You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.12.14 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | সুন্দরবনের হরির লুট! | রোডেশিয়া সমস্যার সমাধান কি সমাসন্ন? | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১৪ই ডিসেম্বর, শনিবার, ২৮শে অগ্রহায়ণ, ১৩৮১

সুন্দরবনের হরির লুট!

সুন্দরবনের সম্পদ নিয়ে রীতিমতোভাবে হরিরলুট চলছে। হঠাৎ করেই অবশ্য এ লুণ্ঠন কাজ শুরু হয়নি। পাকিস্তান আমলে অপরাপর প্রতিটি জিনিসের মতোই আমাদের বনজ সম্পদ বিশেষতঃ দুর্গম সুন্দরবনের অঢেল সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ ও উচ্চ প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার সুযোগে সুন্দরবন জুড়ে চলেছে ভয়াবহ নৈরাজ্য। হরিণ শিকার, মধু আহরণ, পাখি শিকার, মাছধরা, সুন্দরী গাছ সহ মূল্যবান সম্পদ আহরণ এবং গোলপাতা সংগ্রহের ক্ষেত্রে যে আইন গুলো চালু ছিল, বন বিভাগের এক শ্রেণীর কর্মচারীর অসহযোগিতার দরুন সে আইনগুলোর যথাযথ প্রয়োগ হতে বোধ করি কেউ কোনদিন দেখেননি বা শোনেননি। ফলে সম্পদ লুণ্ঠনে নিয়োজিত ব্যক্তি ও তাদের মদদ দাতা বনবিভাগের একশ্রেণীর কর্মীর উচ্চাশা আর দুঃসাহস মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে নৈরাজ্য আর অরাজকতা যেহেতু উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সুতরাং স্বাধীন বাংলাদেশে সুন্দরবনের সম্পদ নিয়ে হরিলুট চলবে তাতে আর বিচিত্র কি?
গতকাল বাংলার বাণী প্রথম পৃষ্ঠার এ ধরনের একটি নাতিদীর্ঘ সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদদাতা লিখেছেন, সুন্দরবন অসাধু ব্যক্তিদের স্বর্গ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। ২৩০০ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত সুন্দরবনের গাছপালা ছাড়াও প্রাণিসম্পদ সাবার হয়ে যাচ্ছে। দুষ্কর্ম বিরোধী অভিযান চালানো তো দূরের কথা-স্থানীয় বন বিভাগের এক শ্রেণীর কর্মী তাদেরকে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করছে। অর্থাৎ সাবেক ট্রাডিশন সমানে চলেছে সুন্দরবনের গহীন অরণ্যে। স্বাধীনতা-পূর্ব কালে যত্রতত্র দেখা গেছে, হরিণ শিকার নিষিদ্ধ ঘোষিত হলো মুসলিম লীগ পান্ডা আর এক শ্রেণীর উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী ভ্রমণের সময় শতশত হরিণ নির্বিচারে বধ করে সেগুলো শহরাঞ্চলে নিয়ে এসেছে। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এবং সরকারি পদমর্যাদার এইভাবে হরিণ নিধন যজ্ঞ চালানো হয়েছে। আমাদের সংবাদদাতা খোলাবাজারে মৃগ মাংস বিক্রির অভিযোগ করে সংবাদ পরিবেশন করেছেন এবং বলাবাহুল্য এই অভিযোগ অত্যন্ত পুরনো এবং সর্বাংশে সত্য। মংলা বন্দরের হোটেল গুলোতে সস্তায় ও সহজেই মৃগ মাংস সরবরাহের লোভনীয় জনশ্রুতি দীর্ঘকালের এবং মৃগ মাংস লোভাতুর মানুষকে সহজে সেখানে আকৃষ্ট করে। অথচ এমন একটা ঘটনার কথা কোনদিন শোনা যায়নি যে, হরিণ মাংস বিক্রির দায়ে কোনদিন কোন হোটেল মালিককে দণ্ড প্রদান করা হয়েছে। খোদ এই রাজধানীতেও ৫০টি টাকা ফেললে একখানি মৃগ ছাল সহজলভ্য। খুলনার প্রতিটি কাঁচা চামড়ার দোকান ঘুরলে এমন শত শত হরিণের চামড়া আর শিং পাওয়া যাবে। হরিণ শিকার নিষিদ্ধ এই কি তার নমুনা? বন বিভাগ এর তরফ থেকে কোনো দিন কি এর বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত অভিযান পরিচালিত হয়েছে? গোলপাতা কেটে নেয়া, কাঠ কাটা বা মাছ ধরা এসবই একই নিয়মে চলে আসছে এবং অহরহ অভিযোগ পাওয়া যায়-সংশ্লিষ্ট এলাকার বন বিভাগের কর্মচারী ও সুন্দরবনের আশেপাশের থানা বা পুলিশ ফাঁড়ির শান্তি-শৃঙ্খলায় নিয়োজিত পুলিশকর্মীরা মিলিতভাবে নিজেদের আখের গোছানোর জন্য অবৈধভাবে শিকারিদের বনে প্রবেশের অনুমতি দিয়ে থাকে-গোলপাতা, গাছ কাটা, মাছ ধরার ব্যাপারেও তারা একইভাবে অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনের জন্য লোকজনকে বনের মধ্যে প্রবেশাধিকার দিয়ে থাকে।
অথচ কে না জানে, বাংলাদেশের একমাত্র নিউজপ্রিন্ট মিলের কাঁচামাল সবই আসে সুন্দরবন হতে। সংশ্লিষ্ট বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের যদি আয়াশে দিন কাটাতে আর সাধারন কর্মচারীদেরকে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের এইভাবে ঢালাও পারমিট দেয়া হয়ে থাকে-আমাদের তাতে কিছু বলবার নেই। তবে আতঙ্কিত হয় এই ভেবে যে, হরির লুটের যথেচ্ছারিতা যদি অবিলম্বে বন্ধ করা না হয়-কোথায় যাবে কেনিয়ার অনুকরণে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পার্ক নির্মাণের মাধ্যমে পর্যটন শিল্পের উন্নতির স্বপ্ন আর অঢেল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা। প্রাকৃতিক সম্পদই যদিনা রইল কি দিয়ে পার্ক নির্মাণ করা হবে!
শুধু কি পার্ক আর নিউজপ্রিন্ট মিল? এভাবে অবৈধ সম্পদ পাচার আর বিনাশের ফলে বাংলাদেশ সরকার বর্তমানে কত কোটি টাকা বছর বছর লোকসান দিয়েছে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের কাছে তার একটু হিসাব মিলিয়ে দেখতে অনুরোধ করছি। আর পশু সম্পদের নির্বিচার নিধনযজ্ঞ বন্ধ যদি আপনারা না করতে পারেন-সমূলে তা নির্বংশ হতে আর কতকাল বাকি আছে একটুখানি খতিয়ে দেখুন। খতিয়ে দেখুন সুন্দরবনের ধান চাষ করতে আর কতদিন বাকি আছে।

রোডেশিয়া সমস্যার সমাধান কি সমাসন্ন?

উদ্যোগ-আয়োজন এবং ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে, রোডেশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আয়ান স্মিথের কিছুটা শুভবুদ্ধি জাগ্রত হয়েছে। অন্ততঃ রোডেশিয়া বিরোধের সাংগঠনিক সমাধানকল্পে আয়ান স্মিথ সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষ্ণাঙ্গ বিপ্লবী নেতাদের সঙ্গে রাতারাতি আলোচনায় মতৈক্য প্রকাশ করবেন, তা ছিল মরীচিকাতূল্য। এইতো ক’দিন আগেও শোনা গিয়েছিল যে, জাতীয়তাবাদী আফ্রিকানদের সঙ্গে রোডেশিয়ার সংখ্যালঘু শেতাঙ্গ নেতা আয়ান স্মিথের মধ্যে জাম্বিয়ার রাজধানী লুসাকায় যে দীর্ঘ গোপন আলোচনা চলছিল তা নাকি ব্যর্থ হয়ে গেছে। কেন্দুয়ায় আয়ান স্মীথ হঠাৎ করেই বলা যায় রোডেশিয়ায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছেন। শুধু যুদ্ধবিরতির নয়, শাসনতান্ত্রিক সম্মেলন অনুষ্ঠানের অনুকূল অবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য আফ্রিকান রাজবন্দিদের মুক্তি দেওয়া হবে। প্রধান মন্ত্রী আয়ান স্মিথ ঘোষণা করেছেন, যারা বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাবেন এবং যাদের উপর বিধিনিষেধ জারি রয়েছে, তারা এখন আমাদের দেশের স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। যুদ্ধবিরতি গঠিত হবার পরও আয়ান স্মিথ যুদ্ধবিরতি পুরোপুরি কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত জনগণকে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। এদিকে জাতীয়তাবাদী নেতারা বলেছেন, রোডেশিয়া সরকার এবং ব্রিটেন কর্তৃপক্ষের মধ্যে নতুন বৈঠকের তারিখ নির্ধারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রোডেশীয় গেরিলাদের সংঘর্ষের অবসান ঘটানোর নির্দেশ দেবেন। রোডেশিয়া সংখ্যাগুরু কৃষ্ণাঙ্গ এবং সংখ্যালঘু শেতাঙ্গ দীর্ঘ নয় বছর ধরে বিরাজ করছে। আড়ানী স্মিথের নেতৃত্বে রোডেশিয়ায় বর্ণবৈষম্য এক মারাত্মক রূপ নিয়েছে। কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি শ্বেতাঙ্গদের অত্যাচার-অবিচার এবং নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছিল। জাতীয়তাবাদী আফ্রিকানদের দাবি, সংখ্যাগরিষ্ঠ আফ্রিকানদের শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা। কিন্তু ব্রিটেন এবং জাতিসংঘ রোডেশিয়া বিরোধ মীমাংসার ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য কোনো প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা কার্যত গ্রহণ করেনি। ফলে নিগৃহীত, নির্যাতিত আফ্রিকানরা গেরিলা আন্দোলন এবংসন্ত্রাসবাদের প্রতি ঝাঁপিয়ে পড়ে। মানবাধিকার যখন ধুলাগড়ি যাচ্ছিল, তখনও জাতিসংঘ কোন প্রতিকার করতে পারেনি। আয়ান স্মিথ গায়ের জোরে দিব্যি রোডেশিয়ায় বর্ণবৈষম্য জিইয়ে রেখেছিলেন। জাতীয়তাবাদী গেরিলা আন্দোলনের মুখে স্মীথ সরকার চোখে সর্ষেফুল দেখছিলেন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানে রোডেশিয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠ আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ে সরকার গঠনই ছিল ন্যায় সঙ্গত। কিন্তু আড়াই লাখেরও কম শ্বেতাঙ্গ উপনিবেশবাদীদের নিয়ে আয়াত স্মিথ এর নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়েছিল। গোড়াতেই যে এরকম একটি ভ্রান্ত নীতির চালু হয়েছিল, তার খেসারত আয়ান স্মিথ সরকারকে একদিন অবশ্যই দিতে হবে। বৃটেনের উচিত ছিল, রোডেশিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া। ব্রিটেনের নাকি এ ব্যাপারে চেষ্টাচরিত্র করতেও কার্পণ্য করেনি। কিন্তু ১৯৬৫ সালের পর নয়টি বছর চলে যাচ্ছে, রোডেশিয়ার বিরোধ মীমাংসার ব্যাপারে বৃটেনের আন্তরিকতা এবং সদিচ্ছার তেমন পরিচয় পাওয়া যায়নি। আজ যখন বিশ্বের দেশে দেশে উপনিবেশিক শক্তিগুলো পর্যুদস্ত হচ্ছে তখন রোডেশিয়া শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের যে অবসান হবেই এ ব্যাপারে আমাদের কোনো দ্বিমত নেই। রোডেশিয়ার যুদ্ধ বিরোধী এবং বিনা শর্তে সাংবিধানিক বিরোধ মেটানোর জন্য আলোচনা অনুষ্ঠান তাই রোডেশিয়ার সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবেই চিহ্নিত হবে।
আফ্রিকানদের দাবি আয়ান স্মিথ খুব সহজেই যে মেনে নেবেন, সে ব্যাপারে আমরা নিঃসন্দেহ। কারণ দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় আঁকড়ে থেকে যেসব ধিক্কৃত কার্যকলাপ রোডেশিয়ার অশ্বেতাঙ্গদের প্রতি চালিয়েছেন, তাতে তাঁর ধূর্ততাই বিশ্ববাসীর কাছে ধরা পড়েছে। তবুও রোডেশিয়ায় যদি সাংবিধানিক বিরোধ ভালোয় ভালোয় মিটে যায়, তাহলে আমরা খুশি হবো। কারণ কৃষ্ণাঙ্গদের ও রক্তের রং লাল। কৃষ্ণাঙ্গরাও মানুষের মতো মাথা তুলে বেঁচে থাকার অধিকারী। আয়ান স্মীথ সরকার সংখ্যাগুলো কৃষ্ণাঙ্গদের ন্যায্য পাওনা যদি মিটিয়ে দেন তাহলেই হয়তো রোডেশিয়া থেকে ঘৃণ্য বর্ণ বৈষম্য নীতি দূরীভূত হতে পারে। কিন্তু ধূর্ত আয়ান স্মিথ কি সত্যিই রোডেশিয়ার বিরোধ মীমাংসা করতে সক্ষম হবেন?

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন