বাংলার বাণী
ঢাকা : ২৬শে নভেম্বর, মঙ্গলবার, ১৯৭৪, ১০ই অগ্রহায়ণ, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ
স্বাগতম মহামান্য অতিথি
জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের মন্ত্রী পরিষদের চেয়ারম্যান হস্ট সিন্ডারম্যান আজ চারদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে আসছেন। সঙ্গে তার স্ত্রী মিসেস সিন্ডারম্যানও রয়েছেন। জি.ডি.আর মন্ত্রী পরিষদের প্রধান তাঁর সফরকালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করবেন। এছাড়া তিনি আমাদের রাষ্ট্রপতির সঙ্গেও সাক্ষাৎ করবেন। জি.ডি.আর প্রধানমন্ত্রী মিঃ হস্ট সিন্ডারম্যান-এর সাথে তিরিশ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল রয়েছে। এর মধ্যে এগারো জন সাংবাদিক ছাড়াও জি.ডি.আর পরিকল্পনা কমিশনের স্টেট সেক্রেটারী, সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সহকারী বৈদেশিক বাণিজ্যমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর সেক্রেটারিয়েট প্রধানও রয়েছেন।
জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী মিঃ হস্ট সিন্ডারম্যানের প্রথম বাংলাদেশ সফর নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ এবং অর্থবহ। বিশ্বের বন্ধুদেশ সমূহের মধ্যে জি.ডি.আর আমাদের অন্যতম একটি বন্ধুদেশ। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যারা আমাদের নৈতিক সাহায্য ও সমর্থন জুগিয়েছিল তাদের মধ্যে জি.ডি.আর অন্যতম। স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরে যে কয়টি দেশ আমাদের সরকারের প্রতি দ্রুত স্বীকৃতি জানিয়েছিল জি.ডি.আর তার মধ্যে ছিল তৃতীয়তম। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ এবং একটি সম্পূর্ণ অবিন্যস্ত সরকারের সঙ্গে সেদিন যে সকল দেশ অর্থনৈতিক সহযোগিতা স্থাপন করে ব্যবসা বাণিজ্য সম্প্রসারণ করেছিল তাদের মধ্যেও জি.ডি.আর-এর নাম উল্লেখযোগ্য। যখন বিশ্বের অনেক ধনী দেশ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে এমনকি বাংলাদেশের টিকে থাকা না থাকার বিষয় নিয়ে বিবেচনা করে অত্যন্ত সন্তর্পণে আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছিল তখন ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, জি.ডি.আর সহ সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো নির্দ্বিধায় এগিয়ে এসেছিল আমাদের জাতীয় অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ার প্রাথমিক পদক্ষেপ সহায়তার জন্য। বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষ বন্ধুদেশগুলোর সেই মহান অবদান কোনোদিনও ভুলতে পারেনা। সে কারণে জি.ডি.আর প্রধানমন্ত্রীর প্রথমবারের মতো এই বাংলাদেশ সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং আনন্দের বিষয়।
জি.ডি.আর প্রধানমন্ত্রী মিঃ হস্ট সিন্ডারম্যান আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রীয় অতিথি। তাঁর আজকের এই শুভ আগমনের দিনে দেশের একটি রাজনৈতিক দল দেশব্যাপী হরতালের আহ্বান জানিয়েছে। মহামান্য অতিথির আগমনের দিনটি বহুপূর্বেই নির্ধারিত হয়েছিল। হরতাল আহ্বানকারী জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল তাদের কর্মসূচী অনেক পরে প্রণয়ন করেছেন। অতএব অত্যন্ত সহজেই ধরে নেওয়া যায় যে, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল তাদের হরতালের দিনটি জেনেশুনেই জি.ডি.আর প্রধানমন্ত্রীর আগমনের নির্দিষ্ট দিনই ধার্য করেছেন। একটি দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে এ ধরনের রীতিবিরুদ্ধ এবং উস্কানিমূলক আচরণ আশা করা যায় না। এছাড়া একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের সরকারের সঙ্গে অন্য একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের সরকারের যোগাযোগ বা কথাবার্তা বলার স্বাভাবিক এবং ন্যায়সঙ্গত নিয়ম ভঙ্গ করে জাসদ-এর পক্ষ থেকে জি.ডি.আর-এর রাষ্ট্রদূতের নিকট চিঠি প্রেরণ করার দৃষ্টান্তও দেশের সাধারণ মানুষকে বিস্ময়াভিভূত করেছে। তাদের যোগ্যতা এবং কান্ডজ্ঞান সম্পর্কে সবার মনে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। এ ধরনের আচরণ যে বালখিল্যতার সামিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বস্তুতঃ এতদসত্ত্বেও সরকার সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন অথচ সেক্ষেত্রে জাসদ-এর পক্ষ থেকে ক্রমাগত উস্কানিমূলক তৎপরতা অব্যাহত রাখা হয়েছে। বিদেশী মহামান্য অতিথিকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপনের উন্মুক্ত পরিবেশ বিনষ্ট করার এহেন প্রচেষ্টা শুধু রীতি বা নীতি বিরুদ্ধই নয় দেশের শান্তি শৃঙ্খলার প্রতি মারাত্মক হুমকিও বটে। গোটা জাতীয় মর্যাদাকে তারা বিদেশী অতিথি’র সামনে হেয় প্রতিপন্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুযায়ী যে কোনো নাগরিক শান্তিপূর্ণভাবে সভা-সমিতি, বক্তৃতা-বিবৃতি বা মিছিলের মাধ্যমে সরকারী কাজের প্রতিবাদ জানাতে পারেন। কিন্তু কথায় কথায় হরতাল ডাকা এবং নিজেদের শক্তি প্রদর্শনের জন্য আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে সংকটাপন্ন করে তোলা কোনেরা রকমেই সমর্থনযোগ্য নয়।
সরকারী পর্যায়ে সমাজতান্ত্রিক দেশের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মিঃ হস্ট সিন্ডারম্যান বাংলাদেশে আসছেন। জি.ডি.আর প্রধানমন্ত্রী ছাড়া এর পূর্বে সমাজতান্ত্রিক যুগোশ্লাভিয়ার প্রধানমন্ত্রীও বাংলাদেশে শুভেচ্ছা সফরে এসেছিলেন। বেসরকারী পর্যায়ে ইতিপূর্বে দক্ষিণ ভিয়েতনামের বিপ্লবী সরকারের প্রধানমন্ত্রীও আমাদের দেশে এসেছেন। আমাদের রাষ্ট্রীয় এবং জনগণের দৃষ্টিকোণে এঁরা সবাই সমাজতান্ত্রিক দেশের সরকার প্রধান। এঁরা সবাই সমাজতন্ত্রের মহান আদর্শ প্রতিষ্ঠায় নিবেদিত প্রাণ। অথচ বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক সম্প্রতি এক বিবৃতি প্রদান করে জি.ডি.আর প্রধানমন্ত্রীকে সমাজতান্ত্রিক দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বলে আখ্যায়িত করে যে দ্বন্দ্বের বা বিতর্কের সূচনা করেছেন তাতে কৌতুহলী মানুষের মনে যথার্থ সমাজতন্ত্র বা সমাজতান্ত্রিক দেশ সম্পর্কে বিভ্রান্তি জেগেছে। একজন বিদেশী অতিথির আগমনকে কেন্দ্র করে এ ধরনের দ্বন্দ্বমূলক বিবৃতি মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। বস্তুতঃ বিরোধীদলগুলোর কাছ থেকে জনসাধারণ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তা আশা করেছিল কিন্তু উপরোক্ত ঘটনাগুলো তাদেরকে সম্পূর্ণভাবে নিরাশ করেছে।
আমরা জি.ডি.আর প্রধানমন্ত্রী মিঃ হস্ট সিন্ডারম্যান-এর শুভ আগমনকে স্বাগত জানাই এবং দু’দেশের নেতৃবৃন্দের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠক সমূহের সাফল্য কামনা করি।
মারণাস্ত্র সীমিতকরণ
দশ বছর মেয়াদী মারণাস্ত্র সীমিতকরণ চুক্তির রূপরেখা সম্পর্কে মতৈক্যে পৌঁছেছেন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ব্লাডিভোস্টকে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভ ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের মধ্যে অনুষ্ঠিত শীর্ষ আলোচনা শেষে প্রকাশিত এক যুক্ত ইশতেহারে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৫ সাল মেয়াদে মারণাস্ত্র সীমিতকরণে নতুন চুক্তির মৌল শর্তাবলীর ব্যাপারে তাঁরা একমত হয়েছেন।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ কিসিঞ্জার এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বলেছেন, এই যুক্ত ইশতেহার মারাত্মক অস্ত্র আলোচনায় অচলাবস্থা ভাঙার সূচনা করেছে। তিনি বলেন, আলোচনার ‘সবচাইতে খারাপ অংশটুকু পেরিয়ে এসেছি।’
ডঃ কিসিঞ্জার আরো বলেন, জেনেভায় নিরস্ত্রীকরণ আলোচনায় অংশগ্রহণকারী সোভিয়েত ও মার্কিন আলোচকদের শীর্ষ বৈঠকের পুরো বিষয় না জানানো পর্যন্ত চুক্তিতে বর্জিত ক্ষেপণাস্ত্র ও অস্ত্রের প্রকৃত সংখ্যা কয়েকদিন গোপন রাখা হবে। চুক্তি বলা হয়েছে, (ক) উভয় পক্ষই নির্দিষ্টসংখ্যক মারাত্মক সমরাস্ত্রবাহী যান রাখতে পারবে। (খ) উভয় পক্ষই স্বতন্ত্র লক্ষ্যে আঘাতক্ষম বহুমুখী অস্ত্র সজ্জিত আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং স্বল্পদৈর্ঘ্যের ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র রাখতে পারবে।
ব্লাডিভোস্টক শীর্ষ বৈঠক প্রসঙ্গে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভও বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ফোর্ডের সঙ্গে তার শীর্ষ বৈঠক বিশ্বে উত্তেজনা প্রশমনের ক্ষেত্রে নতুন উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। মিঃ ব্রেজনেভ আরো বলেন, যে সব দুরূহ আন্তর্জাতিক সমস্যার এখনো সমাধান হয়নি সেগুলো প্রণালীবদ্ধ করা এবং সকল বিপদজনক পরিস্থিতির অবসান ঘটানোর ব্যাপারে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করতে পারে।
মিঃ ব্রেজনেভের বক্তব্যের মধ্যে একটা সুস্পষ্ট আশার বাণীই প্রতিধ্বনিত হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট মিঃ ফোর্ডও এ ব্যাপারে আশাবাদী। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বিশ্ব নানান সমস্যা ও সংকটের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্ব অনেক বেশী। কারণ দু’টিই বৃহৎ শক্তি। এই দুই শক্তির মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা ও সহযোগিতার অভাব ঘটলে তার প্রতিফলন ঘটে সারাবিশ্বে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে দুনিয়ার শান্তিকামী মানুষ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে যে, আরেকটা মহাযুদ্ধের ভার বহন করার ক্ষমতা বর্তমান বিশ্বের নেই।
আরেকটা মহাযুদ্ধের সূচনা হলে মানব সমাজ ও সভ্যতাই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কারণ অত্যাধুনিক মারাত্মক অস্ত্র নির্মাণ প্রতিযোগিতায় দু’টো বৃহৎ শক্তিই পরস্পরকে ছাড়িয়ে গেছে। এ ব্যাপারে সোভিয়েত ইউনিয়নে এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে অধিক শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে আর মার্কিনীদের রয়েছে অধিকতর বহুমুখী ক্ষেপণাস্ত্র। কাজেই এই দুই বৃহৎ শক্তির দায়িত্ব ও কর্তব্য যে অধিকতর বৃদ্ধি পেয়েছে এ কথা আর বিস্তারিত বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে না।
মারণাস্ত্র সীমিতকরণ সম্পর্কে ইতিপূর্বে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনা হয়েছে। বিগত শীর্ষ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট মিঃ নিক্সন এবারের আলোচনা হয়েছে বর্তমান প্রেসিডেন্ট মিঃ ফোর্ডের সঙ্গে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট মিঃ ফোর্ডের ভাষায় বললে বলতে হয় আগামী বছরে পারমাণবিক অস্ত্র চুক্তির সম্ভাবনা উৎসাহব্যঞ্জক।
আগামী দিনগুলোতে কি হবে তা আমাদের জানা নেই। তবে ব্লাডিভোস্টকে বিশ্ব উত্তেজনা প্রশমনের যে পথ উন্মুক্ত হলো সে সম্ভাবনার পথ আরো প্রশস্ত হোক এ কামনাই আমরা করছি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক