You dont have javascript enabled! Please enable it!

কেস স্টাডি-৮ কৃষক সামছুর আলী মণ্ডল

‘কবাডি-কবাডি-কবাডি  পিলে চমকানাে দম লােকটার এক দমে আউড়ে চলেছে কবাডি, কবাডি ‘ আর  প্রতিপক্ষের সবাইকে ছুঁয়ে যাচ্ছে; কিন্তু কেউ তাকে ধরতে সাহস করছে না। ইনিই হচ্ছেন সামছুর আলী মণ্ডল যিনি মুক্তিযুদ্ধের অনেক আগে থেকেই যশাের ও তৎসংলগ্ন জেলা খুলনা এলাকায় দাপুটে একজন কাবাডি খেলােয়াড় হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিলেন। হরহামেশা এখান-সেখান থেকে তাকে ‘হায়ারে’ খেলতে নিয়ে যেত কাবাডি খেলে সামছুরের যে রােজগার হতাে তার ওপর তার পুরাে সংস্কারও কিয়দংশে নির্ভরশীল ছিল।  সংসারে ছিলেন মা, বাবা, ৫ ভাই, ২ বােন ও সদ্য বিয়ে করা নিজের স্ত্রী সামছুরই মা-বাবার বড় সন্তান লেখাপড়া করেছিলেন নবম শ্রেণী পর্যন্ত গ্রামের নাম রাঘবপুর, থানা শার্শা, জেলা যশাের। এই হলাে তার বাড়ির ঠিকানা বাবার ছিল একজোড়া বলদ গরু আর লাঙল-জোয়াল চাষাবাদের মাঠে লাঙল দিতেন চুক্তিতে কিংবা দিনমজুরিতে সামছুরও মাঝে মাঝে তার সাথে থাকতেন তবে সবকিছুর ওপরে কাবাডি খেলার প্রতিই তার ঝোঁক ছিল বেশি। সংসারের অসচ্ছলতা তাকে আটকাতে পারতাে না। অবশ্য খেলেও তিনি মন্দ আয় করতেন না। অভাবী সংসারে সে আয় ভালােই কাজে লাগতাে  তাছাড়া কাবাডি খেলে তিনি পেয়েছেন প্রভূত প্রশংসা পেয়েছেন অজস্র প্রশংসাপত্র ও মেডেল তাই বােধহয় খেলা ছাড়া অন্য কোনাে কাজ বা ব্যবসা কখনােই তার মাথায় খেলতাে না। ইচ্ছে করলে নিশ্চয়ই কিছু করতে পারতেন কারণ খেলার সুবাদে যশাের-খুলনা ছাড়াও নানা জায়গায় তার যাতায়াত ছিল, ছিল নামিদামি নানাজনের সাথে তার পরিচয় সামছুরের বয়স তখন চব্বিশ চারদিক থেকে খবর আসছে, দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন খেলাশেষে তিনি খুলনা থেকে ফিরছেন। স্থানীয় বাজার স্ট্যান্ডে বাস থেকে নেমে দেখেন এখানে-ওখানে লাশ। লাশের ওপর লাশ। ছড়িয়ে| ছিটিয়ে রাস্তায় আর বাজারের নানা জায়গায় পড়ে রয়েছে মানুষের লাশ। সামছুর এ দৃশ্য দেখে হতবিহ্বল  জীবনে কখনাে এমন দৃশ্য দেখেন নি। দু’একজন মানুষ যাদের চোখে পড়লাে তাদের কারাে মুখেই রা নেই। সবার চেহারা যেন কাগজের মতাে সাদা।

তবু সামছুর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিগ্যেস করে জানতে পারলেন, হানাদার পাক মিলিটারিরা গ্রামে ঢুকে এই হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে গেছে। ডাকসাইটে কাবাডি খেলােয়াড় সামছুর ঐ মুহূর্তেই | অগুনতি লাশের সামনে দাড়িয়ে মনে মনে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন এবং শপথ করলেন আগ্নেয়াস্ত্র চালনায় উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নিয়ে এই বর্বরতার প্রতিশােধ নেবেন। উত্তেজিত মনে তিনি বাড়ি পৌঁছালে তার স্ত্রী সব শুনে অবাক যার এক বেলার খােরাক কমপক্ষে দুই সের চালের ভাত, তিনি আজ এক লােকমা ভাতও মুখে দিতে পারলেন না। স্ত্রী ও অন্য সবাইকে আশ্বস্ত করে সেই রাতেই তিনি পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আরাে কয়েকজন বন্ধুর সাথে ভারত অভিমুখে রওনা হলেন। সামছুর প্রথমে ভারতের হাকিমপুর গিয়ে সেখানকার ইয়ুথ ক্যাম্পে ভর্তি হন। সেখানে কয়েকদিন থাকার পর তাদের নিয়ে যাওয়া হয় বিহার প্রদেশের কোনাে এক স্থানে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য সেখানে তাদের সবরকম হালকা ও ভারি অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণশেষে পুনরায় হাকিমপুর ক্যাম্পে ফিরে এলে তাকে ৮নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডারের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। তারপর কোম্পানি কমান্ডারের নেতৃত্বে তিনি খুলনা জেলার কলারােয়া ও বালিয়াডাঙ্গা অঞ্চলে বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নেন। অন্যত্র পাক মিলিটারির সাথে বেশ কয়েকটি সম্মুখযুদ্ধেও নির্ভিকচিতে অংশ নেন। এছাড়া মাদ্রা নামক এক স্থানে অপারেশনে গেলে তার কয়েকজন সহযােদ্ধা পাক আর্মির এ্যাম্বুশে আটকা পড়েন। তাদের উদ্ধারের জন্য তিনি একাই একটানা চারদিন যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। শেষে তার এলএমজির একটি মাত্র ব্রাশ ফায়ারে শক্রর জিপ বিধ্বস্ত হয়ে যায় এবং এক রেঞ্জার ক্যাপ্টেনসহ চার শত্রুসেনাকে তিনি একাই বন্দি করতে সক্ষম হন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এরপর অন্য একটি লােমহর্ষক যুদ্ধে অংশ নিতে গেলে বেকায়দায় পড়ে হানাদার বাহিনীর মর্টার শেলের আঘাতে এই অসম সাহসী মুক্তিসেনার সমস্ত শরীর গুরুতরভাবে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়। সহযােদ্ধারা তাকে অজ্ঞান অবস্থায় কোনােক্রমে ভারতের ব্যারাকপুর মিলিটারি হাসপাতালে স্থানান্তর করতে সক্ষম হন। সেখানে পরপর নয়টি অস্ত্রোপচার করা হয় তার শরীরে কয়েক মাসের চিকিৎসায় তিনি কিছুটা সুস্থ হন।

তাৎকালীন ভারতীয় মেজর এন জি গঙ্গোপাধ্যায় এই যুদ্ধাহত মুক্তিযােদ্ধাকে দেখতে এসে একটি মারফি রেডিও উপহার দেন। সেখানে তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় থাকতেই বাংলাদেশ হানাদার বাহিনীর হাত থেকে দখলমুক্ত হয় স্বাধীন দেশে ফেরার পরও যশাের ও ঢাকা মিলিটারি হাসপাতালে তাকে অনেকদিন থাকতে হয়। আরাে বেশ কয়েকটা অস্ত্রোপচার করতে হয় তার শরীরে। অবস্থা এমন হয়। যে, তার পুরনাে শখ কাবাডি খেলার কোর্টে আবার ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে যায় তিনি স্বাভাবিক চলাফেরার শক্তি হারিয়ে প্রায় পঙ্গু হয়ে পড়েন। দেশ স্বাধীন হলে সামছুর প্রথমবারের মতাে বাড়ি ফিরে এসে শুনলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ভারত চলে গেলে তার ছােট দুই বােনকে রাজাকাররা সেই যে বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল আজও তাদের কোনাে সন্ধান মেলে নি। পরেও কোনােদিন নয়  এ দুঃখ নিজের দুঃখের চাইতেও অনেক বড় হয়ে বাজে তার মনে  তবুও তিনি যখন সুস্থভাবে বেঁচে থাকার নানা অবলম্বন নিয়ে মশগুল তখনই হঠাৎ দুঃখজনকভাবে ১৯৯৭ সালে, এক স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। শরীরের এক অংশ অবশ হয়ে। পড়ে যার ফলে হুইল চেয়ারই হয়ে দাঁড়ায় তার একমাত্র বাহন।

এখন তিনি স্বাভাবিকভাবে  কথাও বলতে পারেন না। মুক্তিযােদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে যে ভাতা পান তা-ই এখন তার একমাত্র সহায় সামছুরের মা মারা গেছেন। বর্তমানে সংসারে আছেন তার বাবা, নিজের স্ত্রী, ছেলে ও ছেলের বউ এবং নাতি-নাতনি ছেলে সাতক্ষীরায় একটা সরকারি চাকরি করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় দখলদার বাহিনীর মর্টার শেলের আঘাতে যখন তার শরীর প্রায় ঝাঝরা এবং তিনি বেহুঁশ হয়ে মৃতপ্রায় তখন যেসব সহযােদ্ধা তাকে ফেলে রেখে চলে না গিয়ে তাকে উদ্ধার করে ভারতীয় ভূখণ্ডে ব্যারাকপুর মিলিটারি হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন তাদের কথা তিনি কোনােদিনই ভুলতে পারেন না। আহা, কত বড় আর মানবিক ছিল তাদের হৃদয়! শেষে তিনি দুঃখের সাথে জানালেন, দেশ স্বাধীন হয়েছে এদেশের মানুষ অনেকেই তরতর করে উন্নতি আর সুখের মুখ দেখেছেন। কিন্তু তিনি মানসিকভাবে খুব কষ্টে আছেন তার শুধুই মনে হয়, মুক্তিযােদ্ধা হিসেবে তার মতাে অনেকেই যেন আজ কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। অথচ তাদেরই তাে বেঁচে থাকার কথা ছিল সকলের চোখের সামনে গৌরবমণ্ডিত বীরের চেহারা নিয়ে। তাই দেশের ভবিষ্যতের কথা ভাবার চাইতে তিনি তার সন্তান ও পরবর্তী প্রজন্মের আপনজনদের মুখে হাসি ফোটানাের কথা ভাবতেই বেশি ভালােবাসেন।

সূত্রঃ  মুক্তিযুদ্ধ জনযুদ্ধ আর্থ সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত – আতিউর রহমান

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!