You dont have javascript enabled! Please enable it!

কেস স্টাডি-৭ শ্রমিক মােশারফ শেখ
তৎকালীন ফরিদপুর (বর্তমানে গােপালগঞ্জ) জেলার অন্তর্গত মােকসেদপুর থানার মনিরকান্দি গ্রাম মুক্তিযুদ্ধের সময় সেই গ্রামের ২০/২২ বছর বয়সের এক টগবগে যুবক মােশারফ শেখ মুক্তিযুদ্ধে কেন গিয়েছিলেন, কোথায় প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন, কোথায়। কোথায় যুদ্ধ করেছিলেন এসব কথা জানতে চাইলে আজও তিনি টগবগ করে কথা বলে চললেন। “জানেন, আমি খুব গরিব পরিবারের ছেলে মা-বাবার ৪ মেয়ে আর ৩ ছেলের মধ্যে আমি দ্বিতীয় সন্তান আমি, আমার বড় ভাই ও বােনেরা অভাবের জন্যে কেউ-ই লেখাপড়া শিখতে পারি নি। বাবা শীতের মৌসুমে গ্রামের মানুষের খেজুর গাছ কাটতেন অন্য সময় ক্ষেতে চাষাবাদের কাজ করতেন দিনমজুরিতে আমি আর আমার বড় ভাই মাঝে মাঝে তার সাথে এইসব কাজই করতাম। ছােট ভাইটা পাঠশালায় আসাযাওয়া করতাে তবে  সেই যে কী যেন বলে-শীতের দিনের গােধূলিবেলা দূরে মাঠের ধার ঘেঁষে ধোঁয়ার মতাে দেখতে হালকা হিমের চাদর ঠিক সেই সময় খেজুর গাছের মাথা ঝােড়া শেষ করে রসের কলসি পেতে বাবার পেছনে পেছনে বাড়ি ফিরছি বাবার কাঁধে জড়ানাে মােটা দড়ি আর পিঠে বাঁশের ডােলা যার মধ্যে রয়েছে গাছ কাটার অস্ত্র হেঁশাে আমরা হাঁটছি আর সাথে সাথে হাঁটছে আমাদের দু’জনের ছায়া। সেই অপূর্ব দৃশ্য আজও আমার মনে পড়ে।”
এই খেজুর গাছ কাটা আর মাঠের কাজ ছাড়াও একটা কাজ মােশারফ শেখ মুক্তিযুদ্ধের আগে মাঝে মধ্যে করতেন। রঙ মিস্ত্রির কাজ। ট্রাংক-সুটকেস হােক আর কাঠের দরজাজানালা হােক—সব ধরনের রঙের কাজ কাজটা কবে কিভাবে তিনি শিখেছিলেন তা আর আজ মনে নেই শুধু মনে পড়ে, বাবার ছিল দুই সংসার। সৎ মায়ের ঘরের এক বােন থাকতাে খুলনা শহরে। ভগ্নিপতি চাকরি করতেন সেখানকার ইস্টার্ন জুট মিলে মােশারফ মাঝে মাঝে সেখানে বেড়াতে যেতেন এবং রঙের কাজ করে কিছু উপার্জন-শেষে বাড়ি ফিরে আসতেন চুক্তি কিংবা দিনমজুরিতে উপার্জনটা হতাে। তার ধারণা, সেই অর্থে তিনি একই সাথে একজন কারিগর, দিনমজুর ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এই সুবাদে ঘনঘন না হলেও বছরে এক আধবার ঢাকাসহ দেশের অন্য দু’একটা বড় শহরেও তার যাতায়াত ছিল। মােশারফের নিজের গ্রাম মনিরকান্দির পাশেই বামনডাঙ্গা গ্রাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় বামনডাঙ্গা গ্রামটি সম্পূর্ণ রাজাকারের গ্রাম বলে পরিচিত ছিল সেই রাজাকাররা  মিলিটারিদের সাথে করে নিয়ে এসে আশপাশের গ্রামগুলােতে প্রায়ই লুটপাট করতাে আর যুবক পুরুষ ও যুবতী মহিলাদের ধরে ধরে নৌকায় তুলে খাল দিয়ে মিলিটারি ক্যাম্পে নিয়ে যেত রাজাকাররা দেখলে ধরে নিয়ে যেতে পারে এই আশঙ্কায় মােশারফকে তার মা-বাবা। সবসময় পালিয়ে থাকতে বলতেন কিন্তু মােশারফ তার নিজের চোখের সামনে রাজাকার ও মিলিটারিদের এইসব অনাচার-অত্যাচার দেখে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।  মুক্তিযােদ্ধা হিসেবে মােশারফ প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন দেশের ভেতরে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার অবস্থানও ছিল দেশের ভেতরেই। প্রথমে তিনি চলে যান কোটালিপাড়া থানার অন্তর্গত জহরের কান্দি হাই স্কুল মাঠে। সেখানে সেনাবাহিনী ত্যাগ করে চলে আসা। সেনাসদস্যরা গ্রামের যুবকদের অস্ত্র চালনা শিক্ষা দিতেন। তিনি তাদের কাছে থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল চালনা ও গ্রেনেড ছোড়া শেখেন।
তারপর হেমায়েত বাহিনীতে যােগ দিয়ে অন্যান্য অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নেন। জুলাই মাসের প্রথমদিকে হেমায়েতউদ্দিন বীর বিক্রমের নেতৃত্বে যেসব মুক্তিযােদ্ধার দিগনগর মিলিটারি ক্যাম্প আক্রমণ করে বহু পাকসেনাকে হতাহত করেন তাদের সাথে মােশারফ শেখও ছিলেন সেই ক্যাম্প থেকেই উদ্ধার করা হয় ৫/৬ জন নির্যাতিত বন্দি মেয়েকে। কাননবালা বণিক নামে এক হিন্দু তরুণীও ছিলেন তাদের মধ্যে মােশারফ শেখ আরাে যেসব অপারেশনে অংশ নেন তার মধ্যে মধুমতি নদীতে। পাকসেনাদের জাহাজ আক্রমণ ও টেকেরহাট ফেরিঘাট আক্রমণ অন্যতম। প্রথম অপারেশনে ২৬ জন পাকসেনা মারা যায় এবং মুক্তিযােদ্ধারা তিনটি গম ও চাউল বােঝাই বার্জ দখল করে নেন। সেই অপারেশনে শক্রর গুলির আঘাতে তার বাম হাতের একটি আঙুল উড়ে যায় দ্বিতীয় সফল অপারেশনেও উল্লেখযোেগ্যসংখ্যক পাকসেনা ও রাজাকার খতম হয় এবং বেশকিছু রাজাকারকে বন্দিও করা হয় স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময়ের আরাে কিছু কথা জানালেন। তিনি একবার ঠিক করেছিলেন, শাহেদ মল্লিক নামে তার এক মামার বাড়ি গিয়ে ৪/৫ জন সহযােদ্ধাসহ পেট পুরে ভালাে খাবার খাবেন। মামাও খবর পেয়ে সানন্দে রাজি হয়ে হাটবাজার করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেই গােপন কথা কিভাবে যেন রাজাকারদের কাছে ফাঁস হয়ে যায়। বাজার থেকেই শাহেদ মল্লিককে রাজাকার-মিলিটারিরা তুলে নিয়ে যায়। এবং বিলের মধ্যে তাকে চোখ বেঁধে গুলি করে মারে এছাড়া দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি যখন বীরাঙ্গনা মুক্তিযােদ্ধা কাননবালা বণিককে (নাজমা বেগম) বিয়ে করেন তখন তার মা-বাবা তাকে ত্যাগ করেন। এসব স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগে মােশারফ শেখের গলা ভিজে আসে মােশারফ শেখ বর্তমানে স্ত্রী নাজমা বেগম, ৩ ছেলে ও ১ মেয়ে নিয়ে মিরপুর ১০নং সেকশনের নিকটবর্তী মিল্কভিটা বস্তিতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। প্রায়ই অসুস্থ থাকেন। যখন সম্ভব হয় তখন চুড়ি-লেস-ফিতা ফেরি করে বিক্রি করে বেড়ান বড় ছেলেটা টেম্পাের হেলপার হিসেবে কাজ করে। সংসারে আয়ের উৎস বলতে শুধু এই। অনেক ঘােরাঘুরি করেও আজ অবধি মুক্তিযােদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে কোনােরকম ভাতা।

সংগ্রহের ব্যবস্থা করতে পারেন নি। তবু তিনি খুশি, অনেক কষ্ট হলেও মেয়েটাকে একটু লেখাপড়া করাতে পারছেন। সামনের বার সে এসএসসি পরীক্ষা দেবে। মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে বাংলাদেশের মানুষ যে কত বদলে গেছে তা নিয়েও তিনি। আক্ষেপ করলেন। এখন মানুষ খুবই স্বার্থপর। কিন্তু তখন মানুষের মধ্যে একটা বড় অন্তর’ ছিল। উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একটা ঘটনা উল্লেখ করলেন একদিন সন্ধ্যার সময় তিনি কয়েক সহযােদ্ধাসহ এক খালে নৌকার মধ্যে লুকিয়ে ছিলেন। খাল পাড়ের অদূরে বিরাট এক বাড়ি কিন্তু নীরব-নিস্তব্ধ বাড়িতে লােকজন আছে কি নেই বােঝা যাচ্ছিল না। খাবারের সন্ধানে তিনি সবাইকে নিয়ে সাহস করে বাড়ির উঠোনে। গিয়ে দাঁড়াতেই দেখেন, অত বড় বাড়িতে শুধু দু’জন বয়স্ক মহিলা। মহিলা দু’জন তাদের রাজাকার ভেবে ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু পরে পরিচয় পেয়ে খুশি হলেন। জানালেন, বাড়ির সব পুরুষ ও মহিলারা রাজাকার-মিলিটারির উৎপাতে অন্যত্র পালিয়ে আছে তারা দু’জন এখন বাড়িতে এসেছেন শুধু সকলের জন্যে রান্না করে নিয়ে যেতে সেই দুঃসময়েও তারা মুক্তিযােদ্ধাদের ক্ষুধার্ত জেনে তাড়াতাড়ি নারকেল আর গুড়-মুড়ি দিয়ে আপ্যায়ন করতে দ্বিধা করেন নি। পরে রান্না শেষ হলে সেই রাত্রে সবাইকে পেট পুরে ভাত খাইয়েও ছেড়েছিলেন এমন মনের মানুষ কি এখন সহজে পাওয়া যাবে? এখন কারাে মনে আর সেই সহানুভূতি নেই। মােশারফ শেখ সেদিন জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। অথচ পরে। তিনি কোনােদিন সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার মতাে কিছুই পান নি। তবুও তার অহঙ্কার, দেশের স্বাধীনতা আনয়নে তার মতাে নগণ্য মানুষেরও অংশগ্রহণ বা ছােটখাটো অবদান। ছিল। পরক্ষণেই তিনি আক্ষেপের সাথে একটা ছােট্ট দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, দেশ আজ স্বাধীন দেশের মানুষও স্বাধীন কিন্তু দেশের ভালাে ভবিষ্যৎ বলে তাে কিছু দেখি না। 

সূত্রঃ  মুক্তিযুদ্ধ জনযুদ্ধ আর্থ সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত – আতিউর রহমান

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!