বাংলার বাণী
ঢাকা : ১লা অক্টোবর, মঙ্গলবার, ১৯৭৪, ১৪ই আশ্বিন, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ
বাংলাদেশ শূন্য ভান্ড নয়
আর দশটি নব্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত উন্নয়নশীল দেশের মতোই আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ এখনো অব্যবহৃত রয়ে গেছে। মাটির নীচে রয়ে গেছে গ্যাস, পিটকয়লা এমনকি তেলপ্রাপ্তির সম্ভাবনাও আজ আর কেউ উড়িয়ে দিতে পারে না। কৃষিজাত যে সকল সামগ্রী এতদিন আমাদের অর্থপ্রাপ্তিতে সাহায্য করে আসছিল ভূ-গর্ভস্থ সম্পদ আহরিত হবার পর তা অনেক গুণ বেড়ে যাবে। এসব কিছুর সঙ্গে রয়েছে আমাদের বিপুল জনসম্পদ। কারিগরি এবং প্রযুক্তি শিক্ষায় অনগ্রসর হলেও এই জনসম্পদ আমাদের উৎপাদন এবং বিনির্মাণের ক্ষেত্রে বলিষ্ঠতর ভূমিকা পালন করতে পারে।
বঙ্গবন্ধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে আমাদের আহরিত এবং অনাহৃত সম্পদের সেই বাস্তব ছবিটিই তুলে ধরেছেন। স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই স্বার্থান্বেষী মহল বাংলাদেশের ‘ইকোনোমিক ভায়াবিলিটি’ নিয়ে নানা রকম প্রশ্ন তুলে আসছিল। তারা এমনকি আমাদের স্বাধীনতার আয়ুষ্কাল নিয়েও অপপ্রচার ছড়াতে পিছপা হয়নি। বঙ্গবন্ধু এই সকল অপপ্রচারের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে গিয়ে বলেছেন, সাময়িকভাবে যদিও আমরা অর্থনৈতিক দুর্দশার মধ্যে নিপতিত তবুও খুব তাড়াতাড়ি সে দুর্দশার অবসান ঘটবে। স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলার মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হবে বঙ্গবন্ধু দৃঢ় আশাবাদ প্রকাশ করেছেন।
যারা বিজ্ঞের মতো হঠাৎ করে বিদেশে বসে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যত সম্পর্কে নানা রকম হতাশাজনক মন্তব্য আর নাক উঁচানো ‘থিওরি’ আওড়ান তারা নিতান্ত শিশুর মতোই ভুলে বসে থাকেন যে, বাংলাদেশ যুগ যুগব্যাপী ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে এই সেদিন মাত্র স্বাধীনতা অর্জন করেছে। বৃটিশ এবং পাকিস্তানীরা এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ গড়ে তোলার ব্যাপারে এতটুকু উৎসাহবোধ করেননি। উপরন্তু বাংলাদেশকে কাঁচামাল সরবরাহের মূল উৎস হিসেবেই সেখানকার শিল্পপতি এবং ব্যবসায়ীরা ব্যবহার করে এসেছে।
এখানকার প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ এবং তার সদ্ব্যবহারের ব্যাপারে ঔপনিবেশিক শাসনামলে বারবার দাবী জানানো সত্ত্বেও কোনো প্রকার সাড়া সে তরফ থেকে পাওয়া যায়নি। ফলে অধিকাংশ মূল্যবান সম্পদ অনাহৃতই রয়ে গেছে। এর উপরে প্রাকৃতিক বিপর্যয় বারবার আঘাত হেনে আমাদের অর্থনীতির মেরুদন্ডকেও দুর্বল করে ফেলেছে।
স্বাধীনতা উত্তরকালে আমাদের মূল দায়িত্ব ছিল সেই বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে গুছিয়ে তোলা এবং স্বাধীন অর্থনৈতিক বিকাশের একটা কাঠামো গড়ে তোলা। এ ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় সাফল্য হয়ত এখনো অর্জিত হয়নি কিন্তু তাই বলে সার্বিক সম্ভাবনাটাই উড়িয়ে দেবার যুক্তিযুক্ত কোনো কারণ থাকতে পারে না।
ইতিমধ্যে তেল উত্তোলনের ব্যাপারে তিনটি বিদেশী কোম্পানীর সঙ্গে আমাদের চুক্তি হয়েছে। আরো চারটি কোম্পানী খুব শীঘ্রই চুক্তিবদ্ধ হবে। তেল প্রাপ্তির যথেষ্ট প্রমাণাদি পাওয়া গেছে। ভূগর্ভে আমাদের গ্যাসের পরিমাণও কিছু কম নয়। এছাড়া মৎস্য, পাট, চা এবং চামড়া শিল্পের সুষ্ঠু সদ্ব্যবহার আমাদের অর্থনীতিকে দৃঢ়ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করার জন্য একেবারে সামান্য নয়। বঙ্গবন্ধুর দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা অপপ্রচারকারীদের চক্ষু উন্মোচনে সহায়ক হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
মরার উপর খাঁড়ার ঘা
ঘোড়াশাল সার কারখানায় অপ্রত্যাশতভাবে বিস্ফোরণ হবার পর বিএডিসি কর্তৃপক্ষ সার বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন। বিক্রি বন্ধের কারণ স্বরূপ বলা হয়েছে যে, দেশে কত সার মওজুত রয়েছে তারই একটা হিসাব-নিকাশ করা হবে। আপাতঃ দৃষ্টিতে বিএডিসি’র পদক্ষেপকে যুক্তিযুক্ত মনে হলেও এ নিয়ে সমস্যা ও সংকটের সৃষ্টি যে হতে পারে তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখেননি। এ সমস্যা সম্পর্কিত সংবাদ গতকালই স্থানীয় একটি দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে।
সংবাদে বলা হয়েছে, যে মুহূর্তে সারের সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন সে সময় সার বিক্রি বন্ধ করার জন্য বিএডিসি কর্তৃপক্ষ তার জেলা ও মহকুমা অফিসারদের নির্দেশ দিয়েছেন। এই পরিস্থিতির মধ্যে ১০ দিন পার হয়ে গেল কৃষকরা মোটেই সার কিনতে পারেনি। ফলে আমন ধান এক মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। এদিকে এই সংবাদ অন্যদিকে আবার আরেক সংবাদ বেরিয়েছে অন্য আরেকটি দৈনিকে। এতে বলা হয়েছে, ভয়াবহ বন্যার পর শুরু হয়েছে শস্যক্ষেতে পোকার উপদ্রব। চাঁদপুর, হবিগঞ্জ, নেত্রাকোনা ও পাবনা হতে প্রাপ্ত সংবাদে জানা গেছে ইতিমধ্যেই পোকার আক্রমণে হাজার হাজার বিঘার ফসল নষ্ট হয়েছে।
সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যায় আমন, পাট, জালা ও আউশ ফসলের সম্পূর্ণটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখনো কোনো কোনো অঞ্চল থেকে বন্যার পানি সরে যায়নি। যেসব এলাকা থেকে বন্যার পানি নেমে গেছে সে সমস্ত এলাকায় কৃষকরা দূরাঞ্চল থেকে জালা সংগ্রহ করে অনেক আশায় বুক বেঁধে রোপা আমনের চাষ করেছিলেন। কিন্তু পোকার এই ব্যাপক আক্রমণে ফসলের অবস্থা দেখে কৃষকেরা দারুণ চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। দুঃখের বিষয় পোকার আক্রমণ প্রতিরোধে কৃষি বিভাগীয় কর্মীরা নিষ্ক্রিয় রয়েছেন বলে বিভিন্ন এলাকা থেকে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। একদিকে সারের অভাব অন্যদিকে পোকার আক্রমণ—এ দু’য়ে মিলে কৃষকদের অবস্থাটা হয়েছে ত্রাহি মধুসূদন। এ যেন ঠিক জ্বলন্ত কড়াই থেকে আগুন লাফিয়ে পড়ার মতোই ব্যাপার-স্যাপার।
কৃষি বিভাগীয় সমস্যাদি নিয়ে আলোচনা বা সমালোচনা যে হয়নি এমন নয়। কিন্তু কাজ কিছুই হয়নি। সবই অরণ্যে রোদনে পর্যবসিত হয়েছে। অথচ আমরা ‘সবুজ বিপ্লব’ এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের কথা প্রায়ই বলে থাকি। কিন্তু কাজের বেলায় দেখা যায় কাজের চেয়ে অকাজই বেশী হচ্ছে। দেশের বর্তমান ভয়াবহ সংকটজনক অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রেখে পরিশেষে আমরা এ কথাই বলবো যে, অকাজের মাত্রাটা কমিয়ে কিছু কাজকর্ম করা হোক। এতে অন্ততঃ বন্যা পরবর্তী অবস্থায় অর্ধমৃত মানুষের উপর খাঁড়ার ঘা পড়বে না। মানুষগুলো বেঁচে ওঠার সুযোগ পাবে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক