বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১৯শে আগস্ট, সোমবার, ২রা ভাদ্র, ১৩৮১
আরো ব্যাপক কার্যক্রম প্রয়োজন
চারদিকে ক্ষয়ক্ষতি আর নিঃস্ব মানুষের আর্তনাদের পাশাপাশি নতুন করে জীবন শুরুর আহ্বান। ভাঙছে যেমন, গড়ার তাগিদও তেমন তীব্র হচ্ছে। নিঃস্ব যারা আশ্রয়ের সন্ধানে বাঁচার জন্য ছুটছিল এদিক-ওদিক, বন্যার তান্ডব লীলা কিছু কমে আসতেই নূতন করে ভাবনা চিন্তা শুরু হয়ে গেছে ফেলে আসা জমি, ভেসে যাওয়া ঘর, বীজ এসবই আবার সংগ্রহ করতে হবে। বন্যার পানি নেমে গেলে হাল বলদের প্রয়োজন হবে, ছিটাতে হবে বীজ।
পত্রিকান্তরে খবরে প্রকাশ, ইতিমধ্যেই কৃষকেরা বীজ সংগ্রহ শুরু করেছে। সরকারি পর্যায়ে কোন কোন স্থানে বীজ সরবরাহ শুরু হয়েছে। সরকারি সরবরাহ অপ্রতুলতার কারণে বাজার থেকেও বেশি দামে অনেককে বীজ কিনতে হচ্ছে।
বনা আমাদের অর্থনীতিতে যে ক্ষত রেখে যাচ্ছে তাড়াতাড়ি দূর করা সম্ভব হবে না। শুধু খাদ্যশস্যের দিকটা বিবেচনা করলেই যে চিত্র আমাদের সামনে ভেসে ওঠে তা সত্যিই ভয়াবহ। এমনিতেই ১৯৭৪-৭৫ সালে খাদ্য ঘাটতি অনুমান করা হয়েছিল সতের লাখ টন। গত পরশু সাংবাদিক সম্মেলনের ত্রাণ ও খাদ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, এবারকার খাদ্যশস্যের ক্ষতি হয়েছে ১৩ লাখ টন। সবমিলিয়ে এবারকার খাদ্য ঘাটতি আশঙ্কা করা হচ্ছে ৩০ লাখ টন। এই ৩০ লাখ টনের মধ্যে মাত্র তিন লাখ টন বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়েছে। গত বছরের মজুদ ছিল দুই লাখ টন। সাড়ে ১২ লাখ টন আমদানির ব্যবস্থা নাকি পাকাপাকি করা হয়েছে। এরপর বন্যায় খাদ্যশস্যের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা কিভাবে পূরণ হবে তা ভেবে উঠা মুশকিল।
মন্ত্রী মহোদয় অবশ্য আরও সাড়ে সাত লাখ টন খাদ্য আমদানি করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন। বাকি ঘাটতির ব্যাপারে তার বক্তব্য অনাহারে-অর্ধাহারে থেকে সেই ঘাটতির মোকাবিলা করতে হবে। কিন্তু এভাবে খাদ্যাভাব মোকাবিলা কি এতই সহজ!
সারা দেশে কৃষি পুনর্বাসন এর জন্য সরকার ২৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকার একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। হতাশা এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে সরকারের এই পরিকল্পনা নিঃসন্দেহে আলোর সন্ধান দেবে। পরিকল্পনার অধীনে এ মৌসুমে আমন ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বন্যা দুর্গত কৃষকদের তারা, বীজ এবং বীজধান বরাদ্দ ও স্বাভাবিক উপাদান ছাড়াও শীতকালে বাড়তি ৪ লাখ একর জমিতে খাদ্যশস্য উৎপাদনের বিশেষ কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে আমাদের বিশ্বাস, মানুষের দুর্ভোগ কিছু হলেও হ্রাস পাবে।
আসলে বন্যার পানি হ্রাস পাবার সাথে সাথে যে মারাত্মক পরিস্থিতির মধ্যে গোটা জাতি নিপতিত হবে তা থেকে রক্ষা পাবার জন্য মুখ্যতঃ খাদ্য ও কৃষি ব্যবস্থার দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। ঔষধ, পথ্য এবং অন্যান্য রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থা তো চালাতেই হবে। উপরোক্ত রয়েছে বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি পুনঃর্নির্মাণ এবং শিল্পক্ষেত্র উৎপাদন অব্যাহত রাখা। জাতির ইতিহাসে এমন বিপর্যয় আর কোন সময় দেখা যায়নি। এই বিপর্যয় মোকাবিলায় তাই ব্যাপক প্রস্তুতি প্রয়োজন। প্রয়োজন সমস্যার গভীরতা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সচেতন হওয়া।
আসন্ন দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট সম্পদ আমাদের হাতে নেই। সম্পদের সীমাবদ্ধতা আমাদের মেনে নিতে হবে। বিদেশি সাহায্য এবং সহযোগিতার ব্যাপারে কতটুকু পাওয়া যাবে তাও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তাই ও হিসেব না কষে আমাদের আর্থিক এবং জনসম্পদের উপর নির্ভরশীল হয়েই ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ব্যাপারে উদ্যোগ যত বিলম্বিত হবে সমস্যাও ততো তীব্রতর হবে। গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে সকল সম্পত্তি একত্রিত করে তবেই সম্ভব দুর্যোগের মোকাবিলা করা। এ ব্যাপারে আমরা জাতীয় নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
অস্ত্র দিয়ে সমাধান হবে না
পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে গোলযোগ দানা বাঁধছে এবং কেন্দ্রীয় প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর মধ্যে কর্ম তৎপরতা জোরদার হয়েছে। গত শনিবার ইসলামাবাদ থেকে এএপি পরিবেশিত এক খবরে বলা হয়েছে যে, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আজিজ আহমেদ সিনেটে ঘোষণা করেছেন, গত ১৫ই মে বেলুচিস্তানের সেনাবাহিনীর তৎপরতা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল তা প্রত্যাহার করা হয়েছে। তিনি বলেন, মে মাস থেকে সেনা বাহিনীর তৎপরতা বন্ধ করার পর বেলুচিস্তানে দুর্বৃত্তরা জঘন্য কার্যক্রম শুরু করেছে। পাক প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রীর ঘোষণায় বেলুচিস্তানের গোলমাল দানাবাঁধা এবং তা দমন করার জন্য সেনাবাহিনী নিয়োগের সরকারি স্বীকৃতি মিলল, কারণ গত মে মাস থেকে সরকারিভাবে সেনাবাহিনীর তৎপরতা বন্ধের কথা বলা হলেও আসলে বেলুচিস্তান কখনো শান্ত ছিল না একথা পাক প্রতিরক্ষামন্ত্রী কথাতেই পরিষ্কারভাবে বুঝা যাচ্ছে। বেলুচিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন, ৫০ থেকে ৬০ জন ‘দুর্বৃত্ত’ ছাড়া আর সকল বিপথগামী লোকজন ধীরে ধীরে তাদের বাড়িঘরে ফিরে আসছে এবং সামরিক ও বেসামরিক লোকজন তাদেরকে পুনর্বাসন দেয়ার কাছে তৎপর রয়েছে। এখানে পাক রাত্রি রক্ষা মন্ত্রী ও বেলুচ মুখ্যমন্ত্রী বক্তব্যে ব্যাপক অমিল।
সত্যিকারভাবে বেলুচিস্তান কখনো শান্ত ছিল না এবং গত মে মাসে বেলুচিস্তানের যে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার কথা বলা হয়েছিল এবং এটা পরিষ্কারভাবে বুঝা যাচ্ছে যে, ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত বেলুচ জনগণ প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোর টোপ গেলেনি। আমরা জানি বেলের জনগণের নির্বাচিত সরকার ভেঙে দিয়ে কেন্দ্রের পদলেহী সরকারকে বসানো হয়েছে কোয়েটায় এবং বেলুচিস্তানের জনপ্রিয় নেতা সরদার আতাউল্লাহ খান মেঙ্গল, মীর খয়ের বক্স ভারী, মীর গাউস বক্স বেজেঞ্জোকে বিনা বিচারে দীর্ঘদিন যাবৎ কারাগারে আটক রাখা হয়েছে এবং পাক সরকার হয়তো মনে করেছিলেন মিলিটারি শাসনের ভয় এবং অপরদিকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার টোপ বেলুচ জনগণকে শান্ত করবে। তাই যদি হতো তাহলে মাত্র তিন বছর আগে পাক সরকারের অনুসৃত নীতি বাংলাদেশ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতো না। পাক জাতীয় পরিষদে আজ সরকারিভাবে বলা হলেও বেলুচ জনগণের ওপর নির্যাতনের মাত্রা কোনদিন হ্রাস পাবে পায়নি এবং বেলুচিস্তান হতে কখনো সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করা হয়নি। এ নিয়ে পাক পরিষদে কথা উঠলে কেন্দ্রীয় প্রশাসন থেকে যুক্তি দেখানো হয় যে, বেলুচিস্তানের ভাঙা ও পুরান রাস্তাঘাট মেরামত ও পুনঃনির্মাণের জন্য সেখানে সেনাবাহিনীকে রাখা হয়েছে। কিন্তু কিছুদিন আগে বেলুচিস্তানের বেসামরিক এলাকার জনগণের ওপর নির্বিচারে বোমাবর্ষণ করে হত্যাযজ্ঞ চালানো হলে জনাব ওয়ালী খান বোমা বিধ্বস্ত এলাকা পরিদর্শন করতে চাইলে তাকে সে অনুমতি দেওয়া হয়নি। বেলুচিস্তানে যে পদলেহী সরকার বসানো হয়েছে, তাদের মধ্যেও কোন্দল চরমে উঠেছে। নবাব আহমদ ইয়ার খান সম্প্রতি একটি পত্রিকার সাক্ষাৎকারে সুস্পষ্টভাবে নিজের প্রশাসনের এক শ্রেণীর অফিসার ও আপন মন্ত্রিসভার লোকজনদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন। ফলতঃ হয়তো দেখা যাবে প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো একদিন বর্তমান সরকার ভেঙে দিয়ে নয়া সরকার বসাচ্ছেন। কিন্তু তাতে কি মূল সমস্যার সমাধান হবে? ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত বেলুচ জনগণকে অন্ততঃ অস্ত্রের হুমকি দিয়ে মোকাবেলা করা যাবেনা। জনাব ভুট্টো আশা করি বাংলাদেশের সৃষ্টি থেকে শিক্ষা পেয়েছেন এবং পেয়েছেন বলেই আমরা মনে করি পাকিস্তানকে সংকুচিত হবার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বেলুচ নেতৃবৃন্দের প্রতি তিনি আপোষের হস্ত সম্প্রসারিত করবেন।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক