কেস স্টাডি-৪ মধ্যবিত্ত (শিক্ষক) খলিল আহমেদ মুক্তিযােদ্ধা খলিল আহমেদের নিবাস কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর থানার অন্তর্গত কুরিপােল গ্রামে। সম্পন্ন ও শিক্ষিত পরিবারের মানুষ বাবা ব্রিটিশ আমলের গ্র্যাজুয়েট এবং সেই ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত তিনি একাউন্টেন্ট জেনারেলের অফিসে এ্যাকাউন্টস অফিসার হিসেবে সরকারি চাকরি করেছেন। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এই দ্রলােক একই সাথে ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ ও সুফি মানুষ কুষ্টিয়া-পাবনা অঞ্চলে ‘পীরসাহেব’ বলে তার ব্যাপক পরিচিতি ও খ্যাতি ছিল। ছিল অসংখ্য মুরিদ। এহেন পিতার সন্তান খলিল আহমেদ ম্যাট্রিক পাসের পর প্রথম জীবনে এটা সেটা করে শেষে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। সংসারে বাবা-মা ছাড়া ছিল আরাে ৪ ভাই এবং ৪ বােন তিনি তখন নিজেও ৩ ছেলে ও ১ মেয়ের পিতা বয়স ততদিনে পৌঁছে গেছে। ৩২/৩৩-এর কোঠায় বড় ভাই একজন নামকরা চিত্রশিল্পী ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একটা বিজ্ঞাপনী সংস্থায় চাকরির সুবাদে করাচি থাকতেন অন্য ভাইয়েরা করতেন লেখাপড়া বােনদের মধ্যে বড়টির বিয়ে হয়েছিল। আর নিজের অল্প বয়সী সন্তানেরা কেউ হয়তাে স্কুলে পড়তাে, কারাে আবার স্কুলে যাওয়ার বয়সই হয় নি তখনাে বিরাট পরিবার, তবুও একান্নবর্তী। ছিল অনেক কৃষি জমি সবই বর্গাচাষ হতাে খলিল আহমেদ গর্বের সাথে স্বীকার করেন, বঙ্গবন্ধু এবং একমাত্র বঙ্গবন্ধুর ডাকেই তিনি বিদ্রোহী হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। ফলশ্রুতিতে শত্রুর হাত থেকে বাংলা মাকে মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
নানা রকম আগ্নেয়াস্ত্র চালনা তার আগেই শেখা ছি। কারণ তিনি ষাট দশকে মুজাহিদ বাহিনীতে ছিলেন। তাছাড়া তিনি ছিলেন স্থানীয় থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কাজেই ‘৭১-এর মার্চে অসহযােগ আন্দোলনের সময় তারই উদ্যোগে থানা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ২৫ মার্চের পর পাক মিলিটারির দখলে চলে যাওয়া কুষ্টিয়া শহর উদ্ধারের জন্য যে যুদ্ধ হয় খলিল আহমেদ তাতে অংশ নেন। ৩১ মার্চ কুষ্টিয়া পুলিশ লাইনে অবস্থানরত পাক মিলিটারির সাথে মুক্তিবাহিনীর তুমুল যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে দেড়শাে মতাে মিলিটারি মারা পড়ে এবং কুষ্টিয়া শহর তাদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়। ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত কুষ্টিয়া মুক্তই ছিল। তারপর পাক মিলিটারি আবার আক্রমণ করলে উপযুক্ত অস্ত্র ও জনবলের অভাবে বিদ্রোহীরা প্রতিরােধ শক্তি হারিয়ে ফেলেন। তখন অন্যদের সাথে খলিল আহমেদও ভারতে চলে যান। প্রথমদিকে তিনি নদীয়া জেলার করিমপুর ইয়ুথ ক্যাম্পে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। তারপর দেশের ভেতর গেরিলা যুদ্ধের জন্যে আফতাবউদ্দিন খানের নেতৃত্বে যে কোম্পানি গঠিত হয় তিনি সেই কোম্পানির অন্তর্ভুক্ত হয়ে দেশের ভিতরে ঢােকেন। যেসব অপারেশনে তিনি অংশ নেন তার মধ্যে উল্লেখযােগ্য হচ্ছে মিরপুর থানার কাকিলাদহ এবং দৌলতপুর থানার ধর্মদহ ও শেরপুর গ্রামে রাজাকার- আর্মির সাথে সম্মুখযুদ্ধ সব ক’টা অপারেশনই সফল হয়। প্রচুর শত্রু সেনা হতাহত হয়। তবে দু’চারজন মুক্তিযােদ্ধার সাথে তিনি নিজেও আহত হন।
মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে মিরপুর থানা মুক্ত করার জন্যে যে আক্রমণ পরিচালিত হয় তাতে তিনি নিজেই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। খলিল আহমেদ বর্তমানে অবসর জীবনযাপন করছেন। ২ ছেলে ও একমাত্র মেয়েটির বিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলে সংসার দেখাশােনা করে। আরেক ছেলে ঢাকায় একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। ছােট ছেলে বেকার মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের ভেতরে-বাইরে অনেকেই অকৃপণভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন বলে তিনি মনে করেন। পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু সম্প্রদায় সবরকম জাতিগত ও ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে অনেক মুসলমানদের নিজেদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন ও খাইয়েছেন। তাই বিশেষভাবে এক আধজনের কথা উল্লেখ করা কঠিন বলে তিনি জানান খলিল আহমেদ নিজের আর্থ-সামাজিক স্বাধীনতার কথা নিয়ে কখনাে ভাবেন নি, এখনাে ভাবেন না। তার নিজের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যই তাকে হয়তাে এ ব্যাপারে কিছুটা স্বতন্ত্র থাকতে সাহায্য করেছে। তার মতে, বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কিংবা বিপুল সম্ভাবনা অবশ্যই ছিল। কিন্তু তা নােংরা রাজনীতির কাছে চিরকাল মার খাচ্ছে। তাই রাজনৈতিক মুক্তি জিনিসটা শুধু বইয়ের মলাটের মতােই মনে হচ্ছে ভেতরে ভেতরে ব্যক্তিস্বাধীনতা বা মানবাধিকার প্রায় প্রতিপদে হোঁচট খাচ্ছে। এতে করে আর্থ-সামাজিক মুক্তি অর্জনও বােধহয় সহসা সম্ভব নয়।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধ জনযুদ্ধ আর্থ সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত – আতিউর রহমান