কেস স্টাডি-২ মধ্যবিত্ত (সামরিক বাহিনীর সদস্য) গােলাম গােস্তফা বীরবিক্রম
গােলাম মােস্তফা বীরবিক্রমের ভাষ্যমতে, যুদ্ধ করাই তার পেশা। কারণ তিনি সৈনিকের চাকরি করেন। সে অবশ্য ৭০ দশকের কথা। তখন তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে ল্যান্সনায়েক হিসেবে কর্মরত। অবস্থান ছিল জয়দেবপুরে তিনি আবেগতাড়িত কণ্ঠে আরাে জানালেন, যুদ্ধ সবসময়ই চ্যালেঞ্জের কাজ কিন্তু ‘৭১-এর মার্চে এসে যেন সেই চ্যালেঞ্জ জীবনের একমাত্র ব্রত হয়ে দাঁড়ালাে। কারণ তখন তার মনে হয়েছিল, এবার একটা নতুন যুদ্ধ করতে হবে। জীবনের সবচেয়ে মহান ও গৌরবের যুদ্ধ। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে পরাভূত করে নিজের মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ অস্ত্রের জোরে দখলদার বাহিনী নিরীহ বাঙালি জাতির ওপর যে অত্যাচার-নিপীড়ন শুরু করেছিল তার প্রতিশােধ নিতে তিনি সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দিয়েছিলেন। একমাত্র আকাঙ্ক্ষা ছিল, বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে চিরকালের জন্য স্বাধীন করা গােলাম মােস্তফার বয়স তখন ২৩/২৪ বছর তখনও অবিবাহিত পড়াশােনা করেছিলেন নবম শ্রেণী পর্যন্ত গ্রামের বাড়ি ঢাকা জেলার অন্তর্গত দোহার থানার ঝনকীতে পরিবারে ছিল মা, বাবা, ৩ ভাই ও ৪ বােন তিনি ভাইদের মধ্যে বড়। মা-বাবার তৃতীয় সন্তান বাবা ডেমরায় লতিফ বাওয়ানী জুট মিলে চাকরি করতেন বড় ২ বােনের বিয়ে হয়েছিল।
ছােট ২ ভাই ও ২ বােন স্কুলে পড়তাে আর্থিক অবস্থা মােটামুটি সচ্ছল গ্রামে ফসলের জমাজমিও ছিল কিছু। নিজের জেলা সদর হিসেবে ঢাকা তাে বটেই, চাকরির সুবাদে দেশের অন্যান্য শহরের সাথেও মােটামুটি যােগাযােগ ছিল সেনাবাহিনী ত্যাগ করে গােলাম মােস্তফা প্রথমে অন্য কয়েক সেনাসদস্যের সাথে মিলে গ্রামের যুবকদের অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেন। তারপর সরাসরি মুক্তিবাহিনীতে গিয়ে যােগ দেন ২নং সেক্টরে মাস দুয়েক থাকার পর তিনি যান ৩নং সেক্টরে। আশুগঞ্জ, মাধবপুরসহ অনেক অপারেশনে তিনি অংশ নেন কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে চান্দুরা ব্রিজ আক্রমণকালে শত্রু সেনার এলএমজির ব্রাশ ফায়ারে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন তার ডান পা জখম হয়ে ক্ষত তৈরি হয়। সেই ক্ষতের স্থান গ্যাংগ্রিনে আক্রান্ত হলে শেষ পর্যন্ত ডান পা কেটে ফেলতে হয়। সেই থেকে তিনি আজও হুইল চেয়ারে চলাফেরা করছেন অসীম সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করার জন্যে স্বাধীনতার পর তিনি বীরবিক্রম খেতাবে ভূষিত হন। স্বাধীনতার পর তিনি বিয়ে করেন। বাবা মারা গেছেন সংসারে আছেন মা, স্ত্রী আর ৫ পুত্র সন্তান বড় দুই ছেলে এসএসসি পাশ করে চাকরির সন্ধানে ঘুরছে বাকিরা লেখাপড়া করছে। গােলাম মােস্তফা বর্তমানে তার নিজের জীবনযাপনে নিজেই যেন মাঝেমাঝে। হাঁপিয়ে ওঠেন যে অকুতােভয় সৈনিক দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জীবন দিতেও কুণ্ঠা করেন নি, দেশ রক্ষার কর্তব্যে যিনি চৌকস সৈনিকের উর্দি পরে সর্বদা থাকবেন অতন্দ্র প্রহরীর মতাে জেগে, আজ তিনিই ঢাকার মােহাম্মদপুরে অবস্থিত যুদ্ধাহত মুক্তিযােদ্ধাদের রােগমুক্তি বিশ্রামাগারে ঠাই পেয়ে অলস জীবন কাটাতে কাটাতে হয়ে পড়েছেন ক্লান্ত।
মানুষের মানবিকতাবােধের অতীত ও বর্তমানের একটা তুলনামূলক চিত্র আঁকতে গিয়ে গােলাম মােস্তফা বীরবিক্রম সিলেট জেলার মাধবপুরের স্মৃতি উল্লেখ করেন। সেখানে পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিবাহিনীর সম্মুখযুদ্ধে দুই দুইজন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হওয়ার পর বাকিরা টিকতে না পেরে পশ্চাদপসরণ করেন। কোনাে প্রকারে তেলিয়াপাড়া নামক এক গ্রামে পৌঁছলে মুক্তিযােদ্ধাদের বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে গ্রামবাসীরা সহানুভূতির সাথে সবাইকে একেক বাড়িতে আশ্রয় দেন সেবা-শুশ্রুষা করে নানাভাবে তাদের চাঙ্গা করে তুলতে চেষ্টা করেন। এমনকি, আনন্দের আতিশয্যে গরু জবাই করে সবাইকে ভােজ খাওয়ানাে হয় মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা সেখানে বসেই গ্রামবাসীর সহযােগিতায় পরবর্তী অপারেশনের পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নিতে থাকেন তিনি মনে করেন, তখন দেশের আপামর মানুষের মনে এমন সহানুভূতি না থাকলে দেশ স্বাধীন করতে মুক্তিবাহিনীর অনেক বেগ পেতে হতাে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, দেশের সেই মানুষেরাই আজ হয়ে উঠেছে হিংস্র-স্বার্থপর করে চলেছে একে অপরের সাথে অযথা হানাহানি। দেশ স্বাধীন হলেও তিনি নিজে স্বাধীনতার সুফল থেকে বঞ্চিত মানুষ শুধু মুখেই বলে, মুক্তিযােদ্ধারা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে সেটাও করুণা করে বলার শামিল বলে মনে হয়। তাই তিনি আজ মানসিক, অর্থনৈতিক কিংবা সামাজিক- সবদিক দিয়ে বড়ই বিধ্বস্ত তাছাড়া বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটের বিবেচনায় তিনি দেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল বলার মতাে কোনােই যুক্তি খুঁজে পান না। শুধুই মনে হয়, যে স্বপ্ন নিয়ে দেশ স্বাধীন করা হয়েছিল তার সবই ব্যর্থ হয়েছে।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধ জনযুদ্ধ আর্থ সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত – আতিউর রহমান