You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ১৩ই অক্টোবর, রোববার, ১৯৭৪, ২৬শে আশ্বিন, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ

আবার খাদ্যশস্য সংগ্রহ অভিযান !

সীমান্ত এলাকা থেকে বাধ্যতামূলকভাবে খাদ্যশস্য সংগ্রহের আশ্বাস জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী। মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় সীমান্তের চোরাচালান বন্ধের জন্য সরকারী প্রচেষ্টাকে সহায়তা দানের ব্যাপারে সম্প্রতি সুনামগঞ্জে এক ভাষণ দিচ্ছিলেন। সরকারী কর্মচারী ও জনপ্রতিনিধিদের উদ্দেশে তাঁর উদাত্ত আহ্বান রাখার সময় তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, বন্যার পরও যে সকল ফসল রক্ষা পেয়েছে তা যদি সীমান্ত দিয়ে পাচার হয়ে যায় তাহলে জনসাধারণের দুর্দশার সীমা থাকবেনা। অতএব এ অবস্থার অবসান চাই-ই।
কৃষিমন্ত্রী আরও বলেন যে, চোরাচালানীরা যেমন বাংলাদেশের বন্ধু নয়, তেমনি আমাদের প্রতিবেশীরও বন্ধু নয়। বরঞ্চ তারা দু’টি বন্ধু দেশের পারস্পরিক সম্পর্ককে ক্রমশঃই তিক্ত করে তুলছে। যা ভবিষ্যতের জন্য কোনো দেশের পক্ষেই কল্যাণবাহী নয়। এবং মুষ্টিমেয় কালোবাজারীর জন্য সীমান্ত এলাকার দুর্নীতি ও নৈরাজ্য বৃদ্ধি পেতে থাকবে। যার ফলে সরকারী পর্যায়ে কোনো লাভ না হলেও গণদুর্দশা বৃদ্ধির জন্য প্রশাসনিক দুর্গতি বাড়বে। সে ক্ষতিও মারাত্মক।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, সীমান্ত এলাকা সীল করা ও সীমান্ত দুর্নীতি রোধ করার বহু প্রয়াস এ যাবত নেয়া হয়েছে। প্রতি মওসুমী ফসলের সময়েই এ রকম হুমকিমূলক ও আশ্বাসসূচক কথাবার্তা সংশ্লিষ্ট মহল বলেও থাকেন। এমনকি সীমান্ত নৈরাজ্য দমনের জন্য রক্ষীবাহিনীও নামানো হয়েছে অনেকবার। কিন্তু দুঃখের বিষয় রহস্যজনকভাবে সকলই গরল ভেল হয়ে যায় শেষ পর্যন্ত। এর নিশ্চয় কোনো কারণ আছে—যার সূত্র খুঁজে বেড়ানো বা পাওয়া আমাদের কর্ম নয়। গত বছরের ধান মৌসুমেও সীমান্ত এলাকা থেকে বাধ্যতামূলকভাবে ধান-চাল সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সংশ্লিষ্ট মহল। বহু ক্রয় কেন্দ্র খুলে কাজও শুরু করা হয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, সমগ্র বাংলাদেশের শত শত মাইল সীমান্ত এলাকা থেকে যে পরিমাণ ধান-চাল সংগ্রহ করার লক্ষ্য ঘোষিত হয়েছিল তার এক ষষ্ঠমাংশও খাদ্যশস্য সংগৃহীত হয়েছিল না। নিশ্চয়ই এই ব্যর্থতারও অনেক সুন্দর ও সাজানো কৈফিয়ৎ দিতে পারবেন সংশ্লিষ্ট মহল। কিন্তু তা দিয়ে কি ক্ষুধার্থ জনগণের পেটের আগুন নেভানো সম্ভব কোনো কালে?
এবারও সদম্ভে ঘোষণা করা হচ্ছে—সীমান্ত এলাকা থেকে বাধ্যতামূলকভাবে খাদ্যশস্য সংগ্রহ করা হবে। হয়তো গতানুগতিকভাবে এবারেও বহু ক্রয় কেন্দ্র খোলা হবে। সীমান্ত এলাকায় তথাকথিত কর্মীরা প্রাণ ঢেলে কাজ করবেন। ধান-চালের দর নির্ধারণ করে দেয়া হবে। দেখতে দেখতে ফসলের মওসুমও শেষের পথে যাবে। তারপর লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলো কিনা শুরু হবে সে হিসেবের কড়চা।
কি হবে আর কি হবে না—এ নিয়ে আগ বাড়িয়ে কথার অবতারণাকে ধৃষ্টতা বলে গণ্য না করার জন্যই অতীত উদাহরণ উপস্থিত করতে হয় আমাদের। এবং তার দ্বারা শুধু সমালোচনা নয়—অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়ার অবকাশও তৈরী করা যায় বৈকি! আত্মবিশ্লেষণের পথ সেটি। সেজন্যই বার বার অতীতের দিকে আমরা সবাই দৃষ্টি দিই। তবু আশাবাদের ক্ষেত্র এবার বেশ মলিন। ভুখা পেটে খাদ্যশস্য সংগ্রহের কথা শুনে তাই ক্ষুধার্ত জনসাধারণ এখন আর বড় বেশি আশা ও উৎসাহ বোধ করতে পারেনা। কারণ সরকারী ঘোষণা ও স্থির সিদ্ধান্তের পাশাপাশি আবারও সীমান্তে নতুন ধান-চাল পাচারের খবর সংবাদপত্রের প্রতিবেদনেই প্রকাশিত হচ্ছে। পত্রিকান্তরের বিশেষ প্রতিবেদনে প্রকাশ, দিনাজপুর জেলার সব ক’টি হাট ও ব্যবসাকেন্দ্র প্রচুর চাল আমদানী হচ্ছে তবু চালের দাম কমছে না। নতুন আউশ চাল প্রতি সের ছয় টাকা কিংবা তারও বেশী।
উক্ত প্রতিবেদন সূত্র আরও জানাচ্ছে, দিনাজপুর বাজারে চালের আমদানী বেড়ে যাওয়াতে একশ্রেণীর অস্থানীয় এবং নতুন মুখের আবির্ভাব হয়েছে। এবং বাজারে বহু বেসরকারী চাল ক্রয় কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। এসব কেন্দ্রগুলো সীমান্তবর্তী এলাকাতেই বেশী। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, আকস্মিকভাবে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেক জেলা শহরে সরকার অনুমোদিত দোকান ছাড়া চাল কেনা-চেনা নিষিদ্ধ রয়েছে। তা সত্ত্বেও এসব অননুমোদিত ক্রয় কেন্দ্র খোলা হয় কি করে তা আমরা জানি না। যদি প্রতিবেদন তথ্য সত্য হয়, তবে এ সংবাদি মর্মান্তিক। তদুপরি ঐ অননুমোদিত ক্রয় কেন্দ্র থেকে রাতের বেলা ট্রাক ভর্তি চাল কোনো অজ্ঞাত স্থানে চলে যায় বলে স্থানীয় অধিবাসীরা প্রতিবেদন সূত্রকে জানিয়েছে। এ খবর আরও মারাত্মক। অতএব এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট মহলের দৃপ্ত ঘোষণা ও আশ্বাসের প্রতি জনগণ যদি আজ আস্থা স্থাপন করতে দ্বিধা করে তাহলে দোষটা কার বা কাদের?

শ্রমিক দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা

দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অস্থিরতা কাটিয়ে বৃটেনে শ্রমিকদল নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। সর্বশেষ পাওয়া হিসেব অনুসারে ৬৩৫ আসন বিশিষ্ট কমন্স সভায় শ্রমিকদল পেয়েছে ৩১৯টি আসন। ৭টি আসনের ফলাফল এখনো জানা যায়নি।
গত ফেব্রুয়ারী মাসে খনি শ্রমিকদের ধর্মঘট এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে টোরী সরকার যখন নির্বাচন দেয় তখন থেকেই মূলতঃ সেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা চরমে পৌঁছে। ফেব্রুয়ারীর নির্বাচনে কোনো দলের পক্ষে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সম্ভব না হওয়ায় শ্রমিকদল সংখ্যালঘু সরকার গঠন করে। সরকার টিকিয়ে রাখার জন্য দলের নেতা মিঃ উইলসনকে লিবারেল পার্টির সমর্থনের উপর নির্ভর করতে হয়।
বৃটেনের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা মোকাবেলা করা কোনো সংখ্যালঘু সরকারের পক্ষে সম্ভব ছিলনা। বিগত প্রায় আট মাসকাল তাই শ্রমিক দলীয় সরকারকে বার বার কমন্স সভায় বিরোধী দলীয় সদস্যদের কাছে হার মানতে হয়। লিবারেল পার্টিও মিঃ উইলসনকে রক্ষা করবার জন্য খুব একটা আগ্রহ প্রকাশ করেনা।
এমনি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যেই মিঃ উইলসন পুনরায় নির্বাচন দেবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। এমনটি অনেকেই আশা করছিলেন। শ্রমিকদল নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা দান এবং একটি শক্তিশালী সরকার গঠনের জন্য ভোটারদের কাছে আহ্বান জানান। মুদ্রাস্ফীতি এবং অর্থনৈতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় শ্রমিকদল কিছু স্পষ্ট এবং সাহসী বক্তব্য পেশ করেন। সবার উপরে দীর্ঘদিন রক্ষণশীল মনোভাব পোষণকারী বৃটিশ জনগণের সামনে তারা তুলে ধরেন বৃটেনের কয়েকটি মূল শিল্প জাতীয়করণের কর্মসূচী।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বৃটেনকে এমন অর্থনৈতিক দুর্যোগের কবলে কোনোদিন পড়তে হয়নি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, মুদ্রাস্ফীতি এবং স্বল্পবেতন বৃটেনের জনগণকে দিশেহারা করে তুলেছে। এই সুযোগে চরম দক্ষিণপন্থী শ্লোগান যে সোচ্চার হয়নি তা নয়; কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল দৃষ্টে অনুমান করা কষ্টকর নয় যে, বৃটেনবাসী তাদের সেই শূন্যগর্ভ শ্লোগানে খুব একটা আকর্ষণ বোধ করেনি।
নির্বাচনী ফলাফল মিঃ উইলসনের পক্ষে গেলেও অনেকের আশংকা তিনি তাঁর ওয়াদা পালনে দৃঢ়তার সঙ্গে অগ্রসর হতে গিয়ে নিজ পার্টিরই কোনো কোনো সদস্যের বিরোধিতার সম্মুখীন হবেন। তার জাতীয়করণ কর্মসূচী এমনকি কমন মার্কেট সংক্রান্ত নীতি শ্রমিকদলেরই কারো কারো মনপুত নয়। এ ব্যাপারে অবশ্য পার্টি তাঁর সাহায্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
দীর্ঘদিনের পার্লামেন্টারী গণতন্ত্রের ঐতিহ্যবাহী বৃটেন শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকেই নয়, রাজনৈতিক দিক থেকেও এক সন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছেছে। এখন তার সেই সিদ্ধান্ত নেবার সময়—যে সিদ্ধান্ত বৃটেনের ভবিষ্যত নিধারণ করবে। এমনকি এতদিনের পুরনো যে গণতান্ত্রিক ইনস্টিটিউশন তাও আজ মহাপরীক্ষার সম্মুখীন। বৃটেন কি সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারবে? অথবা ‘গণতন্ত্রের’ নামে জনগণের গণতান্ত্রিক রায়কে নস্যাৎ করার হীন প্রক্রিয়ায় নিজেদের অনিশ্চিত অন্ধকারময় ভবিষ্যতের গহ্বরে নিক্ষেপ করবে?

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!