You dont have javascript enabled! Please enable it!
বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের যুদ্ধ

চাই জনগণের ইতিহাস আমাদের জাতীয় জীবনে একই সঙ্গে সবচেয়ে আনন্দের এবং বেদনার সময়টি ছিল ১৯৭১। একাত্তরেই মুক্তিযুদ্ধের ফসল বাংলাদেশের জন্ম হয়। প্রথমবারের মতাে আমরা স্বাধীন সার্বভৌম একটি দেশের নাগরিক হবার গৌরব অর্জন করি। এই অর্জনের কী যে আনন্দ তা ভাষায় প্রকাশ করা মুশকিল। পাশাপাশি একাত্তর ছিল আমাদের তীব্র বেদনারও বছর। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অসংখ্য মানুষের আত্মত্যাগেরও বছর এটি। লক্ষ শহীদের রক্তেভেজা একাত্তরের কথা আমরা ভুলি কীভাবে? তাই একাত্তর আমাদের জীবনে সুখ-দুঃখের এক মূর্ত প্রতীক। অবশ্যি, হঠাৎ করেই বাঙালি একাত্তরে এসে উপস্থিত হয়েছেন তেমন কথা কোনাে ইতিহাসবিদ বলতে সাহস করবেন বলে মনে হয় না। এক দীর্ঘ রক্তঝরা সংগ্রামের ফসল যে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এমনই দুর্ভাগ্য আমাদের যে, ইতিহাসের এই স্বীকৃত উপসংহারটিকেও আজ আর স্থির রাখা যাচ্ছে না। ইতিহাসের এই সত্যকে আজ উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিতর্কিত করা হচ্ছে  চেষ্টা চলছে তাকে ছাই চাপা দেয়ার। আমরা যারা নিজের চোখে মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি, নিজেরা তাতে অংশগ্রহণ করেছি তাদের আজ ভীষণ বিড়ম্বনা। যা দেখেছি, যা শুনেছি তাকেই অস্বীকার করার এই ষড়যন্ত্রমূলক আয়ােজন কী মেনে নেয়া যায়? বিশেষ করে কোমলমতি শিশুদের মনে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের নামে যে বিভ্রান্তি ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে তা সত্যি দুঃখজনক। অথচ যারা এ কাজটি করছেন তারাও নিশ্চয় জানেন, ইতিহাসের সত্যকে জোর করে মনগড়া খাতে প্রবাহিত করা যায় না। ইতিহাসকে পাশ কাটিয়ে যাবার কোনাে উপায় নেই। এমনকি যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি সেই পাকিস্তানিরাও এখন পর্যন্ত বাঙালির ইতিহাস নিয়ে ছক্কা পাঞ্জা খেলার সাহস দেখান নি। অথচ আমরা নিজেরাই আমাদের ইতিহাস নিয়ে কেবল ধস্তাধস্তি করে চলেছি। একাত্তরে সারা বিশ্বের অগ্রসারির গণমাধ্যমের সেরা সব প্রতিনিধিরা এসেছিলেন ঢাকায় তাদের প্রতিবেদনগুলাে এখনও কালের সাক্ষী সেগুলােই-বা অস্বীকার করি কীভাবে? এমনকি অনেক যাচাই-বাছাই করার পর সরকারি উদ্যোগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র তৈরি করা হয়েছিল। তাকেই-বা উপেক্ষা করি কিভাবে? মনে রাখা দরকার তা প্রয়াত হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় তৈরি ঐ দলিলপত্রের তথ্যাবলি দেশের সুপ্রতিষ্ঠিত ইতিহাসবিদরাও যাচাই করেছিলেন। তখন মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দলটিও ক্ষমতায় ছিল না। সেক্ষেত্রে নিশ্চয়ই সেই দলিলপত্রে তারে দলীয় কোনাে প্রভাব ছিল না বলে ধরে নেয়া যায়  বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হঠাৎ করেই শুরু হয় নি। এর পটভূমি তৈরি হয়েছে।

 
দীর্ঘদিন ধরে। হাজার বছর ধরে বাঙালি জনগােষ্ঠী সমাজ ও সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে টিকে থাকলেও একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের নাগরিক হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের পর থেকেই। অবশ্যি ভাষা আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে শুরু হয়েছিল ১১ মার্চ ১৯৪৮ থেকে। একমাত্র উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে জিন্নাহর চেষ্টার প্রতিক্রিয়া হিসেবে এই আন্দোলন দানা বাধে। একথা ঠিক, বাঙালিরাও বিপুলভাবে পাকিস্তান চেয়েছিলেন। মূলত আর্থসামাজিক মুক্তির আশা নিয়েই তারা তা চেয়েছিলেন। তারা আশা করেছিলেন, পাকিস্তান রাষ্ট্রটি হবে গণতান্ত্রিক, মানবিক ও সামাজিক ন্যায়পরায়ণধর্মী। জমিদারি প্রথা দ্রুত উচ্ছেদ করে পূর্ব বাংলার কৃষকদের ওপর শোষণের প্রক্রিয়া বন্ধ করতে এই রাষ্ট্র তৎপর হবে। প্রশাসনিক ন্যায়বিচারের মাধ্যমে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প, বাণিজ্য বিকাশের পূর্ণ সুযােগ অনগ্রসর বাঙালিদের দেয়া হবে। কিন্তু, নয়া রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকেই সকল ক্ষেত্রেই বাঙালিরা হতে থাকেন উপেক্ষিত নতুন রাষ্ট্রের বাজেটের প্রায় পুরােটাই খরচ হতে থাকে পশ্চিম পাকিস্তানিদের জন্যে। সেদিনের সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের শীর্ষে ছিলেন তারাই। তাই সরকারি জমাখরচের ন্যায্য হিস্যা বাঙালিরা যে পাননি তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। উল্টো তাদের প্রাণের চেয়েও প্রিয় বাংলা ভাষার ওপর নেমে আসে নগ্ন আঘাত ফলে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতির বিকাশের পথ হয় রুদ্ধ আমলাতান্ত্রিক, অমানবিক ও অগণতান্ত্রিক পাকিস্তানি রাষ্ট্রের চাপে বাঙালির বেড়ে ওঠার সকল স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায় বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে।
সেদিন পুলিশের  গুলিতে নিহত হয় বেশ কটি ভাষাপ্রেমী তাজা প্রাণ। সেদিনই পূর্ববাংলার মূলত কৃষক-সন্তান মধ্যবিত্ত তরুণেরা পাকিস্তান ধারণাটির কবর রচনা করে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও বহুমাত্রিক এক নয়া রাষ্ট্রচিন্তার বীজ বপন করে। চুয়ান্নর প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন ও যুক্তফ্রন্টের নিরঙ্কুশ বিজয়, একষট্টির রবীন্দ্র শতবার্ষিকী উদ্যাপন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ৬-দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এবং অসংখ্য ছাত্র, শ্রমিক ও কৃষক বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে | গড়ে ওঠে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান। এসব আন্দোলনে অনেক নেতারই অবদান ছিল কিন্তু তাদের সকলের অবদানকে আত্মস্থ করে ধীরে ধীরে একজনই কেবল বেড়ে উঠেছিলেন বাঙালি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবে তার সঙ্গে যােগাযােগ রাখলেই যেন সমগ্র বাঙালি জাতির সঙ্গে যােগাযােগ রাখা হতাে।
 
তার চোখ দিয়েই যেন সমগ্র বাংলাদেশকে দেখা যেত। সুখে-দুঃখে তার উপস্থিতি প্রায় সকলেই অনুভব করতেন। আর সে কারণেই ঊনসত্তরের সফল গণঅভ্যুত্থান শেষে ছাত্র-জনতা তাকে বাংলার বন্ধু বা বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধীরে ধীরে নিজে বেড়ে উঠেছেন আর সেই সঙ্গে বাঙালি জাতিসত্তার পূর্ণ বিকাশের প্রক্রিয়াকে জোরদার করেছেন। তিনি নিজে সাহসী ছিলেন, এবং সেই সাহস সঞ্চারিত করেছেন বিকাশমান পুরাে জাতির মনে। ভাষা আন্দোলনকাল থেকে তার পাশে ছিলেন এক ঝাক দক্ষ, মেধাবী, সহযােগী নেতা ও সংগঠক তাঁরা তাঁকে সর্বক্ষণ সহযােগিতা করেছেন বলে বেড়ে ওঠার এই প্রক্রিয়া আরাে বেগবান হতে পেরেছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল নামটি অবশ্যই তাজউদ্দীন আহমদ। তাছাড়া সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, কামারুজ্জামান ছাড়াও বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে আগ্রহী বামপন্থী নেতৃবৃন্দের সহায়তা ও আশীর্বাদ তিনি সক্রিয়ভাবে পেয়েছেন। মওলানা ভাসানীকে তিনি সবসময় শ্রদ্ধেয় নেতার সম্মান দিয়েছেন। মওলানা ভাসানীও তার সাংগঠনিক দক্ষতায় ছিলেন। মণি সিংহ-মােজাফফর আহমদের মতাে অনেক নেতাই তার চিন্তা ও চেতনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। আর তরুণ ছাত্রনেতাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল। গুরু-শিষ্যের সামরিক আইনের বেঁধে দেয়া গণ্ডির মধ্যেও সত্তরের নির্বাচন ছিল বাঙালি জাতির জন্যে এক টার্নিং পয়েন্ট’ এই নির্বাচনকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে গণভােটে রূপান্তর করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সত্তর সালে শহরে-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে তিনি যেসব প্রাক-নির্বাচনী সভায় বক্তৃতা করেছিলেন তাতেই দারিদ্র্য ও শােষণমুক্ত একটি স্বতন্ত্র দেশের কথা আকারেইঙ্গিতে ফুটে উঠেছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও বাঙালিকে দেশ শাসনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলাে।
জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডেকেও সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার কোনাে মতামত না নিয়েই তা হঠাৎ করে স্থগিত করে দেয়া হলাে। এর প্রতিবাদে একাত্তরের পয়লা মার্চ থেকেই শুরু হলাে অসহযােগ আন্দোলন। এরপর এলাে সাতই মার্চ এবারের সগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে রণ-হুঙ্কার দিলেন রাজনীতির এক অমর কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এর পরের ইতিহাস আমাদের সকলেরই জানা। তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্য বিচক্ষণ নেতৃবৃন্দের সহায়তায় এ ভূখণ্ডের পুরাে বেসামরিক শাসনভার বঙ্গবন্ধু নিজের হাতে তুলে নিলেন। তার নির্দেশেই একাত্তরের মার্চ মাসের বেশিরভাগ সময় বাংলার জীবন ও প্রশাসন স্বাধীনভাবে চলতে থাকে (দেখুন রহমান, ১৯৯৮)। পাশাপাশি সশস্ত্র সংগ্রাম করে স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনের স্বপ্নও সুদৃঢ় হতে থাকে।
 
ঔপনিবেশিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা আলাপ-আলােচনার নামে কালক্ষেপণ করে ২৫ মার্চের কালরাত্রে হায়েনার মতাে ঝাপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর। এর পরপরই ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরেই (১২-২০ মিনিট) টেলিফোন, টেলেক্স, টেলিগ্রাম ও ইপিআরের ওয়ারলেসের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণ করেন। ইংরেজি সেই ঘােষণায় তিনি বলেন : “This may be my last message, from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved” (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র : তৃতীয় খণ্ড, ১৯৮২, পৃ. ১). এর পরপরই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয় । কিন্তু স্বাধীনতার এই ঘােষণা নানভািবে জনগণের কাছে প্রচারিত হতে থাকে চট্টগ্রাম থেকে এটি প্রথমেই প্রচার। করেন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ এম. এ. হান্নান। ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট থেকে। যখন মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘােষণাটি একটু ভিন্নভাবে পুনরায় পাঠ করলেন তখন মুক্তিপাগল জনগণের মনে স্বস্তি ও সাহস দুই-ই যােগ। হয়েছিল (ঐ, পৃ. ২)। তার ঐ বেতার ঘােষণাটির ঐতিহাসিক মূল্য কোনােভাবেই সেদিনের ঐ ঘােষণার যে ক্যাসেটটি এখন পাওয়া যাচ্ছে তাতে তিনি আমাদের মহান জাতীয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের পরেই স্বাধীনতার ঘােষণাটি পাঠ করেছিলেন (‘I, Major Ziaur Rahman do hereby declare independence of Bangladesh on behalf of our great national leader Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman’) i Anthony Mascarenhas 1 Bangladesh : A Legacy of Blood (১৯৮৬) বইয়ের ‘Zia : The Man and the Myth’ শিরোনামের এগারাে পরিচ্ছদ স্বাধীনতার ঘােষণা। প্রসঙ্গে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। বেতার কর্মী বেলাল মােহাম্মদকে উদ্ধৃত করে তিনি জানিয়েছেন যে, একাত্তরের ২৬ মার্চ ২-৩০ মিনিটে এম, এ, হান্নানই প্রথম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘােষণাটি পাঠ করেন।
 
কিন্তু দশ কিলােহার্টজের ট্রানমিটারে প্রচারিত সেই ঘােষণাটি মাত্র ৬০ মাইলের মধ্যেকার সামান্যসংখ্যক মানুষই শুনতে পেয়েছিলেন। কিন্তু পরের দিন অর্থাৎ ২৭ মার্চ সন্ধে ৭-৩০ মিনিটে কালুরঘাট থেকে প্রচারিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত মেজর জিয়ার ঘােষণাটি বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতীয় ভূখণ্ডের বেতার তরঙ্গে ধরা পড়ে এবং এভাবেই তিনি ইতিহাসে তার নাম লিখতে সক্ষম হন। মেজর রফিকের ‘A Tale of Millions বইতেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এ ক্রান্তিকালে তকালীন মেজর জিয়ার ভূমিকা নিয়ে যে আলোচনা রয়েছে, তিনি জীব-শায় তার বিরােধিতা করেন নি • (দেখুন, Mascarenhas, ঐ, পৃ. ১২০)। তবে মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রে একই ঘটনা একটু অন্যভাবে রেকর্ড করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে : Major Zia, Provisional Commander-in-Chief of the Bangladesh Liberation Army, hereby proclaim, on behalf of Sheikh Mujibur Rahman, the independence of Bangladesh; I also declare, we have already framed a sovereign, legal Government under Sheikh Mujibur Rahman which pledges to function as per law and the constitution. The new democratic Government is committed to a policy of non-alignment in international relations. It will seek friendship with all nations and strive for international peace. I appeal to all Government to mobilise public opinion in their respective countries against the brutal genocide in Bangladesh. The Government under Sheikh Mujibur Rahman is sovereign legal Government of Bangladesh and is entitled to recognition from all democratic nations of the world (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড, পৃ, ২)। উল্লেখ্য, মেজর জিয়াউর রহমানের ৭ মার্চের স্বাধীনতা ঘােষণা পাঠের ঐতিহাসিক মূল কপিটি নিরাপত্তার কারণে নষ্ট করে ফেলা হয়েছিল । তবে স্বাধীন বাংলা বেতারে প্রচারিত অনুষ্ঠানমালার টেপরেকর্ড, ২৭ মার্চ, ১৯৭১ এবং দি স্টেটসম্যান, দিল্লি, ২৭ মার্চ, ১৯৭১ সূত্র ধরে উপরের ঘোষণাটি ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্রে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
 
খাটো করে দেখার উপায় নেই। তাছাড়া ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চের দৈনিক বাংলায় একটি জাতির জন্ম’ শিরােনামে যে লেখাটি তিনি লিখেছিলেন তাতে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা বলে অন্তত দু’বার উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, “তারপর এলাে ১ মার্চ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদাত্ত আহ্বানে সারা দেশে শুরু হলাে ব্যাপক অসহযােগ আন্দোলন। এরপর তিনি ৭ মার্চের কথা লিখেছেন। তাঁর ভাষায়, “৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘােষণা আমাদের কাছে এক গ্রীন সিগনাল বলে মনে হলাে।” ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে যে বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘােষণা করেছিলেন তার স্বীকৃতি সেদিনের দখলদার পাকিস্তানিদের লেখাতেও ধরা পড়েছে। জেনারেল নিয়াজির জনসংযােগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক তার ‘Witness to Surrender’ গ্রন্থেও বঙ্গবন্ধুর এই ঘােষণার কথা লিখেছেন। মাসুদুল হক অনূদিত সিদ্দিক সালিকের ‘নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল (নভেল পাবলিকেশন, ১৯৮৮) গ্রন্থে লেখা হয়েছে : “যখন প্রথম গুলিটি বর্ষিত হল, ঠিক সেই মুহূর্তে পাকিস্তান রেডিওর সরকারি তরঙ্গের (ওয়েভলেংথ) কাছাকাছি একটি তরঙ্গ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ভেসে এলাে ওই কষ্ঠের বাণী মনে হল আগেই রেকর্ড করে রাখা হয়েছিল। তাতে শেখ মুজিব পূর্ব  পাকিস্তানকে গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ হিসেবে ঘােষণা করলেন” (পৃ. ৮৫)। পরবর্তীকালে পাকিস্তান সফরকারী এক বাঙালি সাংবাদিকের কাছে জেনারেল টিক্কা খানও বলেছেন যে, শেখ মুজিবের কন্ঠস্বর তিনি চিনতেন এবং ২৬ মার্চের ঐ। ঘােষণা যে তারই ছিল তিনি সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন (মুসা সাদিক, ইতিহাসের আলােকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণা’, জনকণ্ঠ, ৪ এপ্রিল ২০০২)। 
 
বিবিসিও স্বাধীনতার এই ঘােষণার কথা প্রচার করেছিল। ২৭ মার্চ বিবিসির সকালের অধিবেশনে বলা হয় “শেখ মুজিবুর রহমান প্রদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেছেন” (বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বিবিসি’, বিসিডিজেসি, ২০০১)। ঐ একই গ্রন্থে মার্ক টালীর এক প্রতিবেদনের উল্লেখ রয়েছে যাতে বলা হয়েছে: “খবর পাওয়া গেছে যে, শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘােষণা করেছেন। … প্রেসিডেন্টের (ইয়াহিয়া খান) বক্তৃতায় কোন সন্দেহের অবকাশ রাখেন নি যে, সঙ্কটের জন্য তিনি সম্পূর্ণভাবেই শেখ মুজিব এবং তার অনুসারীদের দোষী করেছেন।”  উল্লেখ্য, ইয়াহিয়া খান ঐ ভাষণেই দম্ভ করে বলেছিলেন । এইবার শেখ মুজিব তার শাস্তি এড়িয়ে যেতে পারবেন না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার তিনিই ছিলেন মধ্যমণি আর সেই কারণেই ১০ এপ্রিল ‘৭১ মুজিবনগর থেকে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের যে আনুষ্ঠানিক ঘােষণা দেয়া হয় তাতেও বঙ্গবন্ধুর ঘােষিত স্বাধীনতার ঘােষণাটি পুনরায় নিশ্চিত করা হয় (বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ : দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ৪০-৬। সেই ঘােষণাটিই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের মূল স্তম্ভ। সেই অর্থে আমাদের পবিত্র সংবিধানের অংশ।
 
ব্রিটিশ পত্র-পত্রিকাও বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতার ঘােষণা দিয়েছেন তা নিশ্চিত করেছে। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চের ‘দি টাইমস’ প্রথম পাতায় শিরােনাম করেছিল: “Heavy fighting as Sheikh Mujib declares E. Pakistan independenti” অনুরূপভাবে একই দিনে ‘দি গার্ডিয়ান’ লিখেছিল: “Shortly before his arrest, Mujib had issued a proclamation to his people, which informed them: you are citizens of a free country” এরপরে নয় মাস ধরে যে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয় তার সুযােগ্য নেতৃত্ব দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুরই নামে তাঁরই আস্থাভাজন নেতৃবৃন্দ (সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীনসহ আরাে  অনেকে)। যুদ্ধকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন দু’বার তার  বজ্রকণ্ঠ’ প্রচারিত হতাে এবং মুক্তিযােদ্ধারা তাতে উজ্জীবিত হতেন। সাধারণ মানুষ অনুপ্রাণিত হতেন।  তাছাড়া, হালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিবরণ সংবলিত এমন আরাে অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি বের হয়েছে রােয়েদাদ খানের সম্পাদনায় (১৯৯৯) The American Papers। এই বইয়ে সন্নিবেশিত ঢাকাস্থ মার্কিন কলার অফিস থেকে স্টেট ডিপার্টমেন্টকে পাঠানাে গােপনীয় চিঠি ও দলিলপত্র পড়লে বােঝা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা দেয়ার মতাে নৈতিক ও রাজনৈতিক সক্ষমতা কার ছিল। সেদিনের সকল বার্তা, আলােচনা, সমালােচনা ছিল শুধু একজনকেই ঘিরে।  তিনি বাঙালির প্রশ্নাতীত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ঐ বইয়ের ৪৫৭ পৃষ্ঠায় শেখ মুজিবকে অবিসম্বাদিত নেতা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। একই বইয়ের ৪৬৫  পৃষ্ঠায় তাঁর ‘Charisrnatic Personalityর বর্ণনা দেয়া রয়েছে। তবে অন্য | গুরুত্বপূর্ণ এক গােপন দলিলে (৫ মার্চ, ১৯৭১) State Department বিশ্লেষণ PCIC 40164 : “All indications are that Mujib intends to cast the die in his speech on March 7 and will probably call for action tantamount to independence” (ঐ, পৃ. ৪৯৮)।
 
পরবর্তীকালে ঠিকই লক্ষ করা গেল, তিনি ৭ মার্চের ভাষণে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘােষণা না করলেও তাকে প্রায়। স্বাধীনতার ঘােষণাই বলা চলে (ঐ, পৃ. ৫০১)। এর পরে অন্যান্য দলিলপত্রেও Whereas in the facts and circumstances of such treacherous conduct Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, the undisputed leader of the 75 million people of Bangladesh, in due fulfilment of the legitimate right of self-determination of the people of Bangladesh, duly made a declaration of independence at Dacca on March 26, 1971, and urged the people of Bangladesh to defend the honour and integrity of Bangladesh (COTICHY স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ৪২)।  খুব সল্পবত সে কারণেই আজও (ডিসেম্বর ২০০২) বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমােদনক্রমে ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের ওয়েবসাইটে (দেখুন; http://www.bangladpoog/aboutbangladesh.asp) একই কথা আরাে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ওয়েবসাইটের তৃতীয় পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে যে, “Bangabandhu declared the Independence of Bangladesh on March 26, 1971 and urged upon the people to liberate the country through armed struggle. The entire nation stood like a rock and followed the command of their supreme leader and finally succeeded in vanquishing the marauding Pakistani occupation forces.”
 
শেখ মুজিব কর্তৃক ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ ঘােষিত হওয়ার প্রকৃত সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে (দেখুন, ঐ, ‘Alternate US postures toward possible East Pakistan secession’, পৃ. ৫০৮-৫১২ এবং Contingencies and actions to be taken in the event of separation, পৃ. ৫১২-৫১৭)। এসব দলিলপত্রে কোথাও শেখ মুজিবকে আপােসকামী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় নি। বরং স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি হিসেবেই তাঁকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।  হালে প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি বই হচ্ছে সাবেক মার্কিন কূটনীতিবিদ আর্চার ব্লাডের ‘দি জুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ (২০০২)। একাত্তরের দুর্বিষহ  দিনগুলােতে তিনি ঢাকায় কর্মরত ছিলেন। সুতরাং বাংলাদেশের জনগণের এবং তাদের প্রতিনিধিত্বকারী নেতৃবৃন্দের মনােভাব যেভাবে তিনি তাঁর এই বইতে বর্ণনা করেছেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই বইয়েরও মধ্যমণি শেখ মুজিবুর রহমান। ব্লাড নিয়মিত ওয়াশিংটনে বার্তা পাঠাতেন। সেই সব বার্তাতেও স্বাধীন বাংলাদেশের ইঙ্গিত ছিল। ছয় দফার প্রশ্নে শেখ মুজিব বরাবরই অনমনীয় ছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি পূর্ব। পাকিস্তান’-এর বদলে বাংলাদেশ’ শব্দটি ব্যবহার করতে শুরু করেন। শব্দের এই রূপান্তরও যে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল সেদিকটিও ব্লাডের দৃষ্টি এড়ায় নি। তিনি লিখেছেন : “Upon reading this report after a gap of many years, I was struck by Mujib’s frequent reference to Bangla Desh instead of East Pakistan. I do not recall any earlier public use of the term Bangla Desh, which means Bengali homeland. Mujib may have done so in order to convey a subtle hint to a West Pakistani audience that there was an alternative to the continual union of East Pakistan and West Pakistan. In those early days of 1971 Bangla Desh was expressed in two words, later when joined together Bangladesh carried the clear connotation of an independent country, i.e., for the Bangalis of East Pakistan” (Blood, 2002: ১৪৬)।
পয়লা মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত ঘােষণার পর। বাংলাদেশের স্বাধীন অ্যুদয় যে অবধারিত হয়ে যায় সে কথাটি ব্লডের কথায় ফুটে ওঠে। অসহযােগের অবয়বে যে আন্দোলন দানা বাঁধে তা যে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেবে সে কথা তিনি স্পষ্টই বলেছেন (“It would be difficult, perhaps impossible, for the movement toward independence to be checked now”) (ঐ, পৃ. ১৬৩)। তাই ইতিহাসের এই বাস্তবতা সেই আন্দোলনের অদ্বিতীয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মওদুদ আহমদও জাতির প্রতিষ্ঠাতা জনক।  মার্কিন গােপন দলিলে আশঙ্কা করা হয়েছে যে পূর্ব পাকিস্তান ধীরে ধীরে স্বাধীনতা ঘােষণার দিকেই “With the steady drift toward independence in East Pakistan over the past several days this posture has now been overtaken as a practical recoverse … If agreement is not reached, Mujib is expected to announce on March 7 complete or virtual independcnce”…(ঐ, পৃ: 503)। (‘The founding father’) বলে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছেন (দেখুন, Ahmed, 2002, p. ৫১)।
 
শাপাশি তিনি জিয়াউর রহমানকে সমর নায়ক (‘War। hero’) বলে পরিচিতি দান করেছেন (ঐ, p. ৫২)। The New Encyclopaedia Britanica (1982 : 427), Vol 9 ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস বিষয়ে বিস্ত রিত তথ্য উপস্থাপন করেছে। সেই তথ্য মতেও শেখ মুজিবই যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেছেন সে কথা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে : “The success of the Awami League in East Pakistan surprised even its friends. Sheikh Mujib emerged with a majority at his command among the membership of the new assembly (167 of the 300 total)…. Yahya’s plan provided that when the new assembly met it must produce a constitution within 100 days. Mujib, however, stood out for complete independence for East Pakistan, except for foreign policy, though the East wanted to make its own aid, trade, and defense agreements. Bhutto rejected these terms and refused to bring his party to Dacca to participate in the assembly. On March 1, 1971, President Yahya announced that the National Assembly would be suspended indefinitely. Sheikh Mujib replied by ordering a boycott and general strike throughout East Pakistan. Bowing to the inevitable, Yahya proceeded to Dacca in midMarch to negotiate a compromise that would concede the substance of Mujib’s demands while retaining tenuous tics that might still preserve the name of Pakistan. But compromise proved impossible. President Yahya denounced Mujib and his men as traitors and launced a drive to “reoccupy” the East with West Pakistan troops. Warfare between government troops and supporters of the Awami League broke out in the East in March. Sheikh Mujib and many of his colleagues were arrested, while others escaped to India, proclaiming East Pakistan an independent state under the name Bangladesh (Bengal Land).” আমি এতােটা বিস্তৃতভাবে দলিলপত্র উদ্ধৃত করে স্বাধীনতার ঘােষণা প্রসঙ্গটি টানলাম এজন্যে যে, এই বিষয়টি নিয়ে অযথা একটি বিভ্রান্তিকর বিতর্ক জিইয়ে রাখা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এই বিতর্ক ইতিহাসের স্রোতে একদিন ভেসে যাবে।
 
এই  বিতর্কের মাধ্যমে শুধু শুধু মুক্তিযুদ্ধের আরেকজন সমরনায়ককে (যিনি নিজেও বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা মানতেন) খাটো করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, তাঁর জীবদ্দশায় এ ধরনের বিতর্ককে তিনি প্রশ্রয় দেন নি। আশা করছি, ইতিহাসে যার যে স্থান  নির্ধারিত হয়ে আছে তার হেরফের করার কু-যুক্তি ও কু-বুদ্ধি দেয়ার মতাে সুবিধাবাদী মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম না হওয়া সত্ত্বেও জাতি তাতে বিভ্রান্ত হবে। বরং আমাদের গৌরবােজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল পর্যায়ের সংগঠক ও নেতাদের প্রতি জাতির কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ধারা অব্যাহত থাকবে। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে অযথা এই ধস্তাধস্তির অবসান হওয়া একান্ত জরুরি। জাতীয় ঐকমত্যের জন্যেই এ প্রশ্নে চূড়ান্ত বােঝাপড়া কাম্য  আমাদের জাতীয় অগ্রগতির স্বার্থেই তা হওয়া উচিত। এলিটদের প্রাধান্যনির্ভর বিভ্রান্তিকর এই ইতিহাস দেশের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনে সহায়ক হতে পারে না। কেননা, ইতিহাসের দোহাই দিয়ে শাসক শ্রেণী জনগণকে আচ্ছন্ন করে ফেলে বিভক্ত করে রাখে সমাজকে। এই আচ্ছন্নতা থেকে তাদের মুক্তি দিতে পারে একমাত্র বিকল্প ইতিহাস বা নিচতলার ইতিহাস। নয়া ধারার এই ইতিহাসচর্চার সময় একজন গবেষককে শুধু অতীতের ঘটনাপ্রবাহ ব্যাখ্যা করলেই চলবে না, তাকে বর্তমানের সঙ্গেও সংযুক্ত করতে হবে (হবসবম, ১৯৯৮ : ২৮৪)। ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহের পেছনের কার্যকারণ খুঁজে পেতে হবে।  অতীতের পরিবর্তন বুঝতে পারলে বর্তমানের গতিপ্রকৃতিও ধরা সহজ হবে এবং ভবিষ্যৎকেও পরিবর্তন করার শক্তি অর্জন করা যাবে তবে সেজন্যে ইতিহাসের মূলনায়ক জনগণের অংশগ্রহণের বস্তুগত ভিত্তি খুঁজে বের করতে হবে।
তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ধরতে হবে। সেই আকাক্ষার আদলে দেশ গড়ার কাজে সবাইকে ব্রতী হতে হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমাদের প্রচলিত ইতিহাস নানা বিভ্রান্তিতে ভরা সেখানে নেতানেত্রীর কথা থাকলেও সাধারণ মানুষের অবদানের উল্লেখ থাকে কদাচিৎ নির্মোহ দৃষ্টির অভাবেই আমাদের ইতিহাসে অস্পষ্টতা। বাড়ছে, যা আমাদের চলার পথে দিন দিন বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ইতিহাসের বিকল্প অনুসন্ধান বলা চলে, আমরা মােটেই সৌভাগ্যবান নই। কেননা “যে-সকল দেশ ভাগ্যবান্ তাহারা চিরন্তন স্বদেশকে দেশের ইতিহাসের মধ্যেই খুঁজিয়া পায়, বালককালে ইতিহাসই দেশের সহিত তাহাদের পরিচয়সাধন করাইয়া দেয়। আমাদের ঠিক তাহার উল্টা। দেশের ইতিহাসই আমাদের স্বদেশকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছে” (রবীন্দ্র-রচনাবলী, ২য় খণ্ড, পৃ. ৭০৪)। নিজের দেশের ইতিহাস যদি থেকে যায় অস্পষ্ট তাহলে কোথা থেকে আমরা প্রাণ আকর্ষণ করবাে? বর্তমানে আমরা যে ইতিহাসচর্চা করছি তাতে আমাদের দেশের মানুষ নেই আছে শুধু নেতাদের কথা ।
 
মারামারি কাটাকাটিতে ভরা সেই। ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায় না অগুণতি সাধারণ মুক্তিযযাদ্ধার সরব উপস্থিতি। ইতিহাস গবেষণার দৃষ্টিভঙ্গি ও পদ্ধতি নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। ইতিহাসের অনুসন্ধান সম্পর্কে অনন্ত গিরি বলেন : “ঐতিহাসিক অনুসন্ধান।  অতীতের ধারণাসমূহকে পাল্টে ফেলা নয় বরং অতীতে অস্তিত্বশীল জীবনের কী রূপ ছিল তা বােঝার একটি অমীমাংসিত বিষয়” (গিরি, ১৯৯৪ : ৩০৪)। এ প্রসঙ্গে। আরেকটু বিস্তৃত করে ওম প্রকাশ বলেন : “ইতিহাস হচ্ছে অতীতের সঠিক রূপটির অনুসন্ধান এবং তা হচ্ছে সাধারণভাবে ঘটনা বলতে যা বােঝা যায় তার ভিত্তিতে। ঘটনার পরম্পরায় একটি সরলরৈখিক উপস্থাপন” (প্রকাশ, ১৯৯২ উল্লেখ : গিরি, ঐ)। ইতালির দার্শনিক আন্তোনিও গ্রামশি (১৮৯১-১৯৩৭) তার Prisort Notebooks-এ যে subalterm পদটি ব্যবহার করেছেন তা সর্বহারার প্রতিশব্দ। পুঁজিবাদী সমাজে নিম্নবর্গ হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণী এবং সমাজের সর্বময় ক্ষমতা বুর্জোয়া আর তার সহচর এলিট বা উচ্চবর্গ শ্রেণীর হাতে। উভয়ে মিলে সাবঅলটার্ন শ্রেণীর ওপর শােষণ-শাসন পরিচালনা করে। এই সমাজ-পরিচালক তথা ব্যবস্থাপক শ্রেণী hegemonic বা আধিপত্যবাদী গ্রামশি এই নিম্নবর্গ-আধিপত্যবাদী সম্পর্কের বিশ্লেষণে সেই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন, যার মাধ্যমে বুর্জোয়া  শ্রেণী কেবল শাসনযন্ত্রে তার প্রভুত্বই প্রতিষ্ঠা করে না, বরং সৃষ্টি করে এক সার্বিক সামাজিক কর্তৃত্ব (চট্টোপাধ্যায়, ১৯৯৮ : ৩)। তাঁর এই চিন্তা মার্কসীয় ঐতিহাসিক বস্তুবাদের সম্প্রসারণ, কেননা ঐতিহাসিক বস্তুবাদে ইতিহাসের একটি বিশেষ বস্তুগত পর্যায়ে বুর্জোয়া শ্রেণী সমাজের অন্যান্য উৎপাদনশীল শ্রেণীকে উৎপাদনের উপায়ের ওপর তাদের মালিকানা থেকে বিচ্ছিন্ন করে এবং এই প্রক্রিয়ায় তারা হয়ে  ওঠে সর্বহারা শ্ৰেণী আর গ্রামশির রচনাতে, এই দ্বন্দ্বমূলক প্রক্রিয়ায়, দেখা যায় যে শ্রমিককে তার অন্য সব সামাজিক ক্ষমতা থেকেও উৎখাত করার জন্য এবং তার ওপর প্রভুত্ব তৈরির সময় চেষ্টার অংশ হিসেবে বুর্জোয়া শ্রেণী সার্বিক সামাজিক কর্তৃত্ব বা hegemony সৃষ্টি করে। এ অবস্থায় রাষ্ট্রীয় শক্তির পাশাপাশি সংস্কৃতি ও ভাবাদর্শের জগতে এক আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে হেজেমনিক বুর্জোয়া  শ্ৰেণী তার শাসনের নৈতিক ভিত্তি হিসেবে সাবঅলটার্ন’ শ্রমিক শ্রেণীর কাছ থেকে সামাজিক সম্মতিও আদায় করে নেয় (ঐ, পৃ. ৩)। আর সাবঅলটার্ন শ্রেণীর কাছে  তা অভিযােজনমূলক প্রত্যাশার মত, কারণ যে প্রক্রিয়ায় তারা উৎপাদনের উপায়সমূহ থেকে উৎখাত হয়, সেই একই প্রক্রিয়ায় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্বতন্ত্র অবস্থান থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয় কিংবা নতুন সংবিন্যাসে সংযুক্ত হয়, অথবা তথাকথিত ‘সামাজিক সম্মতিদাতা’ হয়ে ওঠে। 
 
গ্রামশির লেখা থেকে দেখা যায়, সংস্কৃতি বা ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে  লােকসংস্কৃতি যদিও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের চাপে ভারাক্রান্ত থাকে তবুও সাবঅলটার্ন শ্রেণীগুলাে তাদের নিজেদের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও প্রয়ােজন অনুযায়ী সেই প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতির সবটুকু নেয় না। শাসক শ্রেণীর ধর্মবিশ্বাস আর তাদের অধীন শ্রেণীগুলাের ধর্মবিশ্বাস প্রাতিষ্ঠানিক দিক থেকে এক হলেও তাদের আকার  ও চরিত্র পৃথক। এমনকি বিরােধীও হতে পারে, যা থেকে সাবঅলটার্ন শ্রেণীর প্রতিরােধ জন্ম নেয় (ঐ, পৃ. ৫)। এর স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় তকালীন পূর্ব। পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের সকল সংগ্রাম ও বিদ্রোহের ইতিহাসে  এ অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ নিষ্ঠাবান মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দের ইসলাম পছন্দ রাজনীতির প্রতি সবসময় সমর্থন দেয় নি। বরঞ্চ ভাষা আন্দোলনের পর থেকে তাদের সন্তানদের বড় অংশ ইহজাগতিক বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে ওঠে এবং মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসে। কিন্তু ঐ সব মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের ক্রিয়াকর্মের ইতিহাস আমাদের সামনে আজও অনুপস্থিত বলা যায়, নিম্নবর্গীয় গবেষণার সবচেয়ে গ্রহণযােগ্য ভূমিকা ছিল। তল থেকে দেখা ইতিহাস গবেষণায় তৃণমূল পর্যায়ের ইতিহাস, তল থেকে দেখা ইতিহাস বা সাধারণ মানুষের ইতিহাসের গবেষণার অনন্য পথিকৃত হচ্ছেন জর্জ রুডি উনিশশ’ সত্তর-আশির দশকে ইউরােপে এ ধরনের ইতিহাস লেখার প্রচলন ছিল। ক্রিস্টোফার হিল, এডওয়ার্ড টমসন, এরিক জে, হবসবম প্রমুখ মার্কসবাদী ইতিহাসবিদদের ধারা অনুসরণ করে অনেকেই তখন অবহেলিত জনগােষ্ঠী এবং তাদের ভিন্ন ধরনের জীবনযাত্রার কথা লিখেছিলেন। এর মাধ্যমে প্রধানত ইতিহাস রচনায় বাদ পড়ে যাওয়া অনেক ঘটনা, মতাদর্শ, স্মৃতি ইত্যাদি খুঁজে বের করে আনা গিয়েছিল এবং এর ঐতিহাসিক ন্যায্যতা সম্পর্কে কোনাে প্রশ্ন ওঠার সম্ভাবনা ছিল না (ঐ, পৃ. ১৫-১৬)। এরিক হবসবম তল থেকে দেখা ইতিহাস’ প্রসঙ্গে বলেন : “তৃণমূল পর্যায়ের ইতিহাস শুধুমাত্র তখন থেকেই গতানুগতিকভাবে লিখিত ইতিহাস অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও ঘটনাসমূহের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইতিহাসের মতাে বা তার অংশ হয়ে দাঁড়ায় যখন থেকে সাধারণ জনগণ ঐসব সিদ্ধান্ত ও ঘটনাসমূহ তৈরিতে একটি অনিবার্য উপকরণ হয়ে ওঠে” (হবসবম, ১৯৯৮: ২৬৮)।
 
তার মতে, পৃথিবীতে শ্রমিক আন্দোলন বৃদ্ধির সাথে সাথে তৃণমূল পর্যায়ের ইতিহাসও বিকশিত হয়েছে। তিনি বলেন : “শ্রমিক আন্দোলন বৃদ্ধির সাথে সাথে তৃণমূল পর্যায়ের ইতিহাসের প্রতি মার্কসবাদীদের কিংবা আরাে সামগ্রিকভাবে সমাজতন্ত্রীদের আগ্রহ সৃষ্টি হয়। যদিও এটা সাধারণ মানুষের বিশেষ করে শ্রমিক শ্রেণীর ইতিহাস গবেষণায় বিরাট সুবিধা এনে দিয়েছে, তবুও এটা সমাজতন্ত্রী ইতিহাসবিদদের দৃষ্টিকে একপেশে করে দিয়েছে তারা স্বাভাবিকভাবেই শুধুমাত্র সাধারণ মানুষের ইতিহাস অধ্যয়নে রত থাকেন নি বরং যাদেরকে এই আন্দোলনের পুরােধা বলা যায় সেইসব মানুষের ইতিহাসও গবেষণা করেছেন; কিন্তু শ্রমিক আন্দোলনকারী, ট্রেড ইউনিয়নবাদী, কিংবা জঙ্গী শ্রমিকদের কথা খুব বেশি আসেনি একই সঙ্গে অবশ্য তারা ধরে নিতে আগ্রহী ছিলেন যে আন্দোলনের ইতিহাস এবং যে সংগঠনগুলাে শ্রমিকদের সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছে এবং সেহেতু প্রকৃত অর্থে শ্রমিকদের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছে তাদের ইতিহাস সাধারণ মানুষদের নিজেদের ইতিহাসকে প্রতিস্থাপিত করতে পারে” (ঐ, ২৬৯-৭০)।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, নিম্নবর্গের মানুষ প্রকৃত অর্থে বাদ পড়া মানুষ। কেননা একই সঙ্গে এরা উৎপাদনের উপায় ও ক্ষমতা থেকে বাদ পড়ে যাওয়া, অন্যদিকে আবার ইতিহাসের প্রধান ধারা থেকেও বাদ পড়ে যাওয়া। এদের অন্তর্ভুক্তির ফলে প্রধান ইতিহাসের যে পরিপূরক ইতিহাস (complementary history) বিনির্মিত হয় তাতে কে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়। সে ইতিহাস এমন তথ্য দিয়ে আমাদের চোখ খুলে দিতে পারে যে, অবহেলিত, উপেক্ষিত এবং বাদ পড়ে যাওয়া মানুষ অর্থাৎ নিম্নজনই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং সময়ের প্রধান নির্মাতাও বটে এই জাতীয় নয়া ধারার ইতিহাসে বিপুলসংখ্যক নিম্নবর্গীয় মানুষের উপস্থিতি আগের চেয়ে বেশি হয়েছে ঠিক, কিন্তু তাদের গুরুত্ব সেই অর্থে বাড়েনি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষেরাই মুখ্যত বিদ্রোহ ও সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন কিন্তু এই মধ্যবিত্ত প্রচলিত অর্থের মধ্যবিত্ত নয়। এদের কেউ কেউ হয়তাে সেরকম অভিজাত মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি হতে পারেন তবে তাদের বেশির ভাগই বেড়ে উঠেছেন একেবারে সাধারণ মানুষের কাতার থেকে। কেউ কেউ বলেন, এরা নয়া মধ্যবিত্ত  ইতিহাসে নিম্নবর্গীয় মানুষের পদচারণার ধরন বুঝতে হলে তাই মধ্যবিত্তের নয়া ব্যঞ্জনাও বােঝা জরুরি। সেই কথা মনে রেখেই এখানে একটি বিকাশমান সমাজ ও অর্থনীতিতে আমরা মধ্যবিত্তের নয়া মাত্রার তাত্ত্বিক অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছি। আর এই নয়া মধ্যবিত্তের ভেতর থেকেই বের হয়ে এসেছিল একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব সেই নেতৃত্বের সুদৃঢ় ভিত্তিভূমি তৈরি করেছিল এ দেশের অগুণতি সাধারণ মানুষ। কৃষক, শ্রমিক, নারী, ছাত্র এবং নানা পেশার মানুষ নাম না জানা লক্ষ কোটি মানুষ।
 
মুক্তিযুদ্ধ ও মধ্যবিত্ত
 
বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয়-—উভয়ের নেতৃত্বেই ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণী তবে এই মধ্যবিত্তের নাড়ির যােগ ছিল নিম্নমধ্যবিত্ত, কৃষক ও শ্রমিকের সাথে। চল্লিশের দশকে যখন নবাবদের হাত থেকে মুসলিম লীগের নেতৃত্ব মধ্যবিত্তের হাতে চলে আসে এবং পাকিস্তানের দাবি জোরদার হয় তখন এই দলের কার্যক্রমে পূর্ব বাংলার কৃষকদের অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক। তাদের ছেলেমেয়েরাই পাকিস্তান আন্দোলনের তরুণ কর্মী তাদের স্বপ্ন ছিল পাকিস্তান সৃষ্টি হলে মুখ্যত হিন্দু জমিদারদের শােষণের অবসান হবে তাদের বাবা-মা-ই জমির মালিক হবেন তারা নিজেরা লেখাপড়া শিখে রাজনীতি, প্রশাসন, অর্থনীতিতে নেতৃত্ব দেবেন। তাদের বিকাশের পথে কোনাে বাধা থাকবে না ভূমি সংস্কার, শিক্ষা সংস্কার, জনপ্রশাসন সংস্কারের মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্র পূর্ব বাংলার বিকাশমান মধ্যবিত্তের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল তাদের এসব আকাঙ্ক্ষা পূরণ হওয়ার নয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি সৃষ্টির দিন থেকেই চলে যায় আমলা, মহাজন, শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী এবং তাদের মদদদাতা সুবিধাবাদী রাজনীতিকদের নিয়ন্ত্রণে এরা গণতন্ত্রের মূল স্পিরিট অর্থনৈতিক সাম্যের ধার ধারলাে না। সংখ্যাগুরু বাঙালি মধ্যবিত্ত এবং তার  সাথে যুক্ত কৃষক শ্রমিকের স্বার্থের কথা, স্বপ্নের কথা তারা আমলেই আনলাে না । উল্টো বাঙালির অগ্রসর সাংস্কৃতিক চিন্তা ও অহঙ্কারের ওপর আঘাত হানলাে ভাষার ওপর আঘাত করলাে।
আটচল্লিশের মার্চেই আঘাত এলাে বাংলা ভাষার ওপর বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করলাে পাকিস্তানের নিপীড়নবাদী রাষ্ট্র স্বাভাবিকভাবেই যে তরুণ কর্মীরা পাকিস্তান আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তারা পাকিস্তান রাষ্ট্রের মতিগতি দেখে ক্ষিপ্ত হলেন তাদের উৎসাহ-উদ্দীপনা দেয়ার জন্যে প্রগতিশীল নেতৃত্বের একাংশ এগিয়ে এলেন। মওলানা ভাসানী প্রকাশ্যে তরুণ নেতৃত্বকে উৎসাহ দিলেন। শেখ মুজিব ছাত্রনেতাদের সংগঠিত করলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য ছাত্র, যারা। মধ্যবিত্তেরই সন্তান (গ্রামের সাথে তাদের যােগাযােগ ছিল খুবই ঘনিষ্ঠ), তারাই ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যােগ দিলেন। আটচল্লিশ থেকে বায়ান্ন পর্বে ভাষা আন্দোলন সংস্কৃতির চৌহদ্দি থেকে রাজনীতির অঙ্গনে চলে এলাে বৃহত্তর জনগােষ্ঠীর অর্থনৈতিক চাওয়া-পাওয়া আন্দোলনকারী ছাত্রদের আলােড়িত করলাে (দেখুন রহমান ও অন্যান্য, ২০০০)। নিপীড়নবাদী রাষ্ট্রের পুলিশ ছাত্র হত্যা করার পরপরই এই আন্দোলন গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়লাে।
 
বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির পর পাকিস্তান রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি একেবারেই নড়বড়ে হয়ে গেল। মধ্যবিত্ত সমাজও ধরে নিল, তারা আর কখনই পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামাের ভেতরে থেকে স্বাধীনভাবে বিকশিত হতে পারবে না। তাদের ছেলেমেয়েরা শিক্ষিত হয়ে বড় চাকরি করবে, ব্যবসা করবে, শিল্প গড়বে তেমন আশা ছেড়েই দিল বাঙালির মধ্যবিত্ত ফলে দ্রুত বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্ম হলাে। পুরাে পঞ্চাশের দশকে মধ্যবিত্তের নেতৃত্বেই গণতান্ত্রিক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে আন্দোলন চলতে থাকে চুয়ান্নতে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে বাঙালি মধ্যবিত্তের বিপুল বিজয় লক্ষ করা যায়। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্র বাঙালির এই গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে সহ্য করতে পারলাে না। তাদের গণতান্ত্রিক বিজয়কে প্রথমে ষড়যন্ত্র এবং পরে সামরিক শাসনের যাতাকলে ধ্বংস করার চেষ্টা করা হলাে। এই ধ্বংসস্তুপ থেকেই শেখ মুজিবের নেতৃত্বে এক দল তরুণ নেতৃত্বের উদ্ভব ঘটলাে বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ৬-দফা আন্দোলন এবং অবশেষে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান বাঙালি মধ্যবিত্তের এই নেতৃত্বকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর স্থাপন করেছিল। আগরতলা যড়যন্ত্র মামলার মধ্য দিয়ে এই নেতৃত্বের শেকড় জনগণের ভেতরে প্রবেশের সুযোেগ পেল উনসত্তরেই শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু উপাধি নিয়ে বাঙালি জাতির আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীকে রূপান্তরিত হলেন। সত্তরের নির্বাচন সেই প্রতীকের বৈধতা যােগাল এবং বাঙালির মুক্তিদাতা হিসেবে তার নেতৃত্বকে স্বাগত জানালাে।
খুব স্বাভাবিক নিয়মেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামাে বাঙালির এই উথানকে মেনে নিতে পারেনি। তাদের সামনে তখন দুটো পথ খােলা ছিল। এক, বাঙালি নেতৃত্বকে মেনে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে তাদের শােষণের কারণে যে অবিচার করা হয়েছে তা শুধরে নেয়া। দুই, প্রয়ােজনে বাঙালি নেতৃত্বকে ঠেকানাের লক্ষ্যে পাকিস্তান রাষ্ট্রটিকেই ধ্বংস করে ফেলা তারা দ্বিতীয় পথটিই বেছে নিয়েছিল (দেখুন সােবহান, ১৯৯৭)। বাঙালিও তার মুক্তির চিন্তায় বরাবরই অটল ছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হলাে। এই দীর্ঘ মুক্তি সংগ্রামে বাঙালি মধ্যবিত্তের ক্রমবর্ধমান বিকাশ এবং তাদের নেতৃত্বের অবদান কিছুতেই খাটো করে দেখার উপায় নেই। তবে এই মধ্যবিত্ত ছিল সনাতনী মধ্যবিত্ত থেকে খানিকটা ভিন্ন। আর সেদিনের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর দূরদৃষ্টির কারণে, এই মধ্যবিত্ত শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, জনতার সাথে এমনভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছিল যে তাদের পক্ষে সুবিধাবাদী পথে এগুনাের সুযােগ ছিল না। বললেই চলে। অবশ্যি তাজউদ্দীনের মতাে সহযােগী থাকাতে এবং প্রগতিশীল অন্য নেতাদের সমর্থন পাওয়াতে তার পক্ষে এমন দৃঢ়চেতা নেতৃত্ব দেয়া সহজ হয়েছিল।
 
তরুণ ছাত্র ও যুব নেতাদের দৃঢ়তাও তাঁকে শক্তিশালী নেতৃত্ব দিতে বিশেষভাবে উৎসাহী করেছে।  সনাতনী মধ্যবিত্ত শ্রেণী সাধারণত পুঁজিপতি, ভূমির মালিক ও ভূমিহীন প্রােলেতারিয়েতের মাঝামাঝি পর্যায়ে অবস্থান নিয়ে বেড়ে উঠে কিন্তু এর বাইরেও এক নয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে উঠতে পারে। এরা নানা পেশা ও কাজে জড়িয়ে থাকা নানা বর্গের মানুষ মালিকদের সহায়তাকারী একদল মানুষ শুধুমাত্র গতানুগতিক ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করা ছাড়াও সুযােগ পেলেই বড়াে বড়াে সিদ্ধান্ত গ্রহণেও অংশ নেয়। এরা তাই নিজেদের শাসক শ্রেণীর অংশ হিসেবেই ভাবতে শুরু করে। তবে সংখ্যায় এরা নগণ্য এর বাইরে অন্যান্য মধ্যবিত্তের সিদ্ধান্ত গ্রহণের তেমন ক্ষমতা থাকে না। প্রতিদিন নানা চাপের মধ্যে তাদের কাজ করতে হয়। এরা শ্রমিক শ্রেণীর সকল অনিশ্চয়তা, অতৃপ্তি নিয়েই কাজ করতে থাকে শ্রমিক কিংবা প্রান্তিক কৃষকের মতােই তাদেরও নুন আনতে পানতা ফুরােয় । যে-কোনাে সময় চাকরি চলে যাওয়ার ভয় তাদেরও রয়েছে আর চাকরি চলে গেলে তাদের সামাজিক মর্যাদাও এক ধাক্কায় প্রােলেতারিয়েতের মতােই একেবারে নিম্নে নেমে যেতে পারে। এই যে দুর্ভাবনা ও দুশ্চিন্তা মধ্যবিত্তকে নিরন্তর অনিশ্চয়তার মধ্যে রাখে তার কারণেই তারা মানসিকভাবে শাসক শ্রেণীর অংশ হিসেবে নিজেদের আর ভাবতে পারে না। তাদের জীবনও তাই কাটতে থাকে শ্রমিক-কর্মচারীদের টানাপােড়েনের জীবনের চলার মতাে আর সেই কারণেই শ্রমিকদের স্বার্থ ও তাদের স্বার্থ ভাবনা এক সময় খুব কাছাকাছি চলে আসে। পুরাে ষাটের দশক ধরে ঠিক এই প্রক্রিয়াটিই চলছিল তখন কৃষক খাদ্য  সঙ্কটে ভুগছিল, শ্রমিকের ছাঁটাই হবার ভয় ছিল, আর মধ্যবিত্তের ভয় ছিল নানা অনিশ্চয়তার ।
 
তবুও রাজনৈতিক নেতৃত্ব মধ্যবিত্তের মধ্য থেকে এসেছিল বলে সাধারণ মানুষের সাথে তাদের ছিল গভীর যােগাযােগ তাদের রাজনৈতিক শ্লোগান ‘সােনার বাংলা শ্মশান কেন?’-এর মাধ্যমে সকল শ্রেণীর মানুষের বিকাশের স্বপ্নকে তারা ঠিকই ধরতে পেরেছিলেন। তাই সত্তরের নির্বাচন সকল শ্রেণীর মানুষকে  বাঙালি জাতীয়তাবাদের এক মােহনায় আনতে পেরেছিল। ফলে, যখন মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলাে তখন মধ্যবিত্ত, শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র-জনতা হাতে হাত রেখে এক হয়ে মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্যে রক্ত দিতে পেরেছিল। যদিও এদের অর্থনৈতিক মুক্তির আকাক্ষা ভিন্ন ভিন্ন ধরনের ছিল, কিন্তু দেশমাতৃকার স্বাধীনতা ছাড়া যে এসব আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা যাবে না সে সত্যটি সকল শ্রেণীর মানুষই  বুঝতে পেরেছিল আর সে কারণেই একাত্তরের রণাঙ্গনে আমরা সকল শ্রেণীর মানুষের সমাবেশ দেখতে পেরেছি। অবশ্যি মুক্তিযােদ্ধাদের বড় অংশই ছিল ছাত্র, যারা মধ্যবিত্তেরই সন্তান। কেউ সরাসরি কৃষক সন্তান কেউবা এক বা দু’ প্রজন্মের শহরবাসীর সন্তান এদেরও গভীর যােগ ছিল গ্রামের সাথে তাদেরও আয়ের একটা বড় অংশ আসতে কৃষি থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পুরাে জাতির এমন ঐক্য হলাে কী করে? মধ্যবিত্তই-বা স্বাধীনতার জন্যে এতােটা অঙ্গীকারবদ্ধ হলাে কী করে? এ প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয়া মুশকিল তবুও ইতিহাসের পাতা থেকে কিছু। কথা তুলে আনতে চাই। যে পথে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটেছিল তাতে বােঝাই যায়, তার একটা ঐতিহাসিক প্রভাব পড়েছিল মধ্যবিত্তের মানসগঠনে। কিন্তু তার চেয়েও কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না সত্তর-একাত্তরের নেতৃত্বের দূরদর্শিতা এবং যাদুর মতাে জনমনকে প্রভাবিত করার পারদর্শিতা মনে রাখতে হবে, উনসত্তরের মার্চ থেকে সত্তরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়টি ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশের শ্রেষ্ঠ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার সমর্থক কর্মী বাহিনী এবং ছােটখাটো আরাে কিছু প্রগতিশীল দল বাঙালির স্বাধিকারের প্রয়ােজনীয়তার কথা প্রায় প্রতিটি ঘরে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
 

তাদের এসব কথাবার্তার মূল বার্তাই ছিল বাঙালির ওপর অর্থনৈতিক শােষণের বিষয়টি বাঙালির সমস্যা যাতে বাঙালি নিজেই সমাধান করতে পারে সেজন্যে চাই স্ব-শাসন সুতরাং, একাত্তরের মার্চ জুড়ে যে অসহযােগ আন্দোলন হয়েছিল তা ছিল ঐ স্ব-শাসনের আকাক্ষারই দীপ্ত প্রকাশ। চরম প্রতিকূলতার মধ্যেও বাঙালি তার স্ব-শাসন চালাতে পারে—সেটিই প্রমাণ করেছিলেন বাঙালি নেতৃত্ব সত্তরের নির্বাচন তাদের স্ব-শাসন চালু করার বৈধ অধিকার দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দল যেন সেই উত্তাল দিনগুলােতে সাড়ে সাত কোটি মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির দায়িত্ব নিয়েছিলেন। মার্চ মাসে যখন বঙ্গবন্ধু এবং ইয়াহিয়া খানের মধ্যে আলাপ চলছিল তখন পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রধান অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারক এম, এম, আহমদ স্বীকার  করেছিলেন যে, বাঙালিদের ওপর অর্থনৈতিক দিক থেকে বড় ধরনের অবিচার করা হয়েছে। তিনি ছয় দফার অর্থনৈতিক দাবিগুলাে মেনে নিয়ে সংবিধান সংশােধনের উদ্যোগও নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ততক্ষণে আর পরিস্থিতি তার অনুকূলে ছিল না (সােবহান, ১৯৯৭, পৃ. ৭৯২)। প্রশ্ন করা যায়, পাকিস্তানের শাসক শ্রেণী বাঙালি মধ্যবিত্তের অর্থনৈতিক বঞ্চনার দিকটি অনুধাবন করতে এতাে বিলম্ব করলাে কেন? তাদেরকে সন্তুষ্ট করার কোনাে প্রচেষ্টা কি পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামাে করেছিল? অবশ্যি তাদের এ চেষ্টা করার সুযােগই দেননি বঙ্গবন্ধু উনসত্তরের পর শহুরে মধ্যবিত্তের আকাক্ষার আধিপত্য ছাপিয়ে গ্রাম-বাংলার মানুষের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টি বেশি করে গুরুত্ব পেতে থাকে তখনকার গণঅভ্যুত্থানের সময়ই আঁচ করা গেল, আন্দোলন সাধারণের আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিফলিত করতে শুরু করেছে। শ্রমিক শ্রেণীর অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে কৃষকদের সন্তান তথা তখনকার ছাত্রনেতারা। বাঙালি জাতীয়তাবাদের আন্দোলনকে রাজপথে ছড়িয়ে দিয়েছিল আন্দোলনের এই গণভিত্তিকে আরাে পােক্ত করা হয় সত্তর-একাত্তরে নির্বাচনী তৎপরতার মধ্য দিয়ে। আওয়ামী লীগ গ্রামের প্রতিটি ঘরে ঘরে এই বার্তা পৌঁছে দিল যে, স্ব-শাসন অর্জন না করা গেলে কৃষকের-শ্রমিকের-মধ্যবিত্তের কোনাে আকাঙ্ক্ষাই পূরণ করা সম্ভব নয়। তারা সাধারণ মানুষকে বােঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, ছয় দফার দাবিগুলাে পূরণ হলেই কেবল সকল শ্রেণীর বাঙালির অর্থনৈতিক বঞ্চনার ইতি টানা যাবে দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত, অপমানিত, বঞ্চিত বাঙালি তাই সত্তরের নির্বাচনে ব্যাপকভাবে ছয় দফার পক্ষে ভােট দিলেন এই ভােটের মাধ্যমে তারা এ-ও বুঝিয়ে দিলেন যে, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ছয় দফার বাইরে যেতে পারবেন না। কেননা, ভােটাররা তাদের ম্যান্ডেট দিয়েছেন অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করার জন্যে নির্বাচনের পরপরই বঙ্গবন্ধু বিষয়টিকে আরাে বৈধতা দেয়ার জন্যে সকল নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সম্মেলন ডাকলেন। রেসকোর্স ময়দানে তিনি তাদের দিয়ে শপথ করালেন যে বাঙালির ‘ম্যাগনাকার্টা’ ছয় দফা অর্জনের প্রশ্নে তারা কোনাে আপােস করবেন না। অসহযােগের দিনগুলােতে বাঙালির অর্থনৈতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়নেরও একটা বৈধ মহড়া দেয়া হয়। বাঙালি প্রথমবারের মতাে তাদের নির্বাচিত নেতৃত্বের নির্দেশমতাে দেশ শাসনের স্বাদ পেলেন।

 
আর তাই একাত্তরের পঁচিশ মার্চ যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালিদের ওপর বর্বর আক্রমণ হানে তখনও তারা অর্থনৈতিক মুক্তির আকাক্সক্ষা মনে রেখেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে শুরু করেন। সাধারণ মানুষের মনে অর্থনৈতিক মুক্তির এই আকাক্সক্ষা প্রজ্বলিত না রাখতে পারলে বাঙালি মধ্যবিত্তকে কি একাত্তরে এমন করে স্বাধীনতার পক্ষে পাওয়া যেত? এ প্রশ্নের উত্তর একটু ঘুরিয়ে দেয়া যাক ষাটের দশকের শুরু থেকেই এবং বিশেষ করে শেষ দিকে (‘৬৯-এর পর) পূর্ব পাকিস্তানে সরকারি বিনিয়ােগ বাড়ানাের একটা প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিল। গ্রামের ধনিক শ্রেণীর অংশ মৌলিক গণতন্ত্রীদের মাধ্যমে সরকারি সম্পদ প্রবাহিত করে তাদের দুর্নীতিবাজ করার একটা উদ্যোগ নেয়া হয়। কেন্দ্রীয় প্রশাসনেও বাঙালি সচিবদের সংখ্যা বাড়ছিল এমন সুযােগ-সুবিধে বাড়িয়ে দিয়ে সে সময় পাকিস্তান রাষ্ট্র একটা ইঙ্গিত দিতে চাইছিল  ভবিষ্যতে বাঙালি মধ্যবিত্তের জন্যে বাড়তি সুযােগের দুয়ার খুলে যাবে যদি তারা স্ব-শাসনের পথ ছাড়ে বঙ্গবন্ধু এই আপােসের ধারাটিকে ঠিক সময়ে ধরতে পেরেছিলেন। এর মর্মার্থ বুঝতে পেরেছিলেন। আর সে কারণেই তিনি সচেতনভাবে সাধারণ মানুষের কাছে স্ব-শাসনের বার্তাটি পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করলেন তাদেরকেই আন্দোলনের মূল স্রোতের নিয়ন্ত্রক বানালেন। মধ্যবিত্ত নেতৃত্বকে সুবিধের মূলাে ঝুলিয়ে যাতে পাকিস্তান রাষ্ট্র বাঙালিকে বিভক্ত না করে  ফেলে সেজন্যে তিনি সরাসরি কৃষক শ্রমিকদের স্বার্থকে আন্দোলনের মূল ধারায় নিয়ে এলেন। ফলে, পাকিস্তানি শাসক শ্রেণী স্পষ্ট বুঝতে পারলেন যে হয় বাঙালির স্ব-শাসনের দাবি মেনে নিতে হবে অথবা জনতার দাবি মানতে বাধ্য ঐক্যবদ্ধ জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বকে ধ্বংস করতে হবে তারা দ্বিতীয় পথটিই বেছে নিয়েছিল। কিন্তু তারা একটি সত্যি উপলব্ধি করতে পারেনি যে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি এদ্দিনে বিস্তৃত হয়ে গেছে বাংলার ঘরে ঘরে সাধারণের মনে সুতরাং বাঙালি  জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বকে ধ্বংস করতে হলে পাকিস্তান রাষ্ট্রটিকেই যে ধ্বংস করতে হয় তারা শেষমেশ ঐ পথই বেছে নিয়েছিল। গণহত্যার পথ বেছে নিয়ে তারা আসলে পাকিস্তানকেই হত্যা করেছিল। বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটির অভ্যুদয়ের প্রক্রিয়ার সাথে তাই সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টি জীবন্তভাবে জড়িতদুই অর্থনীতির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তােলার মধ্য দিয়ে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ, সেই বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে সাধারণ মানুষের কল্যাণ চিন্তা অবশ্যি প্রধানত বিবেচ্য হতে হবে। ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বেতার ভাষণে সাধারণ মানুষের কল্যাণ চিন্তাই যে ছিল মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
 
তিনি বলেছিলেন : “এ যুদ্ধ গণযুদ্ধ এবং সত্যিকার অর্থে একথাই বলতে হয় যে, এ যুদ্ধ বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের যুদ্ধ। খেটে খাওয়া সাধারণ কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, ছাত্র-জনতা তাদের সাহস, তাদের দেশপ্রেম, তাদের বিশ্বাস, স্বাধীন বাংলাদেশের চিন্তায় তাদের নিমগ্নপ্রাণ, তাদের আত্মাহুতি, তাদের ত্যাগ ও তিতিক্ষায় জন্ম নিল এই নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ। সাড়ে সাত কোটি মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ফলপ্রসূ হয়ে উঠুক আমাদের স্বাধীনতার সম্পদ। বাংলাদেশের নিরন্ন দুঃখী মানুষের জন্য রচিত হােক এক নতুন পৃথিবী, যেখানে মানুষ মানুষকে শােষণ করবে না। আমাদের প্রতিজ্ঞা হােক ক্ষুধা, রােগ, বেকারত্ব আর অজ্ঞানতার অভিশাপ থেকে মুক্তি” (বাংলাদেশের স্বাধীনতা। যুদ্ধ : দলিলপত্র, ঐ, পৃ. ৯৫)। দুঃখজনক হলেও একথা সত্যি যে, বত্রিশ বছর বয়সী বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিমালায় সাধারণের কল্যাণ চিন্তাটি ঠিক সেই গুরুত্ব নিয়ে আজও যুক্ত হতে পারেনি। তাই যখন আমরা লক্ষ করি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বেশ খানিকটা ভালাে হওয়া সত্ত্বেও শতকরা প্রায় পঞ্চাশ ভাগ মানুষ এখনও গরিব তখন অবাক হই না। এখনও এ দেশের প্রায় শতকরা বিশভাগ। মানুষের চালচুলাে কোনােটাই নেই। সমূহ অনিশ্চয়তা তাদের জীবনের নিত্যসঙ্গী। মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে দ্রুতই সম্পদ জড়াে হচ্ছে। দুর্নীতি ও দুঃশাসন সাধারণ মানুষের স্ব-উন্নয়নের আকাঙক্ষাকে দুমড়ে-মুচড়ে ফেলছে। অর্থনৈতিক মুক্তির যে অভিপ্রায় বঙ্গবন্ধু সাধারণের মনে গেঁথে দিয়েছিলেন তার সাথেও কি আমরা বিশ্বাসঘাতকতা শুরু করেছি? সেই দিক থেকে চিন্তা করলে, একাত্তরের শহীদের  রক্তের সঙ্গেও কি বেইমানি করছি না? আমরা এ প্রশ্নগুলাে করছি এমন এক সময়ে যখন প্রযুক্তি আর সৃজনশীলতা দুইয়ে মিলে আমাদের সামনে নতুন নতুন সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে।

এসব সুযােগের সদ্ব্যবহার করে আমরা এমন এক প্রবৃদ্ধির ধারা চালু করতে পারি যেখানে গরিবদের ক্ষমতায়ন হয়, পরিবেশ সমুন্নত থাকে এবং দেশের সম্পদ দক্ষভাবে ব্যবহৃত হয়। অনেক নেতিবাচক দিক থাকা সত্ত্বেও বিশ্বায়নের কিছু কিছু প্রক্রিয়া এমনতরাে সুযােগ করে দেয়ার সঙ্কেত দিচ্ছে আমাদের চাই শক্তির বৈপ্লবিক বিকাশ কৃষিতে এর মধ্যেই আমরা এই বিকাশের লক্ষণ দেখতে পেয়েছি। কৃষি উৎপাদনে আমাদের কৃষকদের সাফল্য সত্যি বিস্ময়কর এই ইতিবাচক প্রক্রিয়াকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবাে যদি নেতৃত্বের সুবিধাবাদিতাকে চাপে রাখতে পারি। দুনীতির পথ রুদ্ধ করতে পারি সন্ত্রাস নিশ্চিহ্ন করতে পারি। সেজন্যে আমাদের ফিরে যেতে হবে একাত্তরের দিনগুলােতেদরকার হলে আরাে পিছিয়ে ঊনসত্তরের সেই উত্তাল দিনগুলােতে। যে অর্থনৈতিক মুক্তির আকাক্ষা ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহযােগীরা, আমাদের দৃষ্টি আবার সেদিকেই | ফেরাতে হবে। যে স্বপ্নে বিভাের হয়ে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের জীবন বাজি রেখেছিলেন (দেখুন, সংযােজনী : ‘তাহাদের যুদ্ধ’) সে স্বপ্ন কিভাবে বাস্তবায়িত করা যায় সে দিকে নজর দিতে হবে।

 
মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ : একটি পদ্ধতিগত আলােচনা
 
আজকাল বিভিন্ন আলােচনায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে জনযুদ্ধ হিসেবে দেখার প্রবণতা বাড়লেও তাতে নারীর অংশগ্রহণের কথা তেমন জোরালােভাবে আসছে না। অবশ্যি দু’একটি উদ্যোগে, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের ওপর তৈরি ডকুমেন্টারিতে মুক্তিযােদ্ধা নারীর কথা বেশ গুরুত্ব সহকারে এসেছে। সম্প্রতি নারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের | দালিলিক প্রমাণসহ ডা. এম. এ. হাসানের ‘যুদ্ধ ও নারী গ্রন্থটি বহুলাংশে একাত্তরে  নারীর আত্মত্যাগ ও অবদানের কথা ভালােভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। দু’একজন পর্যবেক্ষক বলেছেন, আন্তর্জাতিক আদালতে কখনও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সুযােগ সৃষ্টি হলে এই গ্রন্থটির তথ্যসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। লক্ষ লক্ষ নারীর ইজ্জত লুণ্ঠন ছাড়াও অসংখ্য নারীকে যুদ্ধাপরাধীরা হত্যা করেছে একাত্তরে। নারীর সেই দুঃখের কথা আফসান চৌধুরীর ‘তাহাদের যুদ্ধ এবং তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদের ‘নারীর কথা ডকুমেন্টারিতে স্পষ্ট করেই তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রকাশনাতেও নারী মুক্তিযােদ্ধাদের অবদানের কথা ভালােভাবে স্থান পেয়েছে। তা সত্ত্বেও এ কথা বললে বােধহয় অন্যায় হবে না যে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মূলধারার ইতিহাসচর্চায় নারীর অবদানের কথা সেভাবে স্থান করে নিতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা তাঁদের স্মৃতিকথা লেখার সময় বিচ্ছিন্নভাবে দু’একজন নারীর ভূমিকা নিয়ে লিখলেও তাদের বিশাল অবদানের কথা আশানুরূপভাবে স্থান পায়নি। বিপুলসংখ্যক নারী অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেন নি বলে হয়তােবা মূলধারার ইতিহাসচর্চায় তাদের পদচারণা লক্ষ করা যায় না। মুক্তিযুদ্ধ কেবল যে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ ছিল না সে কথাটি স্বীকার করে নিতে আমাদের বেশ খানিকটা সময় লেগেছে তবে ইতিহাস গবেষকদের চিন্তার জগতেও পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মতাে বিশাল ক্যানভাসের এই ইতিহাসচর্চা নিচের তলার মানুষদের অংশগ্রহণ ছাড়া কি কল্পনা করা যায়?
আর এদের এক বিরাট অংশই যে নারী সে কথাই-বা অস্বীকারের উপায় কি? কিন্তু এ কথাও তাে ঠিক, এই নারীরা সংখ্যায় বিপুল হলেও সংগঠিত নন। জীবন সংগ্রামে তারা এমনি বিপর্যস্ত যে নিজেদের কথা বলার সুযােগ ও সময় দুটোই পাননি। নারী মুক্তিযােদ্ধাদের অবদানের বিষয়টি তাই পর্দার অন্তরালেই থেকে গেছে আফসান চৌধুরী ও তারেক মাসুদ দম্পতিকে ধন্যবাদ এই অবহেলিত বিষয়টিকে জনদৃষ্টিতে তুলে আনার জন্যে এদের কারণে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চায় নারীর অংশগ্রহণের বিষয়কে আরাে ভালােভাবে উঠে আসার একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণের বিষয়ে যথেষ্ট তথ্য নেই। সে কারণেই এ বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করলে কোন কোন দিকের ওপর তীক্ষ্ণ নজর দেয়া উচিত বলে সে কথা বলার চেষ্টা করেছি এখানে পদ্ধতিগত এই আলােচনা পরবর্তীকালে মূলধারার ইতিহাসচর্চায় সামান্য অবদান রাখলেও আমরা কৃতজ্ঞ থাকবাে।
এক, মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণের বিচার-বিশ্লেষণের সময় মনে রাখতে হবে যে, শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্র হাতেই মুক্তিযোেদ্ধারা তাদের সমর নৈপুণ্য দেখান নি।  যেহেতু সমগ্র জনগােষ্ঠী এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল তাই এর কলাকৌশলও ছিল নানামুখী এর ব্যাপ্তিও ছিল ব্যাপক এই যুদ্ধে নারীরা নানা অবস্থান থেকে অংশগ্রহণ করেছিলেন। মায়েরা সন্তানদের যুদ্ধে পাঠিয়েছেন সাহসের সঙ্গে, স্ত্রীরা  পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য স্বামীকে যুদ্ধে পাঠিয়েছেন অর্থনৈতিক ও সামাজিক ঝুঁকি কাঁধে নিয়ে, প্রেমিকা প্রেমিককে, বােনেরা ভাইকে অনুপ্রাণিত করেছেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে অবরুদ্ধ বাংলাদেশকে উদ্ধার করার জন্যে। ফ্রান্স জামানদের দখলে যাওয়ার পর সেখানেও এমন সর্বব্যাপী প্রতিরােধ যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল। সেই যুদ্ধে নারীরা যেমন নানা অবস্থান থেকে অংশগ্রহণ। করেছিলেন বাংলাদেশেও ঠিক তেমনটি দেখা গেছে সারা দেশ জুড়ে আত্মীয়তার বন্ধন এমন সুদৃঢ় হয়েছিল যে মুক্তিযােদ্ধারা খুব সহজেই যে-কোনাে বাড়িকেই নিজের বাড়ি ভাবতে পারতেন, যে, কোনাে মাকে নিজের মা ভাবতে পারতেন, যে কোনাে বােনকে নিজের বােন ভাবতে পারতেন। নিজের সর্বশেষ সম্বল ডিম পাড়া দুটো মুরগি জবাই করে তাদের ঘরে সাময়িক আশ্রয় নেয়া মুক্তিযােদ্ধাদের খাইয়ে পরম তৃপ্তি পেয়েছেন অনেক গরিব মা লুকিয়ে খাবার রান্না করে একটু দূরে ঘাঁটি গেড়ে থাকা মুক্তিযােদ্ধাদের খাবার বয়ে নিয়ে গেছেন অনেক বােন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মর্টারের গুলি আসছে আর মাথা নিচু করে সানকিতে রুটি এবং পানতা ভাত নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে এগিয়ে গেছেন অনেক কম বয়সী বােন পাশাপাশি যুদ্ধাহত মুক্তিযােদ্ধাদের সেবাশুশ্রুষা দেয়ার জন্যে হাসপাতালে বিপুলসংখ্যক নারীর অংশগ্রহণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে করে রেখেছে উজ্জ্বল যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল চাঙ্গা রাখার জন্যে অন্য ভাইদের সঙ্গে জোট বেঁধে বােনেরা রণাঙ্গনে গণসঙ্গীত গেয়ে বেড়িয়েছেন। এই যে ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও নারীর মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে অংশগ্রহণের এই উজ্জ্বল চিত্র তা আমাদের ধারণ করতেই হবে। এসবের ডকুমেন্টেশনের কোনাে বিকল্প নেই। তা সংগ্রহের নানা কৌশল ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধে নারীর বহুমাত্রিক অবদানকে লিপিবদ্ধ করতে হবে। দুই. সরাসরি অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন এমন নারীর সংখ্যাও কম ছিল না।
তারামন বিবি বা ডা, সিতারার বীর প্রতীক উপাধি প্রাপ্তির ঘটনার মাধ্যমে তাদের ব্যাপক অংশগ্রহণের মাত্রা বােঝা যাবে না। যেসব নারী মুক্তিযােদ্ধা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিলেন তারা খুব দ্রুতই যুদ্ধ-শেষে সমাজে মূলধারায় ফিরে এসেছেন তারা নিজেরাও তাদের অবদানের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি সেভাবে চাননি এবং অনুদার পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থাও নিজের থেকে এগিয়ে গিয়ে তাদের চিহ্নিত ও সম্মানিত করার প্রয়ােজন অনুভব করেননি । অবশ্যি হালে দু’একটি সংগঠন তাদের খুঁজে বের করে সংবর্ধনা দেয়ার উদ্যোগ নিতে শুরু করেছে। এতদিন পরে নারী মুক্তিযােদ্ধাদের চিহ্নিত করা বেশ কষ্টকরই হবে। গণমাধ্যমে তাদের অবদানের কথা তুলে ধরার পাশাপাশি কোনাে গ্রহণযােগ্য বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা প্রতিষ্ঠান উদ্যোগ নিলে হয়তাে তারা এগিয়ে আসবেন প্রাথমিকভাবে সকল সেক্টর কমান্ডার, তাদের নিচের অন্য কমান্ডারদের প্রশ্ন করে করে নারী মুক্তিযােদ্ধাদের সংখ্যা ও পরিচয় সংগ্রহ করা সম্ভব অনেক মুক্তিযােদ্ধা কমান্ডার (যেমন হেমায়েত বাহিনী প্রধান) তাদের লেখা বইতে নারী মুক্তিযােদ্ধাদের কিছু কিছু পরিচয় তুলে ধরেছেন। অন্যদের কাছে পৌছুতে পারলে গবেষকরা মােটামুটি একটা চিত্র নিশ্চয় দাঁড় করাতে পারবেন। তিন, এমন অনেক গ্রাম আছে যেখানে অসংখ্য নারীকে পাখির মতাে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তাদের কেউ কেউ অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছেন (সূত্র: ‘নারীর কথা)। অন্যদিকে পুরাে গ্রামের প্রায় সকল সক্ষম পুরুষদের গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে।
শেরপুরের সেই গ্রামের নাম না-জানা শহীদদের স্মরণে তেমন কোনাে সমাধিক্ষেত্র গড়ে না উঠলেও জনমানসে তার পরিচয় ‘বিধবার গ্রাম’ (সূত্র : ‘তাহাদের যুদ্ধ’)। এই সব নারীর বেঁচে থাকার সংগ্রাম আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের মতােই তাদের দুঃখ, দুর্দশা, বেদনা, অপ্রাপ্তির কথা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল অংশ হতে পারে তাছাড়া নাম না জানা শত সহস্র শহীদের মায়েরা, বােনেরা পাহাড় সমান দুঃখ ও বেদনা নিয়ে আজো কিভাবে বেঁচে আছেন, সেসব কথা গতিশীল ইতিহাসচর্চার অংশ হতে পারে। একেবারে নিচে থেকে এইসব আহত ও বিধ্বস্ত নারীর কথা যে-কোনাে ভাবে হােক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যাতে স্থান করে নিতে পারে সে উদ্যোগ নয়া ধাঁচের ইতিহাসচর্চায় ব্যস্ত গবেষকদেরই নিতে হবে। চার, দেশের বাইরে প্রবাসেও মহিলারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন। উদ্বাস্তুদের জন্যে অর্থ ও ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ, বিদেশের সরকার ও আইন প্রণেতাদের কাছে বাংলাদেশের পক্ষে লবিং করা, সভা-সমাবেশ করাসহ নানাভাবে তারা সহযােগিতা করেছেন। একাত্তরের প্রতিটি ঘরই ছিল মুক্তিযুদ্ধের একেকটি দুর্গ। আর সেই দুর্গের দেখভাল করতেন একেকজন মহীয়সী নারী। সেইসব নারীর কথা কি সেভাবে আমাদের কথাসাহিত্যে, মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক ইতিহাসে বা নাটকে উঠে এসেছে? প্রত্যেক ঘরেই এমন অনেক নারী আছেন যাদের অবদান ছাড়া মুক্তিযােদ্ধারা সেই অবরুদ্ধ বাংলাদেশে হাসের মতাে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গার শত্রু খুঁজে বেড়াতে পারতাে না। সুতরাং এদের কথা আমাদের ইতিহাসচর্চায় ধরতেই হবে তাদের কথা আমাদের বলতেই হবে। তাদের ত্যাগ, ভালােবাসা, দুঃখ-বেদনাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য এনে দিয়েছিল।

দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, তাদের সেই যুদ্ধ আজো শেষ হয়নি তাদের সম্মানজনক জীবন ও জীবিকার সংগ্রাম এখনও অব্যাহত রয়েছে। সমাজ ও অর্থনীতিতে তাদের অবদান নীতিনির্ধারকরা সেভাবে স্বীকার করেন না বলেই তাদের জন্য বাজেট বরাদ্দ বাড়ে না। নীতি বিতর্কে তাদের কথা জোরালােভাবে আসে না সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে তাদের উপস্থিতি সরব করতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদানের বস্তুনিষ্ঠ তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করতে হবে। ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অংশে বাংলাদেশের নারীর কথা আরাে জোরালোভাবে আসতে হবে। কীভাবে তা আসতে পারে এখানে তার কিছু পদ্ধতিগত আলাপ করলাম। সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ গবেষকদের মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণের এই অনালােচিত অধ্যায়টি আলােকিত করে তুলে ধরার দায়িত্ব অবশ্যই স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিতে হবে মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান যেমন অবহেলিত তেমনি আরাে অনেক সাধারণ মানুষের কথাও আমরা এখনও আমাদের ইতিহাসে স্থান করে দিতে পারি নি। আমরা কি মনে রেখেছি একাত্তরের নৌকার মাঝিদের কথা? সারা গ্রামবাংলায় মুক্তিযােদ্ধাদের নিরাপদে বয়ে বেড়িয়েছেন সাহসী মাঝিরা তারাই তরুণদের পার করে নিয়ে গেছেন সীমান্তের ওপারে প্রশিক্ষণ-শেষে তারা আবার ফিরে এসেছেন সেই মাঝিদের নৌকোতেই মুক্তিযােদ্ধাদের পাশাপাশি কতাে মাঝিও যে শহীদ হয়েছেন তার হিসাব কি আমরা রাখি? বিভিন্ন চরে গিয়ে খোঁজ করলেই জানা যাবে ঐ সব বীর মুক্তিযােদ্ধা মাঝিদের বীরত্বের কথা। একইভাবে কতাে দোকানদার, দারােয়ান, চৌকিদার তথ্য আদান-প্রদান করেছেন মুক্তিযােদ্ধাদের জন্যে এসব নাম না জানা সাধারণ মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল বলেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ জনযুদ্ধে রূপান্তরিত হতে পেরেছিল। এই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সেই সব সাধারণ মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থান, তাদের চাওয়া-পাওয়ার খোঁজ করা খুবই জরুরি।

সূত্রঃ  মুক্তিযুদ্ধ জনযুদ্ধ আর্থ সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত – আতিউর রহমান
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!