কেস স্টাডি-১০ কৃষক কাদের আলী
কাদের আলী লেখাপড়া কিছুই জানেন না শুধু নিজের নাম লেখাটুকু শিখেছেন অনেক কষ্টে। তবু তাকে দেখলেই বােঝা যায়, চারপাশের পৃথিবীকে দেখবার ও বুঝবার মতাে চোখ আছে তা। সবাই তাকে ডাকতাে খেদের আলী বলে। তিনিও জানতেন, সেটাই তার সঠিকনাম। কিন্তু হঠাৎ একবার একজন শিক্ষিত লােক বললেন, “তােমার নামটা এভাবে নষ্ট করেছে কারা? আসলে তােমার নাম হবে কাদের আলী।” ব্যাস্, সেই থেকে তিনি হয়ে গেলেন কাদের আলী কাদের আলীর বাড়ি দেশের পশ্চিমাঞ্চলে কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর থানায় ছাতিয়ান নামে প্রত্যন্ত এক গ্রামে গরিব মা-বাবার সন্তান। ৮ ভাই ও ২ বােন তিনিই সবার বড বাবা উত্তরাধিকার সূত্রে মাত্র ৫/৬ বিঘা ফসলের জমির মালিক ছিলেন। এখন যেমন এই এলাকায় গঙ্গা কপােতাক্ষ সেচ প্রকল্পের সাহায্যে এই পরিমাণ জমিতেই একটা পরিবারের সারা বছরের খােরাক হয়ে যায়, বছর ৩০/৩৫ আগে কিন্তু তেমন ছিল না তখন ২০/৩০ বিঘা জমির মালিককেও কম-সে-কম অর্ধেক বছর কিনে খেতে হতাে যাই হােক, কাদের আলীর ছােট এক ভাই কোনাে এক শহরে ড্রাইভারের চাকরি করতেন বাকি সবাই ছিলেন গ্রামে এবং এক পরিবারভুক্ত নিজেদের লাঙল-গরু ছিল। বাবার সাথে ভাইয়েরাও মাঠে উদয়াস্ত চাষাবাদের কাজে পরিশ্রম করতেন। তাতে টেনেটুনে সংসার চলতাে ব্যবসায় বা অন্য কোনাে কাজের সাথে কোনাে সম্পর্ক ছিল না। বিশেষ দরকারে মাঝেমাঝে কুষ্টিয়া যাওয়া ছাড়া অন্য কোনাে শহর-নগরের সাথেও তেমন যােগাযােগ ছিল না। সবে এক বােনের বিয়ে হয়েছে কাদের আলী নিজেও বিয়ে করেছেন। এমন সময় দেশে শুরু হলাে মুক্তিযুদ্ধ ইউনিয়ন চেয়ারম্যান শাস্তি কমিটি গঠন করে তারও চেয়ারম্যান হলাে প্রত্যেক বাড়ি থেকে কমপক্ষে ১ জন রাজাকারে না দিলে সে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়ার হুমকি দিল। তাই আত্মীয়স্বজন সবাই চাপ দিতে লাগলাে রাজাকার হওয়ার জন্যে কিন্তু কাদের আলীর বাবার কথা ছিল, দরকার হলে তার ছেলে মুক্তিবাহিনীতে যাবে, কিন্তু কোনাে মতেই তাকে রাজাকার হতে দেবেন না।
মা-বাবা দুজনেই তাকে পালিয়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দিতে পরামর্শ দিলেন। এবার মা-বাবার উৎসাহ পেয়ে মনের সাহস বেড়ে গেল দ্বিগুণ তিনি সময় নষ্ট না করে স্ত্রীকে-বুঝিয়ে তার বাবার বাড়িতে রেখে বেরিয়ে পড়েন। পরে তাকে গ্রামে দেখতে না পেয়ে চেয়ারম্যান ও রাজাকাররা তার বাবাকে ভয়ভীতি দেখায় এবং নানারকম অত্যাচার করে। কাদের আলী সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের শিকারপুর ইয়ুথ ক্যাম্প গিয়ে ভর্তি হয়ে প্রথমে এক মাসের প্রশিক্ষণ নেন। তারপর তাকে পাঠানাে হয় শিলিগুড়ির কড়ইগাছি ক্যাম্পে ২১ দিন প্রশিক্ষণের পর যাচাই বাছাইতে টিকে যান। এবার তিনি যান বিহারের চাকুলিয়া ক্যাম্পে বিভিন্নরকম অস্ত্র-যেমন এলএমজি, এসএমজি, এসএলআর, বি বি গান, টমিগান চালনা ও মর্টার, গ্রেনেড ছোড়ার প্রশিক্ষণ নেন। সেখানে ১ মাস থাকার পর আবার তিনি ফিরে আসেন শিকারপুর এবার অ্যাকশন ক্যাম্প পরে ৮নং সেক্টরে অন্তর্ভুক্ত হয়ে ১১ জনের একটি দলের সাথে তিনি নিজেদের এলাকায় ঢােকেন দলের কমান্ডার ছিলেন মধুপুর গ্রামের ওসমান।
কুষ্টিয়া শহর থেকে ১০/১৫ মাইল দূরে বিত্তিপাড়া, কীর্তিনগর ও মধুপুর গ্রামের রাজাকার ক্যাম্পগুলাে আক্রমণ করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। সেই অনুযায়ী প্রথমেই বিত্তিপাড়া ক্যাম্প গ্রামের একটি পাকাবাড়িতে সেই ক্যাম্প পরিকল্পনামত কাদের আলী ও কিছু মুক্তিযােদ্ধা রাতের অন্ধকারে বাড়ির ছাদে উঠে। গিয়ে পজিশন নিয়ে ফেলেন সময়-সুযােগমত অপারেশনও শুরু হয়। কিন্তু রাজাকারদের অন্ত্রবলের সামনে টিকতে না পেরে তাদের পিছু হটতে হয়। ভারতে ফিরে গিয়ে আরাে অস্ত্র ও জনবল নিয়ে এসে পুনরায় আক্রমণ পরিচালনা করা হয় এবং তাতে সাফল্যও আসে। অনেক রাজাকার মারা পড়ে। অস্ত্রশস্ত্র তাদের হাতে আসে ঐ এলাকায় মকু ডাকাত নামে পরিচিত একজন ছিল রাজাকার কমান্ডার সে কিভাবে যেন মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে দলবল ফেলে শাড়ি পরে বউ সেজে ঘােড়ার গাড়িতে চড়ে ঝিনাইদহ রােড ধরে পালিয়ে যাচ্ছিল। কাদের আলীরা সেটা জানতে পেরে তার পিছু ধাওয়া করেন এবং ফজরের আজানের সময় তাকে পাকড়াও করতে সক্ষম হন। তাকে হত্যা করে একটা পায়খানার গর্তে ফেলে দেয়া হয়। এরপরেও কাদের আলী আরাে কয়েকটা অপারেশনে সাফল্যের সাথে অংশ নেন। স্বাধীনতার পর কাদের আলী নানারকম কাজকর্ম করে জীবন কাটিয়েছেন।
তবে বর্তমানে তেমন কিছু করেন না। সংসারে স্ত্রী, ২ ছেলে, ২ মেয়ে বড় ছেলেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়িয়েছিলেন। এখন সে ভ্যান চালায় ছােট ছেলে দিনমজুর। মেয়ে দুটিরই বিয়ে হয়েছে। তবে ছােটটি এখনাে তার সংসারেই থাকে এবং মিরপুর গার্লস কলেজে পড়ে কাদের আলী তখনকার কোনাে উঁচু মাপের মানুষের কথা স্মরণ করতে না পারলেও একটা পরিবারের কথা সারাজীবন মনে রেখেছেন। প্রথম অপারেশনে পর্যুদস্ত হয়ে তারা যখন পিছু হটতে বাধ্য হন তখন পাশের এক গ্রামের বাড়িতে দলবল নিয়ে ঢুকে পড়েন আশ্রয়ের আশায় মনে হাজার রকম শঙ্কা থাকলেও সেই পরিবারটি খুশিমনে সর্বতােভাবে তাদের সাহায্যসহযােগিতা করেন। এমনকি ছদ্মবেশে নৌকায় তাদের চাপাইগাছি বিল দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করতেও সাহায্য করেন। কাদের আলী কৃতজ্ঞতাভরে জানান, এসব মানুষকে কি ভােলা যায়। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভের পর কাদের আলী গ্রামে ফিরে এলে গ্রামের সব মানুষ এই বীর মুক্তিযােদ্ধাকে আনন্দের আতিশয্যে ‘ওরে আমার খেদের আলীরে!’ বলে জড়িয়ে ধরেন। এ-ও কি কম পাওয়া? এখনও এলাকার সবাই তাকে ভালাে চোখেই দেখেন। তাই তিনি তার যােগ্যতানুযায়ী মানসিকভাবে কিংবা অর্থনৈতিকভাবে মােটামুটি তৃপ্ত দেশের বর্তমান পরিস্থিতি দেখে তিনি মনে মনে কিছুটা হতাশ তার শুধুই মনে হয়, এই কি সেই সােনার বাংলার চেহারা যার জন্যে এত মানুষকে আত্মাহুতি দিতে হয়েছে?