You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
১৬ই আগস্ট, বৃহস্পতিবার, ১৯৭৩, ৩১শে শ্রাবণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

শিল্প ব্যবস্থাপনায় নয়া প্রশাসন কর্মী

সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের জন্যে প্রয়োজন সমাজবাদী কারিগর। আর এই কারিগর শিক্ষালাভ করে সমাজতন্ত্রের মূল দর্শন এবং সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে। বলশেভিক বিপ্লবের পর রাশিয়ার জনসাধারণকে সমাজতন্ত্র বিনির্মাণে যে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিলো আজ ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকা এবং এশিয়ার এতোগুলো দেশে সমাজতন্ত্রের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সে সমস্যাগুলোর অনেকটা অবসান হয়েছে। পরস্পরের অভিজ্ঞতা, সফলতা এবং ব্যর্থতাকে কাজে লাগিয়ে প্রগতিশীল রাষ্ট্রসমূহ স্তরানুক্রমে সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের সোপান একের পর এক অতিক্রম করতে পারেন। স্বাধীনতাত্তোর কালে বাংলাদেশে যখন রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে সমাজতান্ত্রিক বিকাশের কথা ঘোষণা করা হয় তখন থেকেই সে নীতি বাস্তবায়নে সমাজবাদী কর্মীবাহিনী গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হতে থাকে, অনুভূত হতে থাকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের অভিজ্ঞতা এবং শিক্ষাকে কাজে লাগানোর আবশ্যকতা।
এই প্রয়োজনকে সামনে রেখেই স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে বেশ কিছু সংখ্যক স্বাধীনতা সংগ্রামী যুব কর্মীদের বাছাই করা হয়। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক চক্রান্ত এবং একশ্রেণীর আমলাতান্ত্রিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে এক সময় সেই নীতি পরিত্যক্ত হয়। শুরু হয় প্রগতি এবং প্রতিক্রিয়ার রশি টানাটানি। রাষ্ট্রায়ত্ত কল-কারখানার প্রশাসনিক পদে অধিষ্ঠিত হন এমন সব লোক যাদের অধিকাংশের বিরুদ্ধে পরবর্তীকালে অভিযোগ আসে দুর্নীতি, কল-কারখানার ক্ষতি এমনকি সরকারী নীতি বিরোধিতার। শুধু শিল্প ক্ষেত্রেই নয় রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক কর্পোরেশন থেকে প্রশাসনের সর্বক্ষেত্রে সরকারের প্রগতিশীল নীতি বাস্তবায়নের অন্তরায় সৃষ্টির নানা কৌশল অবলম্বিত হতে থাকে। আমরা বার বার এসব কৌশল এবং চক্রান্তের বিরুদ্ধে সরকারকে সতর্ক হবার আহ্বান জানিয়েছি। বলেছি নতুন সমাজবাদী কর্মী এবং পুরোন আমলাদের মধ্য থেকে দেশপ্রেমিক অংশটিকে নিয়ে নয়া প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে।
সরকার অতঃপর মুক্তিযোদ্ধা তরুণদের মধ্য থেকে প্রশাসনিক কাজে নিয়োগের জন্যে তেরোশ’ চৌদ্দজন কর্মী বাছাই করেন এবং চূড়ান্ত ফলাফল অনুযায়ী ন’শ’ জনকে প্রশাসনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। প্রাথমিক অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধা তরুণদের বাছাই করবার পর আমরা বলেছিলাম শুধু কম বয়সী এই তরুণদের পুরোন আমলাদের হাতে সোপর্দ করলেই সমাজবাদী কর্মীবাহিনী গড়ে উঠবে না, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহ থেকে বিশেষজ্ঞ আনিয়ে তাঁদের দিয়ে এই তরুণ কর্মীবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা করতে হবে। শিল্প ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে শিল্প দপ্তর আমাদের সে প্রস্তাব মেনে নিয়েছেন দেখে আমরা খুশী হয়েছি। ইতিমধ্যেই কিছু রুশ বিশেষজ্ঞ শিল্প ব্যবস্থাপনা ক্ষেত্রে আমাদের তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের সমাজতান্ত্রিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার মহান দায়িত্ব পালনে অগ্রসর হয়েছেন। গত তেরোই আগস্ট বাংলাদেশ ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন কেন্দ্রে এই প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে।
শিল্প দপ্তরের এই উদ্যোগ থেকে আমরা মনে করে নিতে পারি যে, সরকার নীতিগতভাবে নয়া প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যাপারে আমাদের সুপারিশের সঙ্গে একমত। বর্তমান শিল্প প্রশাসকদের অধিকাংশের দুর্নীতি এবং ষড়যন্ত্রের কাঁধে ভর করে সরকারের জাতীয়করণ নীতির ব্যর্থতার কথাই যারা ঢাক-ঢোল পিটিয়ে প্রচার করতে ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে উঠেছেন, প্রশিক্ষণ শেষে এই নতুন কর্মীবাহিনী বিভিন্ন শিল্পের দায়িত্বভার গ্রহণের পর সে সবের অবসান হবে বলে আমরা দৃঢ় আশা পোষণ করি। আমরা সরকারের এই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণকে আন্তরিকভাবে অভিনন্দন জানাই এবং একই সঙ্গে প্রস্তাব করি শুধু শিল্প ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেই নয় প্রশাসনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও তরুণ কর্মীদের সমাজবাদী বিশেষজ্ঞদের দ্বারা প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা করা হোক। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে সমাজতান্ত্রিক শিক্ষা অনুপস্থিত থাকার কারণেই আমাদের এ প্রস্তাব কার্যকরী করার প্রয়োজনীয়তা আমরা আরো বেশী করে অনুভব করছি।

এখনো সময় আছে—অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিন

দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষার জন্যে এক লাখ পুলিশের প্রয়োজন অথচ সারাদেশের পুলিশের সংখ্যা হচ্ছে পঁয়তাল্লিশ হাজার। বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর প্রধান সম্প্রতি এ পরিসংখ্যান দিয়েছেন। পুলিশ প্রধান এক সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, কিছু সংখ্যক ‍পুলিশের সঙ্গে দুর্বৃত্তদের যোগসাজশের জন্যেই নাকি আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। পুলিশ প্রধান অবশ্য এ কথাও ঘোষণা করেছেন যে, পুলিশ বাহিনী যে কোন মূল্যে থানা ও ফাঁড়িতে দুষ্কৃতকারীদের আক্রমণ প্রতিরোধ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। পুলিশ প্রধানের এই দৃঢ়তার কথা প্রচারিত হওয়ার পরই আবার দুষ্কৃতকারীদের অশুভ কার্যকলাপের খবর পাওয়া যাচ্ছে। এক স্থান থেকে নয়, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দুষ্কৃতকারীদের লুন্ঠন ও আক্রমণাত্মক অভিযানের খবর পাচ্ছি। খবরগুলো যে আমাদের নতুন করে শংকিত করে তুলেছে, তা না—আমরা বহু আগে থেকেই শংকাকূল দিন কাটাচ্ছি। শান্তিপ্রিয় প্রতিটি নাগরিকই আজ আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম দুর্দশা দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে রয়েছি। এমতাবস্থায় যখনই খবর পাই চট্টগ্রামে ব্যাংক ডাকাতি, লালদীঘিতে গ্রেনেড নিক্ষেপের ফলে আওয়ামী লীগ নেতা সহ ১৮ জন আহত, পাথরঘাটায় রেঞ্জার অফিসের অস্ত্র লুট, কুষ্টিয়ায় পুলিশ ফাঁড়ির উপর দৃষ্কৃতকারীদের হামলা তখনই আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির সার্বিক প্রতিচ্ছবি আমাদের চোখের আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে। আমরা ভাবতে বাধ্য হই যে, দেশটা কি তাহলে মুগের মুল্লুকে পরিণত হয়েছে? আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহেবও বহুবার দুষ্কৃতকারীদের কঠোর হস্তে দমন করা হবে বলে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন। কিন্তু তাকে কোনো ফলোদয় হয়েছে কি? বরং দিনের পর দিন যেন থানা, ফাঁড়ি আক্রমণ এবং ব্যাংক লুন্ঠনের মতো মারাত্মক অপকর্মগুলো নির্বিবাদে ঘটে চলেছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলুন আর পুলিশ প্রধানই বলুন, সবার হুঁশিয়ারী শুধু হুঁশিয়ারী হয়েই থাকছে। ঐদিকে দুষ্কৃতকারীরা তাদের আপনাপন তৎপরতা সমান গতিতে চালিয়ে যাচ্ছে। কারো কোন তোয়াক্কা করছে না। ফলে দেশের নাগরিকরা জীবনের নিরাপত্তাবোধে অভাবে আজ দিশেহারা হয়ে উঠেছেন। কোন আশ্বাসবাণীই আজ তাদের আশ্বস্ত করতে পারছে না। অপ্রতুল পুলিশ দিয়ে যে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কোন উন্নয়ন সাধন করা যাবেনা, তা আমরা ইতিপূর্বে বারংবার উল্লেখ করেছি। এবং আমরা এ-ও উল্লেখ করেছি যে, দেশের বুক থেকে যদি সমাজবিরোধী দুষ্কৃতকারীদের উচ্ছেদ করতেই হয়, তাহলে পুলিশ বাহিনীর মধ্যে যাদের দৃষ্কৃতকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। নইলে ঘরের শত্রু বিভীষণের মতো শেষ পর্যন্ত পুলিশরাই দেশের অভ্যন্তরে মারাত্মক এক গোলযোগের সৃষ্টি করবে। পুলিশ প্রধান অবশ্য বলেছেন যে, সরকার এ অবস্থা আর সহ্য করবেন না। আমরাও বলি, এ অবস্থা কিছুতেই সহনীয় নয়—এ অবস্থায় আমরা সম্পূর্ণ অবসান চাই। কিন্তু যে হারে দেশের বিভিন্নস্থানে দৃষ্কৃতকারীদের হামলা চলেছে, ব্যাংক এবং থানা লুন্ঠিত হচ্ছে, তাতে আমরা আন্দাজ করছি, দেশের অব্স্থা খুবই নাজুক। বিশেষ করে আইন-শৃঙ্খলার অবনতিই এ পরিস্থিতির জন্যে প্রধানতঃ দায়ী। আজ যাদেরকে আমরা দুষ্কৃতকারী বলে অভিহিত করছি একদিন সুযোগ মতো হয়তো এই দুষ্কৃতকারীরাই চরম সন্ত্রাসমূলক কাজে অবতীর্ণ হওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করবে। এখনো সময় আছে এবং সময় থাকতে সাবধান হোন, অবস্থার গুরুত্বানুযায়ী সতর্কতামূলক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করুন—সরকার সমীপে এ-ই আমাদের আবেদন।

মেঘনার ভাঙনে চাঁদপুর

মেঘনার ভাঙনে চাঁদপুর পুরানো বাজার বিলীন হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে। চাঁদপুরের কাছে মেঘনার পানি কেবলই বাড়ছে—গতিবেগ বাড়ছে ভাঙনের। চাঁদপুর আওয়ামী লীগ সম্পাদক জানিয়েছেন, মেঘনার ভাঙন যদি এভাবে অব্যাহত থাকে তবে চাঁদপুর পুরান বাজারের কোন অস্তিত্ব আর কোন দিন হয়তো খুঁজেও পাওয়া যাবে না।
মেঘনার ভাঙন—চাঁদপুর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে—চাঁদপুর পুরান বাজারের অস্তিত্ব আর খুঁজে পাওয়া যাবে না—এই শিরোনামায় এদেশের সংবাদপত্রগুলোতে গত বেশ ক’বছর ধরেই সংবাদ ছাপা হচ্ছে। দেশ স্বাধীন হবার আগে প্রায় প্রতিবছর বর্ষাকালেই এই সংবাদগুলো আসতে খবরের কাগজের পাতায়। আর তার সাথে সাথেই শোনা যেতো উপনিবেশবাদী আমলের লেজুড় কর্তাব্যক্তিদের আশ্বাস—পাওয়া যেতো আমলাদের পরিসংখ্যান। চাঁদপুরকে রক্ষা করার কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে—এত মাইল বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে বা এত কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে ইত্যাদি।
কিন্তু কাজের বেলায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা দেখা যেতোনা। এত ঢাক-ঢোল পিটানোর পর মাত্র একটি বাঁধ নির্মাণ ছাড়া চাঁদপুরকে রক্ষার জন্যে বিশেষ করে পুরান বাজারকে রক্ষা করার জন্যে তেমন কিছু করা হয়নি। তাই আজও দেশ স্বাধীন হবার পরে এ ধরনের খবর আসছে। কিন্তু এ ধরনের খবর আসা বন্ধ করতে হবে—সঠিক অর্থে এখন কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
১৯৬৭-৬৮ এর ভাঙনে আমরা চাঁদপুরের পার্শ্ববর্তী নীলকমলের এক বিস্তীর্ণ জনপদ হারিয়েছি। হারিয়েছি উত্তরবঙ্গের ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী চিলমারী বন্দর। আর এখন পাকিস্তানী আমলের মতো ডিমেতেতালা ব্যবস্থা নিয়ে চাঁদপুর পুরান বাজারের মতো ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী নৌবন্দর ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র হারাতে আমরা চাই না—বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রণালয়—নদী ভাঙন নিয়ন্ত্রণ দপ্তর সে ব্যবস্থাই করুন। দোহাই আপনাদের।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!