You dont have javascript enabled! Please enable it!
মুক্তিযুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণী : অসহযােগ পর্ব
পেছনে ফিরে দেখা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নেতৃত্বে বিভিন্ন পেশার মানুষের সম্মিলিত অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিজয়ের মুখ দেখেছে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়, স্বাধীন দেশের জন্মের দীর্ঘ সংগ্রামে অংশ নেয়া সকল পেশা ও শ্রেণীর মানুষের ভূমিকার কথা নানাভাবে উল্লিখিত হলেও বরাবর উপেক্ষিত থেকেছে শ্রমিক শ্রেণী  মূলধারার ইতিহাসে সংগঠিত এই বিশাল অংশকে উপেক্ষা করা হয়েছে। রাজনীতি কিংবা ইতিহাসের ধারাবর্ণনায় তাদের সরিয়ে রাখা হয়েছে। আমাদের মাটির খুব কাছাকাছি বসবাস করা এই শ্রমিক শ্রেণীকে আড়াল করে মুক্তিযুদ্ধের তল খুঁজে পাওয়া মুশকিল বৈ কি কেন এরকম হলাে? কেন মুক্তিযুদ্ধের ধারাবর্ণনায় সরিয়ে রাখা হলাে শ্রমিক শ্রেণীর গৌরবােজ্জ্বল অংশগ্রহণকে? এই অংশে তার অনুসন্ধানের চেষ্টা করা হয়েছে। এই অধ্যায়ে মুক্তিযুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণীর অংশগ্রহণকে খতিয়ে দেখার চেষ্টাও চালানাে হয়েছে নানাভাবে  সম্ভবত মুক্তিযুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণীর অংশগ্রহণ, তাদের আত্মোৎসর্গের ইতিহাস আলােচনায় এলে তা ক্যুনিস্ট বা বাম রাজনীতির অবদান হিসেবেই চিহ্নিত হবে—রাজনীতিবিদ ও ঐতিহাসিকদের এই বিবেচনা থেকেও শ্রমিক শ্রেণীকে উপেক্ষা করা হতে পারে।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সঠিক, দৃষ্টিনিরপেক্ষ আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করতে গেলে মুক্তিযুদ্ধে সংখ্যাঘন এই শ্রমিক শ্রেণীর অংশগ্রহণকেও গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণী আকস্মিকভাবে অংশগ্রহণ করে নি। ১৯৪৭-৭১ দীর্ঘ দুই যুগে কখনাে মূলধারার রাজনীতিতে, কখনােবা শ্রমিক রাজনীতির অবয়বে নানান উত্থানপতনের মধ্য দিয়েই সংগঠিত হয়েছেন তারা। কখনাে এ ধারা ছিল উত্তাল, কখনাে ছিল ধীরগতিসম্পন্ন শ্রমিক শ্রেণীর প্রতি পশ্চিমা শাসকগােষ্ঠীর বৈরী আচরণ ও উপেক্ষা বাঙালি জাতীয়তাবাদী শক্তির উন্মেষে তাদেরকে আরও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণে প্রণােদনা যুগিয়েছে। সম্ভাব্য তথ্য ও সূত্র থেকে এই বিষয়টি অনুসন্ধানের চেষ্টা চালানাে হয়েছে, যদিও তথ্য ও সূত্র পাওয়ার বিষয়টি ছিল দুরূহ মূলত দৈনিক পত্রিকা স্ক্যান করে তথ্যসূত্র জোগাড় করা সম্ভব হয়েছে। দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার’ (১৯৬৫ সাল থেকে কয়েক বছরের) ও পাকিস্তান লেবার গেজেট’-এর প্রাপ্ত কিছু সংখ্যাই ছিল তথ্যের উৎস। এক্ষেত্রে অন্যদের কিছু পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধানকে সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
 
শ্রমিক শ্রেণী ও ট্রেড ইউনিয়ন

প্রত্যেক অর্থনীতিতেই জনগণের নানারকম দল, উপদল থাকে যারা নিজেদের পেশা কিংবা সম্মিলিত স্বার্থকে সুরক্ষিত করতেই সংগঠিত হতে চায়। যখন পেশাগত সম্মিলন ঘটে, স্বার্থসংশ্লিষ্ট ঐক্যবােধ জাগে, অন্য গােষ্ঠীর সঙ্গে ভৌত সুবিধাদি নিয়ে বৈষম্যের বিষয়টি লক্ষণীয় হয় তখনই সমাজের নানান সুবিধে থেকে বঞ্চিত শ্রমিক শ্রেণী ঐক্যের কথা ভাবতে শুরু করে এবং তৈরি করে শ্রমিক সংঘ বা ট্রেড ইউনিয়ন। পেশাগত বৈষম্য নিরসনের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্য থেকেও তৈরি হতে পারে এ ধরনের সংঘবদ্ধতা। শ্রমিকরা এই ধরনের স্বার্থবােধ থেকে যােগ দিতে থাকেন শ্রমিক সংঘে এ বিষয়ে নানান তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও রয়েছে। ১৯২০ সালে দেয়া তত্ত্ব মতে রবার্ট হক্সি মনে করতেন, শ্রমিক শ্রেণীর সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক পরিবেশ থেকেও জন্ম নেয় শ্রমিক ইউনিয়ন। শ্রমিকদের মধ্যে যারা অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে সমান্তরালে অবস্থান করেন, যারা দলবদ্ধভাবে বসবাস করেন, যাদের শিক্ষা এবং মনন সমমানের, তারা তাদের প্রায় একই ধরনের সামাজিক এবং ভৌত সমস্যা সমাধানের চিন্তা থেকে একটি সাধারণ প্লাটফর্ম তৈরিতে উদ্বুদ্ধ হন। এই বােধ আসে ধারাবাহিক এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে (হক্সি, ১৯২০ : ৫৮)। ফ্রাঙ্ক টানেনবমের মতে ট্রেড ইউনিয়নের আন্দোলনের মূল সংগঠক দোকান, মিল, খনি এবং শিল্প কারখানা। শ্রমিক নেতা শুধুমাত্র বিরাজমান সমস্যাগুলােকে তুলে ধরেন (টানেনবম, ১৯৫১: ৬০)। সিডনি ওয়েব ও বিয়াত্রিস ওয়েব মনে করেন, শ্রমিক সংঘের উদ্দেশ্য হচ্ছে এর সদস্যদের অর্থনৈতিক সুবিধা আদায় করা (১৯২০ : ৭১৭)। মার্কস ও এঙ্গেলস-এর মতে, “শিল্প কারখানা বিকশিত হতে থাকলে শ্রমিক শুধুমাত্র সংখ্যাতেই বাড়েন না, তারা বৃহত্তর গােষ্ঠীসমূহে সংঘবদ্ধ হন, শক্তিধর হন. এবং তারা বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে দলবদ্ধ হতে থাকেন। চারপাশে সমমনা শক্তিকে আবিষ্কার করতে থাকেন যারা প্রকৃত যুদ্ধের দিনে তাদের সহায়তা করবেন” (১৯৭২: ৩৮)। তাই আমরা বলতে পারি, শ্রমিক ইউনিয়ন গঠনের পেছনে থাকে নানান সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক কার্যকারণ  শ্রমিকদের সংঘবদ্ধতার পেছনে আরও কাজ করে তাদের প্রতিপক্ষ, মালিকপক্ষের আচরণ, রাষ্ট্র এবং সরকারের ভূমিকাও এক্ষেত্রে লক্ষণীয়। বৈষম্য ও বঞ্চনা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক এবং সামাজিক কারণে শ্রমিক আন্দোলন দানা বাঁধে এবং বিরাজমান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট তাকে প্রভাবিত করে বিদ্যমান ধর্মীয় এবং সামাজিক অনুশাসন শ্রমিক আন্দোলকে বেগবান করে অথবা এর শক্তি খর্ব করে।

 
কিন্তু প্রাথমিকভাবে যদি ইউনিয়নগুলাে অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়াভিত্তিক হয় তবে বিদ্যমান অর্থে সামাজিক কারণই তাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে (ডি কস্টা ১৯৬৩ : ৪৯)। কাজেই পূর্ব পাকিস্তানের শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনকে বিবেচনা করতে হলে তখনকার আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটেই বিবেচনা করতে হবে। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ এবং বিশেষত বাঙালি মুসলমানরা কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের তুলনায় নিজেদের বঞ্চিত মনে করতেন। অর্থনৈতিক জীবনে তাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ও প্রাধান্য ছিল। সেখানে ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রাধান্য জমির মালিকানা ছিল প্রধানত হিন্দু জমিদারদের হাতে। মুসলমানরা ছিলেন হিন্দু জমিদারদের রায়ত কিংবা ক্ষুদ্র চাষী। মধ্যবর্তী আর্থিক কায়কারবার, ব্যবসায়-বাণিজ্য ও গ্রামীণ শিল্পের নিয়ন্ত্রণ ছিল প্রধানত বাঙালি হিন্দুদের হাতে এবং কোনাে কোনাে ব্যবসায়-বাণিজ্যের উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ ছিল মাড়ােয়ারিদের হাতে। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ এবং বিশেষ করে বাঙালি। মুসলমান জনগণ নগরবাসী বাঙালি এরং সংখ্যাগুরু হিন্দুদের তুলনায় নিজেদের বঞ্চিত মনে করতেন। পূর্ব বাংলার কিছু বস্ত্র কারখানা এবং একটি চিনিকলের মালিক ছিলেন হিন্দু। বাঙালি মুসলমানেরা নিজেদের অগ্রযাত্রার কথা ভাবতেন। তারা ভাবতেন জমির ওপর থাকবে তাদের নিয়ন্ত্রণ এবং তারা এ এলাকায় শিল্প। গড়ে তুলবেন (সােবহান, ১৯৯২ : ৭১০)। কিন্তু বাস্তবে মুসলমান বাঙালি উদ্যোক্তার অস্তিত্ব ছিল না। যদিও ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের শিল্পায়ন ছিল যৎসামান্য, শিল্পে প্রবৃদ্ধির হার ছিল পৃথিবীর দ্রুততমদের মধ্যে অন্যতম (লুইস, ১৯৬৯ : ১)। অর্থনীতির অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় দ্রুতগতিতে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল আধুনিক খাত যার মধ্যে ছিল শিল্প, নির্মাণ, খনি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস উৎপাদন। বৃহদায়তন উৎপাদনমুখী শিল্প গড়ে উঠছিল এত দ্রুতগতিতে যা ছিল প্রায় বিস্ময়কর (ঐ, পৃ. ৩)। কিন্তু দৃশ্যতই পূর্ব ও পশ্চিমে শিল্প অবকাঠামাে ও আয়ের বৈষম্যও বাড়ছিল। যদিও পূর্ব বাংলা ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ পাট উৎপাদনকারী এলাকা, তবুও একটি পাটকল ছিল না এ এলাকায় (ঐ, পৃ. ৫০)। পূর্ব পাকিস্তানে কৃষিজ দ্রব্যের কম দামের কারণে এ প্রদেশের কৃষকরা বাণিজ্যের শর্তে (terms of trade) পশ্চিমে পাকিস্তানিদের থেকে পিছিয়ে ছিলেন (ঐ, পৃ. ৯৪)। 
 
১৯৫০-এর দশকে পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতির উন্নতির লক্ষণসমূহ এবং অবকাঠামােগত বিভিন্নমুখিতা বৈষম্যের শর্তসমূহ সুস্পষ্ট করে তােলে। ১৯৬০-এর দশকে তা বাড়তে থাকে পশ্চিম পাকিস্তানি অর্থনীতির অব্যাহত ধারা প্রভাব ফেলতে থাকে দু’অঞ্চলের জীবনযাত্রার মানের ওপর ১৯৪৯-৫০ থেকে ১৯৬৯-৭০-এর মধ্যে মাথাপিছু আয়ের বৈষম্য বেড়ে যায় চূড়ান্ত ভাবে ১৯৫০-এর দশকে বৈষম্যের হার ছিল প্রায় ৫০ শতাংশ, কিন্তু ১৯৬০-এর  দশকে তা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। ১৯৫৯-৬০-এর বৈষম্যের এই হার ৩২.৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৯৬৯-৭০-এ দাঁড়ায় ৬১ শতাংশ (সােবহান, ঐ, পৃ. ৭১৭-১৯)। বৈষম্য সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যায় নিজ ব্যবহার্য পণ্যের ভােগের ক্ষেত্রে। কাপড়, কাগজ, সিগারেট-দিয়াশলাই, জ্বালানি ইত্যাদি ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু ভােগের হার বেড়ে যায় অস্বাভাবিক হারে। সেবা খাতেও এই চূড়ান্ত বৈষম্য লক্ষ করা যায়। স্বাস্থ্যসেবা, হাসপাতাল, শিশুসেবা, মাথাপিছু ডাক্তার, নার্স, হাসপাতালের বেড ইত্যাদি ক্ষেত্রেও বৈষম্য বাড়তেই থাকে। বাঙালিরা ক্রমশ উপলব্ধি করতে থাকেন যে এই বৈষম্য মূলত অবাঙালি কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিনির্ধারণের ফল। এর মধ্যেও পূর্ব পাকিস্তানিরা সামান্য শিল্পায়নের অভিজ্ঞতা লাভ করে, যার মালিকানা থাকে মূলত অবাঙালি উদ্যেক্তাদের হাতে। ১৯৬৪ মিলিয়ন টাকা খরচ করে PIDC পূর্ব পাকিস্তানে ৭৪ টি শিল্পকারখানা স্থাপন করে। বাঙালি মুসলমানেরা শিল্প-বাণিজ্যের সবক্ষেত্রই থেকে যান উপেক্ষিত পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে এ অঞ্চলে ভারত থেকে আসা অবাঙালিরাই শিল্পায়নে মুখ্য ভূমিকা রাখে। ১৯৪৮ সালে শিল্পকারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের সংখ্যা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে ১ লাখ ১৭ হাজার ৩৫৫; পূর্ব পাকিস্তানে ছিল ৫৫ হাজার ৭৪ জন। ১৯৫৪ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে কাজ পান ৮৮ হাজার শ্রমিক। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানে কাজ জোটে মাত্র ৩৩ হাজার জনের (ঐ, পৃ. ৭৪০)। PIDC-এর সক্রিয় সহায়তায় অবাঙালিরা শিল্প-কারখানা স্থাপন শুরু করে। অবাঙালি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলােকে সহায়তা করার জন্য ১৯৫৪ থেকে ১৯৬২ সালের মধ্যে PIDC ২২৯ মিলিয়ন রুপি খরচ করে ১২ টি জুট মিল তৈরি করে।
 
পূর্ব পাকিস্তানে এতে পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক জীবনে অবাঙালিদের অবস্থান যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ৬৭.৫৬ মিলিয়ন টাকায় তৈরি কর্ণফুলি কাগজ কলটি ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানের বিখ্যাত দাউদ গ্রুপের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়।  ১৯৬২ সালে সমগ্র পাকিস্তানের শিল্পায়নের ৭২.৮ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করতাে যে ৪৩টি শিল্প পরিবার তাদের একটি মাত্র ছিল বাঙালি। ব্যবসায়-বাণিজ্য, ব্যাংক| বীমাসহ অর্থনীতির সিংহভাগই নিয়ন্ত্রণ করতাে অবাঙালি সম্প্রদায় ও প্রতিষ্ঠান। (ঐ, পৃ. ৭৪৫-৪৬)। রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপােষকতায় বেড়ে ওঠা অবাঙালি সম্প্রদায়ের হাতে অর্থনীতির  নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ এ দেশের বৃহৎ জনগােষ্ঠীর ন্যায্য অধিকারের ক্ষেত্রে বৈষম্য আরও বাড়িয়ে তুলছিল। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে বাঙালি এই বৈষম্য, আর অসমতা অনুভব করছিল। এই বঞ্চনা, অসহিষ্ণ করে তুলছিল বাঙালি শ্রমিক শ্ৰেণীকে কখনাে কখনাে তারা মালিক সম্প্রদায়ের সাথে জড়িয়ে পড়ছিলেন সংঘর্ষে এবং সহিংসতায়। তাদের ভাবনা ও চিন্তায় এই বৈষম্যের বিষ প্রােথিত হচ্ছিল গভীরভাবে শ্রমিক শ্রেণী মনস্তাত্ত্বিকভাবে অবাঙালি মালিক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধ পক্ষে দাঁড়িয়ে পড়ছিলেন শুধু কলকারখানাতেই নয়, এর বাইরেও রাষ্ট্রের সর্বত্রই শ্রমিক শ্রেণী অনুভব করছিলেন এক সুস্পষ্ট বৈরিতা। তাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই যেন বাধ্য হয়ে তারা রাষ্ট্রশক্তির বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছিলেন। একই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট থাকায় গােটা দেশের শ্রমিক শ্রেণী সম-উষ্ণতায় অনুভব করছিলেন তাদের প্রতি মালিক শ্রেণীর স্পষ্ট বৈরিতা। ভেতরে জমে থাকা বঞ্চনা আর বৈষম্যের এই ক্রোধকে আরও যৌক্তিক এবং রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার সুযােগ করে দিতাে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম। বিশেষত কমিউনিস্ট পার্টি ছিল এক্ষেত্রে অগ্রগামী।
রাজনীতিঘনিষ্ঠ শ্রমিক শ্রেণীর এই সমন্বিত সম্পৃক্ততার বড় কাজটিই করতাে ট্রেড ইউনিয়ন। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের শ্রমিক সংগঠন শ্রমিক লীগও শ্রমিকদের বিক্ষোভকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পারম্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম দিন থেকেই শ্রমিক শ্রেণী এবং বিভিন্ন পেশাজীবীদের সংগঠিত করার চেষ্টা চলতে থাকে। ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন (EPT UF)। ড, এ, এম. মালিক সভাপতি, ফায়েজ আহমদ সাধারণ সম্পাদক, নেপাল নাগ, মােহাম্মদ ইসমাইল, মােহন। জমাদার সহ-সভাপতি এবং অনিল মুখার্জী ও গৌর বর্মণ হলেন সহ-সাধারণ সম্পাদক (কমরুদ্দীন আহমদ, ১৯৭৮ : ৩১)।
 
পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিক শ্রেণীর গুরুত্বপূর্ণ মুখপাত্র হিসেবে EPTUF-এর অভ্যুদয় ঘটে। উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। AITUC-এর সভায় গৃহীত রেজুলেশন মােতাবেক EPTUF-এর জন্ম হয়। এর বাইরেও ক্যুনিস্টসহ অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মীরা শ্রমিক শ্রেণীকে সংগঠিত করবার চেষ্টা চালান। পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্বৈরাচারী আচরণ এবং পূর্ব পাকিস্তানকে একটা উপনিবেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবার শাসক শ্রেণীর অভিপ্রায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার প্রচেষ্টা থেকেই এসব সংগঠনের জন্ম। তরুণ ছাত্র সম্প্রদায়ের কার্যক্রমের মধ্য দিয়েও প্রকাশিত হতে থাকে শ্রমিক শ্রেণীর নানা দাবি-দাওয়া । ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বরে ঈশ্বরদীতে অনুষ্ঠিত রাজশাহী বিভাগীয় যুব সম্মেলনের ইশতেহারে বলা হয় :
“স্বাধীনতার জন্য আমাদের প্রচেষ্টা এখনাে শেষ হয় নাই। আমরা ভেতর-বাইরের কোন শােষককে সহ্য করবাে না । যুব সম্প্রদায় সকল বৈষম্য আর বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে।” সম্মেলনের ইশতেহারে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয় যে, শ্রমিক শ্রেণীর প্রতি অবিচার রুখতে, তাদের ন্যায্য দাবি প্রতিষ্ঠা করতে এবং সমাজতান্ত্রিক দেশগুলাের মতাে সমতা আনতে যুবসমাজ শ্রমিক শ্রেণীকে সংগঠিত করবে (উমর, ১৯৮৪ : ৪১)। ভারি শিল্প, ব্যাংক বীমাসহ সকল বৃহৎ প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয়করণ, শ্রমিকদের জন্য ৮ ঘণ্টা শ্রমদিবস ধার্য এবং ন্যূনতম সুবিধা নিয়ে বাঁচবার জন্য মজুরি নির্ধারণের দাবিও উচ্চারিত হয়। রেলশ্রমিকদের আন্দোলনের প্রতিও সহমর্মিতা প্রকাশ করা হয় এই সম্মেলনে একইভাবে পাকিস্তান ছাত্র র্যালি তাদের সমাবেশে দাবি জানায় যে, দেশের মূল শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলাে হতে হবে রাষ্ট্রায়ত্ত এবং সরকারচালিত। শ্রমিক শ্রেণীর জন্য দিতে হবে বেঁচে থাকার ন্যূনতম সুবিধেসহ মজুরি। সামাজিক নিরাপত্তা প্রথা চালু করতে হবে (ঐ, পৃ ৭৩)। দি পাকিস্তান ইয়ুথ কনফারেন্স ১৯৫১ সালের ২৭-২৮ মার্চে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। এর ঘােষণাপত্রে বলা হয় : “আমরা যারা যুবক, যারা ডকের শ্রমিক, যারা বস্ত্র শিল্পে কর্মরত, যারা রিকশা চালাই, পাকিস্তানে আমরা আশা করি বেঁচে থাকার জন্য সম্মানজনক মজুরি, শিক্ষা এবং চাকরির নিশ্চয়তা। কিন্তু আমাদের মজুরির  হার সম্মানজনক নয়, শিক্ষার সুযােগ নেই এবং আমাদের শােষণ করেই সম্পদের পাহাড় জমাচ্ছে ধনিক শ্রেণী। এই সম্মেলন সম্মানজনক মজুরি, ৮ ঘণ্টা শ্রম এবং শ্রমিকদের জন্য বিনােদন সুবিধাদির দাবি জানায়” (ঐ, পৃ. ১৫৩)।  এই দাবি-দাওয়া শুধুমাত্র ছাত্র সম্প্রদায়ের কাছ থেকেই আসে নি।
 
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীও সুবিধা-বাঞ্চিত জনগণের অর্থনৈতিক ভাগ্য  পরিবর্তনের দাবি জানান। মুসলিম লীগের নেতা হিসেবে তিনি বেকারভাতা, ৮ ঘণ্টা শ্রমদিবস, মহিলা শ্রমিকদের জন্য ডে কেয়ার সুবিধাসহ মাতৃসদন সুবিধা প্রদানের দাবি জানান (ঐ পৃ. ৩৩)। কম্যুনিস্ট পার্টির নেতা খােকা রায় এক জবানবন্দিতে জানান, ১৯৫৪ সালেই আদমজী জুট মিলে তারা শ্রমিকদের নিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠিত করার চেষ্টা শুরু করেন। মােহাম্মদ তােয়াহা, সুনীল রায়সহ অন্য নেতারা নারায়ণগঞ্জে বিভিন্ন পাট ও বস্ত্রকল শ্রমিকদের সংগঠিত করতে থাকেন। চট্টগ্রামেও একই ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। এছাড়াও পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে উচ্চকিত ছিল শেখ মুজিবের কণ্ঠস্বর : “Can they prove that Islam means some people working in mills for Rs. 30 per month and other people going round the world squandering people’s money? My friends call me a Communist. I cannot understand how they call me a Communist. I am a Mussalman.” (রহমান ১৯৯০ : ১৫৮-৫৯)। এ সময় বাঙালি প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষ এবং বিরােধী রাজনৈতিক শিবিরে থাকা সকল সম্প্রদায় শ্রমিকদের নায্য দাবি-দাওয়া নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন। এবং এদের সংগঠিত করতে সমর্থন যােগান।

এভাবেই ক্ষমতাশালী অবাঙালি। ধনিক ও বণিক সম্প্রদায়ের সাথে রাষ্ট্রের বৈরি সম্পর্ক বাড়তে থাকে বছরের পর বছর এসব রাজনৈতিক প্রচারণায় শ্রমিকরা তাদের অধিকার এবং করণীয় সম্পর্কে ক্রমশ সচেতন হয়ে উঠতে থাকেন সমাজের এক বিশেষ শ্রেণী হিসেবে শ্রমিকরা অন্যান্য শ্রেণীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে থাকেন বিশেষ করে ছাত্রদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক সুদৃঢ় হতে থাকে সম্পৰ্কায়নের এই সামাজিক পুঁজির প্রভাব পড়তে থাকে মূলধারার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। রাজনৈতিক দলগুলাে তাদের প্রচারণা ও কর্মসূচিতেও শ্রমিক শ্রেণীর দাবি-দাওয়াগুলাে অন্তর্ভুক্ত করতে থাকে সামন্ত ও আধাসামন্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও মূল্যবােধের ভেতর দিয়ে বেড়ে। ওঠা শ্রমিক শ্রেণীও পরিচিত হতে থাকে অগ্রসরমান নানান চিন্তা-চেতনার সঙ্গে জাতীয়করণ, নির্দিষ্ট শ্রমঘণ্টা আদায়, নারী শ্রমিকদের জন্য সংরক্ষিত বিধান এবং সমাজতন্ত্র ইত্যাদির সাথে তাদের ঘনিষ্ঠ পরিচয় হতে থাকে এভাবেই শ্রমিকেরা। ক্রমশ অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্নে ধাবিত হতে থাকেন শ্রমিক শ্রেণীর ক্রমরাজনৈতিককরণ ছিল ধর্মীয় প্রভাব থেকে মুক্ত। বাঙালি। হিসেবে অধিকারচেতনাপ্রসূত শ্রমিক শ্রেণী বুঝতে শেখে রাষ্ট্রপক্ষ বৈরীশক্তি এবং তা মালিকপক্ষের স্বার্থ সংরক্ষণে সচেষ্ট। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত পূর্ব বাংলার ট্রেড। ইউনিয়ন আন্দোলন সব বাধা বিপত্তিসহ সামনের দিকে এগিয়ে চলে।

 
১৯৬১ সাল থেকে তারা ভিন্ন ধরনের বাধার সম্মুখীন হয় এটা ছিল তত্ত্বগত দিক থেকে স্ববিরােধিতা শিল্পায়ন বাড়লে শ্রমিকদের ঐক্য সুদৃঢ় হওয়ার কথা। ১৯৬০ থেকে শিল্পায়ন দ্রুতগতিতে শুরু হয়। আর এ পর্বেই শ্রমিক নেতৃবৃন্দ হতাশ হয়ে ওঠেন, তাদের মধ্যে ভাঙন দেখা দেয়, নিজেদের ভেতরে সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে। (আহমদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৫)। শিল্পায়ন সত্ত্বেও শ্রমিক সংঘের ঐক্যের হার কমতে থাকে শ্রমিক ইউনিয়নগুলাে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর থাকে এবং প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়ে। আইয়ুব শাসনামলে ধর্মঘট কার্যত নিষিদ্ধ ঘােষিত হয়। এ সত্ত্বেও বামপন্থীরা পূর্ব বাংলার শ্রমিক শ্রেণীকে সংগঠিত করবার প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন। ধারাবাহিক শিল্পায়নের সাথে সাথে শুরু হয় ব্যবস্থাপনা ও শ্রমিকদের মধ্যকার সম্পর্কের নানান সমস্যা। পূর্ব পাকিস্তানে দ্রুত গতিতে বৃহদায়ন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠতে থাকে। ফলে ক্ষুদ্র বস্ত্রশিল্পে নিয়ােজিত শ্রমিক এবং প্রান্তিক চাষীরা ক্রমেই কর্মহীন হয়ে পড়তে  থাকে শহর ও শিল্পাঞ্চল ঘিরে বাড়তে থাকে শ্রমিক-জনতার চাপ পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের ক্ষোভকে ঘিরে সংগঠিত হওয়ার প্রেরণা বাড়তে থাকে ১৯৬৪ সালে ৬০ হাজার জুট মিল শ্রমিকের ৫৪ ঘণ্টা ঐতিহাসিক ধর্মঘট এবং সকল দাবি আদায় তারই সত্যতা প্রমাণ করে। ন্যূনতম মজুরি ৬৫ টাকা থেকে ৮১ টাকায় দাঁড়ায়। কমরুদ্দীন আহমদের মতে, পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম দশকে পূর্ব পাকিস্তানের| শ্রমিক শ্রেণী শােষক ও মালিক শ্রেণীর ব্যাপারে দ্বিধান্বিত থাকলেও দ্বিতীয় দশকে | শ্রমিক স্বার্থ ও মালিক স্বার্থের বিষয়টিতে তারা পরিষ্কার হয়ে যান। পুঁজিপতি ও মালিকপক্ষের দমন নীতির বিরুদ্ধে তারা প্রকাশ্যে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তারা এর প্রতিকার খুঁজতেও সচেষ্ট হয়ে ওঠেন। স্পষ্ট করে তারা কাজের উন্নত পরিবেশ,  মজুরি বৃদ্ধি এবং নির্দিষ্ট শ্রমঘণ্টার দাবি তুলতে থাকেন। প্রতিটি ধর্মঘটেই এসব দাবি-দাওয়া উত্থাপিত হতে থাকে এবং সেগুলাে আদায়ের মধ্য দিয়েই তারা । সুসংগঠিত হতে থাকেন (আহমদ, ১৯৭৮ : ১৫৫)। বিক্ষুব্ধতার কাল পত্রপত্রিকা ঘেঁটে দেখা যায়, বিভিন্ন সেক্টরে শ্রমিকরা সংঘবদ্ধভাবে কিছু করবার চেষ্টা চালান। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত না বৃহৎ শিল্পকারখানার শ্রমিকরা এতে সম্পৃক্ত হন ততক্ষণ পর্যন্ত ফলপ্রসূ কোনাে শ্রমিক আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে নি। সংগঠিত হওয়ার পরই আন্দোলন দানা বেঁধে উঠতে থাকে পাকিস্তান অবজারভার-এর রিপাের্ট অনুসারে অর্থনৈতিক সঙ্কট ঘনীভূত হতে থাকে। বেকারত্ব বাড়তে থাকে এবং হরতাল ধর্মঘটের ডাক চলতে থাকে পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম উভয় অংশে ১৯৬৫ সালের জানুয়ারি মাস থেকে বিভিন্ন পেশার শ্রমিকরা হরতাল সংগঠিত করে ব্যাংক কর্মচারী, পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবের স্কুল-শিক্ষক, করাচির শিল্প।
শ্রমিক, পশ্চিম পাকিস্তানের ডাকপিয়ন, পূর্ব পাকিস্তানের ডাক বিভাগের কর্মচারী, পশ্চিম পাকিস্তানের টেলিগ্রাম বিভাগের শ্রমিক, বস্ত্র ও সুতা কারখানার শ্রমিক, চালনা বন্দরের শ্রমিক, নিউজপ্রিন্ট মিলের শ্রমিক, সড়ক পরিবহন শ্রমিক, ঢাকা ও রাওয়ালপিন্ডির ট্যাক্সি ড্রাইভার, খুলনার শিল্পশ্রমিক এবং আদমজী জুট মিলের শ্রমিকরা হরতাল আহবান করেন। শত সহস্র শ্রমিক কর্মচারী এই হরতালে অংশ। নেন। কতগুলাে হরতাল দমনে সামরিক বাহিনী তলব করা হয়। কতক জায়গায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। আদমজী শ্রমিকরা সিদ্ধিরগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ি আক্রমণ। করেন। শ্রমিকরা পুলিশের আচরণে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। গুলিবর্ষণে একজন শ্রমিক নিহত হন বলে শ্রমিকরা দাবি করেন। পূর্ব পাকিস্তানের রেল শ্রমিকরা বড় ধরনের হরতালের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। কিন্তু মােনেম খানের প্রাদেশিক সরকার তা নিষ্ঠুরভাবে দমন করে। এসব আন্দোলনে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়া এবং মার্কিন-বিরােধী বক্তব্যও উত্থাপিত হতে থাকে। এক কারখানার আন্দোলনে অন্য কারখানার শ্রমিকরাও সমর্থন দিতে থাকেন। ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এসব আন্দোলনকে সমর্থন দিতে থাকেন। এমনকি চরম ডানপন্থী রাজনৈতিক নেতারাও এসব আন্দোলনে সমর্থন দিতে থাকেন। চট্টগ্রামে রেল শ্রমিকদের এক বিদ্রোহে একজন ছাত্র নিহত হয়। ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ ২১ ফেব্রুয়ারিকে ভাষা আন্দোলন দিবস হিসেবে পালন করতে থাকেন।
মে দিবসের সিম্পােজিয়ামে অংশ নিয়ে খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ রেহমান সােবহান ও যশস্বী আইনজীবী কামাল হােসেন পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে কথা বলেন। রেহমান সােবহান জাতীয়করণের পক্ষে এবং কামাল হােসেন লেবার আইনের ক্ষতিকারক দিকগুলাে নিয়ে বক্তব্য রাখেন। শ্রমিক আন্দোলন রাজনৈতিককরণের সপক্ষে এসব পারস্পরিক অংশগ্রহণ ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই সময়ে শ্রমিক শ্রেণী ক্রমেই বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে থাকে। ১৯৬৫ সালের ১৬ জুলাই খুলনাতে শ্রমিকদের এক ঘেরাও কর্মসূচি পালিত হয়। পূর্ব বাংলার শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনের এই ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে পুরাে পরিস্থিতি এ সময় হয়ে ওঠে বিস্ফোরণােনুখ। এ সময় আরেকটি ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে প্রতিবাদস্বরূপ শ্রমিক-কর্মচারীরা কালাে ব্যাজ পরিধান করেন। সে সময় এরকম ঘটনা ছিল অকল্পনীয় এবং আশাতীত সরকার দ্রুত শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনকে দমন করতে উদ্যত হয় এবং প্রাদেশিক সংসদে এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গৃহীত হয় বাঙালি রাজনীতিবিদদের একাংশ এর প্রতিবাদ করেন। তারা উচ্চ কণ্ঠে সরকারি পদক্ষেপসমূহের বিরােধিতা করতে থাকেন।
১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হলে সরকার এই অছিলায় শ্রমিক আন্দোলন নিস্তব্ধ করে দিতে প্রয়াস পায়। জরুরি অবস্থা জারি হয়, সামরিক আইন বলবৎ হয় এবং মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার স্থগিত ঘােষিত হয়। পত্রিকাগুলাের সহায়তায় সরকার সারা দেশে যুদ্ধাতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়। সরকারের স্বার্থকে ত্বরান্বিত করতে শ্রমিককে মজুরির একাংশ যুদ্ধ ফান্ডে জমা দিতে বাধ্য করা হয়। এই খেলায় ভিখিরিদেরও বাদ দেয়া হয় নি। নেত্রকোনার ভিক্ষুক হরিদাস দে, যিনি কিনা ৭ সদস্যের এক পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনিও প্রতিরক্ষা ফান্ডে সপ্তাহের পুরাে আয় ১০ টাকা দান করতে বাধ্য হন, যা এ সময় পাকিস্তান অবজারভারে ফলাও করে প্রচার করা হয়। শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলন এ সময় প্রায় মুখ থুবড়ে পড়ে। যুদ্ধের সুযােগ নিয়ে শাসকগােষ্ঠীর জনবিরােধী কর্মকাণ্ড বাড়তে থাকে। শ্রমিকরা নানারকম অসুবিধার সম্মুখীন হতে থাকেন। তাদের অধিকার কুক্ষিগত করা হয়, আইনগত অধিকার স্থগিত করা হয় এবং অর্থনৈতিক কষ্টাবস্থা বাড়তে থাকে শাসকগােষ্ঠী এসব জনবিরােধী কার্যক্রম চালায় মাতৃভূমির রক্ষার নামে। যুদ্ধাতঙ্ক পুঁজি করে শাসকগােষ্ঠী এমন কিছু পদক্ষেপ নেয়, যা শ্রমিক শ্রেণীকে রাষ্ট্রীয় ন্যায্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে। এসব আলােচনার আগে উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে— ১. ট্রেড ইউনিয়নগুলােকে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত করার কাজ এগিয়ে যাচ্ছিল। এটা হয়তাে ট্রেড ইউনিয়ন সংক্রান্ত কোনাে বিষয় অথবা এটা কোনাে অপ্রকাশিত রাজনৈতিক এজেন্ডার প্রতিফলন, যা আরও গবেষণার দাবি রাখে। পারস্পরিক যােগাযােগ চলছিল পাঁচটি পর্যায়ে — ক, ট্রেড ইউনিয়ন এবং রাজনৈতিক দলগুলাের মধ্যে; খ, এক সেক্টরের ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে অন্য সেক্টরের ট্রেড ইউনিয়নের; গ, ট্রেড ইউনিয়ন এবং ছাত্রদের মধ্যে; ঘ, ট্রেড ইউনিয়ন এবং বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের সঙ্গে এবং ঙ. বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়নের সংঘবদ্ধ কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে যখন ট্রেড ইউনিয়ন ভারতীয় সেনাদলকে পাকিস্তানি বর্ডারে পাঠানাের সমালােচনা করছিল, একই সময়ে তারা উত্থাপন করছিল কিছু। মৌলিক আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক দাবি-দাওয়া। যেহেতু শ্রমিক সংঘবদ্ধতা একটা বড় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছিল  তাই ডানপন্থীরা এদের বিষয়ে মনােযােগী হয়ে উঠছিলেন। শ্রমিক শ্রেণীর বিক্ষোভ রুখতে কর্তৃপক্ষ দমন নীতির আশ্রয় নেয়।
শ্রমিক স্বার্থবিরােধী অধ্যাদেশ জারি হয়। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে এর বিরুদ্ধে রাজনীতিবিদরা প্রতিবাদ করেন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণীর অংশগ্রহণ কোন আকস্মিক ঘটনা ছিল না। বরং তা ছিল ধারাবাহিক প্রস্তুতির ফসল। ১৯৬৫-এর ঘটনা তাই প্রমাণ করে। ১৯৬৫ সালকে আমরা বলতে পারি বিক্ষোভের কাল। এটা ছিল ঝড়ের পূর্বপ্রস্তুতি। শ্রমিকরা ঘেরাও, রাস্তা অবরােধ, গাড়ি ভাঙচুরের মতাে সহিংসতায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেন। শাসক শ্রেণীর শাসনের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণীর নিজস্ব কায়দায় বিক্ষোভ ছিল তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেরই ফল। পাক-ভারত যুদ্ধের পর সরকার বিড়ি তৈরির পাতা ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘােষণা করে। হাজার হাজার বিড়ি শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েন। তাদের প্রতিবাদ এবং চিকার নিষ্ফল হয়ে পড়ে। বরং তারা জানতে পারেন পশ্চিম পাকিস্তানে একইপদক্ষেপ নেয়া হয় নি। এ ঘটনা পূর্বপাকিস্তানে বিপুলসংখ্যক বিড়ি শ্রমিকদের মধ্যে বৈষম্যের বিভীষিকা তৈরি করে। পাটকল শ্রমিকরা অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়া তুলতে থাকেন। বিভিন্ন শ্রমিক। ইউনিয়ন অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক দাবি উত্থাপন করতে থাকেন। ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের সাথে শ্রমিকদের আলাপ-আলােচনা চলতে থাকে। সংগঠিত ও অসংগঠিত শ্রমিকদের মধ্যে সমঝােতা বাড়তে থাকে ৭ জুনের ঘটনা শ্রমিকদের আন্দোলনের মােড় ঘুরিয়ে দেয়। তেজগাঁও, নারায়ণগঞ্জ, টঙ্গী এবং চট্টগ্রামের শ্রমিকদের সাথে শাসকগােষ্ঠীর বর্বর আচরণ শ্রমিক শ্রেণীর সাথে পাকিস্তানি রাষ্ট্রকে মুখােমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। শাসকগােষ্ঠীর ১৪৪ ধারা জারি। সত্ত্বেও নারায়ণগঞ্জ শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকরা ঢাকা অভিমুখে মিছিল সহকারে যাত্রা শুরু করে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ১৪৪ ধারা না ভাঙার সিদ্ধান্ত নেন। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের এই আচরণে শ্রমিকরা কিছুটা হতােদ্যম হয়ে পড়েন। (আহমদ, ১৯৭৮ : ৭৯)। উত্তাল সময় ১৯৬৭ এবং ১৯৬৮ সালের প্রথমার্ধে শ্রমিকরা মূলত অর্থনৈতিক ও ট্রেড ইউনিয়ন। সম্পৃক্ত দাবি-দাওয়াই তুলতে থাকেন। তবে তাদের কর্মসূচিতে রাজনৈতিক দাবিও ছিল। ১৯৬৭ সালের ১২ অক্টোবর তেজগাঁওয়ের এক প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা অবস্থান ধর্মঘট শুরু করেন এবং পরবর্তীকালে তা ঘেরাওয়ের রূপ ধারণ করে। ১৯৬৮ সালের ৫ জানুয়ারি সড়ক পরিবহন শ্রমিকরা এক পুলিশ অফিসারের দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদে কর্মবিরতি পালন করে।
এরকম নানান ঘটনা ঘটতে থাকে বাড়তে থাকে প্রতিবাদ ও ধর্মঘট এসব ঘটনা ক্রমশই শ্রমিক শ্রেণীকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের। বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয়। তারা ছাত্রদের সাথে আরও বেশি করে কার্যকর প্রতিবাদী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, মিছিল ও পথসভায় অংশ নিতে থাকেন। রাজপথে আইনরক্ষাকারী বাহিনীর সাথে সম্মুখ সংঘর্ষের প্রথমদিকে ছাত্ররা। থাকলেও পরবর্তীকালে তার সাথে যােগ দেন কর্মহীন সাধারণ নাগরিক, বেকার ও বস্তিবাসী সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুসারে পুলিশ-ইপিআরের গুলিবর্ষণে শ্রমিক নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে বােঝা যায় এ সময় বিপুলভাবেই শ্রমিক শ্রেণী। জড়িয়ে পড়েন প্রত্যক্ষ সংগ্রামে। উনসত্তরে আইয়ুব শাহীর পতনের সাথে সাথে সামরিক শাসন জারি হয়। সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী দলের সম্ভাব্য সরকারের কাছে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার ক্ষমতা হস্তান্তরের অস্বীকৃতি জনগণকে বিক্ষুব্ধ করে তােলে। জনসাধারণ রাস্তায় নেমে পড়েন। এই সময় শ্রমিক-জনতা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে অসহযােগে অংশ নেন। শুধু ঢাকা শহরেই নয়, ঢাকা নগরের সন্নিকটস্থ শ্রমিক অঞ্চলসহ সারাদেশের বড় বড় শহরেই শ্রমিকরা এই আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন (রহমান, ১৯৯৮ : ১৭)। পরিশেষে বলা যায়, বাঙালি শ্রমিকশ্রেণী অবাঙালি মালিকপক্ষ এবং রাষ্ট্রপক্ষের বৈরিতার শিকার হয়েছে দীর্ঘকাল এই সুদীর্ঘ সংঘাতকালে রাষ্ট্র সকল সময়ে। অবাঙালি মালিকপক্ষকে সমর্থন যুগিয়েছে।

প্রথমদিকে শ্রমিক শ্রেণীর দাবি-দাওয়া। ছিল অর্থনৈতিক পরবর্তীকালে তা রাজনীতিক রূপ নেয় এবং ক্রমশ সরকার ও প্রতিষ্ঠান বিরােধিতায় পর্যবসিত হয়। প্রতিষ্ঠান এবং শাসক শ্রেণী শ্রমিক শ্রেণীর। কাছে শত্রুপক্ষে পরিণত হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদী শক্তি বিশেষ করে আওয়ামী লীগ শ্রমিক শ্রেণীকে তাদের সহযােগী হিসেবে আবিষ্কার করতে থাকে। ক্রমেই তা । বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সহায়ক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলন নতুন ও জঙ্গি রূপ ধারণ করে, যা পরবর্তীকালে যুদ্ধকালে। অধিকতর সহায়ক ভূমিকা পালনে সমর্থ হয়। শ্রমিকদের এক বিরাট অংশ সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তাদের অংশগ্রহণের কারণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় । সামাজিক ন্যায়বিচারের বিষয়টি সুদৃঢ়ভাবে সংযুক্ত হতে পেরেছিল।

সূত্রঃ  মুক্তিযুদ্ধ জনযুদ্ধ আর্থ সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত – আতিউর রহমান

 

 
 
 
 
 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!