্গিক অংশ এখানে তুলে ধরলাম:
“আমি ঢাকায় এলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি, আইন পড়ব। বই পুস্তক কিছু কিনলাম। ঢাকায় এসে শুনলাম গণতান্ত্রিক যুবলীগের এক সভা হয়ে গেছে। কার্যকরী কমিটির নতুন সভা কো-অপ্ট করা হয়েছে। পূর্বে ছিলাম সতেরজন এখন হয়েছি চৌত্রিশজন। কারণ, আমাদের সংখ্যালঘু করার ষড়যন্ত্র। আমাদের অনেকে নােটিশও পায় নাই। অন্য কোনাে কাগজ না ছাপলেও কলকাতার ইত্তেহাদ কাগজ আমাদের সংবাদ ছাপত। ইত্তেহাদেও নােটিশ ছাপানাে হয় নাই। আমি আপত্তি তুললাম এবং বললাম, সতেরজন সদস্য, কেমন করে আরও সতেরজন কো-অপ্ট করতে পারে? সভা ডাকা হােক। কিছুদিন পরে খবর পেলাম, ময়মনসিংহে সভা ডাকা হয়েছে। সকলে নােটিশ পেয়েছে, আমাকে দেওয়া হয় নাই। নােয়াখালীর আজিজ মােহাম্মদ ঢাকা সিটি মুসলিম লীগের সেক্রেটারি ছিলেন, তিনি নােটিশ পেয়ে আমাকে বললেন, আগামী দিনই সভা হবে সকাল নয়টায়। দেখলাম আমরা তিনজন সভ্য ঢাকায় আছি। আজিজ সাহেব, ঢাকার শামসুল হুদা সাহেব (এখন কনভেনশন মুসলিম লীগ করেন) ও আমি। ঠিক করলাম তিনজনই যাব এবং বাধা দিব। অন্য কোনাে জেলায় খবর দেওয়ার সময় হবে না। রাতেই আমাদের রওয়ানা করতে হবে। কারণ একটা মাত্র ট্রেন ছাড়ে রাত দশটায়, ভাের তিনটায় পৌছায় ময়মনসিংহ। ভাের পর্যন্ত আমরা স্টেশনেই ছিলাম। হক সাহেবের কোনাে খবর নাই। তিনি সভায় আসেন নাই। আমরা সভায় উপস্থিত হলাম এবং বৈধতার প্রশ্ন তুললাম। আমাকে ও অনেককে নােটিশ দেওয়া হল না কেন? তারা একটা ম্যানিফেস্টো বের করে এনেছেন। আমরা বললাম, নােটিশ দিয়ে সভা ডাকা হােক ঢাকায় এবং সেখানে ম্যানিফেস্টো গ্রহণ করা হবে কি হবে না ঠিক করা হবে। এত তাড়াহুড়া করা উচিত হবে না। আর আমরা কোনাে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে। যােগদান করতে পারি না। কারণ মুসলিম লীগের এখনও কাউন্সিল সদস্য আমরা। অনেক তর্কবিতর্ক হল, তারপর যখন দেখলাম যে, কিছুতেই শুনছে , সকলেই প্রায় কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন বা তাদের সমর্থকরা উপস্থিত হয়েছে তখন বাধ্য হয়ে আমরা সভা ত্যাগ করলাম। আর বলে এলাম, মুসলিম লীগের কোনাে কর্মী আপনাদের এই ষড়যন্ত্রে থাকবে না। যুবলীগও আজ থেকে শেষ। আপনাদের ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা আমাদের জানা আছে। আমাদের নাম কোথাও রাখবেন না।
মােগলটুলীতে যুবলীগের অফিস ছিল। আমরা বাের্ডটা নামিয়ে দিলাম। এর মধ্যেই তারা ম্যানিফেস্টো ছাপিয়ে ফেলেছে। অফিসেও নিয়ে এসেছে। শওকত মিয়াই এই অফিসের কর্তা। তিনি হুকুম দিলেন, যুবলীগের সকল কিছু এখান থেকে নিয়ে যেতে। কে নিবে? কাউকেও দেখা গেল না। পুলিশ অফিসে তল্লাশি দিল। আমাদের নামও আইনি খাতায় উঠল। ১৫০ নম্বর মােগলটুলী থেকে পাকিস্তানের আন্দোলন হয়েছে, সেই লীগ অফিসেই এখন গােয়েন্দা বিভাগের কর্মচারীরা পাহারা দিতে শুরু করল গােপনে গােপনে। আমরা সকলে শহীদ সাহেবের ভক্ত ছিলাম। এটাই আমাদের দোষ। আমরা সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্য যাতে বজায় থাকে তার চেষ্টাই করতে থাকলাম।…
‘নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের নাম, বদলিয়ে ‘নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ করা হয়েছে। শাহ আজিজুর রহমান সাহেবই সেক্রেটারি জেনারেল হয়ে রইলেন। ঢাকায় কাউন্সিল সভা না করে অন্য কোথাও তারা করলেন গােপনে। কার্যকরী কমিটির সদস্য প্রায় অধিকাংশই ছাত্র নয়, ছাত্র রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছেন। ১৯৪৪ সালে সংগঠনের নির্বাচন হয়েছিল, আর হয় নাই। আমরা ওই কমিটি মানতে চাইলাম না। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ও জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে বহু ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। তারা এই প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত নয়। আমি ছাত্রলীগ কর্মীদের সাথে আলাপ-আলােচনা শুরু করলাম। আজিজ আহমেদ, মােহাম্মদ তােয়াহা, অলি আহাদ, আবদুল হামিদ চৌধুরী, দবিরুল ইসলাম, নইমউদ্দীন, মােল্লা জালালউদ্দিন, আবদুর রহমান চৌধুরী, আবদুল মতিন খান চৌধুরী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং আরও অনেক ছাত্রনেতা একমত হলেন, আমাদের একটা
প্রতিষ্ঠান দরকার। ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি তারিখে ফজলুল হক। মুসলিম হলের এ্যাসেম্বলি হলে এক সভা ডাকা হল, সেখানে স্থির হল । একটা ছাত্র প্রতিষ্ঠান করা হবে। যার নাম হবে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। নইমউদ্দীনকে কনভেনর করা হল। অলি আহাদ এর সভ্য। হতে আপত্তি করল কারণ সে আর সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান করবে না। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ নাম দিলে সে থাকতে রাজি আছে। আমরা তাকে বােঝাতে চেষ্টা করলাম এবং বরলাম, “এখনও সময় আসে নাই। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও দেশের আবহাওয়া চিন্তা করতে হবে। নামে কিছুই আসে যায় না। আদর্শ যদি ঠিক থাকে, তবে নাম পরিবর্তন করতে। বেশি সময় লাগবে না। কয়েক মাস হল পাকিস্তান পেয়েছি। যে আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তান পেয়েছি, সেই মানসিক অবস্থা থেকে। জনগণ ও শিক্ষিত সমাজের মত পরিবর্তন করতে সময় লাগবে।”
প্রতিষ্ঠানের অফিস করলাম ১৫০ নম্বর মােগলটুলী। মুসলিম লীগ নেতারা কয়েকবার চেষ্টা করেছেন এই অফিসটা দখল করতে, কিন্তু শওকত মিয়ার জন্য পারেন নাই। আমরা মুসলিম লীগ ওয়ার্কাস ক্যাম্প’ নাম দিয়ে সাইন বাের্ড লাগিয়ে দিয়েছিলাম। এখন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের । অফিসও করা হল। শওকত মিয়া টেবিল, চেয়ার, আলমারি সকল কিছুই। বন্দোবস্ত করল। তাকে না হলে, আমাদের কোন কাজই হত না তখন। আমরা যে কয়েকজন তার সাথে মােগলটুলীতে থাকতাম, আমাদের খাওয়া। থাকার ভার তার উপরই ছিল। মাসে যে যা পারতাম, তার কাছে পৌছে। দিতাম। সেই দেখাশােনা করত। | ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠান গঠন করার সাথে সাথে বিরাট সাড়া পাওয়া গেল ছাত্রদের মধ্যে। এক মাসের ভিতর আমি প্রায় সকল জেলায়ই কমিটি করতে সক্ষম হলাম। যদিও নইমউদ্দীন কনভেনর ছিল, কিন্তু সকল কিছুই প্রায় আমাকেই করতে হত। একদল সহকর্মী পেয়েছিলাম, যারা। সত্যিকারের নিঃস্বার্থ কর্মী। পূর্ব পাকিস্তান সরকার প্রকাশ্যে নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগকে সাহায্য করত। আর আমাদের বিরুদ্ধে গােয়েন্দা লাগিয়ে দিত। …
ফেব্রুয়ারি ৮ই হবে১, ১৯৪৮ সাল। করাচিতে পাকিস্তান সংবিধান সভার (কন্সটিটিউয়েন্ট এ্যাসেম্বলি) বৈঠক হচ্ছিল। সেখানে রাষ্ট্রভাষা কি হবে সেই বিষয়ও আলােচনা চলছিল। মুসলিম লীগ নেতারা উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষপাতী। পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ লীগ সদস্যেরও সেই মত। কুমিল্লার কংগ্রেস সদস্য বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দাবি করলেন বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা করা হােক। কারণ, পাকিস্তানের সংখ্যাগুরুর ভাষা হল বাংলা। মুসলিম লীগ সদস্যরা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। আমরা দেখলাম, বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার। পূর্ব পাকিস্তান। মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদুন মজলিস এর প্রতিবাদ করল এবং দাবি করল, বাংলা ও উর্দু দুই ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। আমরা সভা করে। প্রতিবাদ শুরু করলাম। এই সময় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদুন মজলিস যুক্তভাবে সর্বদলীয় সভা আহ্বান করে একটা রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করল। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কিছু শাখা জেলায় ও মহকুমায় করা হয়েছে। তমদুন মজলিস একটা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান যার নেতা ছিলেন অধ্যাপক আবুল কাশেম সাহেব। এদিকে পুরানা। লীগ কর্মীদের পক্ষ থেকে জনাব কামরুদ্দিন সাহেব, শামসুল হক সাহেব ও অনেকে সংগ্রাম পরিষদে যােগদান করলেন। সভায় ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চকে ‘বাংলা ভাষা দাবি’ দিবস ঘােষণা করা হল। জেলায় জেলায় আমরা। বের হয়ে পড়লাম। আমি ফরিদপুর, যশাের হয়ে দৌলতপুর, খুলনা ও বরিশালে ছাত্রসভা করে ওই তারিখের তিন দিন পূর্বে ঢাকায় ফিরে এলাম। দৌলতপুরে মুসলিম লীগ সমর্থক ছাত্ররা আমার সভায় গােলমাল করার চেষ্টা করলে খুব মারপিট হয়, কয়েকজন জখমও হয়। এরা সভা ভাঙতে পারে নাই, আমি শেষ পর্যন্ত বক্তৃতা করলাম। এ সময় জনাব আবদুস সবুর আমাদের সমর্থন করেছিলেন। বরিশালের জনাব মহিউদ্দিন তখন ‘নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সদস্য, মুসলিম লীগ ও সরকারের পুরাে সমর্থক। কাজী বাহাউদ্দিন আহমদ আমাদের দলের নেতা ছিলেন। আমি কলেজেই সভা করেছিলাম। মহিউদ্দিন সাহেব বাধা দিতে চেষ্টা করেন। নাই। ঢাকায় ফিরে এলাম। রাতে কাজ ভাগ হল- কে কোথায় থাকব এবং কে কোথায় পিকেটিং করার ভার নেব। সামান্য কিছু সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়
——————————
১ পাকিস্তান গণপরিষদের সভায় ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাংলা ভাষাবিষয়ক প্রস্তাব নাকচ হয় ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি।-এআআ
——————————–
ছাত্র ছাড়া শতকরা নব্বই ভাগ ছাত্র এই আন্দোলনে যােগদান করল। জগন্নাথ কলেজ, মিটফোর্ড, মেডিক্যাল স্কুল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বিশেষ। করে সক্রিয় অংশগ্রহণ করল। মুসলিম লীগ ভাড়াটিয়া গুণ্ডা লেলিয়ে দিল আমাদের উপর। অধিকাংশ লােককে আমাদের বিরুদ্ধে করে ফেরল। পুরান ঢাকার কয়েক জায়গায় ছাত্রদের মারপিটও করল। আর আমরা পাকিস্তান ধ্বংস করতে চাই এই কথা বুঝাবার চেষ্টা করল।
১১ই মার্চ ভােরবেলা শত শত ছাত্রকর্মী ইডেন বিল্ডিং, জেনারেল পােস্ট অফিস ও অন্যান্য জায়গায় পিকেটিং শুরু করল। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে কোনাে পিকেটিংয়ের দরকার হয় নাই। সমস্ত ঢাকা শহর পােস্টারে ভরে ফেলা হল। অনেক দোকানপাট বন্ধ ছিল, কিছু খােলাও ছিল। পুরান ঢাকা শহরে পুরাপুরি হরতাল পালন করে নাই। সকাল আটটায় জেনারেল পােস্ট অফিসের সামনে ছাত্রদের উপর ভীষণভাবে লাঠিচার্জ হল। একদল মার খেয়ে স্থান ত্যাগ করার পর আরেকদল হাজির হতে লাগল। ফজলুল হক হলে আমাদের রিজার্ভ কর্মী ছিল। এইভাবে গােলমাল, মারপিট চলল অনেকক্ষণ। নয়টায় ইডেন বিল্ডিংয়ের সামনের দরজায় লাঠিচার্জ হল। খালেক নেওয়াজ, বখতিয়ার (এখন নওগাঁর এডভােকেট), শহর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এম. এ. ওয়াদুদ গুরুতররূপে আহত হল। তােপখানা রােডে কাজী গােলাম মাহাবুব, শওকত মিয়া ও আরও অনেক ছাত্র আহত হল। আবদুল গনি রােডের দরজায় তখন আর ছাত্ররা অত্যাচার ও লাঠির আঘাত সহ্য করতে পারছে না। অনেক কর্মী আহত হয়ে গেছে এবং সরে পড়ছে। আমি জেনারেল পােস্ট অফিসের দিক থেকে নতুন কর্মী নিয়ে ইডেন বিল্ডিংয়ের দিকে ছুটেছি, এর মধ্যে শামসুল হক সাহেবকে ইডেন বিল্ডিংয়ের সামনে পুলিশ ঘিরে ফেলেছে। গেট খালি হয়ে গেছে। তখন আমার কাছে সাইকেল। আমাকে গ্রেপ্তার করার জন্য সিটি এসপি জিপ নিয়ে। বারবার তাড়া করছে, ধরতে পারছে না। এবার দেখলাম উপায় নাই। একজন সহকর্মী দাঁড়ান ছিল তার কাছে সাইকেল দিয়ে চার পাঁচজন ছাত্র। নিয়ে আবার ইডেন বিল্ডিংয়ের দরজায় আমরা বসে পড়লাম এবং সাইকেল যাকে দিলাম তাকে বললাম, শীঘ্রই আরও কিছু ছাত্র পাঠাতে। আমরা খুব অল্প, টিকতে পারব না। আমাদের দেখাদেখি আরও কিছু ছাত্র ছুটে এসে আমাদের পাশে বসে পড়ল। আমাদের উপর কিছু উত্তম মধ্যম পড়ল এবং ধরে নিয়ে জিপে তুলল। হক সাহেবকে পূর্বেই জিপে তুলে ফেলেছে। বহু ছাত্র গ্রেপ্তার ও জখম হল। কিছু সংখ্যক ছাত্রকে গাড়ি করে ত্রিশ-চল্লিশ মাইল দূরে জঙ্গলের মধ্যে ফেলে আসল। কয়েকজন ছাত্রীও মার খেয়েছিল। অলি আহাদও গ্রেপ্তার হয়ে গেছে। তাজউদ্দীন, তােয়াহা ও অনেককে। গ্রেপ্তার করতে পারে নাই। আমাদের প্রায় সত্তর-পঁচাত্তরজনকে বেঁধে নিয়ে। জেলে পাঠিয়ে দিল সন্ধ্যার সময়। ফলে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠল। ঢাকার জনগণের সমর্থনও আমরা পেলাম।
তখন পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার অধিবেশন চলছিল। শােভাযাত্রা রােজই বের হচ্ছিল। নাজিমুদ্দীন সাহেব বেগতিক দেখলেন। আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছে। ওয়াদুদ ও বখতিয়ার দু’জনই ছাত্রলীগ কর্মী, তাদের ভীষণভাবে আহত করে জেল হাসপাতালে রাখা হয়েছে। এই সময় শেরে বাংলা, বগুড়ার মােহাম্মদ আলী, তােফাজ্জল আলী, ডা. মালেক, সবুর সাহেব, খয়রাত হােসেন, আনােয়ারা খাতুন ও আরও অনেকে মুসলিম লীগ পার্টির বিরুদ্ধে ভীষণভাবে প্রতিবাদ করলেন। আবার শহীদ সাহেবের দল এক হয়ে গেছে। নাজিমুদ্দীন সাহেব ঘাবড়িয়ে গেলেন এবং সংগ্রাম পরিষদের সাথে আলাপ করতে রাজি হলেন।
আমরা জেলে, কি আলাপ হয়েছিল জানি না। তবে সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে কামরুদ্দিন সাহেব জেলে আমাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং বললেন, নাজিমুদ্দীন সাহেব এই দাবিগুলি মানতে রাজি হয়েছেন : এখনই পূর্ব পাকিস্তানের অফিসিয়াল ভাষা বাংলা করে ফেলবে। পূর্ব পাকিস্তান আইনসভা থেকে সুপারিশ করবেন, যাতে কেন্দ্রে বাংলা ভাষাকে অন্যতম। রাষ্ট্রভাষা করা হয়। সমস্ত মামলা উঠিয়ে নিবেন, বন্দিদের মুক্তি দিবেন এবং পুলিশ যে জুলুম করেছে সেই জন্য তিনি নিজেই তদন্ত করবেন। আর কি কি ছিল আমার মনে নাই। তিনি নিজেই হােম মিনিস্টার, আবার নিজেই তদন্ত করবেন এ যেন এক প্রহসন।
আমাদের এক জায়গায় রাখা হয়েছিল জেলের ভিতর। যে ওয়ার্ডে আমাদের রাখা হয়েছিল, তার নাম চার নম্বর ওয়ার্ড। তিনতলা দালান। দেওয়ালের বাইরেই মুসলিম গার্লস স্কুল। যে পাঁচদিন আমরা জেলে ছিলাম সকাল দশটায় মেয়েরা স্কুলের ছাদে উঠে স্লোগান দিতে শুরু করত, আর চারটায় শেষ করত। ছােট্ট ছােট্ট মেয়েরা একটুও ক্লান্ত হতাে না। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘পুলিশি জুলুম চলবে না-নানা ধরনের স্লোগান। এই সময় শামসুল হক সাহেবকে আমি বললাম, “হক সাহেব ওই দেখুন, আমাদের বােনেরা বেরিয়ে এসেছে। আর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করে পারবে না।’ হক সাহেব আমাকে বললেন, “তুমি ঠিকই বলেছ, মুজিব।”
আমাদের ১১ তারিখ জেলে দেওয়া হয়েছিল, আর ১৫ তারিখ সন্ধ্যায় মুক্তি দেওয়া হয়। জেলগেট থেকে শােভাযাত্রা করে আমাদের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে নিয়ে যাওয়া হয়। … গ্রেপ্তারকৃত একজন ছাত্রেরও মনােবল। নষ্ট হয় নাই। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যে কোনাে ত্যাগ তারা স্বীকারে প্রস্তুত ছিল।” পৃ. ৮৭-৯৫
*
১৬ তারিখ সকাল দশটায় বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্রসভায় আমরা সকলেই যােগদান করলাম। হঠাৎ কে যেন আমার নাম প্রস্তাব করে বসল। সভাপতির আসন গ্রহণ করার জন্য। সকলেই সমর্থন করল। বিখ্যাত। আমতলায় এই আমার প্রথম সভাপতিত্ব করতে হল। অনেকেই বক্তৃতা করল। সংগ্রাম পরিষদের সাথে যেসব শর্তের ভিত্তিতে আপােস হয়েছে তার সকলগুলিই সভায় অনুমােদন করা হল। তবে সভা খাজা নাজিমুদ্দীন যে পুলিশি জুলুমের তদন্ত করবেন, তা গ্রহণ করল না; খাজা সাহেব নিজেই প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আমি বক্তৃতায় বললাম, “যা সংগ্রাম পরিষদ গ্রহণ করেছে, আমাদেরও তা গ্রহণ করা উচিত। শুধু আমরা ওই সরকারি প্রস্তাবটা পরিবর্তন করতে অনুরােধ করতে পারি, এর বেশি কিছু না।” ছাত্ররা দাবি করল, শােভাযাত্রা করে আইন পরিষদের কাছে গিয়ে খাজা। সাহেবের কাছে এই দাবিটা পেশ করবে এবং চলে আসবে। আমি বক্তৃতায়। বললাম, তাঁর কাছে পৌছে দিয়েই আপনারা আইন সভার এরিয়া ছেড়ে চলে আসবেন। কেউ সেখানে থাকতে পারবেন না। কারণ সংগ্রাম পরিষদ বলে দিয়েছে, আমাদের আন্দোলন বন্ধ করতে কিছুদিনের জন্য। সকলেই রাজি হলেন।
এক শােভাযাত্রা করে আমরা হাজির হয়ে কাগজটা ভিতরে পাঠিয়ে দিলাম খাজা সাহেবের কাছে। আমি আবার বক্তৃতা করে সকলকে চলে যেতে বললাম এবং নিজেও সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে চলে আসবার জন্য রওয়ানা হলাম। কিছু দূর এসে দেখি, অনেক ছাত্র চলে গিয়েছে। কিছু ছাত্র ও জনসাধারণ তখনও দাড়িয়ে আছে আর মাঝে মাঝে স্লোগান দিচ্ছে। আবার ফিরে গিয়ে বক্তৃতা করলাম। এবার অনেক ছাত্রও চলে গেল। আমি হলে চলে আসলাম। প্রায় চারটায় খবর পেলাম, আবার বহু লােক জমা হয়েছে, তারা বেশিরভাগ সরকারি কর্মচারী ও জনসাধারণ, ছাত্র মাত্র কয়েকজন ছিল। শামসুল হক সাহেব চেষ্টা করছেন লােকদের ফেরাতে।
মাঝে মাঝে হলের ছাত্ররা দু’একজন এমএলএকে ধরে আনতে শুরু করেছে মুসলিম হলে। তাদের কাছ থেকে লিখিয়ে নিচ্ছে, যদি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে না পারেন, তবে পদত্যাগ করবেন। মন্ত্রীরাও বের হতে পারছেন না। খাজা সাহেব মিলিটারির সাহায্যে পেছন দরজা দিয়ে ভেগে গিয়েছিলেন। বহু লােক আবার জড়াে হয়েছে। আমি ছুটলাম এসেম্বলির দিকে। ঠিক কাছাকাছি যখন পৌছে গেছি তখন লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করতে শুরু করেছে পুলিশ। আমার চক্ষু জ্বলতে শুরু করেছে। পানি পড়ছে, কিছুই চোখে দেখি না। কয়েকজন ছাত্র ও পাবলিক আহত হয়েছে। আমাকে কয়েকজন পলাশী ব্যারাকের পুকুরে নিয়ে চোখে মুখে পানি দিতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণ পরে একটু আরাম পেলাম। দেখি মুসলিম হলে হৈচৈ। বাগেরহাটের ডা. মােজাম্মেল হক সাহেবকে ধরে নিয়ে এসেছে। তিনি এমএলএ। তাকে ছাত্ররা জোর করছে লিখতে যে, তিনি পদত্যাগ করবেন। আমাকে তিনি চিনতেন, আমিও তাকে চিনতাম। আমি ছাত্রদের অনুরােধ করলাম, তাকে ছেড়ে দিতে। তিনি লােক ভাল এবং শহীদ সাহেবের সমর্থক ছিলেন। অনেক কষ্টে, তাকে বুঝিয়ে মুক্ত করে বাইরে নিয়ে এলাম। একটা রিকশা ভাড়া করে তাঁকে উঠিয়ে দিলাম। হঠাৎ খবর এল, শওকত মিয়া আহত হয়ে হাসপাতালে আছে। তাড়াতাড়ি ছুটলাম তাঁকে দেখতে। সত্যই সে হাতে, পিঠে আঘাত পেয়েছে। পুলিশ লাঠি দিয়ে তাকে মেরেছে। আরও কয়েকজন সামান্য আহত হয়েছে। সকলকে বলে আসলাম, একটু ভাল হলেই হাসপাতাল ত্যাগ করতে। কারণ, পুলিশ। আবার গ্রেপ্তার করতে পারে। বা সন্ধ্যার পরে খবর এল ফজলুল হক হলে সংগ্রাম পরিষদের সভা হবে। ছাত্ররাও উপস্থিত থাকবে। আমার যেতে একটু দেরি হয়েছিল। তখন একজন বক্তৃতা করছে আমাকে আক্রমণ করে। আমি দাঁড়িয়ে শুনলাম এবং সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। তার বক্তৃতা শেষ হলে আমার বক্তব্য বললাম। আমি যে আমতলার ছাত্রসভায় বলেছিলাম, কাগজ দিয়েই চলে আসতে এবং এ্যাসেম্বলি হাউসের সামনে দাড়িয়ে সকলকে চলে যেতে। অনুরােধ করেছিলাম এবং বক্তৃতাও করেছিলাম, একথা কেউ জানেন কি না? যা হােক, এখানেই শেষ হয়ে গেল, আর বেশি আলােচনা হল না এবং সিদ্ধান্ত হল আপাতত আমাদের আন্দোলন বন্ধ রাখা হল। কারণ, কয়েক দিনের মধ্যে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রথম ঢাকায় আসবেন পাকিস্তান হওয়ার পরে। তাঁকে সংবর্ধনা জানাতে হবে। আমরা ছাত্ররাও সংবর্ধনা জানাব। প্রত্যেক ছাত্র যাতে এয়ারপাের্টে একসাথে শােভাযাত্রা করে যেতে পারে তার বন্দোবস্ত করা হবে।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন শুধু ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ফরিদপুর ও যশােরে কয়েক শত ছাত্র গ্রেপ্তার হয়েছিল। রাজশাহী, খুলনা, দিনাজপুর। ও আরও অনেক জেলায় আন্দোলন হয়েছিল। নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম। ছাত্রলীগ চেষ্টা করেছিল এই আন্দোলনকে বানচাল করতে, কিন্তু পারে নাই। এই আন্দোলন ছাত্ররাই শুরু করেছিল সন্দেহ নাই। কিন্তু এই আন্দোলনের পরে দেখা গেল জনসাধারণও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে বদ্ধপরিকরবিশেষ করে সরকারি কর্মচারীরাও একে সমর্থন দিয়েছিল। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে একদল গুণ্ডা আক্রমণ করলে পলাশী ব্যারাক থেকে সরকারি। কর্মচারীরা এসে তাদের বাধা দিয়েছিল। যার ফলে গুণ্ডারা মার খেয়ে। ভাগতে বাধ্য হয়েছিল। পরে দেখা গেল ঢাকা শহরের জনসাধারণের। মনােভাবের অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। সরকার থেকে প্রপাগাণ্ডা করা হয়েছিল যে, কলকাতা থেকে হিন্দু ছাত্ররা পায়জামা পরে এসে এই। আন্দোলন করছে। যে সত্তর-পঁচাত্তরজন ছাত্র বন্দি হয়েছিল তার মধ্যে। একজনও হিন্দু ছাত্র ছিল না। এমনকি যারা আহত হয়েছিল তার মধ্যেও । একজন হিন্দু ছিল না। তবু তখন থেকেই ‘যুক্ত বাংলা ও ভারতবর্ষের। দালাল, কমিউনিস্ট ও রাষ্ট্রদ্রোহী’- এই কথাগুলি বলা শুরু হয়, আমাদের বিরুদ্ধে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে। এমনকি সরকারি প্রেসনােটেও আমাদের। এভাবে দোষারােপ করা হয়। এ বাংলা পাকিস্তানের শতকরা ছাপ্পান্ন ভাগ লােকের মাতৃভাষা। তাই । বাংলাই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। তবুও আমরা বাংলা ও উর্দু দুইটা রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেছিলাম। পাঞ্জাবের লােকেরা পাঞ্জাবি ভাষা বলে, সিন্ধুর লােকেরা সিন্ধি ভাষায় কথা বলে, সীমান্ত প্রদেশের লােকেরা পশতু ভাষায় কথা বলে, বেলুচরা বেলুচি ভাষায় কথা বলে। উর্দু পাকিস্তানের কোনাে প্রদেশের ভাষা নয়, তবুও যদি পশ্চিম পাকিস্তানের ভায়েরা উর্দু ভাষার জন্য দাবি করে, আমরা আপত্তি করব কেন? যারা উর্দু ভাষা সমর্থন করে তাদের একমাত্র যুক্তি হল উর্দু ‘ইসলামিক ভাষা। উর্দু কি করে যে ইসলামিক ভাষা হল আমরা বুঝতে পারলাম না। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। আরব দেশের। লােকেরা আরবি বলে। পারস্যের লােকেরা ফারসি বলে, তুরস্কের লােকেরা তুর্কি ভাষা বলে, ইন্দোনেশিয়ার লােকেরা ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় কথা বলে, মালয়েশিয়ার লােকেরা মালয়া ভাষায় কথা বলে, চীনের মুসলমানরা চীনা ভাষায় কথা বলে। এ সম্বন্ধে অনেক যুক্তিপূর্ণ কথা বলা চলে। শুধু পূর্ব পাকিস্তানের ধর্মভীরু মুসলমানদের ইসলামের কথা বলে ধোকা দেওয়া যাবে ভেবেছিল, কিন্তু পারে নাই। যে কোনাে জাতি তার মাতৃভাষাকে ভালবাসে। মাতৃভাষার অপমান কোনাে জাতিই কোনাে কালে সহ্য করে নাই। এই সময় সরকারদলীয় মুসলিম লীগ নেতারা উর্দুর জন্য জান মাল কোরবানি করতে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু জনসমর্থন না পেয়ে একটু ঘাবড়িয়ে পড়েছিলেন। তারা শেষ তাবিজ’ নিক্ষেপ করলেন। জিন্নাহকে ভুল বােঝালেন। এরা মনে করলেন, জিন্নাহকে দিয়ে উর্দুর পক্ষে বলতে পারলেই আর কেউ এর বিরুদ্ধাচরণ করতে সাহস পাবে না। জিন্নাহকে দলমত নির্বিশেষে সকলেই শ্রদ্ধা করতেন। তার যে কোন ন্যায়সঙ্গত কথা মানতে সকলেই বাধ্য ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের জনমত কোন পথে, তাকে কেউ তা বলেন নাই বা বলতে সাহস পান নাই।
১৯ মার্চ জিন্নাহ ঢাকা আসলে হাজার হাজার লােক তাকে অভিনন্দন জানাতে তেজগাঁ হাওয়াই জাহাজের আডডায় হাজির হয়েছিল। আমার মনে আছে, ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছিল। সেদিন আমরা সকলেই ভিজে গিয়েছিলাম, তবুও ভিজে কাপড় নিয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা করার জন্য এয়ারপাের্টে অপেক্ষা করেছিলাম। জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তানে এসে ঘােড়দৌড় মাঠে বিরাট জনসভায় ঘােষণা করলেন, “উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে।” আমরা প্রায় চার পাঁচ শত ছাত্র এক জায়গায় ছিলাম সেই সভায়। অনেকে হাত তুলে দাঁড়িয়ে জানিয়ে দিল, ‘মানি না। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভােকেশনে বক্তৃতা করতে উঠে তিনি যখন আবার বললেন, “উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে”- তখন ছাত্ররা তাঁর সামনেই বসে চিৎকার করে। বলল, না, না, না’। জিন্নাহ প্রায় পাঁচ মিনিট চুপ করেছিলেন, তারপর। বক্তৃতা করেছিলেন। আমার মনে হয়, এই প্রথম তাঁর মুখের উপরে তাঁর কথার প্রতিবাদ করল বাংলার ছাত্ররা। এরপর জিন্নাহ যতদিন বেঁচেছিলেন আর কোনােদিন বলেন নাই, উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে।
ঢাকায় জিন্নাহ দুই দলের ছাত্রনেতাদের ডাকলেন। বােধহয় বাংলা ভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতাদেরও ডেকেছিলেন। তবে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের দুইজন করে প্রতিনিধির সাথে দেখা করলেন। কারণ, তিনি পছন্দ করেন নাই দুইটা প্রতিষ্ঠান কেন হবে এই মুহূর্তে! আমাদের পক্ষ থেকে মিস্টার তােয়াহা আর শামসুল হক সাহেব ছিলেন, তবে আমি ছিলাম না। জিন্নাহ আমাদের প্রতিষ্ঠানের নামটা পছন্দ করেছিলেন। নিখিল পূর্ব পাকিস্তানের কর্মকর্তাদের নাম যখন আমাদের প্রতিনিধি পেশ করেন, তখন তারা দেখিয়ে দিলেন যে, এদের অধিকাংশ এখন চাকরি করে, অথবা লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে। তখন। জিন্নাহ তাদের উপর রাগ করেছিলেন। শামসুল হক সাহেবের সাথে জিন্নাহর একটু তর্ক হয়েছিল, যখন তিনি দেখা করতে যান বাংলা রাষ্ট্রভাষা করার বিষয় নিয়ে- শামসুল হক সাহেব আমাকে এসে বলেছিলেন। শামসুল হক সাহেবের সৎ সাহস ছিল, সত্য কথা বলতে কাউকেও ভয় পেতেন না।
জিন্নাহ চলে যাওয়ার কয়েকদিন পরে ফজলুল হক হলের সামনে এক ছাত্রসভা হয়। তাতে একজন ছাত্র বক্তৃতা করেছিল, তার নাম মনে নাই। তবে সে বলেছিল, “জিন্নাহ যা বলবেন তাই মানতে হবে। তিনি যখন উর্দুই রাষ্ট্রভাষা বলেছেন তখন উর্দুই হবে।” আমি তার প্রতিবাদ করে বক্তৃতা করেছিলাম, আজও আমার এই একটা কথা মনে আছে। আমি বলেছিলাম, “কোন নেতা যদি অন্যায় কাজ করতে বলেন, তার প্রতিবাদ করা এবং তাকে বুঝিয়ে বলার অধিকার জনগণের আছে। যেমন হযরত ওমরকে (রা.) সাধারণ নাগরিকরা প্রশ্ন করেছিলেন, তিনি বড় জামা পরেছিলেন বলে।” বাংলা ভাষা শতকরা ছাপ্পান্নজন লােকের মাতৃভাষা, পাকিস্তান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সংখ্যাগুরুদের দাবি মানতেই হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা না হওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব। তাতে যাই হােক না কেন, আমরা প্রস্তুত আছি।” সাধারণ ছাত্ররা আমাকে সমর্থন করল। এরপর পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ও যুবকরা ভাষার দাবি নিয়ে সভা ও শােভাযাত্রা করে চলল। দিন দিন জনমত সৃষ্টি হতে লাগল। কয়েক মাসের মধ্যে দেখা গেল, নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কোনাে সমর্থক রইল না। কিছু নেতা রইল, যাদের মন্ত্রীদের বাড়ি ঘােরাফেরা করা আর সরকারের সকল কিছুই সমর্থন করা ছাড়া কাজ ছিল না। পৃ. ৯৬-১০০
*** *** ***
.. খাজা সাহেব বিরাট ভুল করে বসলেন। | প্রধানমন্ত্রী হয়ে কিছুদিন পরে তিনি পূর্ব বাংলায় আসেন। প্রথমবারে তিনি কিছুই বলেন নাই। কিছুদিন পরে, বােধহয় ১৯৫১ সালের শেষের দিকে অথবা ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে পল্টন ময়দানে এক জনসভায় তিনি বক্তৃতা করলেন। সেখানে ঘােষণা করলেন, “উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে।” তিনি ১৯৪৮ সালের পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে যে ওয়াদা করেছিলেন, সে ওয়াদার খেলাপ করলেন। ১৯৪৮ সালের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম। পরিষদের সাথে চুক্তি করেছিলেন এবং নিজেই পূর্ব বাংলা আইনসভায়। প্রস্তাব পেশ করেছিলেন যে, পূর্ব বাংলার অফিসিয়াল ভাষা বাংলা হবে। তাছাড়া যাতে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হয়, তার । জন্য কেন্দ্রীয় আইনসভার কেন্দ্রীয় সরকারকে অনুরােধ করা হবে। এ প্রস্তাব পূর্ব বাংলার আইনসভায় সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়। যে ঢাকায় বসে তিনি ওয়াদা করেছিলেন সেই ঢাকায় বসেই তিনি উল্টা বললেন। দেশের মধ্যে। ভীষণ ক্ষোভের সৃষ্টি হল। তখন একমাত্র রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান। আওয়ামী মুসলিম লীগ, ছাত্র প্রতিষ্ঠান ছাত্রলীগ এবং যুবা প্রতিষ্ঠান যুগলীগ। সকলেই এর তীব্র প্রতিবাদ করে।
আমি হাসপাতালে আছি। সন্ধ্যায় মােহাম্মদ তােয়াহা ও অলি আহাদ দেখা করতে আসে। আমার কেবিনে একটা জানালা ছিল ওয়ার্ডের দিকে। আমি ওদের রাত একটার পরে আসতে বললাম। আরও বললাম, খালেক। নেওয়াজ, কাজী গােলাম মাহবুব আরও কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকে খবর দিতে। দরজার বাইরে আইবিরা পাহারা দিত। রাতে অনেকে ঘুমিয়ে পড়েছে। তখন পিছনের বারান্দায় ওরা পাঁচ-সাতজন এসেছে। আমি অনেক রাতে একা হাঁটাচলা করতাম। রাতে কেউ আসে না বলে কেউ কিছু বলত না। পুলিশরা চুপচাপ পড়ে থাকে, কারণ জানে আমি ভাগব না। গােয়েন্দা কর্মচারী একপাশে বসে ঝিমায়। বারান্দায় বসে আলাপ হল এবং আমি বললাম, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে। আওয়ামী লীগ নেতাদেরও। খবর দিয়েছি। ছাত্রলীগই তখন ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান। ছাত্রলীগ নেতারা রাজি হল। অলি আহাদ ও তােয়াহা বলল, যুবলীগও রাজি হবে। আবার ষড়যন্ত্র চলছে বাংলা ভাষার দাবি নস্যাৎ করার। এখন প্রতিবাদ না করলে কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলিম লীগ উর্দুর পক্ষেই প্রস্তাব। পাস করে নেবে। নাজিমুদ্দীন সাহেব উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথাই বলেন নাই, অনেক নতুন নতুন যুক্তিতর্ক দেখিয়েছেন। অলি আহাদ যদিও আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সদস্য হয় নাই, তবুও আমাকে ব্যক্তিগতভাবে খুব শ্রদ্ধা করত ও ভালবাসত। আরও বললাম, “খবর পেয়েছি, আমাকে। শীঘ্রই আবার জেলে পাঠিয়ে দিবে, কারণ আমি নাকি হাসপাতালে বসে রাজনীতি করছি। তােমরা আগামীকাল রাতেও আবার এস।” আরও দু’একজন ছাত্রলীগ নেতাকে আসতে বললাম। শওকত মিয়া ও কয়েকজন।
আওয়ামী লীগ কর্মীকেও দেখা করতে বললাম। পরের দিন রাতে এক এক করে অনেকেই আসল। সেখানেই ঠিক হল আগামী ২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে এবং সভা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর করতে হবে। ফেব্রুয়ারি থেকেই জনমত সৃষ্টি করা শুরু হবে। আমি আরও বললাম, “আমিও আমার মুক্তির দাবি করে ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন। ধর্মঘট শুরু করব। আমার ছাব্বিশ মাস জেল হয়ে গেছে। আমি একথাও বলেছিলাম, “মহিউদ্দিন জেলে আছে, আমার কাছে থাকে। যদি সে অনশন করতে রাজি হয়, তবে খবর দেব। তার নামটাও আমার নামের সাথে দিয়ে দিবে। আমাদের অনশনের নােটিশ দেওয়ার পরই শওকত মিয়া প্যামপ্লেট ও পােস্টার ছাপিয়ে বিলি করার বন্দোবস্ত করবে।”
দুই দিন পরেই দেখলাম একটা মেডিক্যাল বাের্ড গঠন করে আমাকে এক্সামিন করতে এসেছে। তারা মত দিলেন আমি অনেকটা সুস্থ, এখন। কারাগারে বসেই আমার চিকিৎসা হতে পারে। সরকার আমাকে ঢাকা জেলে পাঠিয়ে দিলেন, ভালভাবে চিকিৎসা না করে। আমি জেলে এসেই মহিউদ্দিনকে সকল কথা বললাম। মহিউদ্দিনও রাজি হল অনশন ধর্মঘট করতে। আমরা দুইজনে সরকারের কাছে পহেলা ফেব্রুয়ারি দরখাস্ত পাঠালাম। যদি ১৫ই ফেব্রুয়ারির মধ্যে আমাদের মুক্তি দেওয়া না হয় তাহা। হলে ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘট করতে শুরু করব। দুইখানা। দরখাস্ত দিলাম। আমাকে যখন জেল কর্তৃপক্ষ অনুরােধ করল অনশন ধর্মঘট না করতে তখন আমি বলেছিলাম, ছাব্বিশ-সাতাশ মাস বিনাবিচারে বন্দি রেখেছেন। কোনাে অন্যায়ও করি নাই। ঠিক করেছি জেলের বাইরে যাব, হয় আমি জ্যান্ত অবস্থায় না হয় মৃত অবস্থায় যাব। “Either I will go out of jail or my deadbody will go out.” তারা সরকারকে জানিয়ে দিল। বাহিরে খবর দিয়েই এসেছিলাম এই তারিখে দরখাস্ত করব। বাইরে সমস্ত জেলায় ছাত্রলীগ কর্মীদের ও যেখানে যেখানে আওয়ামী লীগ ছিল সেখানে। খবর পাঠিয়ে দিয়েছিল। সামান্য কয়েকটা জেলা ছাড়া আওয়ামী লীগ তখনও গড়ে ওঠে নাই। তবে সমস্ত জেলায়ই আমার ব্যক্তিগত বন্ধু ও সহকর্মী ছিল। এদিকে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদও গঠন করা হয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করা হয়েছে। কারণ, ওইদিনই পূর্ব বাংলার আইনসভা বসবে। কাজী গােলাম মাহবুবকে সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর করা হয়েছিল। ১৯৪৮ সালে ছাত্ররাই এককভাবে বাংলা ভাষার দাবির জন্য সংগ্রাম করেছিল। এবার আমার বিশ্বাস ছিল, জনগণ এগিয়ে আসবে। কারণ জনগণ বুঝতে শুরু করেছে যে, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করতে পারলে তাদের দাসত্বের শৃঙ্খল আবার পরতে হবে। মাতৃভাষার অপমান কোনাে জাতি সহ্য করতে পারে না। পাকিস্তানের জনগণের শতকরা ছাপ্পান্নজন বাংলা ভাষাভাষী হয়েও শুধুমাত্র বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা বাঙালিরা করতে চায় নাই। তারা চেয়েছে বাংলার সাথে উর্দুকেও রাষ্ট্রভাষা করা। হােক, আপত্তি নাই। কিন্তু বাঙালির এই উদারতাটাই অনেকে দুর্বলতা হিসাবে গ্রহণ করে নিয়েছে। এদিকে বাঙালিরা অনুভব করতে শুরু করেছে। যে, তাদের উপর অর্থনৈতিক দিক দিয়ে, ব্যবসা-বাণিজ্য, সরকারি চাকরিতেও অবিচার চলছে। পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে রাজধানী হওয়াতে বাঙালিরা সুযােগ-সুবিধা হতে বঞ্চিত হতে শুরু করেছে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি এবং শেষ পর্যন্ত। সর্বদলীয় ‘গ্রান্ড ন্যাশনাল কনভেনশনে স্বায়ত্তশাসনের দাবি করায়। বাঙালিদের মনােভাব ফুটে উঠেছে। পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগ নেতারা যতই জনগণের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলেন ততই পশ্চিম পাকিস্তানের। কোটারি ও আমলাতন্ত্রের উপর নির্ভর করতে শুরু করেছেন ক্ষমতায় থাকার। জন্য। খাজা নাজিমুদ্দীন ও জনাব নূরুল আমীন জনগণকে ভয় করতে শুরু করেছেন। সেইজন্য টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পরে অনেকগুলি আইনসভার সদস্যের পদ খালি হওয়া সত্ত্বেও উপনির্বাচন দিতে সাহস পাচ্ছিলেন না।

এদিকে জেলের ভেতর আমরা দুইজনে প্রস্তুত হচ্ছিলাম অনশন ধর্মঘট করার জন্য। আমরা আলােচনা করে ঠিক করেছি, যাই হােক না কেন, আমরা অনশন ভাঙব না।…
১৫ তারিখে সকালবেলা আমাকে জেলগেটে নিয়ে যাওয়া হল এই কথা বলে যে, আমার সাথে আলােচনা আছে অনশন ধর্মঘটের ব্যাপার নিয়ে। আমি যখন জেলগেটে পৌছলাম, দেখি একটু পরেই মহিউদ্দিনকেও নিয়ে আসা হয়েছে একই কথা বলে। কয়েক মিনিট পরে আমার মালপত্র, কাপড়চোপড় ও বিছানা নিয়ে জমাদার সাহেব হাজির। বললাম, ব্যাপার কি? কর্তৃপক্ষ বললেন, আপনাদের অন্য জেলে পাঠানাের হুকুম হয়েছে। জিজ্ঞাসা করলাম, কোন জেলে? কিছুই বললেন না। … আমাদের জন্য বন্ধ
ঘােড়ার গাড়ি আনা হয়েছে। গাড়ির ভিতর জানালা উঠিয়ে ও দরজার কপাট বন্ধ করে দিল। দুইজন ভিতরেই আমাদের সাথে বসল। আর একটা গাড়িতে অন্যরা পিছনে পিছনে ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশে রােডের দিকে। চলল। সেখানে যেয়ে দেখি পূর্বেই একজন আর্মড পুলিশ ট্যাক্সি রিজার্ভ করে দাঁড়িয়ে আছে। তখন ট্যাক্সি পাওয়া খুব কষ্টকর ছিল। আমরা আস্তে আস্তে নামলাম ও উঠলাম। কোন চেনা লােকের সাথে দেখা হল না। যদিও এদিক ওদিক অনেকবার তাকিয়ে ছিলাম। ট্যাক্সি তাড়াতাড়ি চালাতে বলল। আমি ট্যাক্সিওয়ালাকে বললাম, “বেশি জোরে চালাবেন না, কারণ বাবার। কালের জীবনটা যেন রাস্তায় না যায়।”
আমরা পৌছে খবর পেলাম জাহাজ ছেড়ে চলে গেছে। এখন উপায়? কোথায় আমাদের নিয়ে যাবে? রাত একটায় আরেকটা জাহাজ ছাড়বে। আমাদের নারায়ণগঞ্জ থানায় নিয়ে যাওয়া হল। ওপরওয়ালাদের টেলিফোন করল এবং হুকুম দিল থানায়ই রাখতে। আমাদের পুলিশ ব্যারাকের সামনে একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। একজন চেনা লােককে দেখলাম, তাকে বললাম, শামসুজ্জোহাকে খবর দিতে। খান সাহেব ওসমান আলী সাহেবের বাড়ি সকলেই চিনে। এক ঘণ্টার মধ্যে জোহা সাহেব, বজলুর রহমান ও আরও অনেকে থানায় এসে হাজির। আমাদের জন্য খাবার নিয়ে এসেছে। পরে আলমাস আলীও আমাদের দেখতে এসেছিল। আমি ওদের বললাম, “রাতে হােটেলে খেতে যাব। কোন হােটেলে যাব বলে যান। আপনারা পূর্বেই সেই হােটেলে বসে থাকবেন। আলাপ আছে।” আমাদের কেন বদলি করেছে, ঢাকা জেল থেকে ফরিদপুর জেলে, এর মধ্যেই বলে দিলাম। বেশি। সময় তাদের থাকতে দিল না থানায়। হােটেলের নাম বলে বিদায় নিল। আমি বললাম, “রাত আটটা থেকে সাড়ে আটটার মধ্যে পৌছাব।” নতুন একটা হােটেল হয়েছে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রােডের উপরে, হােটেলটা দোতলা।
আমি সুবেদার সাহেবকে বললাম যে, “আমাদের খাওয়া-দাওয়া দরকার, চলুন, হােটেলে খাই। সেখান থেকে জাহাজঘাটে চলে যাব।” সে রাজি হল। আমার কথা ফেলবে না এ বিশ্বাস আমার ছিল। আর আমাদের তাে খাওয়াতে হবে। একজন সিপাহী দিয়ে মালপত্র স্টেশনে পাঠিয়ে দিল আর আমরা যথাসময়ে হােটেলে পৌছালাম। দোতালায় একটা ঘরে বসার ব্যবস্থা ছিল। সেখানে আমাদের খাবার বন্দোবস্ত করে রেখেছে। আমরা বসে পড়লাম। আট-দশজন কর্মী নিয়ে জোহা সাহেব বসে আছেন। আমরা আস্তে-আস্তে খাওয়া-দাওয়া করলাম, আলাপ-আলােচনা করলাম। ভাসানী সাহেব, হক সাহেব ও অন্যান্য নেতাদের খবর দিতে বললাম। খবরের কাগজে যা দিতে পারে চেষ্টা করবে। বললাম, সাপ্তাহিক ইত্তেফাক তাে আছেই। আমরা যে আগামীকাল থেকে আমরণ অনশন শুরু করব, সেকথাও তাদের বললাম, যদিও তারা পূর্বেই খবর পেয়েছিল। নারায়ণগঞ্জের কর্মীদের ত্যাগ ও তিতিক্ষার কথা কোন রাজনৈতিক কর্মী ভুলতে পারে না। তারা আমাকে বলল, “২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখে নারায়ণগঞ্জে পূর্ণ হরতাল হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি তাে আছেই, আপনাদের মুক্তির দাবিও আমরা করব।” এখানেও আমাকে নেতারা প্রশ্ন করল, “মহিউদ্দিনকে বিশ্বাস করা যায় কি না! আবার বাইরে এসে মুসলিম। লীগ করবে না তাে।” আমি বললাম, “আমাদের কাজ আমরা করি, তার কর্তব্য সে করবে। তবে মুসলিম লীগ করবে না। সে সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নাই। সে বন্দি, তার মুক্তি চাইতে আপত্তি কি! মানুষকে ব্যবহার, ভালবাসা। ও প্রীতি দিয়েই জয় করা যায়, অত্যাচার, জুলুম ও ঘৃণা দিয়ে জয় করা যায় না ।
রাত এগারটায় আমরা স্টেশনে আসলাম। জাহাজ ঘাটেই ছিল, আমরা উঠে পড়লাম। জাহাজ না ছাড়া পর্যন্ত সহকর্মীরা অপেক্ষা করল। রাত একটার সময় সকলের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। বললাম, “জীবনে আর। দেখা না হতেও পারে। সকলে যেন আমাকে ক্ষমা করে দেয়। দুঃখ আমার নাই। একদিন মরতেই হবে, অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে যদি মরতে পারি, সে মরাতেও শান্তি আছে।”
জাহাজ ছেড়ে দিল, আমরা বিছানা করে শুয়ে পড়লাম। সকালে দুইজন পরামর্শ করে ঠিক করলাম, জাহাজে অনশন করি কি করে? আমাদের জেলে নিতে হবে অনশন শুরু করার পূর্বে। সমস্ত দিন জাহাজ চলল, রাতে গােয়ালন্দ ঘাটে এলাম। সেখান থেকে ট্রেনে রাত চারটায় ফরিদপুর পৌছালাম। রাতে আমাদের জেল কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করল না। আমরা দুইজনে জেল সিপাহীদের ব্যারাকের বারান্দায় কাটালাম। সকালবেলা সুবেদার সাহেবকে বললাম, “জেল অফিসার না আসলে তাে আমাদের জেলে নিবে না, চলেন কিছু নাশতা করে আসি।” নাশতা খাবার ইচ্ছা আমাদের নাই। তবে যদি কারও সাথে দেখা হয়ে যায়, তাহলে ফরিদপুরের সহকর্মীরা। জানতে পারবে, আমরা ফরিদপুর জেলে আছি এবং অনশন ধর্মঘট করছি। আধা ঘণ্টা দেরি করলাম, কাউকেও দেখি না- চায়ের দোকানের মালিক এসেছে, তাকে আমি আমার নাম বললাম এবং খবর দিতে বললাম আমার সহকর্মীদের। আমরা জেলের দিকে রওয়ানা করছি, এমন সময় আওয়ামী লীগের এক কর্মী, তার নামও মহিউদ্দিন- সকলে মহি বলে ডাকে, তার। সঙ্গে দেখা। আমি তখন ফরিদপুরে ১৯৪৬ সালের ইলেকশনে ওয়ার্কার ইনচার্জ ছিলাম, তখন আমার সাথে কাজ করেছে। মহি সাইকেলে যাচ্ছিল, আমি তাকে দেখে ডাক দিলাম নাম ধরে, সে সাইকেল থেকে আমাকে দেখে এগিয়ে আসল। আইবি নিষেধ করছিল। আমি শুনলাম না, তাকে এক ধমক দিলাম এবং মহিকে বললাম, আমাদের ফরিদপুর জেলে এনেছে। এবং আজ থেকে অনশন করছি সকলকে এ খবর দিতে। আমরা জেলগেটে চলে আসলাম, মহিও সাথে সাথে আসল। পৃ. ১৯৬-২০১
*

আমি জেলগেটে এসে দেখি, জেলার সাহেব, ডেপুটি জেলার সাহেব এসে গেছেন। আমাদের তাড়াতাড়ি ভিতরে নিয়ে যেতে বললেন। তাঁরা পূর্বেই খবর পেয়েছিলেন। জায়গাও ঠিক করে রেখেছেন, তবে রাজবন্দিদের সাথে নয়, অন্য জায়গায়। আমরা তাড়াতাড়ি ঔষধ খেলাম পেট পরিষ্কার করবার জন্য। তারপর অনশন ধর্মঘট শুরু করলাম। দুই দিন পর অবস্থা খারাপ। হলে আমাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল।… পৃ. ২০১
.. ভাবলাম আর বেশি দিন নাই। একজন কয়েদিকে দিয়ে গােপনে। কয়েক টুকরা কাগজ আনলাম। যদিও হাত কাঁপে তথাপি ছােট ছােট করে। চারটি চিঠি লিখলাম। আব্বার কাছে একটা, রেণুর কাছে একটা, আর দুইটা শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেবের কাছে। দু’একদিন পরে আর লেখার শক্তি থাকবে না।
২১শে ফেব্রুয়ারি আমরা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা নিয়ে কাটালাম, রাতে সিপাহীরা ডিউটিতে এসে খবর দিল, ঢাকায় ভীষণ গােলমাল হয়েছে। কয়েকজন লােক গুলি খেয়ে মারা গেছে। রেডিওর খবর। ফরিদপুরে। হরতাল হয়েছে, ছাত্র-ছাত্রীরা শােভাযাত্রা করে জেলগেটে এসেছিল। তারা। বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছিল, “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”, “বাঙালিদের শােষণ করা চলবে না”, “শেখ মুজিবের মুক্তি চাই”, “রাজবন্দিদের মুক্তি চাই” আরও অনেক স্লোগান। আমার খুব খারাপ লাগল। কারণ, ফরিদপুর আমার জেলা, মহিউদ্দিনের নামে কোনাে শ্লোগান হচ্ছে না কেন? শুধু “রাজবন্দিদের মুক্তি চাই” বললেই তাে হত। রাতে যখন ঢাকার খবর পেলাম তখন ভীষণ চিন্তামুক্ত হয়ে পড়লাম। কত লােক মারা গেছে বলা কষ্টকর। তবে অনেক লােক গুলি খেয়ে মারা গেছে শুনেছি। দু’জনে পাশাপাশি বিছানায় শুয়ে আছি। ডাক্তার সাহেব আমাদের নড়াচড়া করতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু উত্তেজনায় উঠে পড়লাম। দুইজন কয়েদি ছিল আমাদের পাহারা দেবার এবং কাজকর্ম করে দেবার জন্য। তাড়াতাড়ি আমাদের ধরে শুইয়ে দিল। খুব খারাপ লাগছিল, মনে হচ্ছিল চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলেছি। গুলি করার তাে কোন দরকার ছিল না। হরতাল করবে, সভা ও শােভাযাত্রা করবে, কেউ তাে বিশৃঙ্খলা করতে চায় না। কোনাে গােলমাল সৃষ্টি করার কথা তাে কেউ চিন্তা করে নাই। ১৪৪ ধারা দিলেই গােলমাল হয়, না দিলে গােলমাল হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। অনেক রাতে একজন সিপাহি এসে বলল, ছাত্র মারা গেছে অনেক। বহু লােক গ্রেপ্তার হয়েছে। রাতে আর কোন খবর নাই। ঘুম তাে এমনিই হয় না, তারপর আবার এই খবর। পরের দিন নয়-দশটার সময় বিরাট শােভাযাত্রা বের হয়েছে, বড় রাস্তার কাছেই জেল। শােভাযাত্রীদের স্লোগান পরিষ্কার শুনতে পেতাম, হাসপাতালের দোতলা থেকে দেখাও যায়, কিন্তু আমরা নিচের তলায়। হর্ন দিয়ে একজন বক্তৃতা করছে। আমাদের জানাবার জন্যই হবে। কি হয়েছে ঢাকায় আমরা কিছু কিছু বুঝতে পারলাম। জেল কর্তৃপক্ষ আমাদের কোনাে খবর দিতে চায় না। আমরা যেন খবর না পাই, আর কোনাে খবর দিতে না পারি বাইরে, এই তাদের চেষ্টা। খবরের কাগজ তাে একদিন পরে আসবে, ঢাকা থেকে।
২২ তারিখ সারা দিন ফরিদপুরে শােভাযাত্রা চলল। কয়েকজন ছাত্রছাত্রী এক জায়গায় হলেই স্লোগান দেয়। ছােট্ট ছােট্ট ছেলেমেয়েরা রাস্তায় বেড়ায় আর স্লোগান দেয়। ২২ তারিখে খবরের কাগজ এল, কিছু কিছু খবর পেলাম। মুসলিম লীগ সরকার কত বড় অপরিণামদর্শিতার কাজ করল। মাতৃভাষা আন্দোলনে পৃথিবীতে এই প্রথম বাঙালিরাই রক্ত দিল। দুনিয়ার কোথাও ভাষা আন্দোলন করার জন্য গুলি করে হত্যা করা হয় নাই। জনাব নূরুল আমিন বুঝতে পারলেন না, আমলাতন্ত্র তাঁকে কোথায় নিয়ে গেল। গুলি হল মেডিক্যাল কলেজ হােস্টেলের এরিয়ার ভেতরে, রাস্তায়ও নয়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলেও গুলি না করে গ্রেপ্তার করলেই তাে চলত। আমি ভাবলাম, দেখব কি না জানি না, তবে রক্ত যখন আমাদের ছেলেরা দিয়েছে। তখন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করে আর উপায় নাই। মানুষের যখন পতন আসে তখন পদে পদে ভুল হতে থাকে। বাংলাদেশের মুসলিম লীগ নেতারা বুঝলেন না, কে বা কারা খাজা সাহেবকে উর্দুর কথা বলালেন, আর
কেনই বা তিনি বললেন! তারা তাে জানতেন, উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলে মিস্টার জিন্নাহর মত নেতাও বাধা না পেয়ে ফিরে যেতে পারেন নাই। সেখানে খাজা সাহেব এবং তার দলবলের অবস্থা কি হবে? একটা বিশেষ গােষ্ঠী- যারা ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করতে শুরু করেছেন, তাঁরাই তাঁকে জনগণ থেকে যাতে দূরে সরে পড়েন তার বন্দোবস্ত করলেন। সাথে সাথে তার সমর্থক নূরুল আমিন সাহেবও যাতে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান সে ব্যবস্থাও করালেন। কারণ ভবিষ্যতে এই বিশেষ গােষ্ঠী কোনাে একটা গভীর ষড়যন্ত্রের প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। যদিও খাজা সাহেবের জনসমর্থন কোনােদিন বাংলাদেশে ছিল না।
খবরের কাগজে দেখলাম, মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ এমএলএ, খয়রাত হােসেন এমএলএ, খান সাহেব ওসমান আলী এমএলএ এবং মােহাম্মদ আবুল হােসেন ও খােন্দকার মােশতাক আহমদসহ শত শত ছাত্র ও কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে। দু’একদিন পরে দেখলাম কয়েকজন প্রফেসর, মওলানা ভাসানী, শামসুল হক সাহেব ও বহু আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীকে গ্রেফতার করেছে। নারায়ণগঞ্জে খান সাহেব ওসমান আলীর বাড়ির ভিতরে ঢুকে ভীষণ মারপিট করেছে। বৃদ্ধ খান সাহেব ও তাঁর ছেলেমেয়েদের উপর অকথ্য অত্যাচার হয়েছে। সমস্ত ঢাকায় ও নারায়ণগঞ্জে এক ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছে। আওয়ামী লীগের কোন কর্মীই বােধহয় আর বাইরে নাই।
আমাদের অবস্থা এখন এমন পর্যায়ে এসেছে যে, যে কোনাে মুহূর্তে মৃত্যুর ছায়ায় চিরদিনের জন্য স্থান পেতে পারি। সিভিল সার্জন সাহেব। দিনের মধ্যে পাঁচ-সাতবার আমাদের দেখতে আসেন। ২৫ তারিখ সকালে যখন আমাকে তিনি পরীক্ষা করছিলেন হঠাৎ দেখলাম, তার মুখ গম্ভীর হয়ে গেছে। তিনি কোনাে কথা না বলে, মুখ কালাে করে বেরিয়ে গেলেন। আমি বুঝলাম, আমার দিন ফুরিয়ে গেছে।…২৭ তারিখ দিনেরবেলা আমার অবস্থা আরও খারাপ হয়ে পড়ল। বােধহয় আর দু’একদিন বাঁচতে পারি।
২৭ তারিখ রাত আটটার সময় আমরা দুইজন চুপচাপ শুয়ে আছি। কারও সাথে কথা বলার ইচ্ছাও নাই, শক্তিও নাই। দুইজনেই শুয়ে শুয়ে কয়েদির সাহায্যে ওজু করে খােদার কাছে মাপ চেয়ে নিয়েছি। দরজা খুলে বাইরে থেকে ডেপুটি জেলার এসে আমার কাছে বসলেন এবং বললেন, “আপনাকে যদি মুক্তি দেওয়া হয়, তবে খাবে তাে?” বললাম, “মুক্তি দিলে খাব, না দিলে খাব না। তবে আমার লাশ মুক্তি পেয়ে যাবে।” ডাক্তার সাহেব এবং আরও কয়েকজন কর্মচারী এসে গেছে চেয়ে দেখলাম। ডেপুটি জেলার সাহেব বললেন, “আমি পড়ে শােনাই, আপনার মুক্তির অর্ডার এসে গেছে রেডিওগ্রামে এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের অফিস থেকেও অর্ডার এসেছে। দুইটা অর্ডার পেয়েছি।”… ২০৩-২০৫
*
পরের দিন আব্বা আমাকে নিতে আসলেন। অনেক লােক জেলগেটে হাজির। আমাকে স্ট্রেচারে করে জেলগেটে নিয়ে যাওয়া হল এবং গেটের বাইরে রেখে দিল, যদি কিছু হয় বাইরে গিয়ে হােক, এই তাদের ধারণা।… পাঁচ দিন পর বাড়ি পৌছালাম। মাকে তাে বােঝানাে কষ্টকর। হাচু আমার গলা ধরে প্রথমেই বলল, “আব্বা, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি | চাই।” ২১শে ফেব্রুয়ারি ওরা ঢাকায় ছিল, যা শুনেছে তাই বলে চলেছে।
. ১৯৫২ সালে ঢাকায় গুলি হওয়ার পরে গ্রামে গ্রামে জনসাধারণ বুঝতে আরম্ভ করেছে যে, যারা শাসন করছে তারা জনগণের আপনজন নয়। খবর নিয়ে জানতে পারলাম, ২১শে ফেব্রুয়ারি গুলি হওয়ার খবর বাতাসের সাথে। সাথে গ্রামে গ্রামে পৌছে গেছে এবং ছােট ছােট হাটবাজারে পর্যন্ত হরতাল হয়েছে। মানুষ বুঝতে আরম্ভ করেছে যে, বিশেষ একটা গােষ্ঠী (দল) বাঙালিদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চায়। ভরসা হল আর দমাতে পারবে না। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করে উপায় নাই। এই আন্দোলনে দেশের লােক সাড়া দিয়েছে ও এগিয়ে এসেছে। কোনাে কোনাে মওলানা সাহেবরা ফতােয়া দিয়েছিলেন বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে। তাঁরাও ভয় পেয়ে গেছেন। এখন আর প্রকাশ্যে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস পাচ্ছেন না। জনমত সৃষ্টি হয়েছে, জনমতের বিরুদ্ধে যেতে শােষকরাও ভয় পায়। শাসক যখন শােষক। হয় অথবা শােষকদের সাহায্য করতে আরম্ভ করে তখন দেশের ও জনগণের। মঙ্গল হওয়ার চেয়ে অমঙ্গলই বেশি হয়। পৃ. ২০৬-২০৯
*
মার্চ মাস পুরােটাই আমাকে বাড়িতে থাকতে হল।… আব্বার কাছ থেকে টাকা নিয়ে ঢাকায় রওয়ানা করলাম, এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে।… আমি বরিশাল হয়ে ঢাকায় পৌছালাম। … শামসুল হক সাহেব জেলে। আমি জয়েন্ট সেক্রেটারি। ওয়ার্কিং কমিটির সভা ডাকলাম। তাতে যে বার-তেরজন সদস্য
৯৮
উপস্থিত ছিলেন তারা আমাকে এ্যাকটিং জেনারেল সেক্রেটারি করে প্রতিষ্ঠানের ভার দিলেন। আতাউর রহমান খান সাহেব অন্যতম সহ-সভাপতি ছিলেন, তিনি সভাপতিত্ব করলেন।… পৃ. ২১০-২১১
… আমি সাধারণ সম্পাদক হয়েই একটা প্রেস কনফারেন্স করলাম। তাতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে, রাজবন্দিদের মুক্তি দিতে হবে এবং যারা ২১শে ফেব্রুয়ারি শহীদ হয়েছেন তাঁদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দান। এবং যারা অন্যায়ভাবে জুলুম করেছে তাদের শাস্তির দাবি করলাম। সরকার যে বলেছেন, বিদেশী কোন রাষ্ট্রের উসকানিতে এই আন্দোলন হয়েছে, তার প্রমাণ চাইলাম। হিন্দু ছাত্ররা কলকাতা থেকে এসে পায়জামা পরে আন্দোলন করেছে, একথা বলতেও কৃপণতা করে নাই মুসলিম লীগ নেতারা। তাদের কাছে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ছাত্রসহ পাঁচজন ছয়জন লােক মারা গেল গুলি খেয়ে, তারা সকলেই মুসলমান কি না? যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের মধ্যে শতকরা নিরানব্বইজন মুসলমান কি না? এত ছাত্র কলকাতা থেকে এল একজনকেও ধরতে পারল না যে সরকার, সে সরকারের গদিতে থাকার অধিকার নাই। পৃ. ২১০-২১২ |… মে মাসে আমি করাচি পৌছালাম।…আমি পৌছেই খাজা সাহেবের কাছে একটা চিঠি পাঠালাম, তার সাথে দেখা করার অনুমতি চেয়ে। তিনি আমার চিঠির উত্তর দিলেন এবং সময় ঠিক করে দিলেন দেখা করার অনুমতি দিয়ে।
.. আমি যথাসময়ে প্রধানমন্ত্রী খাজা সাহেবের সাথে দেখা করতে তাঁর অফিসে হাজির হলাম। … আমি তাঁকে অনুরােধ করলাম, “মওলানা ভাসানী, শামসুল হক, আবুল হাশিম, মওলানা তর্কবাগীশ, খয়রাত হােসেন, খান সাহেব ওসমান আলীসহ সমস্ত কর্মীকে মুক্তি দিতে। আরও বললাম, জুডিশিয়াল ইনকোয়ারি বসাতে, কেন গুলি করে ছাত্রদের হত্যা করা। হয়েছিল? তিনি বললেন, “এটা প্রাদেশিক সরকারের হাতে, আমি কি করতে পারি?” আমি বললাম, “আপনি মুসলিম লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী, আর পূর্ব বাংলায়ও মুসলিম লীগ সরকার, আপনি নিশ্চয়ই পারেন। আপনি তাে চান না যে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হােক, আর আমরাও তা চাই না। আমি করাচি পর্যন্ত এসেছি আপনার সাথে দেখা করতে, এজন্য যে প্রাদেশিক সরকারের কাছে দাবি করে কিছুই হবে না। তারা যে অন্যায় করেছে সেই অন্যায়কে ঢাকবার জন্য আরও অন্যায় করে চলেছে।” পৃ. ২১৩-২১৪
.. শহীদ সাহেব বাইরে গেছেন, রাতে ফিরবেন। … রাত দশটায় তিনি ফিরলেন। … তিনি পূর্ব বাংলার কথা জিজ্ঞাসা করলেন, নেতারা সকলেই জেলে আছেন, কি আর ভাল থাকবেন! নাজিমুদ্দীন সাহেবের সাথে আমার যে আলাপ হয়েছিল তা বললাম। একুশে ফেব্রুয়ারি যা যা ঘটেছিল তাও জানালাম। বললাম, রাষ্ট্রভাষা সম্বন্ধে তাঁর মতামত খবরের কাগজে বের হয়েছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “কি বের হয়েছে?” আমি বললাম, “আপনি নাকি কোন রিপাের্টারকে বলেছেন যে, উর্দুই রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। তিনি ক্ষেপে গেলেন এবং বললেন, “এ কথা তাে আমি বলি নাই। উর্দু ও বাংলা দুইটা হলে আপত্তি কি? একথাই বলেছিলাম। আরও জানালেন যে, গুলি ও অত্যাচারের প্রতিবাদও তিনি করেছেন। আমি তাঁকে জানালাম, “সে সব কথা কোনাে কাগজে পরিষ্কার করে ছাপান হয় নাই। পূর্ব বাংলার জনসাধারণ আপনার মতামত না পেয়ে খুবই দুঃখিত হয়েছে।” তিনি আমাকে পরের দিন বিকালে আসতে বললেন, কারণ সকালে কোর্ট আছে। … পৃ. ২১৫
.. আমি আর একটা অনুরােধ করলাম, তাঁকে লিখে দিতে হবে যে, উর্দু ও বাংলা দুইটাকেই রাষ্ট্রভাষা হিসাবে তিনি সমর্থন করেন। কারণ অনেক ভুল বােঝাবুঝি হয়ে গেছে। মুসলিম লীগ এবং তথাকথিত প্রগতিবাদীরা প্রপাগাণ্ডা করছেন তাঁর বিরুদ্ধে। তিনি বললেন, “নিশ্চয়ই লিখে দেব, এটা তাে আমার নীতি ও বিশ্বাস।” তিনি লিখলেন।… পৃ. ২১৬
বিকালে করাচি রওয়ানা করলাম, শহীদ সাহেব নিজে গাড়ি চালালেন, আমি তার পাশেই বসলাম। পিছনে আরও কয়েকজন এডভােকেট বসলেন। রাস্তায় এডভােকেট সাহেবরা আমাকে পূর্ব বাংলার অবস্থার কথা জিজ্ঞাসা করলেন। বাংলা ভাষাকে কেন আমরা রাষ্ট্রভাষা করতে চাই? হিন্দুরা এই আন্দোলন করছে কি না? আমি তাদের বুঝাতে চেষ্টা করলাম। শহীদ সাহেবও তাদের বুঝিয়ে বললেন এবং হিন্দুদের কথা যে সরকার বলছে, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা তা তিনিই তাঁদের ভাল করে বুঝিয়ে দিলেন।…
খাজা সাহেব ও লাহােরের শহীদ সাহেবের ভক্তরা প্রেস কনফারেন্সের আয়ােজন করলেন। … প্রেস কনফারেন্সে সমস্ত দৈনিক কাগজের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। এমনকি এপিপি’র প্রতিনিধিও উপস্থিত ছিলেন। আমার বক্তব্য পেশ করার পরে আমাকে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন, আমি তাঁদের প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দিতে পেরেছিলাম। আমরা যে উর্দু ও বাংলা দু’টাই রাষ্ট্রভাষা চাই, এ ধারণা তাঁদের ছিল না। তাঁদের বলা হয়েছে শুধু বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করছি আমরা। পাকিস্তান আন্দোলনে যে সমস্ত নেতা ও কর্মী মুসলিম লীগ ও পাকিস্তানের জন্য কাজ করেছে তারাই আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠান গড়েছে তা আমি প্রমাণ করতে পেরেছিলাম। আমি যখন এক এক নেতাদের নাম বলতে শুরু করলাম তখন তারা বুঝতে পারলেন বলে মনে হল।…
লাহাের থেকে প্লেনে ঢাকা আসলাম। পৃ. ২১৭-২১৮

সূত্র: ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিব কতিপয় দলিল -ড. এম আবদুল আলীম

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!