You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ : একটি তাত্ত্বিক কাঠামাে - সংগ্রামের নোটবুক
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ : একটি তাত্ত্বিক কাঠামাে
আগেই যেমনটি বলেছি, সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে বের হয়ে আসা নয়া মধ্যবিত্তের প্রতিনিধিদের নেতৃত্বেই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। এই বিষয়টি অনুধাবন করতে হলে উন্নয়নশীল সমাজে এই মধ্যবিত্তের উদ্ভব এবং তার ভেতরের টানাপােড়েন বােঝাটা বেশ জরুরি মধ্যবিত্ত শ্রেণী : সনাতন ধারা এবং সাম্প্রতিক প্রবণতা সনাতন ধারায় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব বুঝতে হলে আমাদের আঠারাে শতকের ইউরােপীয় সমাজের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে হয়। তখন দুটো শ্রেণী ছিল প্রধান : ভূস্বামী এবং তার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সার্বস’ বা দাসেরা ভূমিহীন শ্রমজীবীদের মাঝ  থেকে তৃতীয় আরেকটি শ্রেণী এই সময় থেকে আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করে। প্রথমে জমিসহ আরাে কিছু উৎপাদনের উপকরণের মালিক হওয়ার পর তারা ব্যবসা-বাণিজ্যে ঢুকতে শুরু করেন। কুটির শিল্পের মালিকানা লাভের মাধ্যমে কিছুটা উদ্বৃত্ত সংগ্রহের পর এরা ছােটোখাটো কারখানার মালিকানা লাভ করেন। এই ভাবেই সামন্তবাদী একটি সমাজেও এই তৃতীয় শ্রেণীর হাতে বেশ খানিকটা সম্পদ এসে যায় এবং তারা উৎপাদনের উপায়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করেন (মার্কস, ১৯৫৯ : ৮)। সনাতনী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে এনটনি গিডিনস আঠারাে শতকের শেষদিকের এই উদীয়মান তৃতীয় শ্রেণীর কথাই বলেছেন। তাঁর মতে, এরা সম্পত্তির মালিক এবং উদ্যোক্তা শ্রেণীর মানুষ ভূস্বামী এবং শহরের শিল্পশ্রমিক ও গ্রামের কৃষি শ্রমিকদের মাঝামাঝি এই নয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অবস্থান উত্তরণমুখী সমাজের এরা এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ (এবারক্ৰম্বি ও উরি, ১৯৮৩ : ১)। তবে যথেষ্ট সম্পদ ও উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও সামন্তবাদী সমাজে এদের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও গুরুত্ব খুব একটা ছিল না। এজন্যে তাদের ফরাসি বিপ্লব নাগাদ অপেক্ষা করতে হয়েছে। এই বিপ্লবের মধ্য দিয়েই সামন্তবাদী শক্তির দাপট কমতে শুরু করে এবং তৃতীয় ঐ শ্রেণীর রাজনৈতিক ক্ষমতা ও গুরুত্ব বাড়তে থাকে। এরপর  থেকে সম্পত্তির ওপর নিয়ন্ত্রণই সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তির সূচক |হিসেবে বের হয়ে আসে।
 

এই প্রক্রিয়ায় দুটো নতুন শ্রেণী আত্মপ্রকাশ করে। মার্কসের মতে :.পুরাে সমাজ দু’টো পরস্পরবিরােধী শ্রেণীতে ভাগ হতে শুরু করে। মুখখামুখি এই দুই শ্রেণীর পরিচয় : বুর্জোয়া এবং প্রােলেতারিয়েত (মার্কস, ঐ, পৃ. ৮)। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, এই দুটো শ্রেণীর প্রাধান্য বেড়ে গেলে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিভিন্ন অংশ তাদের নিজেদের স্বার্থ এবং স্বপ্ন অনুযায়ী এই দুইয়ের কোনাে না কোনাে শ্রেণীর সঙ্গে জোট বাঁধবে। এক সময় তারা একেবারেই মিশে যাবে। মধ্যবিত্তের নিম্নাংশে যেমন ছােটখাটো ব্যবসায়ী, দোকানদার, অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী, কুটির শিল্পের মালিক, কৃষকদের কেউ কেউ ধীরে ধীরে অর্থনৈতিকভাবে আরাে নিম্নমুখী হবে এবং এক সময় প্রােলেতারিয়েত বনে যাবে (এবারক্ৰম্বি ও উরি, ঐ. পৃ. ১৫)। মার্কস যদিও পুঁজিপতি ও প্রােলেতারিয়েতদের মাঝামাঝি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উপস্থিতি মেনে নিয়েছিলেন, তবে তাদের স্থায়িত্বের প্রশ্নে ঘাের সন্দেহ পােষণ করতেন তিনি অবশ্যি প্রােলেতারিয়েতের শক্তিশালী শ্রেণী হিসেবে বেড়ে ওঠার ব্যাপারে খুবই আশাবাদী ছিলেন। পাশাপাশি, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আকার দিন দিনই আরাে খর্ব হবে এবং তারা এক সময় প্রেলেতারিয়েতদের সঙ্গে মিশে যাবে বলেও আশাবাদী ছিলেন মার্কস ও এঙ্গেলস মধ্যবিত্তের বিলুপ্তির ব্যাপারে যতােটা আত্মবিশ্বাসী ছিলেন পরবর্তী সমাজবিজ্ঞানীরা কিন্তু তেমনটি হতে পারেননি। বরং তারা বিশ্বাস করতেন, শিল্পোন্নত সমাজে মধ্যবিত্তের উপস্থিতি আরাে সরব হবে। তবে সেই মধ্যবিত্ত হবে নানা রঙের, নানা বর্ণের (দেখুন, ডাহরেনডর্ফ, ১৯৫৯ : ৫১-৭)। নিঃসন্দেহে মার্কস ও এঙ্গেলস যেভাবে মধ্যবিত্তকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন তারপর অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। আর সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মধ্যবিত্তের গঠন ও ধরনেও পরিবর্তন এসেছে। পুঁজির গঠন প্রকৃতিতে যেমন পরিবর্তন এসেছে, সমাজের ওপর তার নিয়ন্ত্রণের ধরনেও এসেছে নানামুখী পরিবর্তন।

 
সমাজের ওপর সনাতনী শিল্পপুঁজির নিয়ন্ত্রণ কমে গিয়ে দিন দিন আমলাতান্ত্রিক পুঁজির নিয়ন্ত্রণ বাড়ছে অবশ্যি আমলাতান্ত্রিক পুঁজিরও বিবর্তন হচ্ছে এবং তার গঠন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন চলছে। মিলস (১৯৫১) মনে করেন, সম্পত্তির সরাসরি মালিকানা লাভের চেয়ে পরােক্ষভাবে তার ওপর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করাই মধ্যবিত্তের মূল লক্ষ্য। গত একশ বছরে যে প্রবণতাটি লক্ষ করা গেছে তাতে মনে হয় উৎপাদনের উপায়ের মালিকানার চেয়ে মধ্যবিত্ত নিজেকে একটি পেশাদারি শ্রেণী হিসেবে গড়ে তুলতেই বেশি আগ্রহী সেজন্যে সে নিজেকে বদলেও নিয়েছে। এখনও বদলাচ্ছে ‘সাদা কলার’ খ্যাত এই পেশাদারি শ্রেণীর ভেতরেও আবার নানা ধারা-উপধারা রয়েছে। তাদের স্বার্থ ও স্বপ্ন এতােটাই পরস্পরবিরােধী যে তা তাদের এখন আর ভিন্ন শ্রেণীর আওতায় ফেলা মুশকিল। একই সঙ্গে তাদের আবার শ্রমিক শ্রেণীর আওতাতেও ফেলা সহজ নয়।
মিলসের ভাষায়, “সামাজিক গঠনের দিক থেকে এরা নানামুখী, বস্তুগত স্বার্থের দিক থেকে পরস্পরবিরােধী এবং আদর্শগত মতাদর্শের দিক থেকে ভিন্ন অভিজ্ঞ রাজনৈতিক আন্দোলনে শরিক হওয়ার মতাে তাদের কোনাে সমদর্শী ভিত্তি নেই” (ঐ, পৃ. ৩৫)। মার্কস ও এঙ্গেলসের বিবেচনায় সম্পত্তির মালিকানাই মধ্যবিত্তের প্রধান শর্তকিন্তু ডাহরেনডর্ফ এই ধারণায় পুরােপুরি বিশ্বাসী নন তার ধারণা, শ্রেণী গঠনে কর্তৃত্বের কাঠামােই বেশি গুরুত্বপূর্ণ তিনি মনে করেন, শুধুমাত্র সম্পত্তির  মালিকানা থেকেই এই কর্তৃত্বের উদ্ভব হয় না। কোনাে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দায়িত্ব পালন করা কিংবা কারাে ওপর দাপ্তরিক মর্যাদা আরােপ করার মাধ্যমেও কর্তৃত্বের উদ্ভব হয়। এ ধারার কর্তৃত্বও কোনাে ব্যক্তির শ্রেণী অবস্থান নির্ণয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয় (ঐ, পৃ. ১৩৬)। এ ধারার শ্রেণী অবস্থানে আমলাতান্ত্রিক হায়ারকি’ বা ব্যবস্থায় এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে সম্পত্তির আনুষ্ঠানিক মালিক হয়েও এই ধারার কর্তৃত্বের অধিকারী যারা তারা সম্পত্তির পরিচালনা বা নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে থাকেন। আর সে কারণেই তিনি মনে করেন, আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্তর্গত বেতনভুক কর্মকর্তারা যেভাবে কর্তৃত্ব প্রয়ােগ করে, অন্যদের পক্ষে সেরকমটি করা সম্ভব নয় (ঐ, পৃ. ৫৫)। শেষের অংশের সাদা কলারের কর্মচারীরা কর্তৃত্ববিহীন বলেই তারা শ্রমিক শ্রেণী প্রলেতারিয়েতদের সামাজিক অবস্থানের কাছাকাছি চলে আসেন। তাদেরও বিশেষায়িত ও কারিগরি জ্ঞান রয়েছে।
 

কিন্তু নেই কর্তৃত্ব এদের মধ্যে রয়েছে—“যে-কোনাে উদ্যোগের দাপ্তরিক স্টাফ’ বা কর্মচারী, প্রকৌশলী, রসায়নবিদ, পদার্থবিদ, আইনবিদ, মনস্তত্ত্ববিদ এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞ আধুনিক ফার্মে এরা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অবিচ্ছেদ্য অংশ” (ঐ, পৃ. ২৫৫)। প্রশাসনিক বিভাগের জুনিয়র অফিসারেরাও সিনিয়র কারিগরি কর্মকর্তাদের চেয়ে বেশি ক্ষমতা ভােগ করেন অথচ প্রথম গ্রুপের কর্মকর্তাদের বেতন শেষােক্তদের চেয়ে ঢের কম প্রশাসনিক এই কর্মকর্তারা আসলে যে-কোনাে উদ্যোগের মালিকের স্বার্থ দেখাশােনা করেন। সরকারি প্রতিষ্ঠান হলে তারা রাষ্ট্রের স্বার্থ দেখেন। তারা আক্ষরিক অর্থে শাসক শ্রেণীর অংশ না হলেও আসলে তারা শাসক শ্রেণীরই অন্তর্গত (ঐ, পৃ. ৩০১)। সুতরাং, যদিও সকল বেতনভুক কর্মকর্তাদের সাধারণত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্গত বলে ধরা হয়, তাদের কাউকে কাউকে ওপরের বিবেচনায় শাসক শ্রেণীর অংশ হিসেবে বিচার করলে তাত্ত্বিকভাবে ভুল হবে না। আমরা যে নয়া মধ্যবিত্তের সন্ধান করছি তার বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে লকউড (১৯৫৮) বেশ কিছু নয়া ভাবনা ব্যক্ত করেছেন। লকউডের মতে, শারীরিক পরিশ্রম করেন এবং সে বিষয়ে সচেতন এমন ব্যক্তি থেকে যিনি এমন পরিশ্রম করেন অথচ সে বিষয়ে সচেতন নন নিশ্চিতভাবেই তিনি আলাদা বৈশিষ্ট্যের মানুষ যদি দু’জন একই সমান আয় করেন তবুও তারা একই শ্রেণীর মানুষ নন। সে কারণেই লকউড একই শ্রেণী চিহ্নিত করার সময় তিন ধরনের সূচকের প্রস্তাব করেছেন (লকউড,

ক, বাজার পরিস্থিতি;
খ. কর্মসংস্থান পরিস্থিতি এবং
গ. মানমর্যাদার পরিস্থিতি।
‘ক’ সূচকের আওতায় আয়ের উৎসসমূহ, চাকরির স্থিতিশীলতা এবং পদোন্নতির সম্ভাবনার মতাে বিষয়গুলাে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ‘খ’ সূচকটি শ্রমের বিভেদের সঙ্গে সামাজিক মর্যাদার কতােটা মিল রয়েছে তার সন্ধান করে। আর ‘গ’ সূচকটি বর্তমান চাকরির সঙ্গে মর্যাদা এবং মানসম্মান কতােটা জড়িত তা খুঁজে বেড়ায়। এই তিনটি শ্রেণীসূচক নিয়েও সমস্যা রয়েছে। একেকটি সূচক আরেকটি থেকে পুরােপুরি ভিন্ন নয়। তাদের ভেতর পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে। তাই অনেক ক্ষেত্রে এই তিন সূচক ব্যবহার করে শ্রেণী বিভাজন করা যায় না। যেমন, যদি সম্পত্তির মালিকেরা শারীরিক পরিশ্রম করেন অথবা সম্পত্তির মালিক না হয়েও শারীরিক পরিশ্রম করে যদি কেউ বেশি বেশি আয় করেন এবং সে কারণে বেশি করে সামাজিক মর্যাদা অর্জন করে থাকেন তাহলে কি হবে? আর সে কারণেই ম্যাক্স ওয়েবারীয় চিন্তায় বিশ্বাসী এনটনি গিডিনস মনে করেন, শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রমকে আলাদা করে দেখে সমাজের শ্রেণী বিভাজন করা সম্ভব নয়। বাজারে তার তুলনামূলক অবস্থান কেমন সেটিই গিডিনসের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তাই শ্রেণী বিশ্লেষণের সময় নিচের তিনটি সূচক ব্যবহারের পক্ষে (গিডিনস, ১৯৭৩ : ১০৭) :
ক, সম্পত্তি অথবা উৎপাদনের উপায়ের মালিকানা;
খ. শিক্ষাগত অথবা কারিগরি যােগ্যতা অর্জন এবং
গ, শারীরিক পরিশ্রম করার সামর্থ্য। গিডিনসের মতে, এই তিনটি সূচক যথাক্রমে পুঁজিপতি, মধ্যবিত্ত ও প্রেলেতারিয়েত শ্রেণীর নির্দেশক। তবে গিডিনস নিজেও স্বীকার করেছেন যে, প্রযুক্তির উপস্থিতির কারণে শ্রেণী বিশ্লেষণের কাজটি বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে উঠছে। অগ্রসর অনেক প্রযুক্তিই আজকাল এতাে সহজে ব্যবহার করা যায় যে, সামান্য লেখাপড়া জানা মানুষও তা আয়ত্ত করতে পারেন এবং প্রয়ােজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। তাছাড়া, শারীরিক পরিশ্রম যারা করেন তাদেরও অনেক বেশি বুদ্ধিমান ও দায়িত্ববান হতে হয়। কেননা, তাদেরও অগ্রসর প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হয়। এরা সাদা কলারের কেরানিদের চেয়ে ভিন্ন সুতরাং মানসিক না শারীরিক পরিশ্রম করছেন সেটিই একজনের শ্রেণী নির্ধারণের জন্যে যথেষ্ট নয়। এসব পদ্ধতিগত সমস্যা হিসেবে নিলে মধ্যবিত্তের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা মােটেই সহজ নয়।
 
রবার্টস এবং তার সহযােগী গবেষকগণ (১৯৭৭) এই সমস্যার সমাধান করার একটা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তারা মনে করেন, শাসক শ্রেণী এবং শারীরিক শ্রমদানকারী শ্রমিক শ্রেণীর মাঝামাঝি সবাই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্গত এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে আবার দুটো উপধারা থাকতে পারে :
ক, স্বনিয়ােজিত এবং
খ. বেতনভুক । ‘ক’ উপধারায় অন্তর্ভুক্ত যারা তারা আসলে সনাতনী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সদস্য এক্ষেত্রেও ক্ষুদে খামারের মালিকদের অবস্থানের কারণে এ রকম শ্রেণী বিভাজন অস্পষ্ট হয়ে যেতে পারে। তবে রবার্টস ও তার সহযােগীদের ধারণা, স্বনিয়ােজিত যারা তারা সময় সময় শারীরিক শ্রমিকদের থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখেন। এদের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও সামাজিক মর্যাদা শ্রমিকদের চেয়ে বেশি এদের দৃষ্টিভঙ্গি রক্ষণশীল। শারীরিক শ্রম দেন যারা তাদের তারা সঙ্গে নিতে চান না এ কারণে যে, এর ফলে তাদের শ্রেণীর স্থিতাবস্থা ভেঙে যাবে। তৃতীয় আরেক ধরনের বিভ্রান্তি দেখা দেয় যখন সনাতনী মধ্যবিত্তের একটি অংশ তাদের শ্রেণীর সকল বৈশিষ্ট্য থাকা সত্ত্বেও শারীরিক শ্রমদানকারীদের মুখপাত্র হয়ে যান। ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের বেলায় এই প্রবণতাটি খুব করে চোখে পড়ে (রবার্টস, ঐ, পৃ. ১৪০)। চতুর্থ আরেকটি বিভ্রান্তি দেখা দেয় যখন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আলােকিত একটি অংশ মধ্যবিত্তের সকল সুবিধে ভােগ করেন এবং একই সঙ্গে শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণে সােচ্চার হন।
প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা এই ধরনের মধ্যবিত্ত। এরা শ্রমিক শ্রেণীর দাবি-দাওয়ার প্রশ্নে সংবেদনশীল এবং সবসময় বর্ণবাদ ও পুঁজিবাদ বিরােধী আন্দোলনের সমর্থক সনাতনী মধ্যবিত্তের চেয়ে এরা উপরের এই সব ইস্যুতে অনেক বেশি উচ্চকণ্ঠ। ওপরের এই আলােচনা থেকে আমরা মধ্যবিত্তকে এখন দুটো প্রধান ধারায় বিভক্ত করতে পারি : এক, সনাতনী মধ্যবিত্ত শ্রেণী এবং দুই. নয়া-মধ্যবিত্ত শ্রেণী নয়া-মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে আবার তিনটি উপ-ধারায় বিভক্ত করা যায় : ক, সাদা কলারের প্রােলেতারিয়েত, যাদের পেশার কোনাে স্থায়িত্ব নেই এবং যারা সর্বক্ষণ চাকরি হারাবার চাপের মধ্যে থাকেন। খ, স্ব-নিয়ােজিত, যাদের আরাে ওপরের সামাজিক অবস্থানে উঠে যাবার আশা চিরন্তন। তারা যে শুধু নিজেদের জায়গাজমিতে নিজেরাই কাজ করেন তাই নয়, অন্যদেরও সহকারি হিসেবে নিয়ােগ দিয়ে থাকেন। স্ব-নিয়ােজনই তাদের জীবিকার উৎস পেশাজীবীদের মধ্যে অনুরূপ স্ব-নিয়ােজিত যারা তাদের সংখ্যাই শুধু যে দিনদিন বাড়ছে তাই নয়, এদের আর্থ-সামাজিক অবস্থানেরও উন্নতি হচ্ছে; এবং  গ, পেশাজীবী শ্রেণী, যাদের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। তাদের আয়-উন্নতিও বাড়ছে। পুঁজিবাদ অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে সাদা কলারের কর্মচারীদের কাজকর্মের সুযােগ সঙ্কুচিত হচ্ছে।
 
পেশাগতভাবে তারা বাড়তি ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। রবার্টস ও তার সহযােগীদের মতে : “পেশার সুযােগ, কর্তৃত্ব এবং যােগ্যদের জন্যেই কেবল কাজ – এমন বাস্ত বতায় সাদা কলারের কর্মচারীদের কাজের সুযােগ কমছে। অফিসের রুটিনমাফিক কাজ, ল্যাবরেটরি ও ওয়ার্কশপের কাজের মধ্যেই তারা সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছেন। পাশাপাশি, একই ধারায় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর যে অংশ সনাতনী উপায়ে (যেমন আনুগত্য ও পরিশ্রমের বিনিময়ে পদোন্নতি পেয়ে) উপরের সামাজিক অবস্থানে উঠেছেন তাদের অবস্থানও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে (ঐ, পৃ. ১৪০)। অন্যদিকে কোল (১৯৫০) তাত্ত্বিকভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণী বলতে কোনাে কিছু | মানতে রাজি নন। তিনি মনে করেন, মাঝে আছে বলেই তাদের মধ্যবিত্ত বলতে হবে তার কোনাে মানে নেই। এই শ্রেণী এখন পর্যন্ত বিশেষ কোনাে বৈশিষ্ট্য অর্জন করে উঠতে পারে নি (কোল, ঐ, পৃ. ২৯০)। মধ্যবিত্তের মাঝে যে বহুমুখী প্রবণতা রয়েছে সে কারণেই কোল এদের আলাদা সামাজিক শ্রেণীতে ফেলতে চান না। কাইন্ড ও কেইনাে (১৯৮১) অবশ্যি মধ্যবিত্তের এই বহুমুখী তৎপরতায় মােটেই বিস্মিত নন। এ রকম তৎপরতা তাদের আগেও ছিল। তবে আধুনিককালে তাদের ভেতরের অসামঞ্জস্য আরাে বেড়েছে। তাদের ভাষায় : “উনিশ শতকের বুর্জোয়া যুগেও মধ্যবিত্তের ভেতরে ঐক্যের অভাব ছিল। তবে আজকাল এই শ্রেণীর ভেতরে আরাে বেশি অসামঞ্জস্য দেখা দিয়েছে। (ঐ, পৃ. ২৪২)। ওয়েবারীয় সমাজবিজ্ঞানীরা এক অর্থে মধ্যবিত্ত শ্রেণী ধারণাটির ডালপালা ছাঁটতে হাঁটতে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যে, এখন আর স্বতন্ত্র এক ক্যাটাগরি হিসেবে একে খুঁজে পাওয়াই মুশকিল অন্যদিকে, মার্কসবাদীরা এখনও মধ্যবিত্তকে একটি সুস্পষ্ট সামাজিক বর্গ হিসেবেই দেখতে চান। তবে এক সময় যে নয়া-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব হতে পারে সে ব্যাপারে মার্কস নিজে সচেতন ছিলেন বলেই মনে হয়। মার্কসের মতে, জয়েন্ট-স্টক কোম্পানিসমূহের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এক দল ব্যবস্থাপক, ক্লার্ক, ফোরমেন, অভারসিয়ার ইত্যাদির উদ্ভব ঘটবে। এরা একসময় কোম্পানির মালিকদের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের ওপর কর্তৃত্ব আরােপ করবেন। পাশাপাশি মার্কস নয়া এক ধরনের ব্যবসায়ী গােষ্ঠীর কথা বলেছেন, যাদের পুঁজিপতি বা প্রােলেতারিয়েত কোনাে বর্গেই ফেলা যায় না। এরা উৎপাদনশীল পুঁজিপতিদের প্রত্যক্ষ বাণিজ্যিক প্রতিনিধি। যেমন ক্রেতা, বিক্রেতা, পরিব্রাজক ইত্যাদি” (মার্কস, ১৯৫৯: ২৯০)। উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করা এবং উদ্বৃত্ত। 
 
আহরণের জন্য মাঝামাঝি একটি স্তরের প্রয়ােজন রয়েছে। পুঁজিবাদী পদ্ধতির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এই স্তরের গুরুত্ব ও ব্যাপ্তি বাড়তে থাকে মার্কসের মতে, এই স্তরের সদস্যদের সংখ্যা এমনকি প্রােলেতারিয়েতের চেয়েও বেশি হতে পারে। মার্কস আরাে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, এমন এক সময় আসবে যখন পুরাে জনসংখ্যার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ বস্তুগত উৎপাদনে নিয়ােজিত থাকবে (এবারক্ৰম্বি, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫০)। রিকার্ডোর ধারণাকে খণ্ডন করে মার্কস বলেন, শ্রমিক ও পুঁজিপতি এবং ভূ-সম্পত্তির মালিকদের মাঝামাঝি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে (ঐ, পৃ. ৫০)। মার্কসের মতে, মধ্যবিত্ত শ্রেণী ক্রমবিকাশমান এবং চূড়ান্ত ক্যাটাগরি হিসেবে এ শ্রেণীর স্থিতি আসবে না। বরং এ শ্রেণী পুঁজিপতি অথবা প্রােলেতারিয়েতের সঙ্গে মৈত্রী গড়ে চলবে। শ্রমিক শ্রেণীর চেয়ে মধ্যবিত্তের জীবনের মান বরাবরই উন্নত মধ্যবিত্তের। সংখ্যা যেহেতু বিশাল তাই আপাত মনে হয়, তারা তাদের জীবনের মান ধরে রাখতে পেরেছেন।
তাদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে বলে তারা তাদের সেবা প্রতিযােগিতাপূর্ণ বাজারে কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হবেন। আর সে কারণে তাদের প্রকৃত আয় কমে যাবে শিক্ষা ও প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন পেশাজীবীদের সংখ্যা বাড়তে থাকবে ফলে সীমিতসংখ্যক চাকরির জন্যে অনেক পেশাজীবীদের মধ্যে প্রতিযােগিতা বাড়তে থাকবে। তখন তাদের পেশায় টিকে থাকা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হবে চূড়ান্ত বিচারে, প্রেলেতারিয়েতের চেয়ে মধ্যবিত্তের পেশাগত নিরাপত্তাও কম ঝুঁকিপূর্ণ নয়। সাধারণত শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে বাণিজ্যিক কর্মীরাই ভালাে বেতন পেয়ে। থাকেন। এদের দক্ষ শ্রমিক বলা হয়। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা বিকশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ শ্রমিকদের তুলনায় এদের বেতন কমতে থাকে শ্রম বিভাজনের কারণেই অংশত এদের বেতন কমে। শ্রমিকরা তাদের নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবেই দক্ষতা অর্জন করতে থাকে এর জন্যে পুঁজিপতিদের বাড়তি খরচ করতে হয় না। শ্রমিকদের সক্ষমতা অর্জনের এই ব্যাপারটি সেই অর্থে একপেশে বিজ্ঞান ও জনশিক্ষা বাড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সর্বজনীনভাবে সস্তায় শ্রমিকদের বাণিজ্যিক অভ্যেস, ভাষা দ্রুত বিস্তৃত হতে থাকে। যেসব শ্রমিকের জীবনের মান নিচু অথচ বিশ্বজনীন এবং শিক্ষা-দীক্ষায় পারদর্শী তাদের ভেতর।
 
থেকে কম বেতনে শ্রমিক নিয়ােগের সুযােগ পুঁজিপতিদের বেড়েছে তার মানে, শ্রমিকদের সক্ষমতা বাড়া সত্ত্বেও তাদের মজুরি কমছে (ঐ, পৃ. ৩০০)। কারচেদী (১৯৭৭) মার্কসের এই ধারণাকে আরাে খানিকটা বিকশিত করেছেন। অবশ্যি একচেটিয়া পুঁজিবাদের নিরিখে তিনি তা করেছেন। তাঁর মতে, একচেটিয়া পুঁজিপতির ওপর ব্যক্তিবিশেষ খুব সামান্যই চাপ সৃষ্টি করতে পারে অন্যদিকে, এক দল পেশাজীবী এই পুঁজির আনুষ্ঠানিক মালিক না হয়েও তার ওপর। পূর্ণ পরিচালনা নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। কারচেদীর মতে, এরাই নয়া মধ্যবিত্ত। তবে এই শ্রেণীও স্থিতিশীল নয়। বিশ্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের সহজ সুযােগ পেয়ে ব্যবস্থাপক পর্যায়ের এই বিপুলসংখ্যক পেশাজীবী আখেরে নিজেদের মজুরি পণ্যে রূপান্তরিত করে ফেলেন এদের মধ্যে যাদের পক্ষে বিশেষায়িত দক্ষতা অর্জন সম্ভব হয় তারা বাদে অন্যরা দিন দিনই তাদের গুরুত্ব হারাতে থাকেন। তাদের গুরুত্ব বা মূল্য কমার সঙ্গে সঙ্গে তাদের সামাজিক মর্যাদাও কমতে থাকে নানামুখী প্রবণতা সত্ত্বেও মধ্যবিত্ত আজো সামাজিক বর্গ হিসেবে টিকে রয়েছে। এই শ্রেণীর অর্থনৈতিক ভিত্তি খুব একটা স্থিতিশীল না হলেও তাদের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং আদর্শিক শ্ৰেণীবৈশিষ্ট্যের স্বাতন্ত্র টিকে আছে। এই মধ্যবিত্তের মাঝে দুটি ধারা লক্ষণীয় : ক, এরা নিজেদের সম্পদ এবং চাকরির ওপর নির্ভরতার ভিত্তি বাড়িয়ে একটি স্বতন্ত্র শ্রেণী হিসেবে আত্মপ্রকাশের সুযােগ তৈরি করতে সক্ষম এবং ক্রমবিকাশমান পুঁজিবাদী পদ্ধতির সহায়ক শক্তি (ম্যানেজার, পেশাজীবী) হিসেবে এবং সম্পত্তির মালিকদের পক্ষ থেকে পুঁজি পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে এরা ‘ক’ বর্গের সদস্যরা পুরােনাে ধাঁচের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্গত আর ‘খ’ বর্গের সদস্যদের নয়া মধ্যবিত্তের আওতায় ফেলা যায়। তবে উভয় বর্গের মধ্যে আবার বৈচিত্র্য রয়েছে। এই বৈচিত্র্য থাকা সত্ত্বেও এদের একটি স্বতন্ত্র শ্রেণীতে কি করে অন্তর্ভুক্ত করা চলে? আর এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার সময় আমরা পােলাতজার সাহায্য নিতে পারি। পােলান্তজার মতে, শ্রেণী-সংগ্রামের ধারণা ছাড়া শ্রেণী-বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। সমাজ বরাবরই নানা স্তরে বিভক্ত। ভিন্ন ভিন্ন স্তরের মানুষেরা তাদের স্ব-স্ব পরস্পর-বিরােধী স্বার্থ সংরক্ষণ করে থাকে।
আর ব্যক্তি বিশেষের ধারণার ওপর নির্ভর করে কোনাে শ্রেণী গড়ে ওঠে না। শ্রমের সামাজিক বিভাজনই ব্যক্তি বিশেষের শ্রেণী অবস্থান নির্ণয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান তবে আরাে উপাদানও রয়েছে। কোনাে ব্যক্তির শ্রেণী অবস্থান নির্ধারণে নিচের উপাদানসমূহ। কাজ করে : এক. উৎপাদন সম্পর্ক দুই. অধিপতি রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক; এবং তিন, অধিপতি মতাদর্শের সঙ্গে সম্পর্ক। বিশেষ কোনাে মুহূর্তে হয়তােবা ব্যক্তি বিশেষ উপরের এই সব সম্পর্কের খানিকটা বাইরেও থাকতে পারেন। তার মানে এই নয় যে তিনি তার শ্রেণী অবস্থান চিরস্থায়ীভাবে বদলে ফেলেছেন। তাছাড়া, নয়া-মধ্যবিত্ত শ্রেণী একটি স্বতন্ত্র শ্রেণী হিসেবে আপাত আত্মপ্রকাশ করলেও, স্বার্থের বৈচিত্র্যের সদা ভঙ্গুরতার কারণে তা স্থিতিশীল এক শ্রেণী হিসেবে টিকে থাকতে পারবে না (পােলান্তজা, ১৯৭৩, ১৯৭৫ এবং ১৯৭৭)। পােলান্তজার মতে, এই নয়া মধ্যবিত্ত না পুঁজিপতি শ্রেণী। প্রােলেতারিয়েত শ্রেণীর আওতায় পড়ে। তারা উৎপাদনের উপায়েরও মালিক নন। তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অনুৎপাদনশীল খাতে কাজ করেন। তাই তারা উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি করতে পারেন না। আর সে কারণেই পুঁজিপতি শ্রেণীর প্রত্যক্ষ শশাষণের শিকার নন তারা (পােলান্তজা, ১৯৭৫ : ২১৬)। এরা পুঁজির মালিকদের পক্ষ থেকে ব্যবস্থাপক কিংবা তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নিয়ােজিত থাকেন।
সুতরাং উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরির প্রক্রিয়ায় তারা সহায়ক শক্তি মাত্র অন্যদিকে, ফোরমেন এবং সুপারভাইজাররা যেহেতু শ্রমিকদের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন তাই তারা সহজেই তাদের ওপর রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করতে পারেন আর সেজন্যেই এদের শ্রমিক শ্রেণীর আওতায় ফেলা যায় না। তাছাড়া, নয়া-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সদস্যরা পরােক্ষভাবে উৎপাদনশীল কাজেও নিজেদের জড়াতে পারেন। ব্যবস্থাপক এবং পেশাজীবী হিসেবে কাজ করার সময় তারা সাধারণত মানসিক শ্রম দিয়ে থাকেন। তাদের কারিগরি দক্ষতা রয়েছে বলে সাধারণ শ্রমিকদের কাছ থেকে তারা বিচ্ছিন্ন (alienated) থেকে যান। পাশাপাশি এই নৈপুণ্যের অধিকারী হওয়ার কারণেই নয়া-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সদস্যরা সাধারণত শ্রমিকদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হন। কারিগরি জ্ঞানের ওপর একচেটিয়া দখলদারিত্বের কারণে তারা সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও তাদের প্রাধান্য বিস্তার করতে পারেন। আর তাই নয়া-মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করা যায়  জ্ঞানের একচেটিয়া অধিকার এবং যাদের সেই জ্ঞান নেই তাদের বাদ দেয়ার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই এই শ্রেণী গড়ে ওঠে। সাধারণ শ্রমিকদের যেহেতু বিশেষায়িত ঐ জ্ঞান নেই তাই তারা মানসিক শ্রম দিতে পারেন না। আর এ কারণেই এরা তাদের থেকে ভিন্ন (এবারক্ৰম্বি, ঐ, পৃ. ৭১)।

অবশ্যি, পােলান্তজা সনাতনী আর নয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে পার্থক্য টানতে আগ্রহী নন। তাঁর মতে তারা উভয়েই একই শ্রেণীর অন্তর্গত সনাতনী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সদস্যদের অনেকেই প্রত্যক্ষভাবে উৎপাদনশীল কাজের সঙ্গে জড়িত নন। সুতরাং, পুঁজিপতিদের সঙ্গে সংগ্রাম শুরু হলে তাদের অনেককে শ্রমিক শ্রেণীর পক্ষ নিতে দেখা যায় আর এই মেরুকরণের প্রক্রিয়ায় তারা একই মতাদর্শিক সমতটে এসে দাঁড়ান। রাজনীতি অথবা রাষ্ট্রীয় নীতি সম্পর্কিত অনেক প্রশ্নেই এরা একই ধরনের মনােভাব ও প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে থাকেন (পােলান্তজা, ঐ, পৃ. ২৯৬-৭)। আমরা যদি উপরের আলােচনার সারসংক্ষেপ টানি তাহলে যে বিষয়টি স্পষ্ট বের হয়ে আসে তা হচ্ছে : পুঁজিপতি, ভূ-সম্পত্তির মালিক এবং প্রােলেতারিয়েত বাদেও বৈচিত্র্যপূর্ণ পেশা ও স্বার্থনির্ভর মধ্যবিত্ত একটি শ্রেণীর অস্তিত্ব রয়েছে মধ্যবিত্তেরই একটি উপগােষ্ঠী সম্পত্তির মালিকদের পাশাপাশি নীতি প্রণয়ন ও উদ্যোগসমূহের ব্যবস্থাপনায় অংশ নিয়ে থাকেন। কার্যত তারা শাসক শ্রেণীরই অংশ। তারা ক্রমবিকাশমান ব্যবস্থাপক গােষ্ঠীর সদস্য এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর গুরুত্বপূর্ণ অংশ তবে মনে রাখতে হবে, তারা এই শ্রেণীর ক্ষুদ্র একটি অংশ মাত্র মধ্যবিত্তের সংখ্যাগুরু অংশ শ্রমিক শ্রেণীর মতাে না হলেও তারা শ্রমিকের প্রায় সকল ধরনের অসহায়ত্ব এবং বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে থাকেন তাদেরও জীবন চলা খুবই অনিশ্চিত। বেকারত্ব এবং ক্রমাবনতিশীল সামাজিক মর্যাদার ভয়ে তারাও সন্ত্রস্ত থাকেন। ফলে, তারা খুব সহজেই প্রেলেতারিয়েতদের সামাজিক সচেতনতার কাছাকাছি চলে আসতে পারেন বিশেষ মুহূর্তে তাই তাদের সঙ্গে মৈত্রী গড়াও এই শ্রেণীর পক্ষে সহজ হয়। ১৯৭১ সাল ছিল তেমনি এক বিশেষ সময়। ঐ দুর্লভ সময়ে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রায় সবাই শ্রমিক-কৃষকদের জীবন-জীবিকার অনিশ্চয়তার স্বাদ পেয়েছিলেন। তাই তাদের সঙ্গে মধ্যবিত্তের ঐক্য গড়ে তােলা সম্ভব হয়েছিল। সে সময় সকল শ্রেণীর মানুষই হাতে হাত মিলিয়ে কর্তৃত্ববাদী (hegemonic) নিপীড়ক পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নেমেছিলেন। আমরা পরের অধ্যায়গুলােতে মধ্যবিত্তসহ অন্যান্য শ্রেণী/বর্গের মানুষদের মহত্তম সগ্রামের কথা বলতে চাই। বলতে চাই তাদের শ্রেণী অবস্থান ও স্বপ্নের কথা। 

সূত্রঃ  মুক্তিযুদ্ধ জনযুদ্ধ আর্থ সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত – আতিউর রহমান