You dont have javascript enabled! Please enable it! হাজী মাে. মহিউদ্দিন -কেস স্টাডি-৬ মধ্যবিত্ত - সংগ্রামের নোটবুক

কেস স্টাডি-৬ মধ্যবিত্ত হাজী মাে. মহিউদ্দিন
মহিউদ্দিনের বাবা ছিলেন গ্রামের মসজিদের ইমাম আর তারা ছিলেন ৫ ভাই, ৩ বােন এক বােন সবার বড় মুক্তিযুদ্ধের বছরে মহিউদ্দিন আই.এ. পরীক্ষার্থী ছিলেন। এক ভাই ব্যবসা করতেন। এক ভাই ঘর-সংসার দেখাশােনা করতেন। বাকি ২ ভাই ছিল স্কুল ছাত্র। বােনেরা সবাই প্রাইমারি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছিলেন এবং সবারই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। বাড়ি কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর থানার অন্তর্গত গােপালপুর গ্রামে ফসলের জমাজমি থাকায় তা  চাষাবাদের জন্য বাড়িতে রাখাল, গরু, লাঙল সবই ছিল। পরিবারের আর্থিক অবস্থা  সচ্ছলই ছিল। তেমন জরুরি প্রয়ােজন ছাড়া শহরের সাথে যােগাযােগ খুব কমই ছিল। কোনােরকম রাজনীতির সাথে মহিউদ্দিন আদৌ জড়িত ছিলেন না। তবু বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ১৮/১৯ বছর বয়সী মহিউদ্দিনের রক্ত টগবগিয়ে ওঠে। দেশ স্বাধীন করার। অনুপ্রেরণায় বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেন। এর জন্যে খেসারতও দিতে হয়েছে। বাবা ও এক ভাইকে রাজাকার-মিলিশিয়ারা আটক করে ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে। অনেক নির্যাতন করেছিল। 
প্রথমে তিনি ভারতে গিয়ে নদীয়া জেলার শিকারপুর ইয়ুথ ক্যাম্পে ভর্তি হন যাচাই বাছাইতে টিকে গেলে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য তাকে পাঠানাে হয় বীরভূম জেলার রামপুরহাট। সেখানে তিন মাসের প্রশিক্ষণে তিনি এলএমজি, এসএমজি, এসএলআর, থ্রি নট থ্রি রাইফেল চালনা ও মর্টার, রকেট লাঞ্চার, গ্রেনেড ছোঁড়াসহ ডিনামাইট বিস্ফোরণ ঘটানাের কলাকৌশল শেখেন। এই প্রশিক্ষণশেষে আবার শিকারপুর ফিরে এলে তাকে ৮নং সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত করা হয় তারপর প্রতিবেশী গ্রাম পাহাড়পুরের মুক্তিযােদ্ধা আফতাবউদ্দিনের নেতৃত্বে ২২/২৩ জনের একটি দলের সাথে তিনি দেশের ভেতরে নিজের এলাকায় ঢােকেন গেরিলা যুদ্ধের জন্যে তিনি যেসব অপারেশনে অংশ নিয়েছেন তার মধ্যে শেরপুর গ্রামে পাক আর্মির সাথে যুদ্ধের কথা তার বেশি করে মনে পড়ে। কারণ এই যুদ্ধে তাদের উপস্থিত বুদ্ধি ও সাহস। যেমন জয় এনে দিয়েছিল তেমনি অভিজ্ঞতাটি ছিল ভয়ানক উত্তেজনাময় ও শ্বাসরুদ্ধকর। শীতের রাতে কেবল তারা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে গ্রামের কয়েকটি বাড়িতে আশ্রয়। 
নিয়েছেন। এমন সময় মাঝ রাতের দিকে আচমকা খবর এলাে, গ্রামে মুক্তির অবস্থান টের পেয়ে পাক আর্মি ঢুকে পড়েছে এবং বাড়িঘর জ্বালানাে-পােড়ানাে শুরু করেছে। মুক্তিযােদ্ধারা তাদের মােকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ক্ষিপ্রতার সাথে একটা পুকুর পাড়ের ঢালে অস্ত্র হাতে পজিশন নিয়ে ফেলেন। একটু পর শত্রুবাহিনীও এসে পুকুরের অপর পাড়ে দাড়িয়ে যায়। শুরু হয় উভয় পক্ষের ফায়ারিং। এই ক্রস ফায়ারিয়ে শক্রদের একজন মারা পড়ার সাথে সাথে কেন যেন ওরা মনােবল হারিয়ে হঠাৎ পিছু হটতে থাকে। কিন্তু ততক্ষণে কুরিয়ার মারফত খবর পেয়ে আরাে একটি মুক্তিযােদ্ধা দল সেখানে পৌঁছে যায় । মুক্তিযােদ্ধা ও গ্রামবাসীরা সবাই একত্রে চারদিক থেকে শত্রুবাহিনীকে ঘিরে ফেলেন। সকালের আলাে ফুটতে না ফুটতে শত্রুবাহিনীর সবাই মারা পড়ে ও বিপুল অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার হয়। তবে এই অপারেশনে মহিউদ্দিন গুরুতরভাবে আহত হন মুক্তিযুদ্ধের সময় মহিউদ্দিনের ছােট ভগ্নিপতি মিলিটারিদের হাতে মারা যান তিনিও মুক্তিযােদ্ধা ছিলেন মহিউদ্দিন স্বাধীনতার পর বি.এ. পাস করে সরকারি চাকরিতে ঢােকেন। এখনাে তিনি সেই চাকরিতেই আছেন, থানা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক হিসেবেচাকরিতে | ঢােকার পর তিনি বিয়ে করেন। স্ত্রী একই অফিসে চাকরি করেন কয়েক বছর আগে তিনি হজ করেছেন। বর্তমানে তার সংসারে আছেন মা, স্ত্রী, ৩ ছেলে ও ১ মেয়ে। এক ছেলে এম,এ, পাস করে চাকরির সন্ধানে ঘুরছে।
বাকি ২ ছেলে একই সাথে কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে এম.এ. পড়ছে মেয়েটি ছােট স্কুলে ৫ম শ্রেণীতে পড়ে মহিউদ্দিনের মতে, মুক্তিযুদ্ধের সময় সব মানুষই কমবেশি উদারতার পরিচয় দিয়েছিলেন। রাজাকার-মিলিটারিরা কোথায় আছে, কখন কোন্ পথে যাতায়াত করে সেসব খবরাখবর গ্রামের লােকেরা মুক্তিবাহিনীর কাছে আগাম এনে দিতেন যার বাড়ি দুইবেলা ঠিকমতাে খাবার জোটে না তিনিও অনেককে আশ্রয় দিয়েছেন। নিজে না খেয়ে অন্যকে খাইয়েছেন; কিন্তু সেদিন আজ আর নেই। মহিউদ্দিন আরাে জানালেন, যে উদ্দেশ্য বা চেতনার দ্বারা দেশ স্বাধীন হয়েছিল তার সবই ধীরে ধীরে সন্ত্রাস আর দুর্নীতির পঙ্কিলতায় ডুবে গেছে তাতে করে মানুষ সত্যিকারভাবে স্বাধীনতার সুফল ভােগ করা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এখনও চোখের সামনে কত তাজা রক্ত ঝরছে। এসব দেখেশুনে তিনি ব্যক্তিগতভাবে খুবই উত্তষ্ঠিত ও বিমর্ষ সারা পৃথিবী বাংলাদেশকে স্বীকার করে নিয়েছে। আজ সবাই বাংলাদেশকে চেনে-জানে। সেই অর্থে দেশের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত সম্ভাবনাময় বলে মনে করেন মহিউদ্দিন। কিন্তু কতটা তার হিসেব কষা তার পক্ষে কঠিন।

সূত্রঃ  মুক্তিযুদ্ধ জনযুদ্ধ আর্থ সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত – আতিউর রহমান