মুক্তিযোেদ্ধাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান ও চাওয়া-পাওয়া : একটি জরিপের ফলাফল
নিঃসন্দেহে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির সমগ্র ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবােজ্জ্বল ঘটনা। ব্রিটিশ শাসন থেকে পাকিস্তানি শােষণের শৃঙ্খল ভাঙার ধারাবাহিক প্রচেষ্টার ফল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের প্রথম সাহসী প্রতিরােধ রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবির মধ্য দিয়ে উপ্ত হয় স্বাধীন ভূখণ্ডের আন্দোলনের শস্যবীজ প্রধানত ধনিক কৃষক পরিবারে জন্ম নেয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণীই সেদিন নেতৃত্ব দেন এই ভাষা আন্দোলনের এই নেতৃত্ব পরিণতি লাভ করে বছরের পর বছর ধরে সাধারণ মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থা পরিবর্তনের ন্যায়সঙ্গত প্রত্যাশার সঙ্গে শাসকগােষ্ঠীর অন্যায় এবং বৈষম্যমূলক আচরণের মধ্য দিয়ে। বিশেষত এই আন্দোলন গতিলাভ করে ১৯৬৯ সালে স্বৈরশাসক আইয়ুব-শাহীর পতনের মধ্য দিয়ে। আরেক সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অগ্রাহ্য করে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার নামে পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে চলে এক বিভীষিকাময় গণহত্যা এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ব্যানারে সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষ সংগঠিত হতে থাকেন। প্রতিরােধ গড়ে তােলেন।
গেরিলা ও সম্মুখসমরে জীবনপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন দেশপ্রেমিক ছাত্র-জনতা। সাধারণ মানুষের সর্বাত্মক সহযােগিতা পায় মুক্তিবাহিনী। কেন এই মুক্তিযােদ্ধারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, কি ছিল তাদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট, আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনাে জরিপ চালানাে হয় নি। এ বিষয়ে যেসব কাজ এরই মধ্যে হয়েছে সেগুলাের মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের প্রত্যাশা ও হতাশা, যুদ্ধের সময় খ্যাতিমান মুক্তিযােদ্ধাদের নানান কাহিনী ইত্যাদির সংবাদ আমরা পেলেও অচেনা, অজানা সাধারণ মুক্তিযােদ্ধাদের আর্থ-সামাজিক তথ্যাদি নিয়ে এখন পর্যন্ত উল্লেখ করার মতাে কোনাে গবেষণা হয় নি। সীমিত আকারে হলেও আলােচ্য এই গবেষণায় এসব তথ্য সগ্রহ ও বিশ্লেষণের চেষ্টা করা হয়েছে। পদ্ধতি ডিসেম্বর ১৯৯১-এ যশাের, কুষ্টিয়া, জামালপুর ও চট্টগ্রামে ১৫৯ জন মুক্তিযােদ্ধার ওপর আমরা জরিপ চালাই।
কেন, কী আশা ও প্রত্যাশা নিয়ে তারা যুদ্ধে যােগ দিয়েছিলেন যখন যুদ্ধে যােগ দেন তখন কোথা থেকে তারা প্রেরণা পেয়েছিলেন কি সমাজিক অবস্থান থেকে তারা এসেছিলেন এরকম প্রশ্নের ওপর ভিত্তি করেই চলেছে এ জরিপ। জরিপের ফলাফল উৎপত্তি জরিপে অংশগ্রহণকারী ১৫৯ জন মুক্তিযােদ্ধার মধ্যে ৭৮ শতাংশ গ্রাম থেকে এসেছিলেন। বাকি ২২ শতাংশ এসেছিলেন শহর থেকে অংশগ্রহণকারীদের নির্বাচনের ক্ষেত্রে জামালপুর ও কুষ্টিয়ায় নেয়া হয়েছে কেবল গ্রামাঞ্চল থেকে, যশাের ও কুমিল্লায় নেয়া হয়েছে গ্রামাঞ্চল ও শহরাঞ্চল উভয় স্থান থেকে। চট্টগ্রামের অংশগ্রহণকারীদের নেয়া হয়েছে কেবল শহরাঞ্চল থেকে এসব মিলে আমরা মােটামুটিভাবে একটি পক্ষপাতহীন নমুনা পাই। নমুনাটি এই কথাই বলে যে, মুক্তিযােদ্ধাদের ভিত্তি ছিল গ্রাম। শহরাঞ্চলের উপনমুনায় (যেমন, চট্টগ্রাম) প্রায় অর্ধেকই এসেছেন গ্রাম থেকে (ছক ৬.১ দ্রষ্টব্য)।
জমির মালিকানার ভিত্তিতে যেমন, আয়ের ভিত্তিতেও তেমনি নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, বেশির ভাগ মুক্তিযােদ্ধা এসেছিলেন উঁচু আয়ের পরিবার থেকে; যদিও তখন পূর্ব পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ২০১ টাকা জরিপে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধাদের বাৎসরিক পারিবারিক আয় গড়ে প্রায় ১৩,৯৫৫ টাকা যদি ধরেও নিই যে পরিবারের সদস্যসংখ্যা ১০ জন (যা খুবই অবাস্তব), তবুও জনপ্রতি আয় ১৩৯৫ টাকা, গড়ে জাতীয় আয়ের অন্তত ৭ গুণ। চট্টগ্রামের মুক্তিযােদ্ধাদের জনপ্রতি আয় জাতীয় গড়ের ৩০ গুণ বেশি। অবশ্যি, আয়ের হিসেবটি কিছুটা সতর্কতার সঙ্গে গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। তবে অঙ্ক যাই হােক প্রবণতা সঠিক। কিন্তু বেশির ভাগ পরিবারের আয়ের উৎস ছিল কৃষি পরিবারের প্রধানদের প্রধান পেশা এই মিলই দেখায় (ছক ৬.৪ দেখুন)। এমনকি যেসব মুক্তিযােদ্ধা শহর থেকে এসেছেন তাদের পারিবারিক আয়ের একটা অংশও ছিল কৃষিভিত্তিক। সুতরাং কৃষির ওপর পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোন আঘাত মানেই হলাে তাদের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া। মুক্তিযােদ্ধাদের বড় অংশ কৃষির সাথে জড়িত থাকলেও ব্যবসায় তাদের কাছে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। মুক্তিযােদ্ধাদের অনেকের (২৯ শতাংশের বেশি) পারিবারিক আয়ের জন্য ব্যবসায় গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এটি এও নির্দেশ করে যে, মুক্তিযুদ্ধে ব্যবসায়-বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পর্কিতদের যথেষ্ট স্বার্থ জড়িত ছিল। তারাও পাকিস্তান রাষ্ট্রের বৈরী আচরণের শিকার এবং তাই যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য সক্রিয় হন। ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মতাে চাকরিজীবীরাও পাকিস্তান রাষ্ট্রের আচরণে ক্ষুব্ধ ছিলেন এবং বাংলাদেশ-প্রত্যাশী ছিলেন মুক্তিযােদ্ধাদের প্রায় ৩৩ শতাংশ জানিয়েছেন, তাদের পারিবারিক আয়ের একটা অংশ আসতাে সাধারণ চাকরিক্ষেত্র হতে। মুক্তিযােদ্ধাদের অন্য ১৮ শতাংশ জানান যে, অন্যান্য উৎসও তাদের পারিবারিক আয়ে অবদান রাখতে (ছক ৬.৪ দেখুন)। উপরােক্ত তথ্যগুলাে মুক্তিযােদ্ধাদের পারিবারিক আয়ের উৎসের বিভিন্ন ক্ষেত্র বা উপায় নির্দেশ করে।
পরবর্তীকালে ছক ৬.৫ ও এসব তথ্যের পক্ষেই রায় দেয়। এই ছক অনুসারে গড়। পারিবারিক বার্ষিক আয় ছিল ১০ হাজার ২৭ টাকা। মনে রাখতে হবে, সত্তরের দশকে মাথাপিছু আয় ছিল ২০০ টাকার মতাে। এমনকি আমরা যদি একে ২৫০ টাকা ধরি এবং পরিবারের সদস্যসংখ্যা আটজন হয়, তবে গড় পারিবারিক আয় দাঁড়ায় প্রায় দুই হাজার টাকা। এর অর্থ দাঁড়ায়, আমাদের জরিপে। অংশগ্রহণকারীদের পারিবারিক আয় জাতীয় গড়ের চেয়ে কমপক্ষে পাঁচগুণ বেশি। চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে পার্থক্যটা আরও বেশি। এখানে শহুরে মুক্তিযােদ্ধাদের ক্ষেত্রে ব্যবসায় এবং চাকরি উভয় উৎস থেকে আয়ের পরিমাণ স্পষ্টতই উঁচু স্তরের কিন্তু যারা গ্রাম থেকে এসেছেন (উদাহরণস্বরূপ, জামালপুর এবং কুষ্টিয়া) ঐসব মুক্তিযােদ্ধার পারিবারিক আয়ের পরিমাণ জাতীয় গড়ের কমপক্ষে দ্বিগুণ। ছক ৬.৫ থেকে এ-ও দেখা যায় যে ব্যবসায়, চাকরি এবং অন্যান্য পেশা থেকে প্রাপ্ত আয়ের গুরুত্বও অনেক। এসবের অর্থ দাঁড়ায়, বেশির ভাগ মুক্তিযােদ্ধাই এসেছেন মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ আয়ের পরিবার থেকে নিম্নবিত্ত শ্রেণী সম্ভবত প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেন নি, কারণ তাদের অর্থনৈতিক এবং শিক্ষাগত শক্তির ঘাটতি ছিল। যেহেতু মুক্তিযুদ্ধে ছাত্ররাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপশ্রেণী তাই বােঝা যায় যে ছাত্রদের মধ্যে গরিবদের সংখ্যার স্বল্পতা মুক্তিযুদ্ধে তাদের সংখ্যা বাড়াতে পারে নি। যাহােক, দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ বিকল্প শক্তি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন এবং পরিপূরক ভূমিকা পালন করছেন।
ছক ৬.৬-এর মাধ্যমে এ কথাও বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধে শিক্ষিতরা একটি বিশাল ভূমিকা রেখেছেন এবং পরিপূরক ভূমিকা পালন করেছেন। তার মানে মুক্তিযুদ্ধে শিক্ষার ভূমিকা ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ১৫৯ জন উত্তরদাতার মাত্র একজন অশিক্ষিত ছিলেন। নমুনার পক্ষপাতকেও যদি আমরা যথেষ্ট গুরুত্ব দিই, তবু এই ছক হতে পরিষ্কারভাবে বােঝা যায় যে, শুধু সচেতন যুবক শ্ৰেণীই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। মাত্র ১২ শতাংশের শিক্ষাগত যােগ্যতা ছিল প্রাইমারি স্কুল পর্যন্ত। ষষ্ঠ হতে দশম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষাগত যােগ্যতাসম্পন্ন মুক্তিযােদ্ধার সংখ্যা ছিল অনেক (২৭ শতাংশ)। মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পাশ মুক্তিযােদ্ধা ছিলেন যথাক্রমে ১৪ এবং ১৯ শতাংশ। স্নাতক ডিগ্রিধারীদের সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ ২৮ শতাংশ এবং বাকি ৩ শতাংশ মুক্তিযােদ্ধার স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ছিল। দেখা যাচ্ছে উচ্চতর শিক্ষাগত যােগ্যতাসম্পন্ন যুবকদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি ছিল। সন্দেহ নেই, তারা এসেছিলেন উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী হতে। মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষিত মুক্তিযােদ্ধাও গরিব পরিবার হতে আসেন নি। এসব নির্দেশকের মাধ্যমে এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, যদিও মুক্তিযােদ্ধাদের একটা বিশাল অংশ গ্রাম হতে এসেছেন, তবুও তারা কিন্তু দরিদ্র শ্রেণীর নন। এদেরকে শ্রেণীবদ্ধ করা যায় মধ্যবিত্ত হিসেবে যাদের আশা-আকাক্ষা বিভিন্নমুখী, এমনকি পরস্পরবিরােধীও হতে পারে।
শিক্ষা এবং স্থাবর সম্পত্তি পরিষ্কারভাবেই মুক্তিযােদ্ধাদের আর্থ-সামাজিক উৎসের নির্ণায়ক হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। যদিও দুটি চলককে কার্যকারণ হিসেবে আলাদা করা কঠিন, তবুও একথা বােধহয় বলা যায়, শিক্ষাই মুক্তিযােদ্ধাদের যুদ্ধ। অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে নির্ধারক হিসেবে কাজ করেছিল। উত্তরদাতা এবং তাদের পিতাদের শিক্ষাগত যােগ্যতা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। ছক ৬.৮ নির্দেশ করে যে, উত্তরদাতার মাত্র ১৫ শতাংশের পিতা অশিক্ষিত ছিলেন। অন্যভাবে, তাদের ৮৫ শতাংশের পিতা শিক্ষিত ছিলেন। মনে রাখতে হবে, ঐ সময় দেশের মােট জনসংখ্যার ৮৫ শতাংশ ছিলেন অশিক্ষিত। শিক্ষিত বাবারা (এবং মায়েরাও) সাধারণত তাদের সন্তানের শিক্ষার প্রতি যত্নবান হয়ে থাকেন। এই তথ্য থেকে বােঝা যায়, মুক্তিযােদ্ধারা এমন পরিবার হতে এসেছেন যেখানে তাদের পিতারা ছিলেন শিক্ষিত।
মুক্তিযােদ্ধাদের আর্থ-সামাজিক পটভূমি বিচারের পর এখন আমরা তাদের রাজনৈতিক পরিচয় এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার অনুপ্রেরণার উৎস সম্পর্কে আলােচনা করবাে। উত্তরদাতাদের রাজনৈতিক পরিচয় ও সচেতনতা ১৫৯ জন উত্তরদাতার মধ্যে ৭৮ শতাংশ ১৯৭১-এর যুদ্ধের আগেই এক অথবা একাধিক রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত ছিলেন। যেহেতু তারা তরুণ ছিলেন (৩৫ শতাংশের বয়স ছিল ২০ বছরের নিচে এবং ৪৮ শতাংশের বয়স ২০ থেকে ৩০-এর মধ্যে), তাই তাদের ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকা ছিল খুবই স্বাভাবিক (ছক ৬.৮)। তাদের প্রায় ৩৯ শতাংশ ছাত্রলীগের (আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন) সাথে জড়িত ছিলেন। বাকি ২২ শতাংশ প্রধান ধারার রাজনৈতিক দলের (উদাহরণস্বরূপ: আওয়ামী লীগ) সাথে যুক্ত হওয়ার মতাে যথেষ্ট পরিণত ছিলেন। আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগ ছাড়া একটি অংশ (৯ শতাংশ) ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের সাথে জড়িত ছিলেন। ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল ৭ শতাংশ মুক্তিযোেদ্ধার যােগান দিয়েছিল। ২২ শতাংশ মুক্তিযােদ্ধার কোনাে পরিষ্কার রাজনৈতিক পরিচয় ছিল না (ছক ৬.৯)। নিঃসন্দেহে বলা যায়, মুক্তিযােদ্ধাদের একটা বিশাল অংশ আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের সাথে জড়িত ছিলেন। সংখ্যার বিচারে তাদের প্রাধান্য সহজেই বােঝা যায়।
রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ততা ছাড়াও আমরা জানতে চেয়েছি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ঠিক পূর্বমুহূর্তে তাদের মাঝে কোনাে রাজনৈতিক বােধ কাজ করেছিল। কিনা ১৫৫ জন উত্তরদাতাই এ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এটা একটা কৌতূহলােদ্দীপক ব্যাপার যে, বেশির ভাগ (৬২ শতাংশ) উত্তরদাতা ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের সামরিক অভিযানের আগে থেকেই মানসিকভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হওয়ার জন্যে তারা সবাই ছিলেন ব্যাকুল।
শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। ৮০ শতাংশ চেয়েছিলেন স্বাধীন দেশে আত্মমর্যাদা নিয়ে বসবাস করতে। ৭২ শতাংশ চেয়েছিলেন সমাজে স্বার্থান্বেষী মহলগুলাের শশাষণের সমাপ্তি সে যাই হােক, ৭০ শতাংশ মুক্তিযােদ্ধাই চেয়েছিলেন যুদ্ধের পর একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। উত্তরদাতাদের এসব বক্তব্য থেকে এটা পরিষ্কার যে, মুক্তিযােদ্ধারা স্বাধীন মাতৃভূমিকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়েছিলেন। যখন আমরা উত্তরদাতাদের প্রাধান্যের ভিত্তিতে পাঁচটা আকাক্ষার তালিকা করতে বলি তখন ৭২ শতাংশ তাদের প্রথম আকাক্ষা হিসেবে দেশের স্বাধীনতার কথা বলেন, ১৪ শতাংশ শােষণমুক্ত সমাজব্যবস্থাকে, ৫৪ শতাংশ স্বাধীন রাষ্ট্রে আত্মমর্যাদার সাথে বসবাসকে প্রথম স্থান দিয়েছেন। বাকি ৩ শতাংশ অন্য সব আকাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। শোষণহীন সমাজের আকাক্ষা দ্বিতীয় প্রাধান্য হিসেবে ব্যক্ত হয়েছে ৫০ শতাংশ উত্তরদাতার কাছ থেকে তারা এরপরে গুরুত্ব দিয়েছেন আত্মমর্যাদা (১৭ শতাংশ) এবং স্বাধীনতার (১১ শতাংশ) আকাক্ষা। তৃতীয় প্রাধান্য পরিষ্কার নয়। এ বিচারে ৩২ শতাংশ আত্মমর্যাদা, ২০ শতাংশ স্বার্থবাদী গােষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং ৯ শতাংশ সমৃদ্ধ বাংলাদেশ চেয়েছিলেন। ৩৩ শতাংশ সমৃদ্ধ বাংলাদেশকে চতুর্থ প্রাধান্য এবং প্রায় একইসংখ্যক মুক্তিযােদ্ধা স্বার্থান্বেষী গােষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধকে পঞ্চম প্রাধান্য হিসেবে ব্যক্ত করেছেন।
বাংলাদেশ অবশ্যই সকল প্রকার শােষণ থেকে মুক্ত হবে এবং যারা এ পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে সেসব স্বার্থান্বেষী মহলকে প্রতিহত করতে তারা ছিলেন প্রস্তুত তারা স্বাধীন বাংলাদেশে এমন একটি সমাজ আশা করেছিলেন যেখানে তারা আত্মসম্মান এবং মর্যাদা নিয়ে বাস করতে পারবেন। তাই একটা ব্যাপার পরিষ্কার যে, স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নই তাদের কাছে ছিল মুখ্য বাকি সবই গৌণ। আবার একথাও ঠিক যে, উৎসাহের এ মূল উৎসটি ওতপ্রােতভাবে জড়িত ছিল অন্য আকাক্ষাগুলাের সাথে যেগুলােকে চিহ্নিত করা হয়েছে পূর্ববর্তী অনুচ্ছেদ গুলােতে মুক্তিযুদ্ধ ছিল একমাত্র বাস্তবসম্মত উপায় যার মাধ্যমে প্রথমে স্বাধীনতা অর্জন এবং তারপর অন্যান্য স্বপ্ন পূরণের সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন। মুক্তিযােদ্ধাদের বক্তব্যও একথাই নিশ্চিত করে। ৫.৬ শতাংশ উত্তরদাতা জানান, তারা ১৯৭১-এর পূর্বেই এর জন্য প্রস্তুত ছিলেন। অবশ্য ৬২ শতাংশ ১৯৭১-এর মার্চ মাসে যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। অন্য ২১ শতাংশ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এপ্রিলে, বাকি ৭ শতাংশ। মে-তে এবং ৪ শতাংশ জুনে (ছক ৬.১২)। পাকিস্তানি সামরিক অভিযানের মাধ্যমে বাঙালিদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল বলে যে ভুল ধারণা প্রচলিত তাকে সরাসরি বাতিল করে দেয় এসব তথ্য। কার্যত বেশির ভাগ মুক্তিযোেদ্ধাই সামরিক অভিযানের পূর্বেই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলেন।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধ জনযুদ্ধ আর্থ সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত – আতিউর রহমান