কেস স্টাডি-৫ মধ্যবিত্ত (ছাত্র) নজরুল করিম মুক্তিযুদ্ধের বছরে নজরুল করিম আই.এ. পরীক্ষার্থী ছিলেন। পড়তেন কুষ্টিয়া শহরে থেকে কুষ্টিয়া কলেজে বাড়ি খন্দকবাড়িয়া গ্রামে। থানা মিরপুর, জেলা কুষ্টিয়া। বয়স ছিল ১৮/১৯ বছর। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি অর্থনীতিতে বি.এ. অনার্স করেছেন। তখন বাড়িতে ছিলেন মা, বাবা, আরাে ৪ ভাই ও ২ বােন বােনেরাই বড় তাদের বিয়েও হয়ে গিয়েছিল বাবা আড়তদারি ব্যবসা করতেন। মেজো ভাইটা তার সাথে সেই ব্যবসাতেই ছিলেন বড় ভাই করতেন নিজস্ব ঠিকাদারি। ছােট দুই ভাই ছিলেন স্কুল ছাত্র। পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা সচ্ছলই ছিল। নিজেদের ধানি জমি ছিল। ছিল নিজেদেরই গরু, লাঙল, রাখাল নিজেদের তত্ত্বাবধানে রাখাল দিয়ে চাষাবাদের কাজ করানাে হতাে। আরাে ছিল মিরপুর বাজারে তেল, চাল ও আটার মিল। লেখাপড়া বা ব্যবসায়ের সুবাদে শহরের সাথে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রাখতেই হতাে। কলেজ ছাত্র নজরুল ছাত্রলীগ করতেন। সেই সূত্রে ছাত্র রাজনীতির সাথে ওতপ্রােতভাবে জড়িয়ে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে ‘৭১-এর মার্চে অসহযােগ আন্দোলনের সময় মিরপুর থানা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। পরে পাক হানাদার বাহিনীর কাছে যখন এলাকার পতন ঘটে তখন দেশ স্বাধীন করার অভিপ্রায়ে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। নজরুল করিমের ইতােপূর্বে সিভিল ডিফেন্সের প্রশিক্ষণ নেয়া ছিল। তাই তিনি ভারতে যাওয়ার পর জমশেদপুর ক্যাম্পে প্রশিক্ষক হিসেবে যােগ দেন। প্রধান উদ্দেশ্য ছিল অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধাদের যুদ্ধের অনুকূলে রাজনৈতিকভাবে উদ্বুদ্ধ করা। আর কখনাে ভারতে না ঢুকে কিংবা অন্য কারাে মুখাপেক্ষী না হয়ে দেশের ভেতরে যুদ্ধ করে শত্রুপক্ষের কাছ থেকে উদ্ধার করা অস্ত্র দিয়েই যাতে প্রয়ােজন হলে শত বছরও যুদ্ধ চালানাে যায় তেমন মনমানসিকতা তৈরি বা সচেতনতা সৃষ্টি করা।
এরপর অবশ্য তিনি আগ্নেয়াস্ত্র চালনায় উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ভারতের উত্তর প্রদেশস্থ দেরাদুনে যান। সেখানে তিনি পিস্তল থেকে শুরু করে এসএলআর, এসএমজি, এলইমজি, স্টেনগান চালনা ও ৩ ইঞ্চি মর্টার, গ্রেনেড ছোঁড়া ইত্যাদি শিক্ষাগ্রহণ-শেষে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে ফিরে আসেন। তার দলের তিনিই ছিলেন কমান্ডার যেসব অপারেশন তিনি সফলভাবে সম্পন্ন করেন তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পােড়াদহের নিকট দোস্তপুর ব্রিজ আক্রমণ। তখন এটি ছিল পােড়াদহ-কুষ্টিয়া রেল সড়কের গুরুত্বপূর্ণ ব্রিজ এবং তা কখনাে রাজাকার-মিলিশিয়া, আবার কখনাে মিলিটারির পাহারায় থাকতাে। সবাই আশ্রয় নিলেন পার্শ্ববর্তী গ্রাম বারুইপাড়ায়। ঠিক হলাে, অপারেশনের সময় তাদের সাথে আরেকটি মুক্তিযােদ্ধা দল যােগ দেবে টুকিটাকি পরিকল্পনামতাে ব্রিজ ও আশপাশের জায়গা এবং দলের সবাই বিভক্ত হয়ে কে কোথায় পজিশন নেবেন তার সবকিছুই আগে রেডি করে আসা হয়েছিল। অপারেশনের রাতটি চাদনি রাত হওয়াতে বােধহয় সুবিধাই হয়েছিল। অকুস্থলে পৌঁছে জানতে পারা গেল, সেদিন রাতে ১৯ জন মিলিশিয়া ও বিহারি রাজাকার ব্রিজ পাহারায় আছে সিদ্ধান্ত হলাে, সব প্রস্তুতির পর একজন আকাশের দিকে টর্চের আলাে ফেলে সিগনাল দেবে আর তার সাথে সাথে অন্যেরা ফায়ারিং শুরু করবে হলােও তাই একেবারে সফল অপারেশন। দু’জন রাজাকার ছাড়া শত্রুপক্ষের সবাই মারা পড়লাে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র দখলে এলাে মুক্তিযােদ্ধারা বিজয়ের আনন্দে মাতােয়ারা হয়ে উঠলাে। শৃঙ্খল ছিড়ে মুক্তির আনন্দে যেন তাদের সীমাহীন উল্লাস নজরুল করিম একটা মজার অভিজ্ঞতার কথা বললেন। আরেকটি কারণে এই অপারেশন তার কাছে স্মরণীয় ধরা পড়া রাজাকার দু’জনের বয়স খুব অল্প দেখে।
নজরুলের মায়া লাগে তিনি তাদের শুদ্ধির প্রচেষ্টায় কোনাে ক্ষতি না করে সাথে নিয়ে চললেন। আশ্রয়স্থলে পৌঁছে দু’জনকে খাইয়ে-দাইয়ে শীতের কাপড় পরিয়ে শুইয়ে রাখলেন। কিন্তু ভােরে দেখা গেল, নিজেদের অসাবধানতার জন্যেই হয়তাে কোন্ ফাকে তারা পালিয়েছে নজরুলের বুঝতে বাকি রইলাে না, এরপর শুরু হবে পাক মিলিটারির প্রতিশােধ গ্রহণের পালা। তাই তিনি দলবল নিয়ে দ্রুত সেখান থেকে সরে পড়লেন। পরে জানা গিয়েছিল, পরদিন সকালেই মিলিটারি এসে পুরাে গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। নজরুল করিম বর্তমানে মিরপুর বাজারে ওষুধের দোকান দিয়েছেন।
সংসারে আছেন মা, বাবা, ভাই, স্ত্রী ও ২ মেয়ে। বাবা এখন বৃদ্ধ কিছু করেন না। ভাইয়েরা অন্য ব্যবসা করেন। বড় মেয়েটি গ্র্যাজুয়েশন করে ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। ছােট মেয়ে কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে অর্থনীতিতে অনার্স পড়ছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের যেসব মানুষ বা ঘটনার কথা নজরুল করিমের স্মৃতিতে আজও জ্বলজ্বল। করে ভাসে তার মধ্যে তিনি দুটো ঘটনার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করলেন। ভারতে প্রশিক্ষণশেষে তিনি ১০-১২ জনের একটি দল নিয়ে দেশের ভেতর ঢুকে কালিদাসপুর গ্রামে এক দরিদ্র দিনমজুরের বাড়িতে আশ্রয় নেন। তার পরদিন ছিল ঈদ। সেই মজুরের মা বুড়ি মহিলা সবরকম ভয়-ভীতি ত্যাগ করে মায়ের স্নেহ দিয়ে অকৃপণভাবে তাদের আপ্যায়ন করেন। আরেকবার চুনিয়াপাড়া নামক এক গ্রামের ধারে মেইন রােডে একটা অপারেশন করার পরিকল্পনা নিয়ে এসে রাস্তার অদূরে এক বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়। শােয়ার জায়গার অপ্রতুলতার জন্যে বাড়ির একমাত্র ঘরটি তাদের ছেড়ে দিয়ে সেই বাড়ির গৃহিণী তার ৬/৭ দিনের শিশু সন্তানসহ রান্নাঘরে শুয়ে সেদিন সারা রাত কাটান। এসব স্মৃতি আজও নজরুলকে তাড়িয়ে বেড়ায় নজরুলের ধারণা, যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতৃত্ব সবসময়ই নানাভাবে দেশের উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলেছে তাই তিনি মনে করেন, মানসিকভাবে স্বাধীন হলেও অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে দেশের সাধারণ মানুষ একটা বেড়াজালের মধ্যে প্রতিনিয়ত ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার ক্ষেত্রে নজরুল করিম এখনাে আশাবাদী। তবে সম্ভাবনাময় করে তুলতে হলে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে অবশ্যই কলুষমুক্ত হতে হবে বলে তিনি মনে করেন।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধ জনযুদ্ধ আর্থ সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত – আতিউর রহমান