কেস স্টাডি-৯ কৃষক মান্নান আলী
বর্তমান সুনামগঞ্জ জেলার দুয়ারা বাজার থানার অন্তর্গত। রইসপুর গ্রামে মান্নান আলীর বাড়ি। কৃষক পরিবারের সন্তান। পড়াশুনাে করেছিলেন মাত্র ক্লাস থ্রি পর্যন্ত বাবা আগেই মারা গিয়েছিলেন। সংসারে শুধু তারা ২ ভাই, ২ বােন আর মা। বড় বােনটির বিয়ে হয়েছিল। অল্প কিছু ফসলের যে জমি ছিল তা দুই ভাই নিজেরাই নিজের হাতে চাষাবাদ করতেন অঞ্চলটি পাহাড়ি। তাই ফসল ফলাতে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হতাে। তবু যাহােক কোনােরকমে সারা বছরের সংস্থান হয়ে যেত সেই সময় রাস্তাঘাট বা যােগাযােগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতার জন্যে সুদূর পল্লীর সাথে শহরাঞ্চলের তেমন বিশেষ জরুরি প্রয়ােজন ছাড়া কোনাে সম্পর্কই ছিল না। তেমনি ছিল অন্য কোনাে ব্যবসায় বা শিল্প-কারখানার সাথে মান্নান আলীদের সম্পর্ক গ্রামেই থাকা। আর চাষাবাদ নিয়ে নিরিবিলি জীবন কাটানাে। কিন্তু ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সেই শান্ত নিরিবিলি জীবনে আচমকা ছন্দপতন ঘটে। মান্নান আলীর বয়স তখন মাত্র ১৯ দেশের নিরীহ মানুষের ওপর বর্বর পাক মিলিটারি দস্যুদের অত্যাচার-নির্যাতন দেখে তার সেই সদ্য কৈশােরােত্তীর্ণ চোখে আগুন জ্বলে ওঠে নিজের জীবন দিয়ে হলেও শক্রর হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার পণ নিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। বাড়ি থেকে বেরিয়ে সােজা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের মেঘালয়ে প্রথম যান তিনি সেখানে একটা যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি হয়ে ১৯ দিন প্রশিক্ষণ নেবার পর তাকে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য মেঘালয় ইকো-১ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাঠানাে হয় এই কেন্দ্রে তিনি এসএলআর, এসএমজি, এলএমজি, রাইফেল, স্টেনগান চালনা ও গ্রেনেড ছোঁড়া শেখেন তারপর তিনি ৫নং সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বিভিন্ন গ্রুপের সাথে বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নেন ছাতক, হাদাটিলা, চাটিবর, চামারা ইত্যাদি স্থানে গেরিলা অপারেশন ছাড়াও পাকবাহিনীর সাথে কয়েকটি সম্মুখযুদ্ধও করেন তিনি।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই বীর মুক্তিযােদ্ধা বিজয়ের আগ মুহূর্তে ছাতকের নিকট ইসলামপুর মাটিভুর টিলায় শত্রুবাহিনীর পেতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে আহত হয়ে ডান পা হারান। বর্তমানে তিনি নকল পায়ের সাহায্যে চলাফেরা করেন। তিনি এখন মুক্তিযােদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের অধীনে ঢাকাস্থ মিরপুরে মুক্তিযােদ্ধা কমপ্লেক্সে চাকরিরত। সেই সাথে যৎসামান্য রাষ্ট্রীয় ভাতাও পান মুক্তিযােদ্ধা মান্নান আলী স্বাধীনতার পরে বিয়ে করে সংসার জীবন আরম্ভ করেন। তার ৩ মেয়ে ও ২ ছেলে দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে ডিগ্রিতে ফেল করে আর লেখাপড়া করে নি।
বর্তমানে সে ঢাকায় মােবাইল ফোনের দোকান দিয়েছে ছােট ছেলেমেয়ে দুটিকে নিয়ে তার স্ত্রী গ্রামের বাড়িতে থাকেন ছেলেমেয়ে দু’জনই গ্রামের স্কুলে লেখাপড়া করছে তাদের দেখাশােনার জন্যে মান্নানকে প্রায়ই ঢাকা থেকে ছােটাছুটি করতে হয় তখনকার দিনের মানুষের উদারতার প্রশ্ন উঠতে মান্নান আলী একরকম বিস্ময়ের চোখে তাকালেন তারপর বললেন, “কি জানি ভাই, আমারই বােধহয় দুর্ভাগ্য যে, পুরাে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমি তেমন সহৃদয় মানুষের দেখা পাই নি। বুঝতেই পারছেন, কী। প্রতিকূল পরিবেশে আমি বা আমার দল শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে সব ক’টা অপারেশন। চালিয়েছিল। দুঃখের সাথে আজ এ-ও বলতে হয়, হাতেগােনা এক আধজন বাদে অধিকাংশ লােক তখন আমাদের বিরুদ্ধাচরণ তাে বটেই, আরাে অনেক অনেক নিষ্ঠুর আচরণও করেছে। না হলে তাে শত্রু বাহিনী আরাে আগেই বিতাড়িত হতাে তাদের হাতে আমাদের এত এত মা বােনের ইজ্জত হারাতে হতাে না। ৩০ লাখ লােককেও শহীদ হতে হতাে না আমার এই অভিজ্ঞতার কথা শুনে হয়তাে অনেকে অবাক হবেন কিন্তু কেন যেন এটাই আমি সত্য বলে মনে করি।” এরপর মান্নান চাপা ক্ষোভের সাথে জানালেন, তাদের পাশের গ্রামের এক ইউনিয়ন চেয়ারম্যানকে সবাই ফকির চেয়ারম্যান বলে ডাকতাে, সমীহ করতাে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় সে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করে গ্রামের মানুষদের সে আজ একে কাল ওকে অযথাই রাজাকার-মিলিটারিদের হাতে ধরিয়ে দিতাে।
তার অত্যাচারে আশপাশের সব গ্রামের মানুষ অতিষ্ঠ ছিল। সে বাজারে বসলে কেউ যদি তাকে সালাম দিতাে তাহলে সে চিৎকার করে বলতাে, ফকির চেয়ারম্যান হাতে সালাম নেয় না, নেয় রাইফেলের মাথায় এইতাে হলাে উদারতার নমুনা যুদ্ধোত্তর জীবনে মুক্তিযােদ্ধাদের চাওয়া-পাওয়ার প্রশ্নে মান্নান আলীর অভিমত, কেউ তাে চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কষে মুক্তিযুদ্ধ করে নি। করেছিল মনের টানে তাই চাওয়া পাওয়ার ব্যাপার তখনও ছিল না, এখনও নেই তবে হ্যা, মুক্তিযােদ্ধাদের অনেকেই আজ পঙ্গু হয়ে আছেন। সমাজের পারিপার্শ্বিকতার জন্যে অনেকেই হয়তাে আর্থিক অনটনে জীবনযাপন করছেন। গৌরব, প্রশংসা বা সম্মান তাে দূরের কথা, সামান্য মূল্যায়নও হয়তাে অনেকের কপালে জোটে নি। তার জন্যে কারাে কারাে মনে ক্ষোভ জন্মাতে পারে। কিন্তু তাই বলে কোনাে কিছু চাইলেই তাে আর সহজে পাওয়া যায় না। দেশের ভবিষ্যতের কথা বলতে গিয়ে আবারও তিনি ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। জানালেন, আমলারা যে দেশের হর্তাকর্তা, ফকির চেয়ারম্যানের মতাে লােকেরা যে দেশ দাবড়ে বেড়ায় সে দেশের মঙ্গল কোনাে দিন হবে বলে বিশ্বাস করেন না তিনি ।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধ জনযুদ্ধ আর্থ সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত – আতিউর রহমান