You dont have javascript enabled! Please enable it!
মুক্তিযুদ্ধের মৌল আকাক্ষা : দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ
“এ কথা সত্য, আধুনিককালে মানুষের যা কিছু সুযােগের সৃষ্টি হয়েছে তার অধিকাংশই ধনীর ভাগ্যে পড়ে অর্থাৎ অল্প লােকের ভােগে আসে, অধিকাংশ লােকই বঞ্চিত হয়। এর দুঃখ সমস্ত সমাজের এর থেকে বিস্তর রােগ তাপ অপরাধের সৃষ্টি হয়, সমস্ত সমাজকেই প্রতিক্ষণে এর প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছে । বর্তমান কাল বর্তমান কালের মানুষের জন্যে বিদ্যা, স্বাস্থ্য ও জীবিকা নির্বাহের জন্যে যে সকল সুযােগ সৃষ্টি করেছে সেগুলাে যাতে অধিকাংশের পক্ষেই দুর্লভ না হয় সর্বসাধারণের হাতে এমন উপায় থাকা চাই” (সমবায় নীতি, রবীন্দ্র-রচনাবলী, ১৪শ খণ্ড, পৃ. ৩২৯-৩০)। এতক্ষণ ধরে আমরা যে বিশ্লেষণ করলাম তা থেকে স্পষ্ট হয়েছে যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্য থেকে উঠে আসা রাজনৈতিক নেতৃত্বের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল; কিন্তু আন্দোলনটির ভিত্তি রচিত হয়েছিল কৃষক, শ্রমিক, জাতীয় শিল্পপতিসহ সর্বস্তরের জনগণ দ্বারা যাদের স্বার্থ ও আশা-আকাঙ্ক্ষা একত্র হয়ে ১৯৭১ সালে আধিপত্যবাদী পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সর্বব্যাপী যুদ্ধ শুরু করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। একটি উন্নয়নশীল সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক ভূমিকাই এই গবেষণামূলক বইয়ের ধারণাগত কাঠামাের প্রতিজ্ঞা এই কাঠামােগত উন্নয়নে সনাতন এবং নয়া মধ্যবিত্ত উভয় শ্রেণীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং আশা-আকাক্ষা বিবেচনা করা হয়েছে।
যদিও মুক্তিযুদ্ধে নয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অধিকাংশ সদস্য শ্রমিক শ্রেণীর সতিকারের অংশ নয় তবুও তারা প্রলেতারিয়েতের সকল বৈশিষ্ট্য এবং আর্থ-সামাজিক অরক্ষিত অবস্থা প্রতিপন্ন করে। তাদেরকেও অনিশ্চিত জীবনযাপন করতে হয়েছে, বেকারত্বের স্থায়ী হুমকি এবং অবনতিশীল সামাজিক অবস্থানে থাকতে হয়েছে ফলে তারা একটি নির্দিষ্ট সময়ে প্রলেতারিয়েত এবং তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সমাজের অন্যান্য শ্রেণী-চেতনার স্তরের খুব কাছাকাছি আসতে পেরেছেন বাঙালিদের জীবনে ১৯৭১ সাল ছিল এমন একটি সময় যখন মধ্যবিত্ত শ্রেণী এমনকি কৃষক শ্রেণীও শ্রমিক শ্রেণীর খুব কাছে এসে পড়েছিল। এই সব শ্রেণী হাতে হাত রেখে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসরদের সাথে যুদ্ধ করেছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণী, যারা উৎপত্তিগতভাবে কৃষক শ্রেণীর অংশ এবং স্বনিয়ােজিত কর্মী (৭০ শতাংশ), তারাই যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে। পরবর্তী মধ্যবিত্ত শ্রেণী হলাে শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী এবং ব্যবসায়ীদের সংমিশ্রণ। এর পরে ছিলেন সরকারি কেরানি এবং অন্যান্য পেশাজীবী। প্রকৌশলী ও পেশাজীবীরাও এই শ্রেণীর অন্তর্গত মধ্যবিত্তের আশা ছিল অর্থনৈতিক এবং সামাজিক দাসত্ব থেকে মুক্তি তাদের সন্তানদের জন্য শিক্ষার উচ্চতর সুযােগের দাবিও তারা জানিয়েছেন।
তার সাথে সাথে এই দাবিটা সােচ্চার হচ্ছিল যে, তাদের শিক্ষিত সন্তানদের জন্য চাকরি চাই, প্রয়ােজনে দরকারি যােগ্যতা শিথিল করে হলেও দিতে হবে। এই উদীয়মান শ্রেণীর আকাক্ষা আরাে জোরালাে হয় ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ এবং পরবর্তীকালে বঙ্গভঙ্গ রদের মধ্য দিয়ে। কলকাতাভিত্তিক হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সকল সামাজিক ক্ষেত্রে প্রাধান্যের কারণে পূর্ববাংলার মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কাছে অবাধ ও নিরপেক্ষ পাকিস্তানের প্রত্যাশা ক্রমশ প্রাণের দাবি হয়ে। উঠছিল, যার আরেকটি প্রধান অনুঘটক ছিল সাম্প্রদায়িকতার তিক্ত অভিজ্ঞতা কিন্তু পাকিস্তানের জন্ম হতে না হতেই এই আশা ধূলিসাৎ হয়। রাষ্ট্রযন্ত্র অভিজাত শাসক শ্রেণীর স্বার্থে কাজ করতে থাকে যারা বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রয়ােজন ও আকাক্ষার প্রতি অপেক্ষাকৃত কম সংবেদনশীল ছিল। যখন পাকিস্তানের অধিকাংশ জনগণের মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘােষণা করার ন্যায়সঙ্গত দাবি শুধু উপেক্ষিতই হলাে না বরং ঐ দাবির প্রতি নৃশংস ব্যবহার করা হলাে তখন বাঙালিরা ভীষণভাবে মর্মাহত হলেন। নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দের মূল্য আছে এমন একটি অধিক সম্মানজনক স্বদেশের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এ সময় তাদের অন্তরে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বীজ উপ্ত হয়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়, ১৯৬২এর শিক্ষা আন্দোলন এবং ১৯৬৯-এর গণ্যুথানের মধ্য দিয়ে এই বীজ মহীরূপে পরিণত হয়। আর ১৯৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়লাভের মধ্য দিয়ে একটি স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি করে বাঙালিরা সেই বৃক্ষের ফল লাভ ভােগ করতে চেয়েছেন মাত্র মধ্যবিত্ত শ্রেণী একটি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিতে পেরেছিল, কারণ তখন। সকল শ্রেণী একটি ইস্যুতে জাতীয়ভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছিল, যা ছিল তাদের জন্মভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা কর্তৃত্ববাদী পাকিস্তান রাষ্ট্র দ্বারা সাম্যভিত্তিক ভূমি সংস্কারের সাত্যিকারের দাবি উপেক্ষার ফলে কৃষকদের অসন্তুষ্টি শক্ত ভিত্তি পেয়েছিল। পরবর্তীকালে কৃষকরা আরাে তেঁতাে হয়ে উঠেছিলেন উদ্দেশ্যপ্রণােদিত খাজনার চাপ এবং খাদ্যের অতিরিক্ত দাম ও অন্যান্য প্রয়ােজনীয় দ্রব্যের মূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে। স্থানীয় প্রশাসনের ব্যাপক দুর্নীতি এবং সেখানে পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপ কৃষকদের হতাশাকে স্পষ্ট রূপ দেয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। পাটের মূল্য হ্রাস এবং কৃষকদের ভাগ্য উন্নয়নে শাসক শ্রেণীর কোনাে পদক্ষেপ না নেয়া। সাধারণ প্রকল্প যেমন V-AID গ্রামীণ সংস্কার কর্মসূচি, কুমিল্লা সমবায় সমিতির মডেল, থানা সেচ প্রকল্প ইত্যাদি শুধু গ্রামের ধনিক শ্রেণীর ক্ষমতাকেই সবল করেছে কিন্তু সাধারণ কৃষকদের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছে কৃষি কাজের স্থবিরতা মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে প্রভাবিত করেছে, যারা সত্যিকার অর্থেই কৃষক শ্রেণীর সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন।
ফলে মুক্তিযুদ্ধে কৃষকদের অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক লক্ষণীয় যে, মুক্তিযােদ্ধাদের প্রায় পাঁচ ভাগের চার ভাগই এসেছেন কৃষকের ঘর থেকে ১৯৬৯-৭০-এর পত্রিকাগুলাে পর্যালােচনা করলে কৃষকদের মধ্যকার বিস্তৃত অসন্তোষ ও ক্ষোভ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। মজুর শ্রেণীকেও ঐ সময় বৈরী আচরণের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তারা শাসক শ্রেণীর অংশ হিসেবে অবাঙালিদের সম্পদ স্পষ্টভাবে নির্ণয় করতে পেরেছিলেন। মজুর শ্রেণীর অভিযােগ স্বাভাবিকভাবেই অর্থনীতি সম্পর্কে ছিল এবং তা রাজনৈতিক আন্দোলনের দাবির দিকে মােড় নেয়। শিগগিরই তারা দেখতে পান যে তারা নিজ ভূমেই পরবাসী বিভিন্ন পদক্ষেপের দ্বারা বাঙালি জাতীয় নেতারা শ্রমিক শ্রেণীর বিশ্বাস অর্জনের মাধ্যমে নেতৃত্ব অর্জন করেছিলেন।
প্রগতিশীল এবং সচেতন মজুর শ্রেণী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে যােগদানের ফলে সংগ্রামের গুণগত মান বৃদ্ধি পায়। ১৯৭১ সালে মুক্তি সংগ্রাম সর্বোচ্চসীমায় পৌঁছায়। শ্রমিক অসন্তোষ জঙ্গি রূপ ধারণ করার ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পক্ষে মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র অংশগ্রহণ সহজ হয়ে দাঁড়ায়। নমুনা জরিপ আরাে নিশ্চিত করে যে কৃষক সম্প্রদায় হতে উদ্ভূত এবং বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর শিক্ষিত, দায়িত্ববান যুবকদের অংশগ্রহণ ছিল। সবচেয়ে বেশি। তবে প্রকৌশলী, চাকরিজীবী, মজুর শ্রেণী ইত্যাদি শ্রেণীর অংশগ্রহণও কম গুরুত্ববহ নয় এটা কার্যত জনগণের যুদ্ধ ছিল। মূলত কৃষক সম্প্রদায় হতে উদ্ভূত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নেতৃত্বের মাধ্যমে সকল শ্রেণী ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। সাধারণ জনগণ শুধু যে তাদের সন্তানদের যুদ্ধে পাঠিয়েছেন তা নয়। তারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে পরােক্ষভাবে যুদ্ধেও লিপ্ত হয়েছেন। তবে সবচেয়ে বড় কথা তারা কখনাে আশা হারান নি এবং সর্বদাই মনােবল উঁচু রেখেছেন। শোষণহীন সমাজব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে এ দেশের সাধারণ মানুষ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন। আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থেকে সমৃদ্ধ এক বাংলাদেশ গড়ে তােলার স্বপ্নও তাদের সেদিন তাড়িত করেছিল। তবে সবচেয়ে বড় স্বপ্ন ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি।
মুক্তাঞ্চল থেকে প্রকাশিত ‘মুক্তিযুদ্ধ’ নামের পত্রিকার ২১ নভেম্বর ১৯৭১ সংখ্যায় বলা হয়েছিল : “স্বাধীন বাংলাদেশের ছবিও সকল শ্রেণীর মানুষের মনে এক রকম নয়। কৃষক ভাবিতেছে স্বাধীন বাংলাদেশে সে জমি পাইবে, সামন্তবাদী শােষণের নাগপাশ হইতে পাইবে মুক্তি শ্রমিক ভাবিতেছে সে পাইবে বাঁচার মতাে মজুরি, কাজের নিরাপত্তা, রাজনৈতিক ও ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার। যুগ যুগ ধরিয়া সে সভ্যতার পিলসুজ হইয়া কাটাইয়াছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মধ্য দিয়া এমন এক উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের দুয়ার খুলিয়া যাইবে সেখানে সে সভ্যতার নির্মাতা হিসাবে উহার ফল ভােগেরও অধিকারী হইবে। সকলের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আশ্রয়ের মতাে ন্যূনতম চাহিদাগুলি মিটিবে”। অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে বলেছিলেন, বাংলাদেশের শহরে ও গ্রামে তরুণেরা যে যুদ্ধে লিপ্ত, তা বিদেশ দখলদারদের উৎখাত এবং অসাম্য ও সুবিধাভােগের অবসান ঘটানাের সংগ্রাম” (বাংলার মুখ, ২৬ নভেম্বর ১৯৭১)। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ন্যাপ নেতা অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ ‘নতুন বাংলা’য় (১৬ ডিসেম্বর ‘৭১) লিখেছিলেন, “কৃষকরা বলাবলি করিতেছে এবারে তারা জমি পাইবে, পাটের ন্যায্য মূল্য পাইবে, প্রতিদিনের প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমিবে, ঘুষ, রিশওয়াত ও অন্যান্য দুর্নীতির হাত হইতে মুক্তি পাইবে। শ্রমিক মনে করে যে তার বাঁচার মত ন্যায্য মজুরি পাইবে ছাত্র ভাবে এবার তার লেখাপড়ার সুযােগ পাইবে। যুবক মনে করে এবার তার চাকুরির সংস্থান হইবে এক কথায়, আজ এদেশের কৃষক-শ্রমিক-ছাত্রশিক্ষক-বৃদ্ধ, নর-নারী, ডাক্তার-কবিরাজ-দোকানদার-ব্যবসায়ী, রিকশাওয়ালাখেতমজুর আপামর জনসাধারণ ভাবিতেছে গরিব এবার মানুষের মতাে বাচিতে পারিবে, কথা বলিবার অধিকার পাইবে।” মােটা দাগে এই ছিল সাধারণ মানুষের মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন এই স্বপ্নের বড় অংশই বাহাত্তরের সংবিধানের মূলনীতি অংশে স্থান পেয়েছে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা দলিলেও আর্থ-সামাজিক মুক্তির (যার শেকড় ছিল ভাষা আন্দোলনে প্রােথিত) আকাক্ষা সন্নিবেশিত হয়েছিল অন্ধকার থেকে আলাের পথে’ যে যাত্রা বাঙালি শুরু করেছিল তার মূল লক্ষ্যই ছিল দারিদ্র্যমুক্ত এক বাংলাদেশ গড়ে তােলা আমরা এমন এক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম যার। প্রতিটি সিদ্ধান্তের মালিক-মােক্তার আমারাই হবে।
আমাদের সম্পদ কিভাবে ব্যয় করা হবে সে সিদ্ধান্ত গ্রহণেরও ক্ষমতা থাকবে আমাদের ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, স্বাধীনতা লাভের একত্রিশ বছর পর গরিব মানুষের মানমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার এ ধরনের স্বপ্নের কথা আমাদের নীতিনির্ধারকদের মনে করিয়ে দিতে হয়েছে একজন বিদেশিনীকে। প্যারিসে গত বছর (২০০২-এ) অনুষ্ঠিত দাতাগােষ্ঠীর সভায় বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট নিশিমিজু বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রীসহ বড় বড় সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে বাংলাদেশের মানুষ কি চায় তার একটা ক্যাটালগ তুলে ধরেছেন। তিনি আমাদের নীতিনির্ধারকদের মনে করিয়ে দিয়েছেন যে বাংলাদেশের মানুষ চান সুশাসন। তারা চান দেশে আইন থাকবে, বিচার থাকবে, দুনীতি থাকবে না, ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করার সুযােগ পাবে, বড় হয়ে তারা চাকরি বা ব্যবসায়বাণিজ্যের সুযােগ পাবেন, কেউ না খেয়ে মরবেন না। সবার জন্যে স্বাস্থ্য পরিচর্যার সুযােগ থাকবে, জন্মের সময় মা বা শিশু মারা যাবে না। এরকম টুকরাে টুকরাে স্বপ্ন মাথায় নিয়েই যে এ দেশের সাধারণ মানুষের। সন্তানেরা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন তার ইঙ্গিত লেখার শুরুতেই দিয়েছি স্বপ্নতাড়িত সেইসব মানুষেরা মনে হয় আজ স্বপ্ন দেখতেও ভুলে গিয়েছেন। আর তাই নতুন করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সেই মৌল স্বপ্ন দারিদ্রমুক্ত অধিকারযুক্ত বাংলাদেশের কথা দেশবাসীকে মনে করিয়ে দিতে চাই। অবশ্যি, এমন এক সময়ে আমি এই লেখা লিখছি যখন বিদেশিরাই বেশি করে বলছেন দারিদ্র্য নিরসনই বাংলাদেশের উন্নয়নের পয়লা নম্বরের চ্যালেঞ্জ আমরা কিন্তু বহু আগেই এমন কথা বলেছি লিখেছি ১৯৯১ সালে প্রফেসর রেহমান সােবহানের নেতৃত্বে যে টাস্ক ফোর্স গঠিত। হয়েছিল তার অন্যতম লক্ষ্যই ছিল দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ কী করে গড়া যায় তার কৌশল বের করা এর দশ বছর পর ২০০১ সালে প্রফেসর সােবহানের অনুপ্রেরণায় আরেকটি টাস্ক ফোর্স গঠিত হয়। তারাও দারিদ্র্য নিরসনের সুনির্দিষ্ট কৌশল বিশেষ করে গরিব হিতৈষী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সুশাসন ও টেকসই উন্নয়নের পথ স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন। কিন্তু আমাদের দেশজ এসব ভাবনা সরকারের উন্নয়ন নীতিমালায় যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে বলে বলা যাবে না। যদি পেতাে, তাহলে বিদেশিদের আজ এমন করে দারিদ্র্য থেকে মুক্তির পূর্বশর্ত আরােপ করার সুযােগ মিলতাে না। তাদের কথামতাে দারিদ্র্য নিরসন কৌশলপত্র তৈরি। করতে হতাে না। আমরা নিজেরাই মুক্তিযুদ্ধে মৌল আকাক্সক্ষা দারিদ্রের বিরুদ্ধে জাতীয় লড়াইয়ের কৌশল প্রণয়ন করতাম। সে যাই হােক, ভেতর বা বাইরে যেখান থেকেই আহ্বান আসুক না কেন। আমাদের দারিদ্র নামের এই শত্রুর মােকাবিলা করার জন্যে জাতীয় প্রস্তুতি নিতেই হবে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর দারিদ্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এক অর্থে সমার্থক স্বাধীনতা লাভের এতাে বছর পরেও দেশের অর্ধেক জনগােষ্ঠী গরিব, তাদের একতৃতীয়াংশ আবার হতদরিদ্র (যাদের চালচুলাে কোনােটিই নেই) এ লজ্জা ঢাকি। কিভাবে? অথচ প্রতিটি বাজেটে ৩০-৪০ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ হয়েছে দারিদ্র। বিমােচনের খাতে। সামাজিক খাতগুলােতেও অর্থ বরাদ্দ দিন দিনই বেড়ে চলেছে। এর পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ অর্থ যােগান দেয়া হয়েছে এনজিওগুলােকে। তাদেরও লক্ষ্য দারিদ্র্য নিরসন। এই যে লক্ষ কোটি টাকা আমরা দারিদ্র্য বিমােচনের নামে খরচ করলাম তার নিট ফলাফল কী? দেশে এখনও এতাে মানুষ। গরিব কেন? অবশ্যি একথা ঠিক নব্বইয়ের দশকে দারিদ্র্য নিরসনে আগের চেয়ে সাফল্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে এসেছে। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে শতকরা এক শতাংশ। হারে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমেছে। এই হার দশকের শেষার্ধে আরাে খানিকটা বেড়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও দারিদ্র্য কমার হার দুই শতাংশে তােলা যায় নি। নব্বই দশকের শেষার্ধে সরকারের সমর্থনে আশ্রয়ণ, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, মুক্তিযােদ্ধা ভাতার মতাে কিছু সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি, আগের ভিজিডি, শিক্ষার জন্যে খাদ্য, পুষ্টি উন্নয়নের মতাে কাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কারণে দারিদ্র্য পরিস্থিতি খানিকটা হলেও নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশের কৃষির অসাধারণ সাফল্যের কারণে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল থাকায়, প্রকৃত মজুরি বাড়ন্ত থাকায় এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে সরকার ও এনজিওদের মনোেযােগী হওয়ার কারণে দুর্ভিক্ষের মতাে আর্থ-সামাজিক বিপর্যয় থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছি পকেটে পকেটে নীরব অনটন থাকলেও না খেয়ে মারা যাওয়ার মতাে ঘটনা ঘটছে না। এই সাফল্যের বরমাল্য নব্বইয়ের দশকের সকল সরকারেরই প্রাপ্য তা সত্ত্বেও দারিদ্র্য পরিস্থিতি এখনও খুবই জটিল ও উদ্বেগজনক এত অর্থ ঢেলেও এই পরিস্থিতির দ্রুত উন্নয়ন না হওয়ার পেছনে দাতা এবং অর্থনীতিবিদদের অনেকেরই ধারণা বাংলাদেশের দুর্বল শাসনব্যবস্থাই এর জন্যে দায়ী। সৃজনশীল মানুষগুলাের পক্ষে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও প্রযুক্তিকে কার্যকরভাবে প্রবাহিত করতে পারি নি বলেই গরিব মানুষের ভাগ্যের চাকা আরাে সচল হতে পারছে না। এই পরিস্থিতিতেই দাতাগােষ্ঠী জনগণের মতামত সংগ্ৰহসাপেক্ষে একটি দারিদ্র্য নিরসন কৌশলের পরিকল্পনা (পিআরএসপি) গ্রহণ করার তাগিদ দিয়েছে।
দুঃখের কথা এই যে, দারিদ্র্য নিরসনের এই কৌশল অনেক আগেই আমাদের উন্নয়ননীতি কৌশলের প্রধান এজেন্ডা হওয়ার কথা ছিল। আমাদের নেতৃত্বের ব্যর্থতা স্বার্থান্বেষণ এবং মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনা রূপায়ণে উদাসীনের কারণেই সেরকম কৌশল আমরা তৈরি করতে পারি নি। আর সে কারণেই বিদেশিদের চাপে প্রথমে একটি কৌশলপত্রের খসড়া তৈরি হয়েছে। পরবর্তীকালে আরাে ব্যাপক জনমত সংগ্রহ করার পর তা চূড়ান্ত হওয়ার কথা। যেভাবে এই কৌশলপত্রটি তৈরি করা হলে একে জাতীয় দলিল বলা যেতাে থাকলেও এদেশের বিপুল গরিব জনগােষ্ঠীর সঙ্গে নীতিনির্ধারকগণ বা তাদের প্রতিনিধিদের যথেষ্ট আলাপআলােচনা ছাড়াই গরিবী হটানাের কৌশলপত্র চূড়ান্ত হয়েছে। সেরকম উদ্যোগ চোখে পড়ে নি। শেষ পর্যন্ত পুরাে জাতিকেই এই ধারণাপত্র প্রস্তুতি যজ্ঞে শামিল করতে পারার কারণে এটি আগের মতােই একপেশে, আমলাতান্ত্রিক, বিশেষজ্ঞ কেন্দ্রিক, বাইরে থেকে চাপানাে একটি প্রক্রিয়াই থেকে গেছে। অবশ্যি, যে প্রক্রিয়ায় খসড়াপত্র তৈরি করা হয়েছে তা আগের চেয়ে খানিকটা উন্নততর বিশেষজ্ঞরা অন্তত মাঠে গেছেন এবং সাধারণ মানুষও তাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তবে অর্থ বণ্টনের যে পরিকল্পনা সেটি নির্ধারণ করা হয়েছে মূলত মন্ত্রণালয়ের সচিবদের সঙ্গে আলাপ করেএটি পিআরএসপি কৌশলের উদ্দেশ্যের। সঙ্গে মেলে না। জনগণের মতামত সাপেক্ষে সরকারি খরচের অগ্রাধিকার প্রথমে নির্ধারণ করা বাঞ্ছনীয় ছিল। এরপর আগামী পাঁচ বা দশ বছরের সরকারি খরচের ছক তৈরি করার উদ্যোগ নেয়া প্রয়ােজন ছিল।
কোন খাতে (জনগণের অগ্রাধিকার মতাে) কতাে খরচ করলে কতাে গরিব মানুষ উপকৃত হবে তার সুনির্দিষ্ট অঙ্ক তৈরি, সেই অঙ্কের আলােকে এখন থেকে জাতীয় বাজেট, স্থানীয় সরকারের বাজেট, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ, পরিকল্পনাটি জনগণের কাছে গ্রহণযােগ্য কিনা তা পুনরায় তাদের কাছে গিয়ে যাচাই করা দরকার ছিল। পাশাপাশি এই পরিকল্পনাকে জাতীয় চরিত্র দেয়ার লক্ষ্যে সকল দলের সংসদ সদস্যকে এই পরিকল্পনার ওপর বিতর্কে শামিল করা উচিত ছিল। এই পরিকল্পনার ব্যাপারে শুধুমাত্র অর্থমন্ত্রীর কথাবার্তাই শােনা গেছে। প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে কী ভাবেন? বিরােধীদলের নেত্রী কী ভাবেন? সাবেক অর্থমন্ত্রী কী ভাবেন? অন্য মন্ত্রীরা কী ভাবেন? স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রধানরা কী ভাবেন? নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা কী ভাবেন? গরিব মানুষের প্রতিনিধিরা কী ভাবেন? গণমাধ্যমে এ বিষয়ে জোরালাে বিতর্ক কোথায়? ইলেকট্রনিক মিডিয়াতেও এমনকি সরকার ও বিরােধীদলের মধ্যে জাতির এই মরাবাঁচার প্রশ্নে বিতর্ক বা আলাপ-আলােচনার লক্ষণ দেখা যায় নি? এসব প্রশ্ন তুলছি এ কারণে যে, এখন থেকে এই পরিকল্পনার বাইরে গিয়ে বিদেশি সাহায্য আর পাওয়া যাবে না। দেশের ভেতরের সম্পদও এই পরিকল্পনার বাইরে গিয়ে খরচ করা যাবে না।
তাই যদি হয় বাধ্যবাধকতা তাহলে আমরা কেন সমগ্র জাতিকে জড়াই নি এই পরিকল্পনা তৈরির প্রশ্নে অবশ্য দেশের সামাজিকরাজনৈতিক পরিস্থিতি এধরনের পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য উপযুক্ত কিনা সে প্রশ্ন যে কেউ করতে পারেন। তা সত্ত্বেও অন্তত দারিদ্র্যমুক্তির প্রশ্নে আমরা জাতীয় ঐকমত্য অর্জনের প্রচেষ্টা করতে পারি। পাশাপাশি আমাদের মতাে করে অর্থনীতি সমাজ ও প্রশাসন ব্যবস্থাকে সংস্কার না করতে পারলে শুধু দারিদ্র্য নিরসনের জাতীয় কৌশল তৈরি করা সম্ভব হলেও কাঙিক্ষত ফল পাওয়া মুশকিল হবে। তা। সত্ত্বেও দারিদ্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সূচনা আমাদের করতেই হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি যে, দারিদ্র্য নিরসনের জাতীয় কৌশলে নিচের কয়েকটি দিক অবশ্যই থাকতে হবে : ১. গরিবহিতৈষী প্রবৃদ্ধির প্রক্রিয়া সচল করতে হবে। গরিব মানুষেরা যেন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সক্রিয় অংশীদার হতে পারেন সেরকম সুযােগ তৈরি করতে হবে। সেজন্যেক, গরিবদের কাছে সম্পদ দেয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। বস্তুগত সম্পদ, মানবিক সম্পদ, সামাজিক সম্পদ, আর্থিক ও রাজনৈতিক সম্পদের হিস্যা তাদের দিতে হবে। বিশেষ করে মানবিক সম্পদের মালিকানা তারা পেতে পারে শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি ও স্বাস্থ্য সুযােগ লাভ করে। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের উপায় তাদের সংগঠিত হওয়ার অধিকারকে নিশ্চিত করার মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতায়ন করার জন্যে গরিবদের সুযােগ নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্বায়ন যে সুযােগ সৃষ্টি করেছে তার ভাগ গরিবদেরও দিতে হবে সে কারণে গরিবদের নিম্নমানের বাজার থেকে তুলে বিশ্বমানের বাজারের সঙ্গে যুক্ত করা চাই তারা যাতে উন্নতমানের পণ্য তৈরি ও বিক্রি করতে পারে সে সুযােগ তাদের জন্যে সরকার ও এনজিওদের সৃষ্টি করে দিতে হবে। সম্ভব হলে তাদের মালিকানাধীন। নয়া সমবায়, নয়া সংগঠন গড়তে সহযােগিতা করতে হবে প্রত্যেকটি নয়া উদ্যোগে তাদেরকে অংশীদার করার উদ্যোগ নিতে হবে। ২. দারিদ্র সংজ্ঞায়নে গরিবদের দৃষ্টিভঙ্গি, অগ্রাধিকার নির্ধারণ, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের কথা যেন স্থান পায় গরিবদের বাস্তবতাকে উপেক্ষা নয় বরং আরাে ভালােভাবে জানার ও বােঝার উদ্যোগ নিতে হবে। গরিবদের সংগঠনকে শক্তিশালী করে তাদের সচেতন করে তুলতে হবে। তার ফলে তারা বাজার ও অন্যান্য সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে।
দরকষাকষির অধিকার অর্জন করতে পারবেন। ৪. কমিউনিটিভিত্তিক সংগঠনগুলাে শক্তিশালী করতে হবে। শক্তিশালী স্থানীয় সরকার গঠন এবং সেই সরকার পরিচালনা, জবাবদিহিতা ও অবলােকনে গরিবদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা গরিবদের উন্নয়নে স্থানীয় সরকারের হাতে সুনির্দিষ্ট বাজেট বরাদ্দ রাখা। এনজিও, নাগরিক সংগঠন, স্থানীয় সরকারকে একযােগে কাজ করার সুযােগ সৃষ্টি করা পরিবেশের অবক্ষয় রােধ করে প্রতিবেশিক দারিদ্র্য নিরসনে উদ্যোগী হওয়া। ৮, যারা গরিবদের সার্ভিস দেয় সেই সব সংগঠনের প্রতিনিধিদের মনের পরিবর্তন করতে হবে তারা গরিবদের দয়া করছেন না। গরিবরাও তাদের মতােই মানুষ সুতরাং তাদের মানমর্যাদা অক্ষুন্ন রাখা চাই নারীর অধিকার নিশ্চিত করে সকল উন্নয়ন ও সামাজিক কর্মকাণ্ড চালু রাখতে হবে। ১০. সুশাসনের জন্যেই গরিবের সংগঠিত উদ্যোগকে উৎসাহ দেয়া। ১১. বাজেট, পরিকল্পনা ও টেকসই উন্নয়নসহ সকল নীতি প্রণয়নও রূপায়ণে গরিবের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। একথা বেশ জোর দিয়েই বলা চলে যে দারিদ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সূচনা এখনও করা হয় নি। অথচ মুক্তিযুদ্ধকে দুঃখী মানুষের যুদ্ধ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন তকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুও নানা বক্তৃতায় গরিবের ভাগ্যোন্নয়নের কথা বারবার বলেছেন। আরাে আগে থেকেই তাই এই লড়াই শুরু করা উচিত ছিল নিঃসন্দেহে এ যুদ্ধ হতে হবে সার্বিক সমাজের সকল পর্যায়ের মানুষেরই এতে যােগ দেয়ার প্রয়ােজন রয়েছে। দেশের অর্ধেক মানুষ গরিব—এ সত্য স্বাধীনতার তিন দশক পরেও মেনে নেয়া যায় না।
এ আমাদের জন্যে বড় লজ্জার কথা জাতীয় এ লজ্জাকে আমরা অপসারণ করবােই সেজন্যে দলমত নির্বিশেষ সকলের পূর্ণাঙ্গ অঙ্গীকারের প্রয়ােজন রয়েছে দেশের চলমান সংঘর্ষপ্রবণ, সার্বিক  উপজাতীয় (Tribal) পর্যায়ের রাজনৈতিক সংস্কৃতির আবহাওয়ায় এমন জাতীয় লড়াইয়ের ডাক দেয়ার সুযােগ কী রয়েছে? এ প্রশ্ন যে কেউ করতে পারেন তা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষ যে চাওয়া, সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার জন্যে তাদের যে আকুতি, মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের যে অবদান ও সার্বিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা, সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ তৈরির যে ঝিলিক এ দেশের কৃষক ও তরুণ উদ্যোক্তারা মাঝে মধ্যেই দেখাচ্ছেন—সে সবের আলােকেই সকল রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তির কাছে আমার বিনীত নিবেদন, আসুন আমরা যেন গরিবদের এগিয়ে যাওয়ার পথের বাধা হয়ে না দাঁড়াই। তাদের চলতে দিন। তাদের বাঁচতে দিন। মুক্তিযুদ্ধের। মৌল আকাক্ষা দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ (নিজেদের) মতাে করে গরিবদেরকে গড়তে দিন মানমর্যাদা নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে বাঁচবার যে আকাঙ্ক্ষার কথা। মুক্তিযােদ্ধারা উল্লেখ করেছেন তার রূপায়ণে পুরাে জাতিকেই এগিয়ে আসতে হবে সেজন্যে চাই বলিষ্ঠ রাজনৈতিক সদিচ্ছা। চাই মুক্তিযােদ্ধাদের স্বপ্নের আদল খুঁজে পেতে। গড়ে তুলতে চাই সেই স্বপ্নের বাংলাদেশকে চাই মাথা উঁচু করা অন্য বাংলাদেশকে ।
কেস স্টাডি-১ নারী নাজমা বেগম
মিরপুর ১০নং গােল চক্কর থেকে রিকশায় মিল্কভিটা বস্তি ভূগােলের হিসেবে দূর বেশি নয়। তবুও যেন বহু যােজন দূর। কারণ বস্তিতে পৌছবার সাথে সাথে নিজের অজান্তেই উপলব্ধিতে ঘা পড়ে নগর-জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেও সেখানে মেলে না। কোনােরকম ঝলমলে নাগরিকতার ছোঁয়া। আছে শুধু কয়েক হাজার মানুষের উৎপীড়িত জীবনের চলমান ছব শুধুই যেন বেঁচে থাকার তাগিদ তাদের যে বাসস্থান তার চেহারাও ভিন্নরকম গায়ে গায়ে লাগােয়া ঘর বাঁশের খুঁটি, তরজার বেড়া মাথার ওপরে চাল কোনােটা টিনের, কোনােটা বেড়ার, কোনােটা আবার শুধুই পলিথিনের ভিত অবশ্যই মাটির লাইন লাইন শুধু এমনি ঘর একজন সাধারণ শরীরের মানুষকেও সতর্কতার সাথে এইসব ঘরবাড়ির ফঁকফোকর গলিয়ে এঁকেবেঁকে চলাফেরা করতে হয়। অনেক গলি-ঘুপচি পেরিয়ে অবশেষে পৌছানাে গেল নাজমা বেগমের বাসা নামক ডেরায় তিনি সবে তার ঘরের মেঝে নিকানাে শেষ করেছেন। ভেজা হাত মুছতে মুছতে কথা শুরু করলেন আমি চেয়ে থাকি তার শক্ত সুঠাম মুখাবয়বের দিকে তিনি একজন মুক্তিযােদ্ধা নারী হয়েও যিনি এ দেশের স্বাধীনতা আনয়নে পালন করেছেন সক্রিয় ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ১৪ বছরের এক তরুণী তবে এখন যে নাজমা বেগম নামে তার পরিচয় তা তখন ছিল না। তিনি ছিলেন কাননবালা বণিক হিন্দু সম্প্রদয়ের মানুষ বাড়ি ছিল তৎকালীন ফরিদপুর জেলার (বর্তমানে গােপালগঞ্জ) মােকসেদপুর থানার ভাজুন্দি গ্রামে ৬ ভাই ও ২ বােনের মধ্যে তিনি ছিলেন গরিব মা-বাবার দ্বিতীয় সন্তান বড়াে ভাই দর্জির কাজ শিখতেন বাকিরা কেউ-ই কোনাে কাজের উপযুক্ত ছিলেন করতেনও না কিছু বাড়িতে বাবার একটা ছােট মুদি দোকান ছিল তা থেকে যে আয় হতাে তাই দিয়ে অতি কষ্টে এত বড় সংসারটা চলতাে এইসব কারণে ভাইবােনদের কারােই লেখাপড়া হয় নি নাজমা কোনােভাবে নিজের নাম লেখাটা শিখতে পেরেছিলেন।
ফসলের জায়গাজমিও কিছুই ছিল না। তাই কৃষি বা অন্য কোনাে শিল্পের সাথে ছিল না তেমন কোনাে যােগাযােগ শহর বলতে হাতের কাছে ছিল তখনকার জেলা সদর ফরিদপুর আর মহকুমা শহর গােপালগঞ্জ কিন্তু এই দুয়ের সাথেও তেমন কোনাে সম্পর্ক ছিল না নাজমার পরিবারের তার বাবা ক্ষুদ্র পুঁজির যে মুদি দোকান চালাতেন তার জন্যে মালপত্র আনা হতাে টেকেরহাট কিংবা ভাঙ্গা থেকে নাজমা বেগম জ্বলজ্বলে চোখে তার অতীত জীবনের কথা বলছিলেন। হঠাৎ এক সময় ধক করে তার চোখের পাতা স্থির হয়ে যায়। তারপর ধীরেসুস্থে বলতে থাকেন সেই সময় তার জীবনের এক রক্তাক্ত অধ্যায়ের কথা মুক্তিযুদ্ধের দু’মাসের মাথায় হানাদার। পাক মিলিটারি ঐ এলাকায় ঢুকে পড়ে। প্রথমে তারা গ্রামে ব্যাপকভাবে লুটপাট চালায় পরে আগুন লাগিয়ে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। নাজমা বেগম ওরফে কাননবালারা তখন সবাই ভয়ে পালিয়ে গিয়ে বিলে লুকিয়ে থাকতেন। তারও মাস দুয়েক পরে একদিন হঠাৎ এক রাজাকার কয়েকজন মিলিটারি নিয়ে তাদের বাড়িতে হানা দেয় এবং চিৎকার করে বলে, “সব মালাউনগাে ধইরা মুসলমান বানাবাে। আমাদের সােনার পাকিস্তানে কোনাে মালাউন থাকবে না। থাকবে শুধু মুসলমান।” মিলিটারিরা কাননকে মুখ বেঁধে টেনে-হিচড়ে নৌকায় নিয়ে তােলে বাবা-মা বাধা দিতে গিয়ে হানাদার বাহিনীর হাতে কেউ খান গুলি, কেউ খান বেয়নেটের খোঁচা হানাদার বাহিনী নিজেদের ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে কাননের ওপর শুরু করে ভয়ঙ্কর নির্যাতন। আঁচড়ে-কামড়ে রক্তাক্ত হয় নিস্পাপ কাননবালা বণিক ওরফে আজকের নাজমা বেগম দীর্ঘ দুই মাস তিনি ঐ ক্যাম্পে আটক ছিলেন। প্রতি রাতেই তার ওপর চলতে পাশবিক নির্যাতন পৃথিবীর আলাে-বাতাস গায়ে মেখে তিনি আর কোনােদিন বেঁচে থাকবেন বলে তার কোনােই আশা ছিল না। তবুও ধীরে ধীরে তার মনের ভেতরে বেঁচে থাকার একটা গােপন তাগিদ জন্ম নিতে থাকে, যখন তিনি দেখতে পান ঐ ক্যাম্পই গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে ধরে আনা যুবতী মেয়েদের ধর্ষণের পর এবং যুবকদের ওপর অমানুষিক নির্যাতনের পর কী নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হতাে তার বেঁচে থাকার স্বপ্ন একদিন সফল হলাে মুক্তিযােদ্ধারা ঐ ক্যাম্প আক্রমণ করে।
হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করে যে ক’জন বন্দিকে জীবিত উদ্ধার করতে সক্ষম হন কাননবালা ছিলেন তাদেরই একজন কিন্তু বাড়ি ফিরে এলে তার মা-বাবা রাজাকারমিলিটারির ভয়ে এবং সামাজিকতার চাপে তাকে গ্রহণ করতে রাজি হলেন না। আর তখনই কাননবালা গত দু’মাসের অভিজ্ঞতার আলােকে মনে মনে শপথ নেন, দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করার কাজেই তিনি নিজেকে উৎসর্গ করবেন। মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে ফিরে আসেন পার্শ্ববর্তী গ্রামে বাইক্কামারী মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্পে ক্যাম্পের কমান্ডারের সহযােগিতায় তিনি অস্ত্র পরিষ্কার করা দিয়ে শুরু করে শেষ পর্যন্ত রাইফেল, এলএমজি, এসএলআর চালনা ও গ্রেনেড ছোঁড়া শিখে মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে বিভিন্ন অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। যদিও তিনি ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে পারেন নি, তবু দেশের ভেতরে থেকেই যেটুকু প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন এবং দেশের ভেতরে থেকে লুকিয়ে-চুরিয়ে গেরিলা পদ্ধতিতে যতটুকুই যুদ্ধ করেছিলেন তাই-বা কম কি! তার মতাে মেয়ের জীবনে সেটাই অনেক বড় পাওয়া বলে তিনি মনে করেন। কিন্তু এ সান্ত্বনা শুধুই তার নিজের। দেশ হানাদারমুক্ত হওয়ার পর ভেবেছিলেন, তিনি| মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নিয়েছেন শুনে মা-বাবা খুশি হবেন এবং তাকে সানন্দে গ্রহণ করবেন। কিন্তু হলাে তার বিপরীত।

তিনি ধর্ষিত, তিনি বীরাঙ্গনা—এই অজুহাতে তার মা-বাবা এবারও তাকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন শেষে তিনি এক মুসলমান পরিবারে আশ্রয় নিলেন এবং সহমুক্তিযােদ্ধা মােশারফ শেখকে একদিন বিয়ে করলেন। ঘর-সংসার দেখা আর ওদের গড়ে তােলার স্বপ্ন নিয়েই নাজমা বেগমের সারাদিনের ব্যস্ততা নাজমা বেগম আক্ষেপ করে বললেন, আজকের দিনে মানুষের মন কতই না যান্ত্রিক হয়ে গেছে কেউ কারাে বিপদে সহজে তাকিয়ে দেখে না। অথচ আগের দিনে একজন আরেকজনের বিপদে বুক আগলে দাঁড়াতাে শেষ যেদিন তার মা-বাবা তাকে পরিত্যাগ করলেন সেদিন সেই মুসলমান পরিবারটি যদি তাকে আশ্রয় না দিতাে তাহলে তার যে কী হতাে সেকথা বলতে গিয়ে তিনি তাদের কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করলেন। দেশের মানুষ একটা স্বাধীন দেশ পেয়েছে সেটাই তার কাছে বড় আনন্দ বলে জানালেন নাজমা বেগম। তার ব্যক্তিগত অভাব-অভিযােগের কথা তখন আর তার মনে পড়ে না। যদিও কদিন বাদেই নাকি এই বস্তি থেকে তাদের উচ্ছেদ হতে হবে। এরপর কোথায় ঠাই হবে তা তার জানা নেই। সবশেষে তার দৃপ্তকণ্ঠের ঘােষণা, স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অবশ্যই উজ্জ্বল। 

সূত্রঃ  মুক্তিযুদ্ধ জনযুদ্ধ আর্থ সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত – আতিউর রহমান

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!