You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.01.31 | ৩১ জানুয়ারি ১৯৭১ দিনলিপি - সংগ্রামের নোটবুক

৩১ জানুয়ারি, ১৯৭১

  • পাঞ্জাব কাউন্সিল মুসলিম লীগের সভাপতি সর্দার শওকত হায়াৎ খান ঢাকায় বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হওয়ার বদৌলতে আওয়ামী লীগ দেশের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের যথেষ্ট ক্ষমতা রাখে। সবার মতৈক্য হওয়া অবশ্যই ভালো কিন্তু তা বাধ্যতামূলক নয় বলে তিনি মন্তব্য করেন। সর্দার শওকত হায়াৎ খান সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত সফরে লাহোর থেকে ঢাকা আগমন করেন। বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সাথে আলোচনাকালে তিনি জানান, জাতীয় এবং প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে বিরাট সাফল্য অর্জনের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অভিনন্দন জানাতে তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করবেন এবং বঙ্গবন্ধু যদি তাঁর সাথে রাজনৈতিক আলোচনা করতে চান তবে, বঙ্গবন্ধুর পছন্দমতো বিষয়গুলি নিয়েই তিনি আলোচনা করবেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের ৬ দফাকে অতীতে যদিও “দেশকে খণ্ড-বিখণ্ড করার ফাঁদ” বলে মনে করা হতো এখন তা সম্পূর্ণরূপে বিবেচনা করার দরকার, কারণ পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ একে সমর্থন করেছে। তিনি বলেন, ৬-দফা বাংলাসহ পাকিস্তানের যে কোন প্রদেশের চেয়ে পাঞ্জাবের বেশি অনুকূলে যাবে।
    সেনাবাহিনীতে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব জনসংখ্যার ভিত্তিতেই হবে বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, ১৫ ফেব্র“য়ারি জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহবানের পক্ষে সুবিধাজনক হবে না। তবে শাসনতন্ত্র গৃহীত হবে বলেই দৃঢ় আস্থা প্রকাশ করেন। ২৩ মার্চের আগেই যদি এটা গৃহীত হয় আমিই সবচাইতে খুশি হবো বলে তিনি মন্তব্য করেন।
  • ঢাকার উন্মেষ সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদ কর্তৃক পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক সভায় গৃহীত প্রস্তাবে কাগজের মূল্য বৃদ্ধির তীব্র প্রতিবাদ ও কাগজের উপর থেকে শুল্ক প্রত্যাহার এবং হ্যান্ডলিং এজেন্ট বাতিলের জোর দাবি জানানো হয়। অপর প্রস্তাবে ঘূর্ণি বিধ্বস্ত চরাঞ্চলে পর্যাপ্ত রিলিফ প্রদান এবং প্রেস এন্ড পাবলিকেশন অর্ডিনেন্স ও জাতীয় পুনর্গঠন সংস্থার (বিএনআর) বিলোপ দাবি করা হয়। উন্মেষের সভাপতি জহিরুল ইসলামের সভাপতিত্বে উক্ত সভায় বক্তৃতা করেন পল্লীকবি জসিম উদ্দিন, প্রখ্যাত সাহিত্যিক-সাংবাদিক রণেশ দাশগুপ্ত, সন্তোষ গুপ্ত, আজিজ মিসির প্রমুখ কবি সাহিত্যিক শিল্পী ও চিন্তাবিদগণ। রণেশ দাশ গুপ্ত বলেন, কাগজের মূল্য বৃদ্ধির দরুণ একদিকে শিক্ষাক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে চরম সঙ্কট, অপরদিকে কবি সাহিত্যিক শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের ফেলেছে উৎকণ্ঠার মধ্যে। তিনি বিএনআর-এর বিলোপ দাবি করে এর ভূমিকা প্রসঙ্গে বলেন, বিএনআর কে রাখার অর্থই হচ্ছে আইয়ুব মোনায়েমী আমলের অভিশাপ ও স্মৃতি চিহ্নকে আকড়িয়ে রাখা। তিনি একই সঙ্গে প্রেস ট্রাস্টেরও বিলোপ দাবি করেন। উক্ত সভায় সন্তোষ গুপ্ত বক্তৃতাকালে প্রেস এন্ড পাবলিকেশন অর্ডিন্যান্স অবিলম্বে বাতিলের দাবি জানান। পল্লীকবি জসিমউদ্দিন সভায় বক্তৃতাকালে ঘূর্ণি উপদ্রুত এলাকাসমূহে রিলিফ তৎপরতা বৃদ্ধি ও পর্যাপ্ত রিলিফ প্রেরণের দাবি জানান। তিনি অভিযোগ করেন, পূর্ব বাংলার উপর দিয়ে এতো কিছু ঘটে গেল, সকল বিদেশী রাষ্ট্র আমাদের দুঃখে পাশে এনে দাঁড়ালো, অথচ আমাদের দুর্গত মানুষের ‘আর্ত আহাজারী’ পশ্চিম পাকিস্তানে পৌঁছলো না। সভাশেষে গণসাহিত্য সঙ্গীতের আসর ও জলোচ্ছ্বাসের জারির আসর এবং সবশেষে ১২ নভেম্বর মহাপ্রলয়ের উপর মহসীন শস্ত্রপাণী রচিত ‘শবের মিছিলে জীবনের জয়গান’ শীর্ষক একটি একাঙ্কিকা মঞ্চস্থ হয়।
  • প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক সংক্ষিপ্ত সফরে মুলতান থেকে করাচী পৌঁছেছেন।
  • প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদ এক বিবৃতিতে বলেন, আমাদের জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে সমতার ভিত্তিতে ঢাকা ও ইসলামাবাদের মধ্যে নয়া রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হলেই কেবলমাত্র পাকিস্তান একটি ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক কাঠামো হিসেবে টিকে থাকতে পারে। একে মূলভিত্তি করে শেখ মুজিবুর রহমান ও ভুট্টোর শাসনতান্ত্রিক কাঠামো রচনা করা উচিত। সরকারের সদর দফতরের বেলাও এর ব্যতিক্রম করা চলবে না। তিনি বলেন, রাষ্ট্রকাঠামোই যেহেতু সনাতনী নয় সেহেতু সরকার সনাতনী হওয়ার কোন অবকাশ নেই। দ্বৈত কেন্দ্রই কেবলমাত্র একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র কাঠামোর সুনিশ্চয়তা বিধান করতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন। এর ফলে দুই অংশের জনগণ তাদের নিজ ভূমিতে বসে সমভাবে তাদের সার্বভৌমত্ব প্রয়োগ করতে পারে। তিনি বলেন, “বিশেষ করে ভুট্টোর প্রতি আমার আবেদন, দেশের শোষণকারী অংশের প্রতিনিধিত্ব তাঁকে করতে হচ্ছে। সেই অংশের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ যা এ যাবৎ উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন তাঁকে তা অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে।
  • চারদিনব্যাপী সফর শেষে ভুট্টো লাহোরের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে তেজগাঁও বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সাথে আলোচনাকালে তিনি বলেন, জাতীয় রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে একটি স্থায়ী শাসনকার্য পদ্ধতি প্রণয়নের সাধারণ লক্ষ্য অর্জনে শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে সমঝোতা ও মতৈক্য খুঁজে বের করতে আমরা চেষ্টা চালাবো। আমরা যদি সহযোগিতা ও সমঝোতার দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখি, তাহলে আমাদের জাতীয় রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে একটি স্থায়ী শাসনকার্য পদ্ধাতি বের করার ব্যাপারে নিরাশ হওয়া উচিত নয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও দুই নেতার মধ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে কী না প্রশ্ন করা হলে  ভুট্টো বলেন, “প্রকৃতপক্ষে আমি কখনই কোন ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের প্রস্তাব করিনি। আমি শুধু বলেছি যদি আমাদের তিনজনের মতৈক্য হয় তাহলে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য ১২০ দিনও লাগবে বলে আমি মনে করি না।”
    বিমানবন্দরে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এ এইচ এম কামরুজ্জামান এবং তাজউদ্দিন আহমদসহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ভুট্টোকে বিদায় জানান।
  • Source: Bangladesh Liberation War Museum