১৯৬১ সাল থেকে তারা ভিন্ন ধরনের বাধার সম্মুখীন হয় এটা ছিল তত্ত্বগত দিক থেকে স্ববিরােধিতা শিল্পায়ন বাড়লে শ্রমিকদের ঐক্য সুদৃঢ় হওয়ার কথা। ১৯৬০ থেকে শিল্পায়ন দ্রুতগতিতে শুরু হয়। আর এ পর্বেই শ্রমিক নেতৃবৃন্দ হতাশ হয়ে ওঠেন, তাদের মধ্যে ভাঙন দেখা দেয়, নিজেদের ভেতরে সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে। (আহমদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৫)। শিল্পায়ন সত্ত্বেও শ্রমিক সংঘের ঐক্যের হার কমতে থাকে শ্রমিক ইউনিয়নগুলাে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর থাকে এবং প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়ে। আইয়ুব শাসনামলে ধর্মঘট কার্যত নিষিদ্ধ ঘােষিত হয়। এ সত্ত্বেও বামপন্থীরা পূর্ব বাংলার শ্রমিক শ্রেণীকে সংগঠিত করবার প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন। ধারাবাহিক শিল্পায়নের সাথে সাথে শুরু হয় ব্যবস্থাপনা ও শ্রমিকদের মধ্যকার সম্পর্কের নানান সমস্যা। পূর্ব পাকিস্তানে দ্রুত গতিতে বৃহদায়ন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠতে থাকে। ফলে ক্ষুদ্র বস্ত্রশিল্পে নিয়ােজিত শ্রমিক এবং প্রান্তিক চাষীরা ক্রমেই কর্মহীন হয়ে পড়তে থাকে শহর ও শিল্পাঞ্চল ঘিরে বাড়তে থাকে শ্রমিক-জনতার চাপ পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের ক্ষোভকে ঘিরে সংগঠিত হওয়ার প্রেরণা বাড়তে থাকে ১৯৬৪ সালে ৬০ হাজার জুট মিল শ্রমিকের ৫৪ ঘণ্টা ঐতিহাসিক ধর্মঘট এবং সকল দাবি আদায় তারই সত্যতা প্রমাণ করে। ন্যূনতম মজুরি ৬৫ টাকা থেকে ৮১ টাকায় দাঁড়ায়। কমরুদ্দীন আহমদের মতে, পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম দশকে পূর্ব পাকিস্তানের| শ্রমিক শ্রেণী শােষক ও মালিক শ্রেণীর ব্যাপারে দ্বিধান্বিত থাকলেও দ্বিতীয় দশকে | শ্রমিক স্বার্থ ও মালিক স্বার্থের বিষয়টিতে তারা পরিষ্কার হয়ে যান। পুঁজিপতি ও মালিকপক্ষের দমন নীতির বিরুদ্ধে তারা প্রকাশ্যে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তারা এর প্রতিকার খুঁজতেও সচেষ্ট হয়ে ওঠেন। স্পষ্ট করে তারা কাজের উন্নত পরিবেশ, মজুরি বৃদ্ধি এবং নির্দিষ্ট শ্রমঘণ্টার দাবি তুলতে থাকেন। প্রতিটি ধর্মঘটেই এসব দাবি-দাওয়া উত্থাপিত হতে থাকে এবং সেগুলাে আদায়ের মধ্য দিয়েই তারা । সুসংগঠিত হতে থাকেন (আহমদ, ১৯৭৮ : ১৫৫)। বিক্ষুব্ধতার কাল পত্রপত্রিকা ঘেঁটে দেখা যায়, বিভিন্ন সেক্টরে শ্রমিকরা সংঘবদ্ধভাবে কিছু করবার চেষ্টা চালান। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত না বৃহৎ শিল্পকারখানার শ্রমিকরা এতে সম্পৃক্ত হন ততক্ষণ পর্যন্ত ফলপ্রসূ কোনাে শ্রমিক আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে নি। সংগঠিত হওয়ার পরই আন্দোলন দানা বেঁধে উঠতে থাকে পাকিস্তান অবজারভার-এর রিপাের্ট অনুসারে অর্থনৈতিক সঙ্কট ঘনীভূত হতে থাকে। বেকারত্ব বাড়তে থাকে এবং হরতাল ধর্মঘটের ডাক চলতে থাকে পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম উভয় অংশে ১৯৬৫ সালের জানুয়ারি মাস থেকে বিভিন্ন পেশার শ্রমিকরা হরতাল সংগঠিত করে ব্যাংক কর্মচারী, পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবের স্কুল-শিক্ষক, করাচির শিল্প।
শ্রমিক, পশ্চিম পাকিস্তানের ডাকপিয়ন, পূর্ব পাকিস্তানের ডাক বিভাগের কর্মচারী, পশ্চিম পাকিস্তানের টেলিগ্রাম বিভাগের শ্রমিক, বস্ত্র ও সুতা কারখানার শ্রমিক, চালনা বন্দরের শ্রমিক, নিউজপ্রিন্ট মিলের শ্রমিক, সড়ক পরিবহন শ্রমিক, ঢাকা ও রাওয়ালপিন্ডির ট্যাক্সি ড্রাইভার, খুলনার শিল্পশ্রমিক এবং আদমজী জুট মিলের শ্রমিকরা হরতাল আহবান করেন। শত সহস্র শ্রমিক কর্মচারী এই হরতালে অংশ। নেন। কতগুলাে হরতাল দমনে সামরিক বাহিনী তলব করা হয়। কতক জায়গায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। আদমজী শ্রমিকরা সিদ্ধিরগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ি আক্রমণ। করেন। শ্রমিকরা পুলিশের আচরণে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। গুলিবর্ষণে একজন শ্রমিক নিহত হন বলে শ্রমিকরা দাবি করেন। পূর্ব পাকিস্তানের রেল শ্রমিকরা বড় ধরনের হরতালের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। কিন্তু মােনেম খানের প্রাদেশিক সরকার তা নিষ্ঠুরভাবে দমন করে। এসব আন্দোলনে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়া এবং মার্কিন-বিরােধী বক্তব্যও উত্থাপিত হতে থাকে। এক কারখানার আন্দোলনে অন্য কারখানার শ্রমিকরাও সমর্থন দিতে থাকেন। ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এসব আন্দোলনকে সমর্থন দিতে থাকেন। এমনকি চরম ডানপন্থী রাজনৈতিক নেতারাও এসব আন্দোলনে সমর্থন দিতে থাকেন। চট্টগ্রামে রেল শ্রমিকদের এক বিদ্রোহে একজন ছাত্র নিহত হয়। ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ ২১ ফেব্রুয়ারিকে ভাষা আন্দোলন দিবস হিসেবে পালন করতে থাকেন।
মে দিবসের সিম্পােজিয়ামে অংশ নিয়ে খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ রেহমান সােবহান ও যশস্বী আইনজীবী কামাল হােসেন পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে কথা বলেন। রেহমান সােবহান জাতীয়করণের পক্ষে এবং কামাল হােসেন লেবার আইনের ক্ষতিকারক দিকগুলাে নিয়ে বক্তব্য রাখেন। শ্রমিক আন্দোলন রাজনৈতিককরণের সপক্ষে এসব পারস্পরিক অংশগ্রহণ ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই সময়ে শ্রমিক শ্রেণী ক্রমেই বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে থাকে। ১৯৬৫ সালের ১৬ জুলাই খুলনাতে শ্রমিকদের এক ঘেরাও কর্মসূচি পালিত হয়। পূর্ব বাংলার শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনের এই ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে পুরাে পরিস্থিতি এ সময় হয়ে ওঠে বিস্ফোরণােনুখ। এ সময় আরেকটি ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে প্রতিবাদস্বরূপ শ্রমিক-কর্মচারীরা কালাে ব্যাজ পরিধান করেন। সে সময় এরকম ঘটনা ছিল অকল্পনীয় এবং আশাতীত সরকার দ্রুত শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনকে দমন করতে উদ্যত হয় এবং প্রাদেশিক সংসদে এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গৃহীত হয় বাঙালি রাজনীতিবিদদের একাংশ এর প্রতিবাদ করেন। তারা উচ্চ কণ্ঠে সরকারি পদক্ষেপসমূহের বিরােধিতা করতে থাকেন।
১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হলে সরকার এই অছিলায় শ্রমিক আন্দোলন নিস্তব্ধ করে দিতে প্রয়াস পায়। জরুরি অবস্থা জারি হয়, সামরিক আইন বলবৎ হয় এবং মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার স্থগিত ঘােষিত হয়। পত্রিকাগুলাের সহায়তায় সরকার সারা দেশে যুদ্ধাতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়। সরকারের স্বার্থকে ত্বরান্বিত করতে শ্রমিককে মজুরির একাংশ যুদ্ধ ফান্ডে জমা দিতে বাধ্য করা হয়। এই খেলায় ভিখিরিদেরও বাদ দেয়া হয় নি। নেত্রকোনার ভিক্ষুক হরিদাস দে, যিনি কিনা ৭ সদস্যের এক পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনিও প্রতিরক্ষা ফান্ডে সপ্তাহের পুরাে আয় ১০ টাকা দান করতে বাধ্য হন, যা এ সময় পাকিস্তান অবজারভারে ফলাও করে প্রচার করা হয়। শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলন এ সময় প্রায় মুখ থুবড়ে পড়ে। যুদ্ধের সুযােগ নিয়ে শাসকগােষ্ঠীর জনবিরােধী কর্মকাণ্ড বাড়তে থাকে। শ্রমিকরা নানারকম অসুবিধার সম্মুখীন হতে থাকেন। তাদের অধিকার কুক্ষিগত করা হয়, আইনগত অধিকার স্থগিত করা হয় এবং অর্থনৈতিক কষ্টাবস্থা বাড়তে থাকে শাসকগােষ্ঠী এসব জনবিরােধী কার্যক্রম চালায় মাতৃভূমির রক্ষার নামে। যুদ্ধাতঙ্ক পুঁজি করে শাসকগােষ্ঠী এমন কিছু পদক্ষেপ নেয়, যা শ্রমিক শ্রেণীকে রাষ্ট্রীয় ন্যায্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে। এসব আলােচনার আগে উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে— ১. ট্রেড ইউনিয়নগুলােকে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত করার কাজ এগিয়ে যাচ্ছিল। এটা হয়তাে ট্রেড ইউনিয়ন সংক্রান্ত কোনাে বিষয় অথবা এটা কোনাে অপ্রকাশিত রাজনৈতিক এজেন্ডার প্রতিফলন, যা আরও গবেষণার দাবি রাখে। পারস্পরিক যােগাযােগ চলছিল পাঁচটি পর্যায়ে — ক, ট্রেড ইউনিয়ন এবং রাজনৈতিক দলগুলাের মধ্যে; খ, এক সেক্টরের ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে অন্য সেক্টরের ট্রেড ইউনিয়নের; গ, ট্রেড ইউনিয়ন এবং ছাত্রদের মধ্যে; ঘ, ট্রেড ইউনিয়ন এবং বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের সঙ্গে এবং ঙ. বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়নের সংঘবদ্ধ কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে যখন ট্রেড ইউনিয়ন ভারতীয় সেনাদলকে পাকিস্তানি বর্ডারে পাঠানাের সমালােচনা করছিল, একই সময়ে তারা উত্থাপন করছিল কিছু। মৌলিক আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক দাবি-দাওয়া। যেহেতু শ্রমিক সংঘবদ্ধতা একটা বড় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছিল তাই ডানপন্থীরা এদের বিষয়ে মনােযােগী হয়ে উঠছিলেন। শ্রমিক শ্রেণীর বিক্ষোভ রুখতে কর্তৃপক্ষ দমন নীতির আশ্রয় নেয়।
শ্রমিক স্বার্থবিরােধী অধ্যাদেশ জারি হয়। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে এর বিরুদ্ধে রাজনীতিবিদরা প্রতিবাদ করেন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণীর অংশগ্রহণ কোন আকস্মিক ঘটনা ছিল না। বরং তা ছিল ধারাবাহিক প্রস্তুতির ফসল। ১৯৬৫-এর ঘটনা তাই প্রমাণ করে। ১৯৬৫ সালকে আমরা বলতে পারি বিক্ষোভের কাল। এটা ছিল ঝড়ের পূর্বপ্রস্তুতি। শ্রমিকরা ঘেরাও, রাস্তা অবরােধ, গাড়ি ভাঙচুরের মতাে সহিংসতায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেন। শাসক শ্রেণীর শাসনের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণীর নিজস্ব কায়দায় বিক্ষোভ ছিল তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেরই ফল। পাক-ভারত যুদ্ধের পর সরকার বিড়ি তৈরির পাতা ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘােষণা করে। হাজার হাজার বিড়ি শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েন। তাদের প্রতিবাদ এবং চিকার নিষ্ফল হয়ে পড়ে। বরং তারা জানতে পারেন পশ্চিম পাকিস্তানে একইপদক্ষেপ নেয়া হয় নি। এ ঘটনা পূর্বপাকিস্তানে বিপুলসংখ্যক বিড়ি শ্রমিকদের মধ্যে বৈষম্যের বিভীষিকা তৈরি করে। পাটকল শ্রমিকরা অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়া তুলতে থাকেন। বিভিন্ন শ্রমিক। ইউনিয়ন অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক দাবি উত্থাপন করতে থাকেন। ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের সাথে শ্রমিকদের আলাপ-আলােচনা চলতে থাকে। সংগঠিত ও অসংগঠিত শ্রমিকদের মধ্যে সমঝােতা বাড়তে থাকে ৭ জুনের ঘটনা শ্রমিকদের আন্দোলনের মােড় ঘুরিয়ে দেয়। তেজগাঁও, নারায়ণগঞ্জ, টঙ্গী এবং চট্টগ্রামের শ্রমিকদের সাথে শাসকগােষ্ঠীর বর্বর আচরণ শ্রমিক শ্রেণীর সাথে পাকিস্তানি রাষ্ট্রকে মুখােমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। শাসকগােষ্ঠীর ১৪৪ ধারা জারি। সত্ত্বেও নারায়ণগঞ্জ শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকরা ঢাকা অভিমুখে মিছিল সহকারে যাত্রা শুরু করে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ১৪৪ ধারা না ভাঙার সিদ্ধান্ত নেন। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের এই আচরণে শ্রমিকরা কিছুটা হতােদ্যম হয়ে পড়েন। (আহমদ, ১৯৭৮ : ৭৯)। উত্তাল সময় ১৯৬৭ এবং ১৯৬৮ সালের প্রথমার্ধে শ্রমিকরা মূলত অর্থনৈতিক ও ট্রেড ইউনিয়ন। সম্পৃক্ত দাবি-দাওয়াই তুলতে থাকেন। তবে তাদের কর্মসূচিতে রাজনৈতিক দাবিও ছিল। ১৯৬৭ সালের ১২ অক্টোবর তেজগাঁওয়ের এক প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা অবস্থান ধর্মঘট শুরু করেন এবং পরবর্তীকালে তা ঘেরাওয়ের রূপ ধারণ করে। ১৯৬৮ সালের ৫ জানুয়ারি সড়ক পরিবহন শ্রমিকরা এক পুলিশ অফিসারের দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদে কর্মবিরতি পালন করে।
এরকম নানান ঘটনা ঘটতে থাকে বাড়তে থাকে প্রতিবাদ ও ধর্মঘট এসব ঘটনা ক্রমশই শ্রমিক শ্রেণীকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের। বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয়। তারা ছাত্রদের সাথে আরও বেশি করে কার্যকর প্রতিবাদী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, মিছিল ও পথসভায় অংশ নিতে থাকেন। রাজপথে আইনরক্ষাকারী বাহিনীর সাথে সম্মুখ সংঘর্ষের প্রথমদিকে ছাত্ররা। থাকলেও পরবর্তীকালে তার সাথে যােগ দেন কর্মহীন সাধারণ নাগরিক, বেকার ও বস্তিবাসী সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুসারে পুলিশ-ইপিআরের গুলিবর্ষণে শ্রমিক নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে বােঝা যায় এ সময় বিপুলভাবেই শ্রমিক শ্রেণী। জড়িয়ে পড়েন প্রত্যক্ষ সংগ্রামে। উনসত্তরে আইয়ুব শাহীর পতনের সাথে সাথে সামরিক শাসন জারি হয়। সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী দলের সম্ভাব্য সরকারের কাছে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার ক্ষমতা হস্তান্তরের অস্বীকৃতি জনগণকে বিক্ষুব্ধ করে তােলে। জনসাধারণ রাস্তায় নেমে পড়েন। এই সময় শ্রমিক-জনতা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে অসহযােগে অংশ নেন। শুধু ঢাকা শহরেই নয়, ঢাকা নগরের সন্নিকটস্থ শ্রমিক অঞ্চলসহ সারাদেশের বড় বড় শহরেই শ্রমিকরা এই আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন (রহমান, ১৯৯৮ : ১৭)। পরিশেষে বলা যায়, বাঙালি শ্রমিকশ্রেণী অবাঙালি মালিকপক্ষ এবং রাষ্ট্রপক্ষের বৈরিতার শিকার হয়েছে দীর্ঘকাল এই সুদীর্ঘ সংঘাতকালে রাষ্ট্র সকল সময়ে। অবাঙালি মালিকপক্ষকে সমর্থন যুগিয়েছে।
প্রথমদিকে শ্রমিক শ্রেণীর দাবি-দাওয়া। ছিল অর্থনৈতিক পরবর্তীকালে তা রাজনীতিক রূপ নেয় এবং ক্রমশ সরকার ও প্রতিষ্ঠান বিরােধিতায় পর্যবসিত হয়। প্রতিষ্ঠান এবং শাসক শ্রেণী শ্রমিক শ্রেণীর। কাছে শত্রুপক্ষে পরিণত হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদী শক্তি বিশেষ করে আওয়ামী লীগ শ্রমিক শ্রেণীকে তাদের সহযােগী হিসেবে আবিষ্কার করতে থাকে। ক্রমেই তা । বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সহায়ক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলন নতুন ও জঙ্গি রূপ ধারণ করে, যা পরবর্তীকালে যুদ্ধকালে। অধিকতর সহায়ক ভূমিকা পালনে সমর্থ হয়। শ্রমিকদের এক বিরাট অংশ সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তাদের অংশগ্রহণের কারণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় । সামাজিক ন্যায়বিচারের বিষয়টি সুদৃঢ়ভাবে সংযুক্ত হতে পেরেছিল।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধ জনযুদ্ধ আর্থ সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত – আতিউর রহমান