You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.09.02 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | মৌসুমী চুরি! | পরলোকে নরম্যান কার্ক | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: ২রা সেপ্টেম্বর, সোমবার, ১৬ই ভাদ্র, ১৩৮১

মৌসুমী চুরি!

সোনা-রূপা নয়–এবার ধান-চাল, কাপড়-চোপড় ইত্যাদি চুরি যাচ্ছে। দুর্বৃত্তদের নজর এখন গম ভর্তি গুদাম বা ওয়াগনের দিকে এবং মাঠের সোনালী শস্যের দিকে। এমনকি জলপথে খাদ্যশস্য বোঝাই জাহাজ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরবরাহ উদ্দেশ্যে পাঠানোও বিপদজনক কাজ হয়ে পড়েছে। ফলের রিলিফের কাজ বা দেশের প্রতিটি অঞ্চলে খাদ্যশস্য সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে এবং এতে আঞ্চলিক বাসিন্দা শহর জনসাধারণের মধ্যে আতঙ্ক ও দুশ্চিন্তা বাড়ছে।
গতকালকের ‘বাংলার বাণী’র পত্রিকার প্রথম পাতায় ট্রেনের ওয়াগন বোঝাই গম লুটের সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে। খুলনা ৪ নং গেট থেকে ১৪টি ওয়াগন সহ একটি ট্রেন খুলনা জংশনে আসার পথে দুর্বৃত্তরা পেছনের ওয়াগনটি কেটে রাখে। পরে তারা ওয়াগনটি ৫ নং ঘাটে নিয়ে আসে। এরমধ্যে ২১০ ব্যাগ গম ছিল। দুর্বৃত্তরা ওয়াগনের দরজা ভেঙে অতঃপর গম গুলো পাচার করতে থাকে। স্থানীয় লোকজনের সচেতন তৎপরতায় পরে অবশ্য ঘটনা অন্য দিকে মোড় নেয়।
প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, রেল ওয়াগন ভেঙ্গে চুরি বা পানি পথে চুরির দৃষ্টান্ত এমন একটি দুটি নয়। ১লা সেপ্টেম্বর ‘বাংলার বাণী’রই অপর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, বিদেশ থেকে যেসব খাদ্যশস্য আমদানি করা হয় তার শতকরা ৬০ থেকে ৭০ ভাগ রেলপথে এবং ৩০ থেকে ৪০ ভাগ নৌপথে পরিবহন করা হয়। এই উভয় প্রকার পরিবহনের সময় যে বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য চুরি যাচ্ছে তার সংশ্লিষ্ট সবাই প্রায় স্বীকার করছেন।
অপরদিকে মফস্বল শহর থেকেও দুর্বৃত্তদের ধান চাল চুরির খবর পাওয়া যাচ্ছে। পত্রিকান্তরে প্রতিবেদনে প্রকাশ বানিয়াচঙ্গ থানার রূপসাপুর গ্রামের একটি বাড়িতে ডাকাত হানা দিয়ে ১৫/১৬ মণ ধান সহ প্রায় ৫ হজার টাকার অন্যান্য মালামাল লুট করে। ঐ প্রতিবেদনের প্রকাশিত তথ্যে আরও আছে মানিকগঞ্জে ও ভেড়ামারায় চোর ডাকাতের উপদ্রব অত্যন্ত বেড়েছে। ঘর-গেরস্থালির জিনিসপত্র, কাপড়-চোপড় সহ ধান-চাল লুট হয়ে যাচ্ছে। দৌলতপুর থানায় গ্রামাঞ্চল থেকে আধা পাকা ধান প্রতিরাতেই চুরি যাচ্ছে। কৃষকরা রাত জেগে পাহারা দেয়ার সাহস পাচ্ছে না।
এসব ঘটনার বিবরণ দেখে মনে হয় এদের মধ্যে অভাবী চোরও কিছু আছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, বেকারত্ব, খাদ্যশস্যের ঊর্ধ্ব মূল্য, নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদির রকেট দৌড় এসব কিছুই সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড একবারে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু যতক্ষণ দেহে প্রাণ আছে ততক্ষণ আছে ক্ষুধা-তৃষ্ণাও। উপায় বিহীন হয়ে তারা সোনা-দানা নয়, হীরে-জহরৎ নয়-চাল, গম আটা চুরি করছে। নিঃসন্দেহে এমন চুরিও খারাপ কাজ। কারণ এর ফলে দেশের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চূড়ান্ত অবনতি ঘটছে এবং জনজীবনে বিশৃঙ্খলা দেখা দিচ্ছে। প্রশাসনযন্ত্রের জন্য তা নিশ্চয়ই শুভ নয়।
আমরা দেখেছি ২৫শে এপ্রিল যৌথ অভিযান শুরু হলে দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, ব্যাংক লুট একাকার কাজকর্ম বেশ নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল। তারই মধ্যে এল সর্বনাশী বন্যা। জরুরি অবস্থার ভিত্তিতে বন্যার্তদের সাহায্যের এগিয়ে আসতে হল সেনাবাহিনীকে। এই সুযোগ নিতে দুর্বৃত্তরা ছাড়লোনা। নখদন্ত গুটানো হিংস্র স্বাপদসম দুর্বৃত্তরা বেরিয়ে এল খোলা ময়দানে। আত্মমানবতার অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার পটভূমিতে দাঁড়িয়ে তারা আবার চুরি-ডাকাতি ইত্যকার ঘৃণা কাজে করল আত্মনিয়োগ এবং এখন দেশে রিলিফের কাজ চলছে। প্রচুর খাদ্যশস্য এখান থেকে সেখানে আনা নেয়া হচ্ছে। তারা করছে এই সুযোগের সদ্ব্যবহার। সোনাদানা যে তারা আসক্ত নয়-একথা ভুল। এ হল মৌসুমী চুরি। প্রশাসন কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের দাবি সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি বিধান করা হোক।

পরলোকে নরম্যান কার্ক

জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা কবে? এই চিরন্তন সত্য নিয়মের পথ ধরে আর দশজনের মতো নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর নরম্যান কার্ক পরলোকে পাড়ি জমিয়েছেন। পেছনে পড়ে রইল রাশিকৃত স্মৃতিমালা আর কর্মমুখর দিনগুলি। শুধু আমরা নই, তার স্বদেশবাসীও কালের নিয়মে একদিন তাকে ভুলে যাবে। কিন্তু তবুও আমরা দুঃখিতও ব্যাথা ভরা মন নিয়ে কার্কের মৃত্যুর খবর শুনেছি। এই সেই নরম্যান কার্ক-একাত্তরের গণহত্যার সময় যার সোচ্চারিত আর উচ্চকিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিলাম আমরা পিঞ্জরাবদ্ধ বাঙালি জাতি। যার কণ্ঠে যুগপৎভাবে ধ্বনিত হয়েছিল বাঙালি জাতির জন্য দরদ ভরা অভয়বাণী আর পাক নির্যাতনের বিরুদ্ধে ধিক্কার। বাংলাদেশের সেই মহান বন্ধু মাত্র একান্ন বৎসরের অপরিণত বয়সে চলে গেলেন। আমাদের জন্য এ এক অপূরণীয় ক্ষতি।
আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম চলাকালে নিউজিল্যান্ড পার্লামেন্টের বিরোধী দলীয় নেতা হিসাবে আমাদের প্রতি তার সমর্থন এবং স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্নমুখী সংকটের ক্রান্তিলগ্নে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমাদের জাতীয় অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তার অব্যাহত সমর্থন দানের কথা কোনোভাবেই বিস্মৃত হবার নয়। এবং বিস্মৃত হবার নয় বলেই বাংলাদেশ পরম বন্ধু নরম্যান কার্কের অকাল মৃত্যুতে আমরা শোকাভিভূত ও মুহামান। বিরোধীদলীয় নেতা এবং পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আমাদের সদ্য স্বাধীন দেশটির প্রতি তার সর্বতোভাবে সমর্থন ও সাহায্যদান ছিল অসীম গুরুত্বপূর্ণ। সামান্য সূত্রধরের ঘরে জন্ম নিয়ে ইঞ্জিন ড্রাইভার হিসেবে যার কর্মজীবনের শুরু, পরবর্তীকালে দেশের সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ, পার্লামেন্টে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ এই সুকঠিন আত্মদর্শনের সুযোগ পৃথিবীর খুব অল্পসংখ্যক জননেতার ভাগ্যে জুটেছে এবং এ কারণেই বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে সঞ্জীবিত নরম্যান কার্ক প্রথমাবধি ছিলেন শান্তির পূজারী। ভারত মহাসাগরের কোলঘেঁষা দ্বীপ মালার জননায়ক নরম্যান কার্ক শুধু মরুভূমিতে নয়, বৃহৎ শক্তি লীলাক্ষেত্র ভারত মহাসাগরীয় উত্তেজনা মুক্ত রাখতে চেয়েছেন।
কালের নিষ্ঠুর নিয়মেই নরম্যান কার্ক পরপারে চলে গেছেন। কিন্তু তার স্মৃতি তার কর্ম প্রেরণা, নির্যাতিতের প্রতি তার সংবেদনশীল হৃদয়ের আকুতি সবই আজ আমাদের স্মৃতিতে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মত ভাস্বর। নিউজিল্যান্ডের শোকাভিভূত জনগণের সাথে আজ আমরা সমব্যথী। তাঁর প্রদর্শিত পথে তার আদর্শকে সমুন্নত রেখে সেদেশের নয়া প্রধানমন্ত্রী নিউজিল্যান্ডকে সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
কার্ক পন্থী ও তার শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আমরাও সমবেদনা জানাচ্ছি এবং স্রষ্টার উদ্দেশ্য প্রার্থনা রাখছি নরম্যান কার্ককের অমরআত্মা যেন শান্তি লাভ করে।
লোকান্তরিত নরম্যান কার্কের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি- ‘তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ।’

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন