You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২৮শে ডিসেম্বর, শনিবার, ১২ই পৌষ, ১৩৮১

এই অপরাধের শাস্তি কি!

ঈদুল আযহার পবিত্র নামাজ অনুষ্ঠানকে কলঙ্কিত করেছে দুষ্কৃতিকারীরা। কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে মরহুম জনাব গোলাম কিবরিয়া এম,পি যখন জামাতে ঈদের নামাজ আদায় করছিলেন সেই পরম পবিত্র দুষ্কৃতিকারীদের গুলিতে তৎক্ষণাৎ তিনি ওই স্থানেই স্থানে মৃত্যুবরণ করেন (ইন্নালিল্লাহি…. রাজিউন)। সেইসঙ্গে আরো একজন গুলিতে আহত হন। এবং এই আকস্মিক আক্রমণের ফলে জামাতে একত্রিত নিরীহ ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের মধ্যে ভীতি ও ত্রাসের সঞ্চার হয়। ফলে ঈদের নামাজ আদায়ে বিঘ্ন ঘটে। ঈদুল আযহার পবিত্র নামাজে অনুষ্ঠানে সংঘটিত নৃশংস হত্যাকান্ডকে আমরা চূড়ান্তভাবে অধর্ম এবং ভয়াবহ পাপের কাজ বলে মনে করি। কারণ ধর্মীয় জীবনের শ্রেষ্ঠ পবিত্র সময় হলে উপাসনার ক্ষণ। যখন অনন্ত-অসীম, চিন্ময় পরম স্রষ্টার উদ্দেশ্য মানুষ ভক্তিনত চিত্তে আপনাকে নিবেদন করে, ক্ষোভ-দুঃখ, লাভ লোকসান হিসাব এর উর্দ্ধে থাকে মানুষের বিনয়াপ্লুত অন্তর। তাই আত্মনিবেদনের আবেগের মুহূর্তে পরম সৃষ্টিকর্তার প্রতি আনুগত্যের ভাবময় অসতর্ক ক্ষণে জিজ্ঞাংসা চালিত হত্যাকান্ডের ধৃষ্টতা সব ধর্মের বিধানেও অমার্জনীয় অপরাধ। খুলাফায়ে রাশেদীনের সাইমন পবিত্র শাসনামলে রসূলাল্লাহ প্রিয় সাহাবা হযরত ওমর (রাঃ) হযরত উসমান (রাঃ) হযরত আলী (রাঃ) নামাজ আদায় কিংবা পবিত্র কুরআন পাঠের সময় শহীদ হন। সেই-সে থেকে মুসলিম সম্প্রদায় দল-মত, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে আরাধনার সময় নিমগ্ন তাপসীকে হত্যার কার্যটিকে ঘৃণিত অপরাধ বলে গণ্য করে আসছে। প্রার্থনার পুতপবিত্র লগ্নে প্রাণ হত্যা অন্যান্য ধর্মেও সমভাবে ধিক্কৃত হয়েছে। তাছাড়া প্রত্যেক ধর্মেই উৎসব অনুষ্ঠানের পবিত্র দিনটিতে বড় শ্রদ্ধা ও সম্মানের সঙ্গে উদযাপন করা হয়ে থাকে। এ হলো সভ্যতার ধর্ম প্রবণতা, মানবতা ও শালীন, সহিষ্ণুতার পরিচায়ক। তাই আমরা দেখেছি ভিয়েতনামে পবিত্র বড়দিন উৎসব উপলক্ষে যুদ্ধবিরতি মানা হত। একটি দিনের জন্য বিসর্জন দেয়া হতো যুদ্ধ জড়িত অস্ত্রের ঝনঝনানি এবং মনের সকল কালিমাকে বিশ্বস্রষ্টার পায় নিবেদন করে আত্মাকে কলুষমুক্ত করার একটা পরিবেশ সৃষ্টি করার প্রয়াস পাওয়া হত। ইহুদীরা ও সম্মত হয়েছে অস্ত্রের ঝনঝনানি বন্ধ রাখতে। অথচ ঈদুল আযহার মত পবিত্র ও তাদের আদর্শ শিক্ষা নামাজ অনুষ্ঠানে সংঘটিত হলো নিছক রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক জঘন্য হত্যাকান্ড। যার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
তাই প্রশ্ন জাগে এদেশে ধর্মের নামে ত্যাগ ও কর্ম ব্রতের আদর্শকে পেছনে ফেলে যারা কোথায় একটা কবিতা লেখা হলো একটা বই প্রকাশিত হল, তা নিয়ে তুমুল তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে রাজধানী সরগরম করতে তৎপর হন-তারা আজ নীরব কেন? যারা ধর্মকে রাজনীতির পোশাক পরিয়ে সাধারন মানুষকে বিভ্রান্ত করতে যথেচ্ছ আচরণ প্রকাশ করে থাকেন, দাড়িতে হাত বুলিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে খোদার নামে স্বার্থসিদ্ধির উপায় খোঁজেন এবং রাজ্যের সকল দুর্নীতির সঙ্গে মূলগত ময়দানে ঘন্টার পর ঘন্টা চিৎকার করেন-এত বড় অমানবিক, অধার্মিক ও পাপের ঘটনায় তারা কিছু বক্তব্য অন্ততঃ রাখুন। নীতি বা আইন অথবা ধর্ম যে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে এই আচরণকে নিন্দিত করুন!
শুধু এই নয়, সারা দেশে আজ গুপ্তহত্যা ও স্বার্থপ্ররোচিত হত্যাকান্ড চলছে এই সঙ্গে তারও অবসান চাই আমরা। একথা অবধারিত যে, সভ্য জাতিকে আইন মেনে চলতেই হবে। এবং জাতি ধর্ম নির্বিশেষে জন্য যেহেতু আইনেই সভ্য জাতির প্রধান রক্ষক, তাই আমরা আজ চাই আইনের নিরাপত্তা। চাই গুপ্ত হত্যা, বোমাবাজি ও সকল নাশকতামূলক কাজের নির্মম উৎখাত। কারণ ওরা যথার্থই দেশ, সমাজ ও জাতির চিরশত্রু। মানবতার কলঙ্ক। পরিশেষে মরহুমের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে তার বিষাদগ্রস্থ আত্মীয়-পরিজনদের আমরা জানাই গভীর সমবেদনা।

ভোগ্য পণ্য সরবরাহ সংস্থা

ভোগ্য পণ্য সরবরাহ সংস্থাকে নতুন করে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। বাণিজ্য বিষয়ক ও বহির্বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী দেওয়ান ফরিদ গাজী এক সাক্ষাৎকারে এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি স্বীকার করেছেন, সংস্থা তার লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি।
ভোগ্য পণ্য সরবরাহ সংস্থার জন্মের পর থেকে সংস্থাটিকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কম হয়নি। জনসাধারণের মধ্যে আমদানিকৃত ও দেশে উৎপাদিত পণ্য বণ্টনের সুষ্ঠু ব্যবস্থা করা বিষয়ে সংস্থা দুঃখজনকভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। শুধু তাই নয়, সীমাহীন দুর্নীতি, অব্যবস্থা ও অপরিণামদর্শিতার জন্য ’৭২-৭৩ সালে সংস্থা গচ্চা দিয়েছে ৩ কোটি ৪০ লক্ষ ৯৯ হাজার টাকা। সংস্থার মাসিক এস্টাব্লিশমেন্ট খরচ হলো ৫০ লক্ষ টাকা এবং এর মধ্যে পরিবহন খরচ হচ্ছে ১৩ লক্ষ টাকা। পর্যাপ্ত মালের অভাব আর্থিক সংকট ও এক শ্রেণীর কর্মচারীদের অভাবনীয় দুর্নীতির ফলে গত ১৫ই সেপ্টেম্বর ভোগ্য পণ্য সরবরাহ সংস্থা নোটিশ জারি করে মফস্বল এলাকায় ১৫ হাজার কর্মচারী ছাঁটাই করেছে এবং সাড়ে ৪ হাজারের মধ্যে পৌনে চার হাজার দোকান বন্ধ করে দিয়েছে। ভোগ্য পণ্য সরবরাহ সংস্থাগত সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ৪০ কোটি টাকার মালামাল জনসাধারণের কাছে বিক্রি করেছে এবং শুধু ইউনিয়ন পর্যায়ে বেতন দিয়েছে সাত কোটি ৬৪ লাখ টাকা।
একটি মহৎ ও জনকল্যাণমূলক সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা কিভাবে ভেস্তে যেতে পারে ভোগ্য পণ্য সরবরাহ সংস্থাটিই হলো তার জ্বলন্ত প্রমাণ। অথচ এই সংস্থা দ্রব্যমূল্যের আকাশচুম্বী গতির আঘাতে সংকটাপন্ন জনসাধারণের সেবা করতে পারত। ‘সাহস করে চাইলেই’ পাওয়া যায় বলে যেসব অসাধু ব্যবসায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধিতে ইন্ধন যোগাচ্ছে তাদের কণ্ঠ স্তব্ধ করে দিতে সক্ষম হতো। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। হয়নি বলেই ভোগ্য পণ্য সরবরাহ সংস্থার নাম শুনলে সাধারন মানুষ আঁতকে ওঠে। একথা তো দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, বাংলাদেশে আজ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলছে। চাল, ডাল, তেল, নুন থেকে আরম্ভ করে শিশুখাদ্যের মূল্য পর্যন্ত অসাধু ব্যবসায়ীদের অদৃশ্য হস্তের ইঙ্গিতে ওঠানামা করে। এমতাবস্থায় আজকের দিনে রেশনিং ব্যবস্থা ও ন্যায্যমূলে জিনিসপত্র সরবরাহের উপরে নির্ভর করছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা। ভোগ্য পণ্যের সরবরাহ সংস্থা ইচ্ছে করলে জনসাধারণের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করতে পারে। সে ইচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নেই এমন শেষ কথা আমরা বলবো না। তার সংস্থাটিকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর সিদ্ধান্তকে কার্যকরী করার পূর্বাহ্নে আমরা বলবো মেহেরবানী করে এমন একটা কিছু করুন যাতে ভোগ্যপণ্য সরবরাহ সংস্থার নামের জনসাধারণ আতঙ্কগ্রস্থ না হয়ে সংস্থার প্রতি আস্থাশীল হয়ে উঠে।

বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের চেক সাহায্য

চেকোস্লোভাকিয়া বাংলাদেশকে ১১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সাহায্য করবে-এই মর্মে বাংলাদেশ চেকোস্লোভাকিয়া মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র টি খুলনায় স্থাপন করা হবে এবং এটি হবে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বিদ্যুৎ জেনারেটর। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে গ্যাস ব্যবহারের ব্যবস্থা রাখা হলেও ফার্নেস অয়েল ব্যবহৃত হবে। আগামী বছরের প্রথম দিকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নকশা তৈরির কাজ শুরু হবে এবং ১৯৮০ সালের প্রথমদিকে এর নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হবে। দেশের পশ্চিমাঞ্চলে বিদ্যুৎ ঘাটতি রয়েছে। সন্দেহ নেই, এই প্রকল্পটির বাস্তবায়ন সাধিত হলে দেশের পশ্চিমাঞ্চলে বিদ্যুৎ ঘাটতি অনায়াসেই অতিক্রম করা সম্ভব হবে। চেকোস্লোভাকিয়া এর আগেও দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে বাংলাদেশকে সাহায্য করেছে। গোয়ালপাড়ার ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র ইতিমধ্যে চালু হয়েছে, চট্টগ্রামের শিকল বাহারের বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণাধীন রয়েছে। নির্মিতব্য দেশের বৃহত্তম বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির সরবরাহকৃত বিদ্যুৎ বাংলাদেশের শিল্প ও কৃষি কাজের ক্ষেত্রে খুবই প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করবে। স্বাধীনতার পর আমরা বারবার বিদ্যুৎ সংকটের কবলে পড়ে নাকানি-চুবানি খেয়েছি। আমাদের কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। এবং স্বাভাবিক নিয়মেই আমরা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে স্বনির্ভর হয়ে উঠতে পারিনি। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থাকে সুগম এবং সুষ্ঠ করার জন্য চেকোস্লোভাকিয়ার সাহায্য অব্যাহত রয়েছে এটা খুবই আনন্দের সংবাদ। বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মে চেক সহযোগিতাকে তাই আমাদের পুরোপুরিভাবে কাজে লাগাতে হবে। নির্মিতব্য এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এতে ফার্নেস অয়েল ব্যবহার করার ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে গ্যাস ব্যবহারেরও ব্যবস্থা থাকবে। আমরা অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে দেখেছি যে, ফার্নেস তেলের অভাবে প্রায় গোয়ালপাড়ার বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু গ্যাস ব্যবহারের ব্যবস্থা থাকাতেই নির্মিতব্য বিদ্যুৎকেন্দ্রটি যেকোনো সময় বন্ধ হয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাবে। তাছাড়া, এই কেন্দ্রটি থেকে দেশের উত্তরাঞ্চলে ও গ্যাস লাইন সম্প্রসারিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কাজেই নির্মিতব্য বিদ্যুৎকেন্দ্রটি দেশের উৎপাদন ব্যবস্থায় একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। গ্যাস লাইন সম্প্রসারণের ব্যবস্থা যদি চূড়ান্ত হয়, তাহলে জ্বালানি সংকটের হাত থেকে পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ যেমন তেমনি উত্তর অঞ্চলের মানুষ ও অব্যাহতি পাবে। এছাড়া, শিল্প এবং কৃষি কাজের ব্যাপারে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি অতীব প্রয়োজনীয় বলে গণ্য হবে। অতএব দেশের বৃহত্তম বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বাংলাদেশ ও চেকোস্লোভাকিয়ার মধ্যে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তাতে আমরা আশার আলোই দেখতে পাচ্ছি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!