You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ২৮শে সেপ্টেম্বর, শনিবার, ১১ই আশ্বিন, ১৩৮১

সমস্যাক্রান্তির জন্য সততার হাতিয়ার চাই

সদ্য স্বাধীন দেশে নানাবিধ সমস্যা দেখা দেয় সত্য কিন্তু স্বাধীনতার মর্যাদা রক্ষা করার জন্য ধীরে ধীরে সেই সমস্যা কাটিয়ে ওঠার ঐকান্তিক চেষ্টা রাখতে হয় সমগ্র দেশবাসীকে। বিশেষ করে স্বাধীনতার অগ্রদূত ও সংগ্রামী বীর সেনানীদেরই সে দায়িত্ব পালন করতে হয়। আমরা জানি রাজনৈতিক চেতনা ও সংগ্রামের দ্বারা বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এবং আজ যারা বিভিন্ন দায়িত্বশীল পদে অধিষ্ঠিত তারা অনেকেই ক্ষমতাসীন দলের কর্মী বা সমর্থক। সে কারণেই স্বাধীনতার পর তাদের প্রতি আমরা গভীর আস্থা পোষণ করেছিলাম। স্বীকার করতে লজ্জা নেই যে-তারা আমাদের তথা দেশবাসীকে হতাশ করেছেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের ধ্বংসস্তূপের ওপর বসে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই যেসব দুর্নীতির মূলে ছিল আজ সেই দুর্নীতির জীবন্ত নাটকের আলোড়িত। চাল, ডাল সহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি, বেবি ফুড, ওষুধ, জ্বালানি, যানবাহন, বাসাবাড়ির সংকট, উৎপাদন ঘাটতি, পাটে আগুন, সার কারখানা উড়ানো ইত্যাকার অস্ত্রবিশেষ যন্ত্রণায় দেশবাসী ক্রমশঃ পিষ্ট ও ক্লিষ্ট হয়েছে এবং হচ্ছে।
শুধুমাত্র নুন ভাত এবং একখণ্ড মোটা কাপড়ের বাসনাও আজ সাধারণ মানুষের কাছে স্বপ্নের সমতুল। শস্যের ভান্ডার বাংলাদেশ এখন শস্য বিহীন আকালের দেশে রূপান্তরিত হয়েছে বলেই মনে হয়। তার ওপর রয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পৌনঃপুনিক ক্রূর ছোবল। অর্ধাহারে-অনাহারে মর্মান্তিক বিবরণে প্রায় প্রতিদিন সংবাদপত্র গুলির পাতা ভারাক্রান্ত থাকে। অবশেষে বঙ্গবন্ধু তার সাম্প্রতিক বিদেশ যাত্রার প্রাক্কালে বলেন যে, দেশে এখন দুর্ভিক্ষ অবস্থা চলছে।
দেশব্যাপী এই দুর্ভিক্ষাবস্থার মোকাবেলায় প্রতিটি ইউনিয়নে লঙ্গরখানা খোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়। ইতিমধ্যে অনেক লঙ্গরখানা খোলাও হয়েছে। এই ব্যবস্থাপনার মানবিক আবেদন অবশ্যই আমাদের কাছে আছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে শুধু লঙ্গরখানা খুলেই কি দেশের অবস্থা দূর করা সম্ভব হবে? দেশের বর্তমান অবস্থার জন্য আনুষাঙ্গিক যে সব নৈরাজ্য ও দুর্নীতি গুলো দায়ী তারও একটা ব্যবস্থা করা চাই। সেই দিকে অঙ্গুলি সংকেত করে যুবলীগ নেতা সম্প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন যে, সকল প্রকার চাপ ও তদবির বন্ধ করে আইনের যথাযথ প্রয়োগ দুর্নীতি ও জরাগ্রস্ত প্রশাসনের আমূল পরিবর্তন শৃঙ্খলা রক্ষা ও কাঁচামাল সরবরাহ করে উৎপাদন নিশ্চয়তা বিধান, রাজনৈতিক দলগুলো থেকে দেশ প্রেমিক কর্মীদের নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রভৃতি পদক্ষেপ গ্রহণ করা ছাড়া কেবলমাত্র ইউনিয়নে লঙ্গরখানা খুলে দুর্ভিক্ষ আর বৃহত্তর দুর্যোগের কবল থেকে পরিত্রান পাওয়া যায় না।
প্রসঙ্গক্রমে বলা যায় যে, প্রকৃত সমস্যার গোড়ায় হাত না দিতে পারলে সমস্যা দূর করা সম্ভব হয় না। যেমন উৎপাদন ঘাটতির ব্যাপারে শুধুমাত্র শ্রমিকদের দোষ না দিয়ে দেখা উচিৎ উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল যথাসময়ে যথোপযুক্ত পরিত্রাণের সরবরাহ করা হচ্ছে কি না, উৎপাদিত মাল গুদামে পড়ে থেকেই নষ্ট হচ্ছে কি না, কেনই বা সিমেন্টের উৎপাদন কমিয়ে দেয়া হলো এবং সাধারন মানুষকে বঞ্চিত করে কালোবাজার এতো জমে ওঠে কেন? চোরাকারবারি, মজুতদার, মুনাফাখোর এবং যাবতীয় দুষ্কৃতিকারীর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত হুমকি এবং চরম ভয় দেখালে কেনই বা কোন কাজ হয় না। দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার নিষ্পত্তি হয় না। কি করেই বা অভিযোগে জর্জরিত সংস্থা দু’টি (টইসিবি, ভোগ্য পণ্য সরবরাহ সংস্থা) আজও বহাল ভবিষ্যতে ঐতিহ্যবাহী নৈরাজ্যমূলক কর্মে লিপ্ত থাকতে পারে।
এখনও দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য সরকারি প্রশাসন বা সরকার কর্তৃক নিয়োগকৃত ডিলারদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলেও যুবলীগ নেতা উল্লেখ করেন এবং আমরাও দেখি যে জনসাধারণের স্বার্থে কোন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান বা নায্যমূল্যের দোকান কোনটিরই, কাজ কারবার চলে না। মুষ্টিমেয় সুবিধাবাদী লোক দলীয় ভেকধারী রাজনৈতিক কর্মী এবং কপট দেশ প্রেমিক এদেরই স্বার্থানুকূল্যে প্রশাসন চাকা ঘুরছে। সবুজ বিপ্লব তাই আজ হয়েছে স্লোগান সর্বস্ব। সার্বিক উন্নয়ন প্রকল্প গুলির হয়েছে অধঃপতনের বিপ্লব। এরই প্রেক্ষিতে শুধুমাত্র লঙ্গরখানা খুলে দেশের দুর্ভিক্ষ অবস্থাকে প্রতিরোধ করা যাবে কিনা তা অবশ্যই ভাবতে হবে।
পরিশেষে, আমরা বিশ্বাস করি যে, সচেতন যুবসমাজ শক্তি, একতা, সংগ্রাম, নিষ্ঠা ও দৃঢ়তা দিয়ে এ দেশকে স্বাধীন করেছে তারা আজ দেশের এই ভয়াবহ ও সামগ্রিক সংকটের দিনে উল্লেখযোগ্য কল্যাণ কর্মের নিদর্শন রাখবে। অন্তত যে দিকে চেয়ে দেশবাসী আশার দিগন্ত খুঁজে পাবে এবং আমরা দেখব সততার হাতিয়ার নির্মমভাবে যথাস্থানেই পড়ছে।

ঐতিহ্যবাহী রেশম শিল্পে সঙ্কট

একদা রাজশাহী রেশম শিল্পের সুনাম ছিল। কিন্তু সমস্যা কণ্টকিত এই দেশের রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী রেশম শিল্পেরও বাঁচোয়া নেই। যন্ত্রাংশ, জ্বালানির প্রয়োজনীয়তা এবং ব্যবস্থাপনার জন্য আজ রেশম শিল্প ধ্বংসের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। ঢাকাই মসলিন যেমন দেশে-বিদেশে সুখ্যাতি কুড়িয়েছিল তেমনি রাজশাহী রেশম বস্ত্র দেশ-দেশান্তরে হয়েছিল সমাদৃত। রাজশাহী রেশম শিল্পের কারখানাটি ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত একটানা একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিগণিত। কিন্তু ১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৭২ সালের মধ্যে এই চারটি বছরে এই রেশম শিল্প কারখানাটি অর্থনৈতিক দিক থেকে পর্যদুস্ত হয় এবং প্রতি বছর পাঁচ লক্ষ টাকার বেশি লোকসান দিতে থাকে। অবশ্য ১৯৭৩-৭৪ সালের বছর দুটিতে সর্বমোট ক্ষতির পরিমাণ এক লাখ আটানব্বই হাজার টাকায় উপনীত হয়। ক্ষতির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে এই ভাবে লাভ করা সম্ভব হলেও অন্যান্য দুর্নীতির বহর প্রতিষ্ঠানটি অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়। রাজশাহী রেশম শিল্প কারখানাটি শতকরা তিরিশ ভাগ যন্ত্রাংশ এবং মেশিন নাকি দীর্ঘদিন ধরে বিকল হয়ে গড়াগড়ি যাচ্ছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, মূল্যবান কিয়েন মেশিনটি সুদীর্ঘ দশ বছর ধরে অকেজো হয়ে আছে। অথচ এই মেশিনটি মেরামত করে চালু করার কোন সুবন্দোবস্ত নেয়া হয়নি। শুধু কিয়েন মেশিন নয় রেলিং মেশিন, বয়েলিং মেশিন এবং বেসিনসহ পঞ্চাশ হাজার টাকার যন্ত্রপাতি মেরামতের জন্য আজ অবধি কোন টেকনিশিয়ান নিয়োগের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ আদৌ তেমন গা করেছেন না। দক্ষ টেকনিশিয়ান যেখানে অপরিহার্য, সেখানে নাকি অনেক টেকনিশিয়ানকে বরখাস্ত এবং অন্যত্র পাঠানো হয়েছ। এতে ফল ফলেছে উল্টো। কারখানার বিভিন্ন যন্ত্রপাতি মেরামতের অভাবে কাজের যোগ্যতা অর্জন করেছে। এই হল যন্ত্রপাতি জনিত অচলাবস্থা। অন্যভাবেও রেশম শিল্প কারখানাটি উঠতে যাচ্ছে বর্তমানে কারখানাটি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এক পর্যন্ত চালু রাখা হয়েছে। তাতে স্বাভাবিক নিয়মেই উৎপাদন বৃদ্ধিতে হচ্ছে। কারখানাটিকে দুই শিফটে সচল রাখতে হলে দরকার ছয় হাজার মণ কোকনের। রাজশাহী প্রধান কোকন উৎপাদনকারী এলাকা হচ্ছে ভোলারহাট। এখানে আঠারো হাজার মণ কোকন উৎপন্ন হয়। কিন্তু ভোলারহাট সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়াতে উৎপাদিত পণ্যের সিংহভাগই নাকি সীমান্তের ওপারে পাচার হয়ে যায়। ফলে কোন ঘাটতি পূরণের জন্য গত বছর সর্বোচ্চ মূল্য প্রতি মণ চারশো পঞ্চাশ টাকা দিয়ে দুই হাজার মণের কিছু বেশি কোকন কিনে কর্তৃপক্ষ কারখানাটিকে সচল রেখেছিলেন। প্রতি মাসে এই কারখানাটি চালু রাখতে দশ হাজার গ্যালন ফার্নেস অয়েল দরকার। কিন্তু অপ্রতুল সরবরাহের জন্য প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। কোকন, দক্ষ টেকনিশিয়ানের দুর্ভিক্ষ, জ্বালানি সংকট ছাড়াও কারখানার একশ্রেণীর দুর্নীতি পরায়ন কর্মকর্তার কারসাজির ফলে আজ রাজশাহী রেশম শিল্প কারখানাটি মারাত্মক অস্তিত্বহীনতার কবলে খাবি খেতে শুরু করেছে। প্রকাশিত অভিযোগে জানা গেছে, কারখানার জনৈক কর্মকর্তা নাকি ১৯৭২ সালে কোকন কেনার জন্য এক লক্ষ পঁচাশি হাজার টাকা অগ্রিম নিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি এক লক্ষ চৌত্রিশ হাজার টাকার কোকন কেনেন। বাকি একান্ন হাজার টাকা কি খাতে ব্যয় হয়েছে তার নাকি হিসেব এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এই ভাগ্যবান কর্মা কর্মকর্তাটি এক লক্ষ চৌত্রিশ হাজার টাকার কোকন কেনার কথা কাগজে কলমে হিসাব দাখিল করলেও নাকি গুদামে মাত্র উনিশ হাজার টাকার কোকন রয়েছে। এত বড় দুর্নীতির নায়ক ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বিত হয়নি সেটাও একটা বিরাট প্রশ্ন বটে!
কারখানাটির অভ্যন্তরে এক ভানুমতির খেল অব্যাহত রয়েছে। কারখানা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য নিয়োজিত উচ্চপদস্থ হর্তাকর্তাদের দুর্নীতি, গাফিলতি আজ এমন এক চরম পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে ১৯৭৩-৭৪ সালে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমা তো দিল্লি দূর-অস্ত, ক্ষয় ক্ষতির অংক বরং পূর্বেকার সমস্ত রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে বলে অনুমিত হচ্ছে। এই টালমাটাল অবস্থায় রেশম শিল্প কারখানাটির ভাগ্যে অনিশ্চয়তার অন্ধকারই ঘনীভূত হয়ে উঠেছে। দুর্নীতি দমন এবং সুষ্ঠু পরিচালনার ব্যবস্থা যদি অচিরেই গৃহীত না হয় তাহলে একথা আমরা জোর গলায় উচ্চারণ করতে পারি যে, রেশম শিল্পের জন্য যে সুখ্যাতি সুবিদিত ছিল তা আর বিরাজিত থাকবে না। রেশম শিল্প কারখানাটির ভাগ্যে “অকাল সকাল” ঘনিয়ে উঠবে। কাজেই রাজশাহী রেশম শিল্প কারখানা টি যাতে বিলুপ্তির পথে এগিয়ে না যায়, রেশম শিল্প কারখানাটি যাতে আবার পূর্ণোদ্যমে সচল হতে পারে, সে জন্য কারখানা কর্তৃপক্ষকে কার্যকর পন্থা অবলম্বন করতে হবে। উৎপাদনে ফিরিয়ে আনতে হবে স্বাভাবিক অবস্থা। অকেজো যন্ত্রপাতিকে কেজো করতে হবে। কোকন এবং জ্বালানি সমস্যার একটা সন্তোষজনক সুরাহা আবশ্যক। নইলে ঢাকাই মসলিনের ঐতিহ্যমন্ডিত রেশম শিল্প ‘কিংবদন্তি’ হয়ে থাকবে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!