You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.06.19 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | সিরিয়াগামী চিকিৎসকদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু | ও-জি-এল-এর কাপড় দ্রুত বাজারে ছাড়া হোক | রাণী সংকাইলে তুলা চাষ | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: ১৯শে অক্টোবর, শুক্রবার, ২রা কার্তিক, ১৩৮০

সিরিয়াগামী চিকিৎসকদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সিরিয়ায়গামী মেডিকেল টীমের উদ্দেশ্যে বলেছেনঃ জয়ের মালা জয় করে যেন তারা দেশে ফেরেন। ইসরাইলের বিরুদ্ধে যেসব আরবীয় বীর সৈনিক অমিত বিক্রমে লড়াইয়ের ময়দানে সত্য ও ন্যায়ের সংগ্রামে আত্মনিবেদন করেছেন তাদের সাহায্য করার জন্য বাংলাদেশ থেকে বত্রিশ সদস্যের একটি মেডিকেল টিম খুব শীগগিরই সিরিয়ায় রওনা হচ্ছেন। কর্নেল খুরশিদ উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে সাত জন ডাক্তার, জেনারেল ডিউটি অ্যাসিস্ট্যান্ট, নার্স ও ল্যাবরেটরী টেকনিশিয়ানদের নিয়ে এই বত্রিশ সদস্য বিশিষ্ট মেডিকেল টিম গঠিত হয়েছে। গত পরশু সিরিয়াগামী মেডিকেল টিমের সদস্যরা গণভবনে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোর-এর লোকদের নিয়ে গঠিত এ মেডিকেল টিমটির সর্বতো সাফল্য কামনা করেছেন। তিনি বলেন ন্যায় সংগ্রামে আরবদের সাফল্য অবধারিত। মেডিকেল টিমের সদস্যদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, তারা আরব ভাইদের জন্য বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন যে, তারা যেনো তাদের সেবা ও ঐকান্তিকতা দিয়ে বাংলাদেশের মান মর্যাদা সমুন্নত রাখেন।
এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম আরবদের সাহায্য করার জন্য একটি মেডিকেল টিম দামেস্কে পাঠাচ্ছে। এই মেডিকেল টিম টি রণাঙ্গনে ছোট আকারের একটি অপারেশন থিয়েটার চালুর উপযোগী সরঞ্জামাদি নিয়ে যাচ্ছেন। বত্রিশ সদস্য বিশিষ্ট সিরিয়া গমনকারী চিকিৎসক বঙ্গবন্ধুর আশীর্বাদ গ্রহণের জন্য গণভবনে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু প্রতিনিধি দলের সদস্যদের সঙ্গে করমর্দন করেন এবং তাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে, আরব ভাইদের জন্য আমাদের জীবন উৎসর্গ করা ছাড়া দেয়ার মত আর কিছুই নেই। বঙ্গবন্ধু আরো বলেছেন যে, “যদি আমরা পাকিস্তানের নিগড়ে বাঁধা পড়ে থাকতাম তাহলে আজ আমরা আরব ভাইদের পাশে দাঁড়াতে পারতাম না।” এ কথা তো সত্য যে, এশিয়া উপমহাদেশীয় দেশগুলোর মধ্যে আরবদের প্রতি যারা সমর্থন দিয়েছে তাদের মধ্যে বাংলাদেশী প্রথম কথায় এবং কাজে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিচ্ছে। সিরিয়ার রণাঙ্গনে অথবা আরব সৈনিকদের সেবা করার জন্যই বাংলাদেশের চিকিৎসক প্রতিনিধিদলটি সেখানে যাচ্ছেন। এতে সত্য ও ন্যায়ের সংগ্রামের প্রতি বাংলাদেশের সমর্থনের বলিষ্ঠ প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে ,তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাছাড়া, মানবতার খাতিরেও যে আমাদের এ ধরনের সেবামূলক কার্যের দৃঢ় পদক্ষেপ নেয়া দরকার এটাই সে প্রমাণ বহন করছে। ইসরাইলী হানাদার বাহিনী আরবদের সঙ্গে লড়াইয়ে বিভিন্ন রণাঙ্গনে ইতিমধ্যেই ধরাশায়ী হচ্ছে। এ লড়াইয়ে আরবদের জয় অবশ্যম্ভাবী। আরবদের প্রতি বাংলাদেশে যে শুধু মৌখিক সমর্থনই দেয় নি বরঞ্চ কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়েছেন, চিকিৎসকদল প্রেরণ সে সত্যেরই প্রতিফলন। বঙ্গবন্ধু সর্বান্তঃকরণে চিকিৎসক দলের যেমন সাফল্য কামনা করেছেন, তেমনি আমরাও এই চিকিৎসক দলটির সাফল্য কামনা করছি। কারণ আমরা জানি বিপদে যে পাশে এসে দাঁড়ায় সেই সত্যিকারের বন্ধু। বাংলাদেশ যে আরবদের প্রকৃত বন্ধু তা বাংলাদেশের কার্যক্রম আরো স্পষ্ট করে তুলেছে। আরব-বাংলাদেশ সংহতি জোরদারে বিরুদ্ধে আরবের বিজয় ঘোষিত হোক, এটাই আমাদের একমাত্র কাম্য।

ও-জি-এল-এর কাপড় দ্রুত বাজারে ছাড়া হোক

ও-জি-এল-এর মাধ্যমে আমদানিকৃত কাপড়ের প্রায় চল্লিশ ভাগ দেশে ইতিমধ্যে এসে গেছে বলে সংবাদে প্রকাশ। কিন্তু উক্ত কাপড় বাজারে এখনো এসে পৌঁছানি। সংবাদে বলা হয়েছে, ও-জি-এল-এর কাপড় নাকি এখনো বিভিন্ন জেলা ও মহাকুমার গুদামে জমা হয়ে রয়েছে। ও-জি-এল-এর মাধ্যমে প্রস্তাবিত আট কোটি টাকার কাপড় আমদানির বিষয়ে নিয়ে অনেক প্রকার তালবাহানা হয়েছে। অনেক দিন-তারিখ অতিক্রান্ত হওয়ার পর শেষ পর্যন্ত গত ১৫ই সেপ্টেম্বর কাপড় আসার দিন কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু সেদিনও পেরিয়ে যাওয়ার পর গত কয়েকদিন আগে ও-জি-এল-এর কাপড় এসে পৌঁছেছে। কাপড়ের দাম নির্ধারণ ও বিতরণ করার জন্যেই ইতিপূর্বে প্রতিটি জেলায় যে কমিটি গঠন করা হয়েছিল, সে কমিটি সম্পর্কে যথেষ্ট দ্বিমত রয়েছে। তার গাফিলতির দরুনই এখন পর্যন্ত নাকি দাম নির্ধারণ হয়নি এবং সুষ্ঠভাবে বিতরণের জন্য কোন কার্যকরী কমিটি গঠন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি অথচ পবিত্র ঈদ সমাগত। ঈদের পুর্বে মানুষের কাপড়ের যে নিদারুণ আবশ্যকতা রয়েছে তা কতৃপক্ষ উপলব্ধি করছেন কিনা তা বোঝা মুশকিল। আমরা আমাদের পত্রিকার পক্ষ থেকে সংবাদ ও মতামত দিয়ে বার বার ও-জি-এল-এর কাপড় আমদানি ত্বরান্বিত করার ওপর জোর দিয়েছি। কিন্তু কতৃপক্ষ বাস্তবে তার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। অথচ দেশের বস্ত্র সঙ্কট যে কত বড় নিদারুণ তা কারও অজানা নয়। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষীয় আগ্রহ বেশি হলেই অনেক ক্ষেত্রে আমদানির কাজ ত্বরান্বিত হতো। কিন্তু সর্বক্ষেত্রে আগ্রহের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। জানা গেছে, যে মাপ বা নমুনা দিয়ে ও-জি-এল-এর লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে তাতে করে রপ্তানিকারকরা যথাসময়ে কাপড় সরবরাহ করতে অসমর্থ বলে জানিয়েছিল। ফলে কাপড় তৈরি করে যথা সময়ে সরবরাহ করা রপ্তানিকারকদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাছাড়া যে বিশেষ নমুনা ও মাপ দেওয়া হয়েছিল তা রপ্তানিকারকদের পক্ষে নতুন তৈরি করে দেওয়া ছাড়া সম্ভব ছিল না। আমাদের কর্তৃপক্ষ এ সকল দিক বিচার বিবেচনা না করেই আমদানিকারকদের ওপর শর্ত আরোপ করেছিলেন। ফলে কাপড় আনতে অপেক্ষাকৃত বেশি হয়ে গেছে। তার উপর রয়েছে কর্তৃপক্ষীয় ঘাপলা ও আন্তরিকতার অভাব। এতদ্বসত্ত্বেও যখন মোট কাপড়ের চল্লিশ ভাগ এসেছে তখন তা বিতরনে বিলম্ব হওয়া মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা বিতরণ ব্যবস্থার জন্য জনপ্রতিনিধি ও দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলসমূহের প্রতিনিধি নিয়ে কমিটি গঠনের জন্য কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানাবো এবং ঈদের পূর্বেই যাতে করে ও-জি-এল-এর কাপড় বাজারে ছাড়া পায় তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানাই।

রাণী সংকাইলে তুলা চাষ

দিনাজপুর জেলার রাণী সংকাইলে তুলা চাষ করার জন্য ১০৮টি পরিবার গত বুধবার সকালে একটি বিশেষ ট্রেনযোগে ঢাকা ত্যাগ করেন।
কমলাপুর স্টেশনে তাদের বিদায় সংবর্ধনা জানানো ভূমি প্রশাসন ও রাজস্ব মন্ত্রী জনাব আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, খাদ্যমন্ত্রী শ্রী ফণিভূষণ মজুমদার, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব আবদুর রাজ্জাক ও আরো অনেক।
জনাব সেরনিয়াবাত ও শ্রী মজুমদার সরকারের তুলা চাষ প্রকল্প কে সফল করে তোলার জন্য চাষীদের প্রতি আহ্বান জানান। তারা বলেন এ প্রকল্পের সফলতার উপর আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের সফলতা উন্নতি নির্ভর করছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, কয়েক বৎসর আগে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান থেকে ৩২৫টি পরিবার পশ্চিম পাকিস্তানের গোলাম মোহাম্মদ এলাকায় যান এবং সেখানে তুলার চাষ করেন। এই পরিবারগুলি থেকেই কিছু অংশ বর্তমানে তুলা চাষের জন্য রাণী সংকাইল গেছে।
বাংলাদেশের তুলা চাষ একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প। এ প্রকল্পের সফলতার উপর ভবিষ্যৎ উন্নয়নের অনেককিছুই নির্ভরশীল। বিশেষতঃ এ প্রকল্প যদি সাফল্যমন্ডিত হয় তাহলে বাংলাদেশের বস্ত্র শিল্পের ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারবে। পাকিস্তানি আমলে বাংলাদেশ বস্ত্র শিল্পের দিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারেনি। বিশেষ করে তুলা ও সুতা আমদানি করে যে বস্ত্র উৎপাদিত হতো তাতেও চাহিদা মেটানো সম্ভব হতো না। বেশিরভাগ কাপড়ই আসতো পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। সুতরাং স্বাভাবিক কারণেই কাপড় আমদানির ওপর নির্ভর করতে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশের অবস্থা এমন ছিল না। ব্রিটিশ শাসকরা উপমহাদেশকে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পঙ্গু করে দেবার পরিকল্পনা নিয়ে ছিল তাতে তখন এ অঞ্চলের বস্ত্রশিল্প নিদারুণ সংকটের সম্মুখীন হয়। যে মুসলিমের জন্য জগৎ জোড়া সুনাম ছিল তাও আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়ে যায়। মসলিন কাপড় এদেশের তুলোতেই তৈরি হতো তুলার জন্য তখন বিদেশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হোত না। অনেক রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশ তুলা চাষের মাধ্যমে আবার বস্ত্রশিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে এ স্বপ্ন প্রতিটি দেশবাসীর। রাণী সংকাইলে তুলা চাষ করার জন্য যে মহতী ও সুদুর প্রসারী প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে তা সার্থক হোক, সফল হোক এই কামনাই আমরা করব।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন