বাংলার বাণী
ঢাকা: ২৮ এপ্রিল শনিবার, ১৫ই বৈশাখ, ১৩৮০
এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে শুভ
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন সংগ্রামী ঐক্য স্থাপনে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। তাদের উভয় সংগঠনের মধ্যে উদ্ভুত বিভিন্ন প্রকার মনোমালিন্যের কারণসমূহের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করবে বলে ঘোষণায় জানিয়েছে। উভয় ছাত্রদলের যৌথ প্রস্তাবের একাংশে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সুদৃঢ় ঐক্যকে ভিত্তি করে ছাত্রসমাজের বৃহত্তর ঐক্য স্থাপনের সচেষ্ট হতে হবে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে গঠনমূলক পরিকল্পনা নিয়ে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে।
বাংলাদেশের এই দুটি বৃহত্তম ছাত্র প্রতিষ্ঠান এই যৌথ উদ্যোগ গোটা দেশের মানুষের মনে এক দারুণ সাড়া জাগাবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। ইতিপূর্বে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ দেশের প্রত্যেকটি প্রগতিশীল রাজনৈতিক, শ্রমিক ও ছাত্র সংগঠনকে উদ্বুদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের নানা সমস্যার মোকাবেলা করার জন্য সে আহ্বান যেমনি ছিলো সময়োপযোগী তেমনি ছিল সুদূরপ্রসারী। বিশেষ করে সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে এককভাবে সরকারি প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয়। আমরা মনে করি এটা একটা সঙ্ঘবদ্ধ আন্দোলনের বিষয়। দেশের প্রত্যেকটি স্তরের আজ দুর্নীতির ঢুকে পড়েছে। প্রত্যেকটি শ্রেণীর মধ্যে আজ অপরাধপ্রবণতা সীমাহীনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারি প্রশাসনযন্ত্র দুর্নীতি চরমে পৌঁছেছে। রাজনৈতিক টাউটরা দেশের প্রত্যেকটি স্তরের কলহ সৃষ্টি করে চলেছে। এদের কার্যকলাপ সাধারণ মানুষের জীবনের উপর নিদারুণভাবে প্রভাব বিস্তার করছে। এই সকল সামাজিক শত্রুদের বিরুদ্ধে এককভাবে সরকার যৌথ প্রচেষ্টায় চালান না কেন আমরা মনে করি তা যথেষ্ট নয়। প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠনগুলোর যৌথ প্রচেষ্টার দ্বারা যদি গোটা দেশব্যাপী একটি সংঘবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা যায় তাহলেই কেবল সম্ভব এই সকল শত্রুদের পরাভুত করা। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে আজ নানা সমস্যা প্রকট হয়ে উঠেছে। সরকারি আমলা যারা প্রশাসনযন্ত্রের রয়েছে তারা বঙ্গবন্ধু মহান আদর্শ বাস্তবায়নের পথে আজ বিরাট বাধা। বিভিন্ন প্রকার সামাজিক শত্রুরা দেশের প্রতিটি উন্নয়নমূলক কাজে আজ সর্বাত্মক বাধা সৃষ্টি করে চলেছে। এদের বিরুদ্ধে যদি সত্যিকারের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয় তাহলে অবশ্যই সংগ্রামী ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন পারস্পারিক কোন্দল ভুলে গিয়ে দেশ গড়ার কাজে যে ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি গ্রহণ করার কথা ঘোষণা করেছে তা নিঃসন্দেহে দেশের শিক্ষিত, অশিক্ষিত প্রতিটি মানুষের মনে আশার উদ্রেক করবে। আমরা এই মহান উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। এই সঙ্গে দেশের অন্যান্য প্রগতিশীল রাজনৈতিক, শ্রমিক ও ছাত্র সংগঠনগুলো দেশ গড়ার কাজে ও দেশের শত্রুদের বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য সংগ্রামী ঐক্যস্থাপনের আহ্বান জানাবো।
এশীয় শান্তি সম্মেলন সফল হোক
বিশ্ব শান্তি পরিষদ আগামী ২৩ থেকে ২৫শে মে পর্যন্ত ঢাকায় এশীয় শান্তি সম্মেলন ও বাংলাদেশের নায়ক, শান্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্রণী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সম্মানজনক জুলিওকুরি শান্তি পদকে ভূষিত করার জন্য এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এই উপলক্ষে বাংলাদেশ শান্তি পরিষদ একটি প্রস্তুতি কমিটি গঠন করে বর্তমানে পূর্ণোদ্যমে কাজ করে যাচ্ছে। ঢাকায় এই প্রথমবারের মত বিশ্ব শান্তি সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। সম্মেলনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, বিশ্ব শান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে এই সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে জুলিওকুরি শান্তি পদক কে সম্মানিত করবে। বাঙালির জাতীয় জীবনে এই অনুষ্ঠানে গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে বিশ্ব শান্তি পরিষদের ভূমিকা কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিশ্ব শান্তি পরিষদ প্রথম থেকেই বাংলাদেশের ন্যায় সঙ্গত সংগ্রামের প্রতীক সাহায্য সহযোগিতা করেছে এবং বঙ্গবন্ধুকে জুলিওকুরি শান্তি পদকে ভূষিত করেছে। শুধু তাই নয়, ঢাকায় এশীয় শান্তি সম্মেলনের আয়োজন করে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অবদান কে স্বীকৃতি দিয়েছে। এশীয় শান্তি সম্মেলনের প্রস্তুতি কমিটি সম্প্রতি এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে যে যুদ্ধবাজ, সম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের শক্তি দেশে দেশে কোণঠাসা হচ্ছে।ভিয়েতনামের যুদ্ধবিরতি সত্বেও এশিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত ও এশিয়াবাসীদের বিরুদ্ধে এশিয়াবাসীকে সংঘর্ষে উস্কানি দান ও রণসজ্জা শেষ হয়নি। লাওস ও কম্বোডিয়ায় সংঘর্ষ জিইয়ে রেখে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলি জবর-দখল নীতি কে প্ররোচিত করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ভারত মহাসাগরকে আক্রমনাত্মক যুদ্ধের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করে চলেছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয় যে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও চিনা দোসররা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক বাস্তবতাকে অস্বীকার জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে বাধাদান এবং পাকিস্তানকে প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক জঙ্গী নীতি গ্রহণে উস্কানি দিয়ে চলেছে।
সাম্রাজ্যবাদীদের এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে এশিয়ার শান্তি নিরাপত্তা ও জাতীয় স্বাধীনতাকে বিপদ মুক্ত করার জন্য প্রতিটি শান্তিকামী মানুষকে এগিয়ে আসা উচিত। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের মাটিতে তাই এশীয় শান্তি, সম্মেলন কে সাফল্যমন্ডিত করে তোলার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিয়োজিত করতে হবে।
এশীয় শান্তি সম্মেলনের মূল স্লোগান হচ্ছে, এশিয়ার বুক থেকে সাম্রাজ্যবাদ হাত গুটাও, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র প্রতিহত কর এবং শান্তি, স্বাধীনতা ও জাতীয় নিরাপত্তার পক্ষের সকল শক্তি এক হও। ঢাকায় এসেও শান্তি সম্মেলনে ফলশ্রুতি অত্যন্ত সুদুরপ্রসারী। বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে শান্তি ও প্রগতির স্বপক্ষে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে চলেছে। বাংলাদেশে শান্তিকামী দেশ হিসেবে সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করার জন্য দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী চক্র এশিয়ার শান্তি বিঘ্নিত করার জন্য নানারকম ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে রেখেছে। ঢাকায় এশীয় শান্তি সম্মেলন তাই সম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের বিরুদ্ধে একটি সুদূরপ্রসারি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে বলেই আমরা বিশ্বাস করি এবং এমনি করেই এশিয়ার বুকে সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের বিরুদ্ধে গড়ে উঠবে একটি শান্তির দুর্গ। আমরা ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য শান্তি সম্মেলনে সর্বত্র সাফল্য কামনা করি।
তেল আসছেঃ সংকট কাটেনি
তেল আসছে, প্রচুর তেল। কিন্তু তবু সংকট কাটেনি, কাটছে না। গত ১৫ই এপ্রিল থেকে এ সংকট ক্রমাগত বাড়ছে। আবার হয়তো তা কিছুটা কমছে। তবে বাড়ার পরিমাণটাই সর্বাধিক।
অথচ চলতি মাসে বিদেশ থেকে সাড়ে সতের হাজার টন কেরোসিন ১হাজার টন ডিজেল ও ২ হাজার টন পেট্রোল ইতিমধ্যেই আমদানি করা হয়েছে। চট্টগ্রাম তেল শোধনাগারে ইতিমধ্যেই প্রতিদিন ১৫শত টন কেরোসিন, ৫শত টন ডিজেল ও ৫শত টন পেট্রোল পরিশোধন এর কাজ শুরু হয়ে গেছে। রেশনিং এবং সমিতির মাধ্যমে বিভিন্ন যানবাহনে ও কলকারখানায় প্রয়োজনমতো তেল ডিজেল ও পেট্রোল সরবরাহ করা হচ্ছে বলেও সংশ্লিষ্ট সরকারি মহল থেকে দাবি করা হচ্ছে।
এই মহল থেকে আরো আশা করা হয়েছে যে, আগামী মাসের তেল সংকট নিরসন করা সম্ভব হবে। কেননা এ সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন, কুয়েত, সিঙ্গাপুর থেকে ৩৯ হাজার টন কেরোসিন ও ৫ হাজার টন পেট্রোল চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে যাবে।
অন্যদিকে দেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলে তেলের সঙ্কট নিরসনকল্পে চালনা বন্দরকে ভিত্তি করে ওই এলাকায় একটি রিফাইনারি খোলার কোথাও সরকার চিন্তা করছেন। কৃষিকাজে যাতে তেলের সংকট না হয় সে জন্য থানায় থানায় তেলের গুদাম স্থাপনের কথাও বিবেচনাধীন রয়েছে। তেল সংকট, তার প্রেক্ষিতে দেশের পরিস্থিতি একটা গুরুতর অবস্থার সম্মুখীন-অস্বীকার করবার উপায় নেই এবং সে ক্ষেত্রে সরকারি দমও প্রশংসনীয়। এই প্রশংসনীয় কার্যক্রমের সাথে এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আন্তরিকতা সবচাইতে বড় প্রয়োজন।
অন্যদিকে এ তেল সংকট যাতে পরবর্তীকালে দেশে খাদ্য সংকটের সৃষ্টি না করে আজ তার প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব অপরিহার্য। শহরের এলাকায় তেল সংকটে যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়ে হয়তো বা নাগরিক জীবনে অচলাবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে তেলের অভাবে পাম্প মেশিন গুলো বিকল হওয়ায় যদি সেচকার্য চালানো যেতে না পারে তবে সেটা ভয়াবহ খাদ্য সংকটের সৃষ্টি করবে তা উল্লিখিত নাগরিক জীবনে অচলাবস্থা সৃষ্টির চাইতে অধিক গুরুত্বপূর্ণ নয়? তাই তেল সঙ্কট নিরসনকালে আমাদের অর্থনীতির মূল ভিত্তি গ্রামের দিকেও নজর দিতে হবে বেশি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক