You dont have javascript enabled! Please enable it!

কেস স্টাডি-৩ মধ্যবিত্ত (ছাত্র) শাহ রশিদুল হাসান ফরহাদ শাহ রশিদুল হাসান ফরহাদ তখন ঢাকার জগন্নাথ কলেজে আই.কম, ১ম বর্ষের ছাত্র। বয়স ১৬/১৭। ছাত্র রাজনীতির সাথে পরােক্ষভাবে কিছুটা সম্পৃক্ততা থাকলেও তা নিয়ে বেশি মাথা ঘামাতেন না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ তাকে নতুন করে ভাবতে শুরু করে এবং সাথে সাথে অসহযােগের সেই উত্তাল দিনগুলাে ধীরে ধীরে তার মনের মধ্যে নিজের অজান্তেই রাজনীতির একটা বীজ অঙ্কুরিত হতে সাহায্য করে। তবে সেটা নিছকই দেশ বিষয়ক রাজনীতি না অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই তা তিনি ঠিক সেই মুহূর্তে অনুধাবন করতে পারেন নি। করেছিলেন তারও কিছু দিন বাদে ফরহাদরা ছিলেন দুই ভাই, দুই বােন। তিনি মা-বাবার দ্বিতীয় সন্তান ছােট ভাই ছিলেন সেই সময় ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী বড় বােন ইডেন কলেজে ডিগ্রির, আর ছােট বােন। সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী ছিলেন। বাবা চাকরি করতেন ঢাকা পৌরসভায় উর্ধ্বতন অফিসার হিসেবে থাকতেন পরিবার নিয়ে গেন্ডারিয়ায়। কিন্তু ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে পাক মিলিটারি নিরীহ বাঙালি জাতিকে আক্রমণ করে বসলে তিনি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে পুরাে পরিবার নিয়ে বগুড়া জেলায় সারিয়াকান্দি থানার অন্তর্গত আদবাড়িয়া গ্রামে নিজের বাড়িতে চলে যান অথচ মুক্তিযুদ্ধের আগে বছরে দুই ঈদ আর বিশেষ কোনাে উপলক্ষে বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া ছাড়া গ্রামের সাথে নিবিড় তেমন কোনাে সম্পর্কই ছিল না পরিবারের কারাে।
সবারই ছিল নাগরিক জীবন এবং আর্থিকভাবেও পরিবারটি ছিল সচ্ছল। গ্রামে অনেক ফসলের জমি ছিল। তবে সেসব চাষীর কাছে বর্গা দেয়া থাকতাে কৃষির সাথে সম্পর্ক শুধু এইটুকুই ফরহাদ নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেন এই জন্যে যে, ২৫ মার্চ কালরাত্রির পরদিন সকালে গেন্ডারিয়ার বাসা থেকে লুকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভিক্টোরিয়া পার্ক (বাহাদুর শাহ পার্ক), সদরঘাট আর নবাবপুরের মতাে ঢাকা শহরের কয়েকটি বিভীষিকাময় স্থান ঘুরে দেখার সুযােগ পেয়েছিলেন বাড়িতে, রাস্তায়, নালায়, রিকশা বা ঠেলাগাড়ির উপরে অগুণতি হতভাগ্য মানুষের লাশ পড়েছিল। ঢাকা শহর ছেড়ে তিনি মা, বাবা, ভাইবােনের সাথে গ্রামের বাড়ি গিয়ে পৌঁছলেন বটে; কিন্তু পরিবার বা জগৎ-সংসার থেকে তার মন হয়ে গেল বিচ্ছিন্ন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, তার  ডাকে অসহযােগ আন্দোলন এবং শেষে পাক আর্মির ক্র্যাকডাউন—দ্রুত-ঘটে যাওয়া এইসব ঘটনা ধাপে ধাপে তার তরুণ মনে বারবার স্পন্দিত হতে থাকে এবং সেই স্পন্দনের ঢেউয়ে উঞ্চেল হয়ে গণহত্যার প্রতিশােধ নেয়ার সঙ্কল্প করে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেন। তার এই সঙ্কল্পের কথা শুনে আরাে কয়েকজন বন্ধু জুটে গেল সঙ্গী হিসেবে গ্রাম সম্পর্কে গেদু চাচা ছিলেন নৌকার মাঝি  পথঘাট তার জানা ছিল। তার নৌকাতেই ফরহাদ সবাইকে নিয়ে রওনা হলেন।
 
আসামের মাইনকার চর পৌছাবার পর সেখান থেকে বাসে ও ট্রেনে করে ধুবড়ি হয়ে কুচবিহারের টাকুরহাট ইয়ুথ ক্যাম্পে গিয়ে ভর্তি হন। সেখানে শুধু নানা বিষয়ে অনুশীলন করানাে হতাে। কিছুদিন বাদে হঠাৎ একদিন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, সেনা প্রধান জেনারেল মানেকশ, পূর্বাঞ্চলের কমান্ড প্রধান জগজিৎ সিং অরােরা প্রমুখ ঐ কেন্দ্র পরিদর্শনে আসেন। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী তাদের সবাইকে দেখে মন্তব্য করেছিলেন, এত অল্প বয়সে যারা যুদ্ধ করতে এসেছে। তাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে ফরহাদ তখন সাহস করে তার কাছে অভিযােগের সুরে বলে বসেন, এখানে তাে অনুশীলন অনেক হলাে। এখন তাদের যুদ্ধে পাঠানাে হােক। তার কথায় কাজ হলাে। ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে সেই দিনই বিশেষ এক ট্রেনে করে তাদের উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্যে দার্জিলিয়েংর মুক্তিনালা মুজিব ক্যাম্পে পাঠানাে হয়। মুক্তিনালা ক্যাম্পে ২১ দিনের একটি সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ দেয়া হয় তাদের এলএমজি, এসএলআর, রাইফেল চালনা, ২ ইঞ্চি মর্টার ও গ্রেনেড ছোড়া, অন্যান্য বিস্ফোরক ব্যবহারের কৌশল শেখানােসহ গেরিলা প্রশিক্ষণও অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রশিক্ষণশেষে ৬ ও ৭নং সেক্টরের অধীনে কয়েকজনকে নিয়ে একটি কোম্পানি গঠন করে রংপুর জেলার বুড়িমারী সীমান্ত ক্যাম্পে পাঠানাে হয়। ফরহাদ ও তার এক বন্ধু মঞ্জুকে কোম্পানি কমান্ডার নির্বাচিত করা হয়। ৭নং সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের নেতৃত্বে তারা পাটগ্রামের বড়খাতা এলাকায় পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটা অপারেশনে সাফল্যের সাথে অংশ নেন। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ একদিন তাদের ক্যাম্প পরিদর্শনে আসেন। তারই নির্দেশে তাদেরকে ১০টি দলে ভাগ করে দেশের ভেতরে এলাকাভিত্তিক গেরিলা যুদ্ধের জন্য পাঠানাে হয়। ফরহাদ তার দলবল নিয়ে নিজ গ্রামে ফিরে এলেন।
 
সারিয়াকান্দি থানা ভবনে তখন দুশাের মতাে মিলিটারি, মিলিশিয়া ও রাজাকার ক্যাম্প বানিয়ে অবস্থান করছিল ফরহাদ মুক্তিবাহিনীর আরাে কয়েকটা গ্রুপকে একত্র করে থানা আক্রমণের পরিকল্পনা করলেন। অক্টোবরের শেষে শীতের রাত ফরহাদ ও তার দলবলের অবস্থান নদীর ওপারের গ্রাম রামচন্দ্রপুরে আগের দিন থানায় মিলিটারি ক্যাম্প রেকি করা হয়ে গেছে রাত দুটোর দিকে সবাই নদী পার হয়ে এসে থানার সামনে যে মসজিদ ও স্কুল তার পেছনে একটি বাঁশঝাড়ের মধ্যে এসএলআর হাতে সবাই পজিশন নিলেন। ঠিক হলাে, ফরহাদ নিজে প্রথম গুলি ছোঁড়া শুরু করবেন। কভার দেয়ার জন্যে ডাইনে, বাঁয়ে ও পেছনে আরাে কয়েকটি ক্ষুদ্র দল পজিশন নিল। সুযােগের জন্যে প্রহরের পর প্রহর অপেক্ষা অবশেষে ফজরের আজান হলাে দূরে মােরগের ডাকও শােনা গেল। ভােরের আলাে ফুটতে না ফুটতে রাজাকার মিলিটারিরা ঘর থেকে বেরিয়ে দাঁত মাজা শুরু করেছে। এমন সময় ফরহাদ ‘জয় বাংলা’ চিৎকারের সাথে সাথে ফায়ার করা আরম্ভ করেন। শত্রুপক্ষও সাথে সাথে ‘নারায়ে তকবির’ হুঙ্কারে সমস্ত গ্রাম কাঁপিয়ে তুললাে। সেই হুঙ্কারে ভুল বুঝে ফরহাদের অন্যান্য গ্রুপের সবাই সরে পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই ফরহাদের প্রকৃত পরিকল্পনা। ব্যর্থ হয়। শত্রুরা ফরহাদসহ কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধাকে ঘিরে ফেলে তবু তারা কৌশলে গুলি ছুড়তে ছুঁড়তে পিছু হটে গিয়ে কোনােক্রমে নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম হন। পাকিস্তানিরা এর প্রতিশােধ নিয়েছিল রামচন্দ্রপুর গ্রামে বিমান থেকে বােম ফেলে, গ্রামটিকে তিন তিনবার আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে তবু ফরহাদরা থেমে থাকেন নি। প্রথম অপারেশন কী কারণে ব্যর্থ হলাে নিজেদের মধ্যে তার পর্যালােচনা করা হলাে।
শেষে আবার একমাস পরে নভেম্বর মাসের শেষদিকে নতুন পরিকল্পনায় অপারেশন পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত হলাে। এবার পুরােপুরি সফলও হলেন। বেশ কিছু রাজাকার-মিলিটারি হত্যা করে তাদের অস্ত্রশস্ত্র দখল করতে পেরে মুক্তিযােদ্ধারা সবাই আনন্দে দিশেহারা। এই অপারেশনে রামচন্দ্রপুরের গ্রামবাসীরা তাদের অকাতরে সহযােগিতা করেছিলেন। তখন পাঞ্জাবি এক দারােগা সারিয়াকান্দি থানার দায়িত্বে ছিল। এই অপারেশনের সময় সে কয়েকজন সঙ্গীসহ পালিয়ে গিয়ে গ্রামের বিচ্ছিন্ন একটি এলাকায় এক কৃষকের বাড়িতে কেউ চেঁকি ঘরে, কেউ খড়ের গাদার মধ্যে, কেউ চালের তুষের মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে লুকিয়ে ছিল। বাড়িটা ছিল একটা উঁচু টিলামতাে জায়গার ওপর। মুক্তিযােদ্ধা এবং সমস্ত গ্রামবাসীরা বাড়িটা ঘিরে ফেলে মাইকে বারবার আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দিতে থাকেন। কিন্তু তারা তা না মানলে শেষ ঘােষণায় গ্রেনেড চার্জ করার হুমকি দেয়া হয়। তখন তারা অস্ত্রশস্ত্রসমেত ধরা দেয়। আর এভাবেই মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে সারিয়াকান্দি থানার পতন ঘটে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ফরহাদের বিশিষ্ট কয়েকজন নিকট আত্মীয় পাক মিলিটারির হাতে শহীদ হয়েছেন। তাদের মধ্যে তার ফুপা যশােরের মশিউর রহমান অন্যতম। ফরহাদের ছােট ভাইও মুক্তিযােদ্ধা স্বাধীনতার পর ভাইবােন সবাই মিলে আবার লেখাপড়া শুরু করেন। ফরহাদ এম.এ. ১ম পর্ব শেষ করে বর্তমানে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত পাশাপাশি তিনি চলচ্চিত্র প্রযােজনাও করে থাকেন। সংসারে আছেন মা, স্ত্রী, ২ ছেলে, ২ মেয়ে। দুই ছেলে একই সাথে এইচএসসি পড়ছে। মেয়ে একজন কিন্ডারগার্টেনের ছাত্রী। আরেকজন এখনাে কোলের শিশু মুক্তিযুদ্ধের স্মরণযােগ্য মানুষের প্রসঙ্গে ফরহাদ গ্রামের সেই নৌকার মাঝি গেদু চাচার কথা উল্লেখ করলেন, যিনি তার নৌকায় ফরহাদদের আসামের মাইনক্যার চর পৌঁছে দিয়েছিলেন। গ্রামের অনেকেই ভয়ে তাকে যেতে নিষেধ করেছিলেন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ বুঝেও তিনি তা মানেন নি। বলেছিলেন, এই ছেলেরা ট্রেনিং নিয়ে ফিরে এসে দেশ স্বাধীন করার কাজ করবে। আর আমি আজ তাদের এইটুকু সাহায্য করতে পারবাে না? তাই ফরহাদের মনে হয়, মুক্তিযােদ্ধাদের বিজয়ের যে গৌরব তিনিও তার অংশীদার। পাকিস্তানি আমলে ২২ সম্পদশালী পরিবারের কথা শােনা যেত। কিন্তু দুঃখের বিষয়, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে হঠাৎ কুড়িয়ে পাওয়া সম্পদ কুক্ষিগত করে গজিয়ে উঠেছে ২২ হাজারেরও বেশি সম্পদশালী পরিবার। অথচ এই বাংলাদেশেই অগুনতি মানুষ অনেক কষ্টে জীবন কাটাচ্ছেন। তাই ফরহাদের ধারণা, সন্ত্রাস-দুর্নীতি রােধ আর সুষ্ঠুভাবে সম্পদের বণ্টন করতে না পারলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নতির সম্ভাবনা শূন্য। 

সূত্রঃ  মুক্তিযুদ্ধ জনযুদ্ধ আর্থ সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত – আতিউর রহমান

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!