বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সামনে কয়েকটি জরুরি প্রশ্ন
সূর্য ঘােষাল
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত ১১টায় বাঙলাদেশে যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় আজ তার বয়স প্রায় দু-মাস হতে চলল। এ যুগে যখন প্রতিটি ধনতান্ত্রিক দেশের রাষ্টযন্ত্র সর্বাধুনিক মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত তখন দু-মাস কেন, দু-বছরেও কোন দেশে জনগণের মুক্তিযুদ্ধ বিজয়ী হবে এ আশা করা শিশুসুলভ কল্পনাবিলাস। ভিয়েতনাম—যেখানে রাশিয়াসহ পৃথিবীর প্রতিটি সমাজতান্ত্রিক দেশ অস্ত্র সাহায্য করছে, সেখানেও দীর্ঘকালের মুক্তিযুদ্ধ এখনও পরিপূর্ণ বিজয়ী হতে পারেনি। সুতরাং বাঙলাদেশের দু-মাসের মুক্তিযুদ্ধ ভবিষ্যতে কী রূপ নেবে, কতদিন দীর্ঘস্থায়ী হবে সে সম্পর্কে এখনই কোনও কথা বলা সম্ভব নয়।
কিন্তু তবু, বাঙলাদেশের এই মুক্তিযুদ্ধের গতিপ্রকৃতি দেখে আমরা সারা এপার বাঙলার অধিবাসী, যারা শারীরিক দিক থেকে এ যুদ্ধের অংশীদার না হলেও মনের দিক থেকে সহযােদ্ধা, তারা এই দু মাসে কী হলাে সে সম্পর্কে নিশ্চয়ই আলােচনা করব। আলােচনা করব—এই মুক্তিযুদ্ধের যারা তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে নয় ; আমাদের আলােচনার দৃষ্টিভঙ্গি হবে সৈনিকের দৃষ্টিভঙ্গি, যে সৈনিক একটা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার পর নিজের তাবুতে ফিরে যুদ্ধের পর্যালােচনা করে ভবিষ্যতে আরও নিখুঁত কায়দায় যুদ্ধ করার জন্য।
২৫ মার্চ গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বাঙলাদেশ সম্পর্কে বেশির ভাগ খবরের উৎস ছিল শুধু গুজব আর রটনা। ছু সাংবাদিক নিজেদের জীবন বিপন্ন করে ভেতরে ঢুকেছিলেন এবং বিভিন্ন অঞ্চল সম্পর্কে কিছু কিছু সঠিক তথ্যও পাঠিয়েছিলেন। ঢাকা এবং অন্যান্য অঞ্চল থেকে কিছু কিছু মানুষ প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণও দিয়েছিলেন। কিন্তু বাঙলাদেশের সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কে মােটামুটি একটা ধারণা পাওয়া গেল যে পাঁচজন বিদেশি সাংবাদিক বাঙলাদেশ ঘুরে এলেন তাদের রিপাের্টে। অ্যাসােসিয়েটেডের প্রেসের প্রতিনিধি মর্ট রােসেন ব্লুম যে বিবরণ পঠিয়েছেন তাতে জানা যায় ‘সৈন্যবাহিনী যখন নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা পেল তখন তারা শহরের উপর গােলবর্ষণ শুরু করল। এবং সচল কিছু দেখলেই তার প্রতি গুলিবর্ষণ করতে লাগল। যেসব প্রমাণ পাওয়া গেছে তাতে বােঝা যায় যে, নাইজেরিয়ার গৃহযুদ্ধেও এইরকম পৈশাচিকতা দেখা যায়নি। বাংলাদেশ ৫ মে শেষ শহরটি হারায়। ঐদিন কক্সবাজার দখলের জন্য পাকিস্তানি সৈন্যরা সমুদ্রপথে এবং স্থলপথে ‘অবতরণ করে। গত ১১ এপ্রিল তারিখে এই শহরটি পুনরধিকৃত হয়েছিল। তারা বাড়িঘর উড়িয়ে দেয় এবং বাঙালিদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে বলে। বাঙালিরা বেরিয়ে এলে তাদের মেশিনগানের গুলিতে হত্যা করে।
‘আগে সাইকেলের জন্য ঢাকার মতাে শহরগুলােতে মােটর চলাচল করতে পারত না। কিন্তু এখন রাস্ত গুলাে প্রায় শূন্যতা ছাড়া বুলডােজার ও ট্যাংক চলাচলের ফলে রাস্তা আরও চওড়া হয়ে পড়েছে সেই আরও চওড়া রাস্তাগুলােতে এখন বাইসাইকেল মােটরগাড়ি তাে চলেই না, লােক চলাচলও নেই বললেই চলে।
‘কর্তৃপক্ষ ঢাকা থেকে মৈমনসিংহ পর্যন্ত প্রায় ১৪৫ কিলােমিটার পথ বরাবর সমস্ত বাড়ি ধ্বংস করে ফেলার নির্দেশ দেন, এর ফলে ত্রিশ হাজার পরিবার নিরাশ্রয় হয়ে পড়ে।
‘গণ-সমাধিকালে শবদেহ গণনা থেকে সে যুক্তিসম্মত হিসাব পাওয়া যায় তাতে শুধু ঢাকাতেই প্রথম কয়েক রাত্র প্রায় ১০ হাজার লােককে গুলিতে অথবা পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে।’
পূর্ব বাঙলার বর্তমান অবস্থা বােঝার পক্ষে রিপাের্টের এই অংশবিশেষই যথেষ্ট। এর পর বাঙলাদেশের যুদ্ধ কোন রূপ নেবে সে সম্পর্কে গবেষণা করে লাভ নেই।
ভবিষ্যতের কথা ভবিষ্যৎ বলবে। কিন্তু বর্তমানে যে দুমাস মুক্তিযুদ্ধ হলাে এই দুমাস যুদ্ধের কতকগুলাে ত্রুটির কথা না ভেবে পারা যাচ্ছে না।
২৫ মার্চের আগের কোনাে কোনাে ঘটনা যেমন ইয়াহিয়ার সঙ্গে এগারদিন আলােচনার সময় কেন সামান্যতম প্রতিরােধের সংগঠন গড়ে তােলা হলাে না—এইসব প্রশ্ন এখন তুলে লাভ নেই। ভুল যা হয়েছে তাতে দায়িত্ব সব দলেরই কিছু না কিছু থেকে যায়। কিন্তু ২৫ মার্চের দরেও সে ভুলের বারবার পুনরাবৃত্তি ঘটছে কেন?
ধরা যাক, মুজিবর রহমানের গ্রেপ্তারের কথা। মুজিবর রহমান যে গ্রেপ্তার হয়েছেন একথা কি আওয়ামী । লীগের নেতৃত্ব জানতেন না? যদি না জানতেন তাে সে কথা তারা সরলভাবে সব মানুষের কাছে বললেন না কেন? ২৫ মার্চ গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে, ১৮ এপ্রিল অর্থাৎ প্রায় ২৬ দিন পরে মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে মুজিবনগরে অস্থায়ী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হলাে। সেখানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রতি নজরুল ইসলাম বললেন, ‘শেখ মুজিব আমদের মধ্যেই আছেন, বিশেষ কোন কারণে তিনি সরকারের কাজ প্রত্যক্ষভাবে করতে পারছেন না। সময়মত তিনি সরকারের দায়িত্ব নেবেন।’ ঐ ঘােষণার কয়েক মিনিট পর প্রধানমন্ত্রী শ্রী তাজুদ্দিন আমেদ বলেন, আমরা যা কিছু করছি সবই তাঁর নির্দেশে। তবে তিনি এখন কোথায় আছেন তা বলব না।
(আনন্দবাজার পত্রিকা)
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মতাে দয়িত্বশীল ব্যক্তিরা কেন এ কথা বললেন? মুজিব গ্রেপ্তার হয়েছেন, অথবা তার কোন সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না বললে কি মানুষের যুদ্ধের মনােবল ভেঙে যাবে ভেবেছিলেন তারা?
মানুষের সংগ্রামী চেতনার ওপর এতখানি অনাস্থা নিয়ে কোন দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ চালানাে যায় কি?
দ্বিতীয়ত, মুজিব যে গ্রেপ্তার হয়েছেন এ কথা ঢাকা ও করাচির বৈদেশিক রাষ্ট্রের দূতাবাসগুলাের পক্ষে না জানার কোন কারণ ছিল না। তবু অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি যখন বলেন মুজিব আমাদের মধ্যেই আছেন তখন ঐ সমস্ত বিদেশি রাষ্ট্র যাদের কাছে স্বীকৃতি আদায়ের জন্য অস্থায়ী সরকার চেষ্টা করছেন তাদের চোখে এই নেতৃবৃন্দের গুরুত্ব ও সম্মান অনেক লঘু হয়ে যায়। | এরপর আসে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন ও স্বাধীনতা ঘােষণার প্রশ্ন। এই সরকার গঠন সম্পর্কে প্রাভদায় যে মন্তব্য করা হয়েছে তাতে বলা হয়েছে hastily organized। Hastily শব্দের অর্থ দ্রুততার সঙ্গে ও হঠকারিতা সহকারে দুরকমই হতে পারে। প্রভদা যে অর্থেই এটা ব্যবহার করুক, যে মৌলিক প্রশ্নটা থেকে যায় সেটা এই যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ সংখ্যালঘিষ্ঠ অংশের কাছ থেকে স্বাধীন হবে কি?
পাকিস্তান যখন সৃষ্টি হয় তখনই পূর্বপাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল শতকরা ৫৪’র মতাে। তারপর এ জনসংখ্যা আরও বেড়েছে। সম্প্রতি যে নির্বাচন হয়ে গেল তাতে পূর্বপাকিস্তানের সদস্যরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। তারা কার কাছ থেকে স্বাধীন হবেন? তাঁরাই তাে সমগ্র পাকিস্তান রাষ্ট্রের হয়ে কথা বলার অধিকারী। টিক্কা খান, আজম খান—এরা সামরিক কর্মচারি। সরকারের চাকর। সরকার তাে এক নােটিশে এদের তাড়িয়ে দিয়ে অপরাধের জন্য বিচার করতে পারে। সাম্রাজ্যবাদের সামরিক চক্রের অধীন পাকিস্তানের বদলে স্বাধীন গণতান্ত্রিক পাকিস্তান, শুধু বাঙলদেশ নয় সমগ্র পাকিস্তানে সিন্ধু, বেলুচি প্রভৃতি প্রতিটি জাতির পূর্ণ মুক্তি, সামরিক শাসনের বদলে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার, অর্থনৈতিক শােষণের বদলে সাম্য রাজনৈতিক প্রশ্ন এইভাবে তুললে তার একটা মানে হয় ; আর পাকিস্তান ভেঙে, দু টুকরাে হয়ে যাবে তার মানে আর একরকম হয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও এর প্রতিক্রিয়া দু রকম হয়, গণ—সমর্থনের ক্ষেত্রেও নানা ধরনের তফাত ঘটে।
সংখ্যালঘিষ্ঠের কাছে থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ স্বাধীনতা চাইছে এটা বােধহয় পৃথিবীতে এই প্রথম ঘটল। সােভিয়েত রাশিয়ার গঠনতন্ত্রে সংখ্যালঘু জাতিগুলাের নানা বিশেষ অধিকার আছে, বিভিন্ন ছােট রাষ্ট্রগুলাের বিচ্ছিন্ন হবার দাবিও স্বীকৃত। পৃথিবীর আরও অনেক দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠের চাপ বা অত্যাচার থেকে সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষার প্রশ্ন | বাঙলাদেশ সরকার শুধুমাত্র নিজেদের স্বাধীনতা ঘােষণা করে এর বিপরীত কাজ করলেন না কি? | তারপর, যে সরকার গঠন করা হলাে, সে সরকারে সব দলের প্রতিনিধিদের নেওয়া হয়নি ; আজও নেওয়া হচ্ছে না কেন? এ কথা আজ সর্বজনস্বীকৃত যে ভাসানীপন্থীরা, মস্কোপন্থী কমিউনিস্টরা এই যুদ্ধে প্রাণ দিয়ে লড়ছে। তাদের এখনও সরকার থেকে বাদ দিয়ে রাখা হয়েছে কেন?
বাঙলাদেশের যুদ্ধের বর্তমান পর্যায়ে পৌছাবার পেছনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলাে ই পি আর, আনসার প্রভৃতি সশস্ত্র সংগঠনের বিদ্রোহ। যে কোন দেশে সৈন্যবাহিনীতে ভাঙন বিপ্লবী পরিস্থিতির বিচারের একটা মাপকাঠি। সেই দিক থেকে বাঙলাদেশের পরিস্থিতি অনুকূল। কিন্তু সরকারে এদেরও প্রতিনিধি নেওয়া হচ্ছে না কেন?
কেন বর্তমান নেতৃত্ব ভিয়েতনামের মতাে একটি জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠন করছেন না?
এরপর যুদ্ধের অবস্থা। প্রাভদা এই যুদ্ধ সম্পর্কে বলেছে scattered resistance। অর্থাৎ ইতস্তত বিক্ষিপ্ত প্রতিরােধ। এই ইতস্তত বিক্ষিপ্ত প্রতিরােধকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে হবে। এ ছাড়াও আরও একটি প্রশ্ন, শহরগুলাে দখল করার জন্য এত শক্তি ক্ষয় করা হচ্ছে কেন? শহরগুলাে দখল হয় মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে। চীনে সাংহাই, ক্যান্টন, পিকিঙের পতন হয়েছিল একেবারে শেষে। ভিয়েতনামে সায়গন এখনও দখল করার কোনাে চেষ্টা করা হয়নি। অথচ বাঙলাদেশের যুদ্ধ-পরিচালকরা বার বার শহর দখলের চেষ্টা করছেন, এবং শহরগুলােকে একটা ‘প্রেসটিজ ইস্যু করে তুলছেন। এটা কি ঠিক? অতীতে যাই হােক, এখনও কি গ্রামভিত্তিক সশস্ত্র সংগঠন গড়ার সময় আসেনি? গেরিলা যুদ্ধ করতে হলে তার মুল নীতিগুলাে তাে নিশ্চয়ই মানতে হবে।
সঠিক রাজনীতি ও সমরকৌশল প্রয়ােগ করার বদলে ব্রিটেন, আমেরিকা আর জাতিসঙ্ঘে ছুটোছুটি করে স্বাধীন বাঙলাদেশ সরকার কী লাভ করবেন?
ভিয়েতনামের কথা বাদ দিলাম, কঙ্গোর ঘটনা, লুমুম্বার কথা কি তারা বিস্মৃত হয়েছেন?
কতকগুলাে জরুরি রাজনৈতিক ও সামরিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সঠিক সময় এসেছে বাংলাদেশ সরকারের সামনে। এগুলাে না করে তার যত বেশি ব্রিটেন, আমেরিকা আর জাতিসংঘ ঘুরে মরবেন তত বেশি পৃথিবীর বিপ্লবী জনগণের চোখে তাদের সংগ্রামী ইমেজ কমে যাবে।
বাঙলাদেশে দখলদার পাকিসৈন্যের মনােবল বলে কিছুই নেই। সর্বশেষ রিপাের্টে দেখা যায় তারা সকালে দল বেঁধে বেরিয়ে শহরের কাছাকাছি অঞ্চলগুলােতে হামলা চালিয়ে বিকেলের আগেই প্রাণভয়ে ফিরে আসছে এধারে বাঙলাদেশের মানুষের মনােবল রয়েছে অটুট। এই অবস্থায় সঠিক রাজনৈতিক নেতৃত্বই এই যুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। জনগণের শত্রুদের প্রধান বল অস্ত্র । কিন্তু বিপ্লবী জনগণের প্রধান হাতিয়ার রাজনীতি। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক রাজনীতির প্রয়ােগই বাঙলাদেশের যুদ্ধকে জয়ের পথে নিয়ে যাবে।
সূত্র: সপ্তাহ, ২৮ মে ১৯৭১